#আমি_জান্নাত
#পর্বঃ০২
#ফারজানা_আক্তার
আকাশ লাল আভা কাটিয়ে কিছুটা অন্ধকারে ছেঁয়ে গিয়েছে প্রকৃতি আবার সেই অন্ধকারের মাঝেই চাঁদের আলোই ঝলমল করছে সর্বত্র, ঝিকঝিক করছে তাঁরাগুলো, মৃদু বাতাস জানালা ভেদ করে আমার মুখে এসে ভারি খাচ্ছে আবার ফিরে যাচ্ছে নিজ ঠিকানায়। মিটিমিটি করে চোখ মেলে দেখি সামনে ভাইয়া বসে আছে গম্ভীর মুখ করে, ভাইয়ার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে বিষন্নতা বিষাদ। আমি মৃদু কন্ঠে ভাইয়া বলে ডাক দিতেই ছলছল নয়নে তাকালো ভাইয়া আমার দিকে। ভাইয়ার চোখ দেখে কিছুটা বুঝতে পেরেছি ভাইয়ার এই কষ্টের কারণ। আমি জানতাম নাহিদ এতো সহজে ধরা দেওয়ার মানুষ নয়, নিশ্চয়ই এভাবে হুট করে শাস্তির ঘোষণা করা টা ওরই কোনো প্লানিং ছিলো, টাকা থাকলে নাকি আকাশের চাঁদও কেনা যায় আর এখানে তো সামান্য নাহিদ নামের নরপশুর স্বাধীন ভাবে চলার বিষয়। ওর বাবার অনেক টাকা, এলাকায় এমনকি সরকারি পোশাক পরা আইনের মানুষেরাও তাদের টাকার কাছে হার মানে, আবার এলাকার মেম্বারও ওর বাবা। এক বছর আগেও ভরা বাজারে একটা মেয়ের বুকের ওড়না সরিয়ে সেই মেয়ের গায়ে হাত দেয়, পরে সেই মেয়ের পরিবার পুলিশের কাছে গেলে উল্টা ওই মেয়েকেই দুশ্চরিত্রা বলে কলঙ্কিত করে সমাজে সেই পুলিশ হঠাৎ করে আমার ঘটনার জন্য নাহিদ কে শাস্তি দিয়েছে শোনে কিছুটা সারপ্রাইজ হয়েছিলাম আমি। সব চিন্তা বাদ দিয়ে ভাইয়াকে বললাম
“চিন্তা করিওনা ভাইয়া, আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেননা, পৃথিবী বিচার না করলেও আল্লাহ একদিন ওই নাহিদের বিচার ঠিকই করবেন।”
ভাইয়া আমার হাত ধরে অজরে কাঁদতে লাগলেন। বুকটা যেনো ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার তবুও নিজেকে শান্ত রেখেছি। জানি না আর কতক্ষণ এভাবে নিজেকে শান্ত রাখতে পারবো কিন্তু সবাইকে শান্তনা দেওয়ার জন্য হলেও নিজেকে শক্ত রাখতেই হবে আমার।
ভাইয়া চলে গেলে আমি আর নিজের চোখের নোনাজল আঁটকে রাখতে পারিনি। ইচ্ছে মতো কাঁদলাম কিছুক্ষণ। একজন নার্স এসে আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে দ্রুত আমার চোখের জল মুছে দিয়ে ডাক্তার আপুকে ডেকে নিয়ে আসেন। চোখের জলে মুখের বামপাশে এসিড আক্রান্ত জায়গার বেন্ডেজ টা একটুখানি ভিজে গেছে, ডাক্তার আপু দ্রুত বেন্ডেজ চেঞ্জ করে দেন তারপর আম্মু এসে আমাকে রাতের খাবার খাইয়ে দিয়ে ঔষুধ খাওয়ায়। আমিও চুপচাপ খেয়ে নিলাম তারপর জীবনের হিসাব মিলাতে মিলাতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
———-
সকাল ৮টায় ঘুম থেকে জেগে দেখি আমার পাশে একটা টুলে বসে আমার হাতের কাছে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে আম্মু। পুরো রুম জোড়ে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে। জানালার গ্লাস ভেদ করে সূর্যের আবছা আলো কিছুটা আমার চোখ-মুখ স্পর্শ করলো। আমার খুব ইচ্ছে করছিলো আয়নায় একবার নিজের চেহারা টা দেখার কিন্তু এখানে আয়না পাবো কোথায়? আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখি পাশের টেবিলেই আম্মুর ফোন রাখা আছে। ফোনের দিকে হাত বাড়াতেই আমার নড়াচড়া অনুভব করে আম্মু জেগে যায় ঘুম থেকে। দ্রুত ফোনের দিক থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে আসি। আম্মু জিজ্ঞেস করলো কিছু লাগবে নাকি আমার, আমিও কিছু না ভেবে বলে দিলাম তৃষ্ণা পেয়েছে পানি খাবো। রুমে পানি নেই তাই আম্মু বাহিরে গেলো পানি আনতে যাওয়ার সময় ফোনটাও নিয়ে গেলো। ডাক্তার আপু বলেছিলো আমার সামনে আয়না জাতীয় মানে আমি নিজের মুখ দেখতে পারি এমন কিছু যেনো ভুলেও না রাখা হয়। অনেকগুলো দিন হয়ে গেলো কিন্তু আমার চেহারা আমি দেখতে পারলাম নাহ, কষ্ট হচ্ছে খুব কিন্তু তবুও সবার সামনে নিজেকে শক্ত রেখেছি।
