একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ৩৮

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৮
নিলয় আর ইমাদ রাস্তার পাশের টঙ দোকানে মুখোমুখি দুটো বেঞ্চে বসে আছে। ইমাদের হাতে চায়ের গ্লাস, নিলয়ের ঠোঁটে সিগারেট। সে সিগারেটে টান দিয়ে বলল, “এই মেয়েকে ভুলে যা, ইমাদ।”
ইমাদ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “আচ্ছা।”
নিলয় হাতের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলল। উঠে এসে ইমাদের বেঞ্চিতে বসে ইমাদের কাঁধ জড়িয়ে ধরল, “সত্যি সত্যি আচ্ছা বল।”
ইমাদ নিশ্চুপ। নিলয় হতাশামিশ্রিত গলায় বলল, “তুইও দীপুর মতই করছিস। আমরা দুজনে মিলে তখন দীপুটাকে না করেছিলাম। ও তো অবুঝ, বুঝেনি। কিন্তু তুই তো এমন না।”
ইমাদ এবারেও চুপ। মুখে কোনো রা নেই। সে তাকিয়ে আছে টঙ দোকানের লাইটের দিকে। যেখানে কয়েকটা পোকা দল বেঁধে আছে। নিলয় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “বুঝলাম প্রেমে পড়লে সবাই এমন। একই!”
ইমাদ তখনও কথা না বলায় নিলয় বলল, “তোর পেট ফেটে যায় না কেন? আর কিছু লুকাচ্ছিস না তো? এমন চুপ করে কেন?”
“না লোকাচ্ছি না।”
“বিশ্বাস নেই তোর। কতকিছু যে লুকাস তুই! আমি যদি সেদিন তোকে কড়ির জানালার সামনে না দেখতাম আর আজ ডিএসপিতে একসাথে তাহলে তো কিছুই জানা হতো না আমার! সেদিন অবশ্য জানালার সামনে দেখেও ঠাহর করতে পারিনি।”
“আচ্ছা।”
নিলয় ইমাদের দিকে তাকিয়ে ওর হাবভাব বোঝার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই বুঝল না। তবুও আন্দাজে বলল, “তুই বুঝতে পারছিস না মেয়েটা খুবই অদ্ভুত? লোভীও।”
ইমাদ এবার মুখ খুলল, “লোভী না।”
নিলয় বলল, “গেছে তোর মাথাটাও গেছে।”
ইমাদ বলল, “আমাকে বাজাতে চাইছে। পরীক্ষা।”
নিলয় কিছু একটা বলতে নিচ্ছিল তার আগেই ইমাদ উঠে দাঁড়াল। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে করতে বলল, “তোর কথাটা শুনে আরেকটা জিনিস মনে হলো।”
নিলয় বলল, “কী?”
ইমাদ দোকানদারকে টাকা মিটিয়ে বলল, “তুই যা ভাবছিস বা সবাই শুনে যা ভাববে তা সে আমাকেও ভাবাতে চাইছে। দূর করবার ফন্দিও হতে পারে।”
নিলয় বলল, “তা এখন কী করবি? যদি মেনেও নিই সে লোভী না তবুও তোর কী করার আছে?”
“যা চায় তাই দিব।”
“এত টাকা কোথায় পাবি? কেমনে সম্ভব?”
“জানি না।”
নিলয় খুবই হতাশ। দীপুর সুখ আসতে না আসতেই ইমির ঝামেলা শুরু। ওর মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
.
