#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৭
মিলা দরজা ধাক্কে মুবিনের ঘরে ঢুকল। একটু আগে বাবার কল এসেছিল। একটা কালো কাঁচবন্ধ গাড়ি নাকি আটজন শিশুকে কিডন্যাপ করে কুমিল্লা শহর ছেড়েছে। ছেলেমেয়েগুলোর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। থানায় নাকি আরো অনেক বাবা- মাই আহাজারি করছে, কাঁদছে, চিৎকার করছে। মিলা মুবিনের বুকশেলফের বইগুলোয় হাত বাড়াল। ঠিক তখনি মুবিনের চিৎকার, “তোর ঠ্যাং ভাঙব, মিলা। খবরদার আমার বইয়ে ধরবি না। তোর বান্ধবীটাকে শুদ্ধ মেরে ফেলব। খবরদার!”
মিলা চমকে তাকাল পাশে। না মুবিন নেই। পুরোনো স্মৃতি! মিলা আবার বুকশেলফটার দিকে তাকাল। দুর্ধর্ষসব রোমাঞ্চকর বই। মুবিন অ্যাডভেঞ্চারের বইগুলো পড়তে খুব ভালোবাসে। মিলা এ ধরনের বই পড়েনি, তাই অত ধারণা নেই। মুবিন নিশ্চয়ই কোনো অ্যাডভেঞ্চারে ব্যস্ত। ওকে কোনো কালো গাড়িতে আটকে রাখা অসম্ভব। যা একরোখা আর গুঁয়ার! তাছাড়া, এই বইগুলোতে নিশ্চয়ই বিপদ থেকে বাঁচবার নানান কৌশল লেখা আছে! যদিওবা, কিডন্যাপ হয়ে থাকে তবুও সে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো বুদ্ধি করে কিডন্যাপারের নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে যাবে, আর নয়তো এমন জ্বালাতন করবে যে কিডন্যাপার নিজেই ওকে ছেড়ে দিয়ে বলবে, “এই ছেলে, তুই যা। পেছনে তাকাবি না। তাকালে একদম গুলি করে দিব।”
মিলা বুকশেলফ থেকে সেবা প্রকাশনীর একটা অ্যাডবেঞ্চার বই টেনে নিয়ে মেঝেতে বসল। ও এখন পড়ে দেখবে ভালো কোনো কৌশল বইগুলোতে লেখা আছে কিনা। মুবিনটা এসব পারবে তো?
শিল্পী রাতের খাবার গরম করে মিলাকে ডাকল, “আয় খেতে আয়। মুবিন কোথায়? ওকে ডাক।”
মিলা মুখ তুলে তাকাল। মা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। মিলা কী বলবে ভেবে পেল না। মা আবার ধমক দিলেন, “অ্যাই কানে শুনিস না? ডাক তোর ভাইকে। খেয়ে মুক্তি দে। সারাদিন দুটোই বোধহয় কিছুই খাসনি।”
মিলা উত্তর দিলো যন্ত্রের মত, “মুবিন নেই।”
“নেই মানে? এত রাতে কই সে? কতদিন বলব এতরাতে বাড়ির বাইরে না যেতে? পড়া নেই ওর?”
মিলার মনে হলো মায়ের মাথা মোটামুটি খারাপ হয়ে গেছে। সে বলল, “মা, মুবিন বাড়ি থেকে পালিয়েছে। সকালেই বলেছি। তুমি অনেক ক্লান্ত, মা। যাও রেস্ট নাও।”
বলতে বলতে মিলা দেখল মা যেন টলছেন। দেয়াল ধরেও ব্যালেন্স রাখতে পারছেন না। মিলা উঠে যেতে যেতে শিল্পী কাঁচের পুতুলের মত ভেঙে পড়ল মেঝেতে। মিলা দৌড়ে গিয়ে মুখে পানি ছিটাল। শিল্পী উঠল, কাঁদল, চেঁচাল। জানতে চাইল, মঈন কোথায়?
থানায় বসে মঈনের নিজেকে এত অসহায় লাগছে! ওরা শুধু বাজে খবরগুলো বলছে। মঈন একা একা আর পারছে না। ছেলেটার জন্য মন কাঁদছে। কোথায় গেল ওর কলিজার টুকরাটা? শিল্পী হন্য হয়ে থানায় এসে হাজির হতেই ওকে দেখে মঈন যেন ধীরে ধীরে তার ফুরিয়ে আসা শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার শক্তি ফিরে পেল। এই সময়ে শিল্পী ছাড়া কিছুই সম্ভব না।
.
কাদিন বাসের টিকিট দুটো হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে!দেখল। টিকিট দুটোতে আঙুল বোলাতে বোলাতে আচমকা একটানে ছিঁড়ে ফেলল টিকিট দুটো। তারপর ঝুড়িতে ফেলে দিলো। হানিমুনের টিকিট । ভেবেছিল গ্রাম থেকে ফিরে এসে দীপাকে নিয়ে হানিমুনে যাবে। আর হানিমুন!
ল্যাপটপ নিয়ে বসল সে। একটু পর দীপা এসে পাশে দাঁড়াল, “একটা কথা বলার ছিল।”
“বলো।” কাদিন দীপার দিকে তাকাল না। দীপা বলল, “মায়ের জন্য মন কেমন করছে। মাকে দেখতে যাব?”
“হুম যাও।”
“আপনি কাল ফ্রি থাকলে কাল যাই?
কাদিন কপাল কুঁচকে তাকাল, “কালিয়াজুড়ি থেকে হাউজিং তোমায় নিয়ে যেতে হবে?”
“একা আমি হজারবার যেতে পারব। কিন্তু বিয়ের পর এই প্রথম যাচ্ছি। আপনাকে ছাড়া গেলে সবাই কি ভাববে?”
আরো কপাল কুঁচকে গেল কাদিনের। আচ্ছা! দীপা এখন সবার ভাবনা চিন্তা নিয়েও ভাবে!
দীপা বলল, “কি হলো কিছু বলেন না কেন?”
“আমি যেতে পারব না। তুমি যাও।”
দীপা কাদিনের হাত ধরে বলল, “প্লিজ, চলুন না। মাকে অনেক মনে পড়ছে। দুপুরের জন্য স্যরি।”
কাদিন হাত ছাড়িয়ে নিলো, “আমার কাজ আছে।”
দীপা কষ্টে নীল হয়ে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। আমার আর যেতে হবে না।”
কাদিন বলল, “সে তোমার ইচ্ছে।”
দীপা মুখ ঝামটা মেরে চলে গেল। যাবে না সে, মরে গেলেও যাবে না। শয়তান লোক! পরে ঘর ঝাড়ু দিয়ে ঝুড়িতে ময়লা ফেলতে গিয়ে দীপা টিকিট দুটো দেখল। মাঝখান দিয়ে ছেঁড়া। দীপা টিকিট দুটো ঝুড়ি থেকে তুলে হাতে নিয়ে ডেইট দেখে অবাক হয়ে গেল। সেখানে বসেই কাদিনকে প্রশ্ন করল, “এটা কিসের টিকিট? ডেইট তো কয়েকদিন পরের। ছেঁড়া কেন?”
কাদিন দীপার দিকে তাকিয়ে প্রায় লাফিয়ে উঠল। কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ছিঃ দীপা তুমি ময়লার ঝুড়িতে হাত দিয়েছো। ইয়াক!”
কাদিন হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরল যেন ওর এখনি বমি চলে আসছে। দীপা হাসিতে ফেটে পড়ল। কিছুক্ষণ আগের কাদিনের না বলা ভুলেই গেল। হাসতে হাসতে বলল, “ওলে ওলে এত নাখড়া বাবুর! ঝুড়ি তো পরিষ্কার। এই টিকিট দুটো ছাড়া আর কিছু নেই।”
“উঠো উঠো বলছি। যাও হাত ধুয়ে এসো।”
দীপা হঠাৎ মজা পেয়ে গেল। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে উঠে দাঁড়াল। হাতগুলো কাদিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে রহস্যময় গলায় বলল, “এখন যদি আপনার গালগুলো টেনে দিই। কেমন হয় বলেন তো?”