_____________
সম্পূর্ণ একমাস পর আমি আমাদের বাসায় পা রাখলাম। হাসপাতালে থাকতে থাকতে কেমন জানি তিক্ততা চলে এসেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে পুরো ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো ঘরের কোনো স্থানে আমি একটা আয়না দেখলাম না। আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা যে আমার জন্যই আয়না জাতীয় সব জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে ঘর থেকে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। একটা সময় ছিলো যখন ঘুম থেকে উঠার পর যতক্ষণ আমি আয়না না দেখতাম ততক্ষণ পর্যন্ত শান্তি পেতাম না আমি আর এখন দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে কিন্তু নিজের চেহারা নিজেই দর্শন করতে পারছিনা। সম্পূর্ণ পর্দা করেই আমি হাসপাতাল থেকে বাসায় এসেছি। আসার পথে আমাদের স্কুলের পাশের বটগাছের শিখরে নাহিদ কে বসে থাকতে দেখেছিলাম, নাহিদকে দেখতেই কেমন জানি কষ্ট টা হাজারগুন বেড়ে গেলো আমার, ওকে দেখতেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছিলো আমার তবে এখন মোটামুটি সুস্থ আছি আলহামদুলিল্লাহ।
অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার পর নিজের রুমে প্রবেশ করলাম। রুমে পা রাখতেই নয়নারা সবাই স্বাগতম জান্নাত বলে চিল্লিয়ে উঠলো। সামনের দেওয়ালে বড় করে লেখা ওয়েলকাম হাউজ। দৌড়ে গিয়ে নয়না কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম, একমাস ধরে যে কান্না লুকিয়ে আসছি সেই কান্নার বাঁধ ভেঙ্গেছে আজকে, নিজেকে আর আঁটকিয়ে রাখতে পারলাম নাহ। আমাকে শান্ত করে নয়না আর বাকি সবাই কিছুক্ষণ আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলো তারপর নয়না আমার মাথায় তেল লাগিয়ে দিতে বসেছে। বাকিরা গোল হয়ে আমাদের চারপাশে বসেছে। সবাই নাকি এই একমাসে হাজার বার পুলিশের কাছে চেয়ারম্যানের কাছে গেছে কিন্তু নাহিদকে কেউ কোনো শাস্তি দিতে রাজি হলোনা কেননা নাহিদের বাবা নিজেও মেম্বার। নয়না আমার মাথায় তেল দিতে দিতে বলে
“চিন্তা করিসনা, নাহিদকে শাস্তি পেতেই হবে এবং তুই-ই দিবি নাহিদকে শাস্তি কিন্তু ধৈর্য ধরতে হবে আমাদের। হারতে নয় জিততে শিখেছি আমরা, এতো সহজে হার মেনে নেওয়ার মতো মেয়ে আমরা নয়। তুই যেভাবে ইচ্ছা শাস্তি দিবি ওই শয়তানটাকে আমরা সবসময়ই তোর পাশে আছি এবং থাকবো”
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে নয়নার দিকে তাকালাম। নয়নার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ওর হাতে একটা চুমু খেলাম তারপর বললাম “তোরা পাশে থাকলে সব যুদ্ধে আমিই বিজয়ী হবো ইনশাআল্লাহ। আমি জান্নাত আমিই নাহিদকে শাস্তি দিবো আল্লাহর সাহায্যে। ”