কড়ি লাগেজ টেনে ঘর থেকে বেরুলো। কাইয়ূম লাগেজটা ধরে বলল, “রিকশা বাইরে দাঁড়ানো। তুই আয়, আমি যাচ্ছি।”
কড়ি বলল, “তোমার যেতে হবে না।”
“আমার যেতে হবে নাকি হবে না সেটা আমি জানি।”
“একা ঢাকা যেতে পারব আর বাস স্টপ পর্যন্ত যেতে পারব না? তুমি অফিসে যাও, অফিসের দেরি হবে।”
রিমা বলল, “তোর বড় ভাইয়া শুধু বাসে উঠাতে যাচ্ছে না, ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে।”
কড়ি হেসে বলল, “হে পারলে কোলে করে নিয়ে যেতে বলো এত বড় মেয়েকে।”
কাদের সাহেব বললেন, “ব্রেক নিয়েছ আশা করি এই সেমিস্টারে মন দিয়ে পড়াশুনা করবে।”
“ইনশাআল্লাহ, বাবা।”
দীপার মুখটা খুবই মলিন। ও পারলে কেঁদে দিতো। কাদিনের জন্য কাঁদতে পারছে না। কাঁদলে আবার কী না কী বলে! কড়িকে বলল, “তোমাকে অনেক মিস করব।”
কড়ি হেসে দীপাকে জড়িয়ে ধরতে গেল। দীপা বলল, ” না, না ধরো না। ধরলেই কেঁদে দিব।”
সবাই হাসল একমাত্র কাদিন ছাড়া। কায়েস বলল, “কেঁদো না মেজভাবি, আমি আছি না তোমার জন্য? শুধু তোমার জন্য…..” শেষের দিকে সুর করে বলল।
দীপা এবার নিজেও হেসে ফেলল। কাদিন বলল, “দেরি হয়ে যাচ্ছে, কড়ি।”
কড়ি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এল। বাসে বসতেই কড়ির মোবাইল টুং করে উঠল। কড়ি পার্স থেকে মোবাইল খুলল। রিমার মেসেজ। মেসেজে লিখা, “তোর বড় ভাইয়া কাল রাতে আমাকে বলছিল হয়তো এটাই বোনের সাথে আমার শেষ এমন যাত্রা। পরে তো ও সবসময় ওর বরের সাথেই আসা যাওয়া করবে। বা আমার সাথে কোথাও গেলেও কতকিছুই বদলে যাবে। পাশের সিটটা তখন ওর বরের হয়ে যাবে। ওর কিছু খেতে ইচ্ছে করলে আমাকে কখনই বলবে না। বরকে বলবে কিনে দাও। ওর ব্যাগ টানবে সেই লাকিম্যান। তাই আমি কাল ওর সাথে ঢাকা যাব। কবে বোনটার বিয়ে হয়ে যায় ঠিক নেই।”
মেসেজটা পড়ে কড়ি হাসবে না কাঁদবে তা নিয়ে দোটানায় পড়ে গেল। রিমাকে রিপ্লাই লিখল, “তুমি আমার কাছে একটা ট্রিট পাওনা রইলে, আপু। থেঙ্ক ইউ।”
তারপর সাথে সাথে পাশের সিটে বসা কাইয়ূমের হাত ধরে বলল, “বড় ভাইয়া, আমার না আচার খেতে ইচ্ছে করছে। এনে দাও।”
কাইয়ূম বলল, “কিসের?”
“প্রাণের আমের আচারটা আনবে। অনেকগুলো।”
কাইয়ূম বলল, “উফ আগে বলবি না? এখন বাস ছাড়বার সময় হয়েছে। এখন এলি বিরক্ত করতে।”
বলতে বলতে কাইয়ূম বাস থেকে নামল। কড়ি হাসল। তার একেক ভাই তাকে একেকরকম আদর করে। কাইয়ূমের আদর মা মা আদর। মায়ের মত সবসময় মায়া আর মায়া। যেন মা যে নেই সেটা সে কোনোভাবেই কড়িকে বুঝতে দিতে নারাজ।আর কাদিন ঠিক বাবার মতন। আসার সময় হাতে কতগুলো টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, “সাবধানে।”
কিন্তু কখনোই জড়িয়ে ধরবে না, আবার কখনো ধমকও দিবে না। কিন্তু কড়িকে সবকিছুই অঢেল দিতে পারলেই সে শান্তি পায়। আর কায়েসের আদর পৃথিবীর সেরা ভাইদের আদরের মতন। জড়াজড়ি, ধমকাধমকি, শাসন, মজা, আদর, স্নেহর ফুলপ্যাকেজ। কড়ি মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলল। এবং সে যা করেছে তা যে ঠিকই করেছে তা নিশ্চিত হলো। এই বাবা – ভাইদের ইচ্ছা আর সাধের চাইতে অধিক মূল্যবান কিছু নেই। ইমাদের কাছে গয়নার চ্যালেঞ্জ ছু্ঁড়ে দেয়া দারুণ একটি কাজ হয়েছে। ইমাদ এখন নিশ্চয়ই তাকে লোভী ভাববে এবং তার প্রতি থাকা অনুভূতিগুলোও মলিন হয়ে যাবে। এইরকম লেইম কথাবার্তা বলা মেয়েদের প্রতি ভালোবাসা ধরে রাখা অসম্ভব। আর যদি কোনোভাবে ইমাদ বিষয়টা ধরতে পারে তাতেও সমস্যা নেই। ইমাদের পক্ষে কতটুকু কী করা সম্ভব, ওর পরিবারের আর্থিক অবস্থা কেমন সব সম্পর্কেই কড়ি দীপার কাছ থেকে ইনিবিনিয়ে সব জেনে নিয়েছে। দীপা ত সহজসরল টেরও পায়নি। সব শুনে কড়ির মনে হয়েছে ইমাদ কখনই এত গয়না যোগাড় করতে পারবে না। আর ইমাদ যেধরনের মানুষ গয়না দিতে না পারলে জীবনে কড়িকে আর মুখও দেখাবে না। সহজ সমাধান। কড়ি নিজের আঙুলে থাকা রামিমের মায়ের দেয়া আঙটি ঘুরাতে ঘুরাতে হাসল। বিড়বিড় করল, “থেঙ্কস আন্টি। আপনার দোয়া আর দাওয়া দুটোই কাজে লাগল! মায়েদের দোয়ার অনেক ক্ষমতা!”
.
দীপার সারাদিন অসম্ভব মলিন হয়ে রইল। একে তো কাদিন ওর সাথে এমন করে, তারপর আবার কড়িও চলে গেল। মায়ের জন্যও মন পুড়ছে। কিন্তু জিদ দেখিয়ে কাদিনকে বলেছে সে না গেলে ও যাবে না। সবদিক মিলিয়ে মন খুবই থমথমে। দুপুরে ভালো মত খেলোও না। কিছু ভালো লাগে না তার। তাই ছাদে এসে বিকেলের নরম রোদে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। এরপর হঠাৎ মনে হলো কেউ বোধহয় তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। দীপা মনে মনে বলল, “হুম জীবনে এখন ভূতপেত্নী আসাটাই বাকি আছে।”
ভাবতে ভাবতে ফিরে তাকিয়েই দেখল ভূত নয়, কাদিন। সে বলল, “ওহ আপনি। আজ এত তাড়াতাড়ি?”
দীপা আবার সামনে তাকাল। কাদিন পেছনে দাঁড়িয়েই বলল, “যাওনি কেন?”
“এমনভাবে বলছেন যেন মনে হচ্ছে আপনি জানেন না!” দীপা ঠেশ দিয়ে বলল।
কাদিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “যাও ঘুরে এসো।”
“আমি জাহান্নামে যেতে রাজি কিন্তু বাপের বাড়ি আর কোনোদিন যাব না। কেউ মরলেও যাব না।” অভিমানে দীপার কণ্ঠ ভেজা ভেজা।
খানিক পরে নিজেই আরো যোগ করল, “হাসপাতালে দেখে নিব।”
কাদিন কথা না বাড়িয়ে নীচে নেমে গেল। দীপা ছাদে বসতে গিয়েও বসল না। ছাদে এভাবে বসলে কাদিন ওকে আবার গোসল করাবে নিশ্চিত। দরকার নেই। পাগলের সাথে বিয়ে হয়েছে তার। আর দাঁড়িয়েও থাকা যাচ্ছে না। পা ব্যাথা করছে তাই সেও নীচে নেমে গেল। ড্রয়িংরুম পাড় করে তারপর ভেতরে ঢুকতে হয়। দীপা সেদিক দিয়েই আসছিল, কাদিন ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “কালকে নিয়ে যাব।”
দীপা আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল। অতিআনন্দে কাদিনের শার্ট খামচে ধরে আচমকা তার গালে চুমু খেয়ে ফেলল। কাদিন বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে এদিকওদিক তাকিয়ে বলল, “দীপা! এসব কী?”
চুমুটা সে ইচ্ছে করেই খেয়েছে। সুযোগ খুঁজছিল এমন কিছু একটার। নিজের ভুল শুধরাতে আর কাদিনের রাগটা যেন কেটে যায়, তাই আরকি। কিন্তু, কাদিন খুশি হওয়ার বদলে ক্ষেপে যাবে সেটা দীপা ভাবেনি। রাগে, লজ্জায় মেঝের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে বলল, “স্যরি, ভুলে দিয়ে ফেলেছি।”
কাদিন দীপাকে ধাক্কা দিয়ে সরে গেল। দীপা ধাক্কা খেয়ে পাশে থাকা সোফায় বসে পড়ল। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কাদিনের চলে যাওয়ার দিকে। কাদিনও হতভম্ব! কী বলে এই মেয়ে? সে ভুলে চুমু খেয়েছে? কাদিন প্রথমে বিরক্ত হয়েছিল এই ভেবে যে, যে কেউ দেখে ফেলতে পারতো! এটা ড্রয়িংরুম। কিন্তু ভুলে কথাটা শুনে কাদিনের মেজাজটা চড়ে গেল।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here