কাদিন কয়েক কদম পেছনে গিয়ে বলল, “হাত কেটে ফেলব, দীপা। আমাকে তুমি চেনো না।”
দীপার কোন ভাবান্তর নেই দেখে
কাদিন এবার নরম গলায় বলল, “প্লিজ, দীপা না।”
দীপ চওড়া হাসি হেসে উপর নীচ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, প্লিজ।”
কাদিন বলল, “আমি কিন্তু কখনো তোমায় ক্ষমা করব না, দীপা।”
হাসতে হাসতে এবার দীপার মরে যাবার মত অবস্থা হলো। কাদিন বলল, “অনুরোধ করছি আমি।”
দীপা বলল, “আচ্ছা, বাবা, আচ্ছা। ভয় দেখালাম। ভয় পাওয়ার দরকার নেই।”
কাদিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, “ভালো করে হাত ধুয়ে এসো। আর কখনো ময়লার ঝুড়িতে হাত দিবে না।”
দীপা বলল, “কিন্তু টিকিট দুটো কিসের?”
কাদিনের চেহারায় একটা মেঘখন্ড এসে জুড়ে গেল। গম্ভীর গলায় সে বলল, “বাসের টিকিট।”
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি কিন্তু ছেঁড়া কেন?”
“আমাদের হানিমুনের টিকিট ছিল।”
“তবে ছিঁড়লেন কেন?”
কাদিন এবার খুব শক্ত করে বলল, “হানিমুনে গিয়ে করবটা কি? শুধু ঘুরতে যেতে হলে তো আমি কোনো ট্রাভেলস গ্রুপের সাথেও ঘুরতে যেতে পারি। আমার মা একটা প্রবাদ বলতেন।
থাকতে দিয়েছ কামরাঙা পাটি আর মরলা দিবে শীতলপাটি। এভাবেই বলতে হয় এখানে পাই কামরাঙা পাটি আর হানিমুনে পাব শীতলপাটি!”
“আপনি এভাবে কেন কথা বলছেন?”
“আর কীভাবে কথা বলব? লুচ্চারা এর চেয়ে ভালো করে কথা বলে নাকি??
কাদিন হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গেল। দীপা এখন খুব ভালো করে বুঝল এজন্যই এভাবে দীপার সাথে গাল ফুলিয়ে থাকা হচ্ছে। কিন্তু দীপা তো স্যরি বলেছে। আর কীভাবে বলবে?
কাদিন খুব রাত করে ঘরে এলো। দীপা দরজা ভেজিয়ে শুয়ে ছিল। কাদিন এসে পাশে শুতেই জড়িয়ে ধরল। কাদিন ভাবল দীপা ওর অভ্যাস মতই বোধহয় ঘুমের ঘোরে জড়িয়ে ধরেছে। কাদিন দীপাকে সরিয়ে দিলো। দীপা এবার রাগে দাঁত ঘঁষে ওপাশ ফিরে শুয়ে মনে মনে কাদিনকে বকে বলল, “অ্যাই ব্যাটা আমি আর কি করমু?”
দীপা ওপাশ ফিরতেই কাদিনের টনক নড়ল! দীপাকে ঘুমের ঘোরে যতবারই সরিয়ে দেয়া হোক কোনো কাজ হয় না। সে ঘুরে ফিরে আবারো জাপটে ধরে। আজ আর ধরেনি, তারমানে ও জেগে আছে!
.
মুবিনের ইচ্ছে করে হুট করেই অনেক বড় হয়ে যেতে। ও ওর ঘরে একা থাকতে চায়। আর চায় মা – বাবাকে বৃদ্ধ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে, যেখানে বাবা- মায়ের দীর্ঘশ্বাসগুলো ও কখনই শুনবে না। যেমনভাবে তাঁরা কখনো ওদের দুই ভাই – বোনের কান্নার আওয়াজ শুনেন না, ঠিক তেমনভাবে। শোনেন না কখনোই। মুবিন জানে মিলার জীবনের সুন্দর এক উদ্দেশ্য আছে। বাবা মায়ের ওর প্রতি অবহেলার জবাব দেয়া। কিন্তু ওর উদ্দেশ্যটা খুব ভয়ঙ্কর। একটা ছেলে বড়ই হচ্ছে এই ভাবনা নিয়ে যে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে! কি দীর্ঘ কালো স্বপ্ন! কি অদ্ভুত!
মুবিন কখনোই ভালো রেজাল্ট করে না, না করে কারো সাথে ভালো ব্যবহার। এজন্য ওর কোনো বন্ধুও নেই। ও আসলে চায় না ওর ভালো রেজাল্ট, বা ওর ভালো যা কিছু আছে তা নিয়ে এই ধরনের বাবা- মায়ের মুখ উজ্জ্বল হোক। ও এরকম বাবা- মাকে কখনো গর্বিত করতে চায় না। কারণ ওর মতে তাঁরা কখনোই তা ডিজার্ভ করে না। হাসি হাসি মুখে শিক্ষকদের প্রশংসা শুনে এরা গর্বিত হবে – দৃশ্যটা মুবিনের কাছে অসহ্য। ও চায় না মিলাও ভালো করুক। মিলাও ওর মত হলে দুজনে মিলে আচ্ছা করে এদের ডুবানো যেত।
কিন্তু ও বোঝে মিলার ভালো করবার দরকার আছে। মুবিনকে নিয়ে মা-বাবা দুজনে রশি টানাটানি খেলছে, ওদিকে মিলার জুটছে অবহেলা। তবুও মুবিনের মনে হয় মিলা ওর চেয়ে ভালো আছে। মিলা ওর নিজস্ব অভিমান নিয়ে একদিকে পড়ে আছে, কিন্তু মুবিনের মত ওর ভাঙচূড় হচ্ছে না। একই ঘটনা মিলাকে করছে শক্ত আর ওকে পিশে ফেলছে, করছে চূড়চূড়।
মিলার নিজস্ব একটা পৃথিবী আছে। সেই পৃথিবীতে সুহার মত একটা বন্ধু আছে, আছে শিক্ষকদের বাহবা আর সাবাসি। মিলার চাইতে কম মার্ক পাওয়া কতজোড়া চোখের জ্বলেপুড়ে যাওয়াও আছে। কিন্তু মুবিনের দুনিয়া থেমে আছে এক বৃদ্ধাশ্রমে। সে এখন বসে আছে কক্সবাজার কলাতলী বিচের সমুদ্রতীরে। থ্রি কোয়াটার প্যান্ট এর নীচের খোলা পা দুটো বালিতে মাখোমাখো। সমুদ্রের ছুটে আসা সাদা ফেণা দৌড়ে এসে মুবিনের পা ধুয়ে আবার পালিয়ে গেল। তার হাতে কাঁকড়া ভাজা। অন্ধকারে বসে বসে ও কাঁকড়া ভাজায় কামড় বসাল। রাত বাড়লেও ভিড়ের কমতি নেই। অন্ধকার সমুদ্র গান গাইছে, গুনগুন করা গান নয়। গলা ছেড়ে মাঝিমল্লারের গানের মত গান। যেন বলছে,
“মুবিন এসো, হেঁটে যাও
কিসে তুমি ডরাও
কি তোমায় থামায়?
মুবিন এসো, ছুঁয়ে নাও।
যা যা তুমি চাও।
কেউ দেখে না তোমায়।”
মুবিন কাঁকড়া ভাজাটা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। পেটের কাছে গেঞ্জিতে হাত মুছে আনন্দে কয়েকটা ডিগবাজি খেল। তারপর হাসি হাসি মুখ করে সমুদ্রের কাছে গেল। কাছে যেতে যেতে কোমর পর্যন্ত সমুদ্রের যে ঢেউগুলো হয় সেগুলোর সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলল। চোখ বন্ধ করে পানি হাতাতে লাগল। কি ঠাণ্ডা, আর মায়া মায়া পানি। মুবিন চোখ খুলল। সমুদ্রের বালিগুলোতে পায়ের ছাপ ফেলে একটা বড় ছেলে আর সুন্দর একটা বড় মেয়ে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে। মুবিন সেদিক থেকে চোখ সরাতেই দেখল একজন আঙ্কেল তাঁর দুই মেয়েকে দু’পাশে নিয়ে ওদের হাত ধরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের গর্জন শুনছেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রমহিলা ওদের ডাকছে, “আর কতক্ষণ? চলো না হোটেলে ফিরি। অনেক রাত হয়েছে। বেশি কাছে যেও না কিন্তু।”
ইতোমধ্যেই দুটো আলুথালু রুক্ষ চুলের দশ, এগারো বছর বয়সী মেয়েকে ঘিরে একটা জটলা তৈরী হয়ে গেছে। জটলার কারণ ওরা গলা ছেড়ে গান গাইছে। মুবিনের একটু আগের
সমুদ্রের গানের ন্যায় বিভ্রমময় গান নয়। সত্যি সত্যি গান,
“আমি তো ভালা না ভালা লইয়া থাইক…”
সাথে হাত হাত ঘষে কেমন একটা তালও তুলছে ওরা। মুবিন গান শুনতে শুনতে মাথা দুলাতে লাগল।
চলবে…