_________
পড়ন্ত বিকাল। অনেকক্ষণ সময় ধরে শুয়ে আছি কিন্তু ঘুম নেই আমার চোখে মাথায় শুধু একটাই চিন্তা আমি আমার চেহারা টা একবারের জন্য হলেও দর্শন করবো। আমার বাথরুমের আয়না টাও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সবাই ভাবতেছে হয়তো আমি নিজেকে নিজেই ভয় পাবো যদি আমি আমার মুখটা দেখি তাই এমনটা করতেছে কিন্তু আমার চেহারা পর্যবেক্ষণ না করা পর্যন্ত নাহিদকে শাস্তি দিতে পারবোনা আমি। আমি বাসায় আসছি তিনদিন হয়ে গেছে, সময়গুলো যেনো খুব দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে। শুয়ে শুয়ে বিভিন্ন চিন্তায় নিজেকে নিয়ে ঘুরছি এমন সময় হাতে করে ফুচকা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো ভাইয়া। ভাইয়াকে দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। হাঁসিমুখে নিজের হাতে ফুচকা বানিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে ভাইয়া আমায়। ফুচকা খুব পছন্দ আমার কিন্তু এতগুলো দিন ফুচকা খাওয়া হয়নি আমার। আজ তৃপ্তি নিয়ে দুই ভাইবোন ফুচকা খেলাম। সব সম্পর্কের মাঝে ভাইবোনের সম্পর্কটাই সেরা, বেঁচে থাকুক ভালোবাসা।
এই তিনদিনে আমি একবারের জন্যও রুম থেকে বের হয়নি। আমার রুমের জানালার পর্দাটাও সরানো হয়নি। এই তিনটা দিন সূর্যের আলো আর চাঁদের রশ্মি অনুভব করতে পারিনি আমি। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসলো, হালকা করে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দেখলাম পৃথিবী যেনো হলদে রঙে রাঙ্গিয়ে নিয়েছে নিজেকে। ঠোঁট হালকা বাঁকা করে একটুখানি হাঁসলাম, সন্ধ্যার এই সময়টা যে ভীষণ প্রিয় আমার তাই লোভ সামলাতে না পেরে আজ বাহিরের জগৎ টা দেখেই ফেললাম নতুন করে। জানালার পর্দা নামিয়ে দিয়ে গা মাথায় ভালো করে ওড়না টেনে দিয়ে রুম থেকে বের হলাম। দু’চার পা হাঁটতেই দেখি রান্নাঘরে রাতের খাবার রান্না করছেন আম্মু। আম্মুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমার ফোনটা কোথায়? কিন্তু প্রত্যুত্তরে কিছুই বললোনা মা, আমি আবারো জিজ্ঞেস করতেই আম্মু কিছুটা কঠিন স্বরে বললো “তোর কোনো ফোনের প্রয়োজন নেই”
ক্যামরাবিহীন একটা ছোট্ট ফোন ধরিয়ে দিয়েছে আমায় যেটাতে কিনা চেহারাও দেখা যায়না স্পষ্ট।
আম্মুকে জড়িয়ে ধরে একটু বায়না করে বললাম “আম্মু অনেকদিন আয়না দেখিনা আমি, খুব ইচ্ছে করছে নিজের মুখের পোড়া দাগটা দেখার। প্লিজ আম্মু একটা আয়নার ব্যবস্থা করে দাওনা আমায়।”
আম্মু কান্না করে দিলো এবার আর বললো “নারে মা আরো কিছুদিন অপেক্ষা কর। এখন তুই সহ্য করতে পারবিনা।”
আমারো কান্না আসছে খুব তবুও নিজেকে সামলিয়ে বললাম “মা তোমার মেয়ে এতোটাও দূর্বল নয়। তোমার মেয়ে অপরাধী কে শাস্তি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে। তোমরাই যদি এভাবে দূর্বল ভেবে আমাকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে রাখো তবে নাহিদ তো আমায় পিঁপড়া ছাড়া আর কিছুই মনে করবেনা। প্লিজ মা আমাকে একটা সুযোগ দাও, আমি পারছিনা আর এভাবে বাঁচতে। ওই নাহিদ কে শাস্তি না দেওয়া অব্দি আমি শান্তি পাবোনা আমার যন্ত্রণা কমবেনা।”
আম্মু আমাকে কিছু বলতে যাবে তখনই ভাইয়া আর আব্বুর চেঁচামেচির সুর ভেসে আসলো ড্রয়িংরুম থেকে। দৌড়ে এসে দেখি ভাইয়াকে_____
#চলবে
#আমি_পদ্মজা গল্পটা আমি এক পর্বও পড়িনি। আমার এই গল্পের সাথে নাকি পদ্মজা গল্পের মিল পেয়েছে কিছু পাঠকরা। সবাইকে একটাই কথা বলবো যেহেতু আমি পদ্মজা গল্পটা পড়িনি সেহেতু আমার পক্ষে আমার এই গল্পের থিম চেঞ্জ করা সম্ভব হবেনা। দয়া করে কেউ বলবেননা যে আমি পদ্মজা গল্পের থেকে এই গল্পটা লিখতেছি। কষ্ট হয় খুব।
((ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি))