আমি_জান্নাত #পর্বঃশেষ_পর্ব

#আমি_জান্নাত
#পর্বঃশেষ_পর্ব
#ফারজানা_আক্তার

নাহিদের চোখে মুখে প্রচুর রাগ লক্ষ করতে পারছি। আমি মিষ্টির প্যাকেট টা নিয়ে নাহিদের সামনে যেতেই ওর লাল চোখ গুলো আরো বেশি লাল হতে থাকে। ওর পরিবারের সবাই ঢেব ঢেব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি কিন্তু পর্দা করার কারণে সেই হাসিটা কেউই দেখছেনা। ও হ্যাঁ এর মাঝে একদিন নাহিদ আর তার পরিবার আমাদের বাসায় গিয়েছিলেন নাহিদের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, সেদিন ইচ্ছে মতো অপমান করেছিলাম তাদের।
নিরবতা ভেঙ্গে নাহিদ বলে উঠে

“পাখি দেখি নিজে নিজেই চলে এসেছে খাঁচায় বন্দী হতে”।

নাহিদের কথা শুনে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আমার। নিজেকে কোনোভাবে সামলিয়ে মিষ্টির প্যাকেট টা এগিয়ে দিয়ে বললাম

“নে তোর দ্বিতীয় হারের পুরস্কার। খুব করে বলেছিলি আমাকে জীবনে কোনো উন্নতি করতে দিবিনা, পড়াশোনা করতে দিবিনা, তুই কি জানিস আজ আমার ইন্টারফাইনাল পরিক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে? তুই কি জানিস আমার রেজাল্ট কতটা ভালো হয়েছে? শুন তবে আমি জিপিএ পেয়েছি। তোর তৃতীয় হার শুরু হবে খুব দ্রুত আর তার আগেই তুই বন্ধ কারাগারে বন্দী হবি আই প্রমিজ।”

আমার কথা শেষ হতে না হতেই নাহিদ আমার দিকে এগিয়ে আসে, তখনই আমি ব্যাগ থেকে ম’রি’চ পাউডার টা বের করে সেখানে উপস্থিত সবার চোখে মুখে স্প্রে করে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে আসলাম। আমি জানতাম ওখানে গেলে আমার জন্য রিস্ক হবে তাই আমিও সেই প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছি।
_______________

আব্বু আম্মু ভাইয়া আমি আমরা সবাই আজকে বাহিরে খেতে গিয়েছি, আমার রেজাল্ট দেখে সবাই খুব খুশি আজ। আম্মুর মুখেও চিন্তার চাপ কমেছে কিছুটা।
রাত তখন ৯টা ৩০মিনিট বাজে। মুনিয়াকে কল দিলাম, মুনিয়া হলো আমার কলেজের বেস্টফ্রেন্ড। কলেজে একমাত্র মুনিয়া ছাড়া আর কেউ দেখেনি আমার চেহারা, এমনকি আমার জীবনের সব সত্যি মুনিয়ার সাথে শেয়ার করেছি আমি। মেয়েটা খুব ভালো, একদম নয়নার মতো।
আমাদের থানায় যে অফিসার আছে উনার মেয়ে হলো এই মুনিয়া। আমি বুঝিনা এমন ঘুসখোর বাবার ঘরে এতো নিষ্পাপ একটা মেয়ের জন্ম হলো কিভাবে। মুনিয়া তার বাবাকে কম পছন্দ করে এইসব কারণে। মুনিয়াকে কল দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো আগামীকাল একটা নাটক সাজাবো মুনিয়াকে দিয়ে আর সেই নাটকের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করার জন্যই।

মুনিয়ার সাথে কথা বলে ফোনটা বালিসের উপর রেখে জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। জানালার পর্দা সরিয়ে কাঁচটা খুলে মৃদু বাতাস উপভোগ করবো এই উদ্দেশ্যেই জানালার কাছে যাওয়া।
বাহিরে এতোই অন্ধকার যে মনে হচ্ছে আমি নিজেকে নিজেই হারিয়ে ফেলবো। আজ অমানিশা নেমেছে পৃথিবী জোড়ে, চাঁদের আলোর ছিটেফোঁটাও নেই কোথাও। খুব মন খারাপ হয়ে যায় আমার কারণ জ্যোৎস্না আমার ভীষণ প্রিয়।
মন খারাপ করে জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিয়ে এসে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।

*স্কুলের টিচার আমাকে এক ঘন্টা আগে ছুটি দিয়ে দিলো,কিন্তু আমি একা কিছুতেই বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। স্যার কে অনেক বুঝিয়ে বলেছি কিন্তু স্যার কেনো জানি আমাকে শেষ এক ঘন্টা ক্লাস করতে দিচ্ছেনা। নয়না আমার সাথে বের হতে চাইলে ক্লাস থেকে স্যার তাকে আটকিয়ে দেন। বাধ্য হয়ে একা স্কুল গেইটের বাহিরে চলে এলাম, প্রিন্সিপাল স্যারকে বলেও কোনো লাভ হয়নি। রাস্তার কোণে কোণে হাঁটতে লাগলাম, মনে নাহিদের ভয়। ভাবতে না ভাবতেই নাহিদ হাজির আমার সামনে। সেদিন সহ সপ্তম বার সে আমায় প্রপোজ করে। আশে পাশে কেউ নেই, নাহিদ একটা লাল গোলাপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে

“তোমার সাথে প্রেম করার বড্ড স্বাদ আমার”

আমি ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে দৌড় দিতেই নাহিদ আমার হাত ধরে ফেলে আর ঠাস রে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেয় আমায়।*

হুট করে ঘুম থেকে জেগে হাঁফাতে লাগলাম আমি। এতো বাজে স্বপ্ন কেনো দেখলাম হঠাৎ আমি? খুব কষ্ট হচ্ছে আমার, পুরোনো স্মৃতি গুলো যতই ভুলতে চাইছি ততোই সেগুলো জড়িয়ে ধরে আমায়। আফসোস হয় বড্ড। সেদিন যদি নাহিদের থাপ্পড়ের জবাব দিয়ে দিতাম তবে আজ আমার জীবন অন্যরকম হতো।
_____________

সকালে নাস্তা শেষ করে আব্বু আম্মুর থেকে দোয়া নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। কলেজের সামনে যেয়ে দেখা করলাম মুনিয়া আর নয়নার সাথে, আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলো দুজন। আমার সাথে সাথে তারা দুজনও পরিপূর্ণ পর্দা করে এখন আলহামদুলিল্লাহ। আমরা তিনজন মিলে একটা পার্লারে গেলাম তারপর মুনিয়াকে তৈরি করে থানার উদ্দেশ্যে বের হলাম। থানায় গিয়ে অফিসার কে বলালম মুনিয়ার অনেক বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে, উনাকে আমাদের সাথে হাসপাতালে যেতে হবে। উনিও মেয়ের এমন অবস্থার কথা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি তাই দ্রুত বেরিয়ে গেলেন আমাদের সাথে। পথে আমরা উনাকে বলি যে কেউ মুনিয়াকে এসিড আক্রান্ত করেছে কিন্তু কে করেছে আমরা জানিনা।
প্রায় তিনমাস লাগলো মুনিয়ার ভালো হতে। এর মাঝে মুনিয়ার বাবা অনেকবার মুনিয়ার কাছে জানতে চেয়েছে তার এমন অবস্থা কে করেছে কিন্তু মুনিয়া তখন কিছুই বলেনি। তিনমাস পর যখন মুনিয়াকে ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় তখন আমরা যায় ওর সাথে দেখা করতে। কিন্তু বাসায় মুনিয়ার বাবা ছিলেননা, তিনি থানায় গেছেন। আমরা তিনজনও বের হলাম থানায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
থানায় গিয়ে মুনিয়া তার বাবার সামনে যেয়ে বললো

“আব্বু আমার এই অবস্থা যে করেছে তাকে কি তুমি শাস্তি দিতে পারবে?”

ভেজা চোখে মুনিয়ার বাবা জাকির হোসেন বললেন

“কেনো পারবোনা মা, অবশ্যই পারবো। তুই শুধু একবার সেই জানোয়ারের নাম টা বল মা আমায়।”

“কিভাবে বিশ্বাস করবো যে তুমি শুধু আমার একজনের কথায় ওই নরপশুকে শাস্তি দিবে? দুই বছর আগে যখন এতোগুলো মানুষ বলার পরেও তুমি ওই নরপশুর কিছু করতে পারোনি তবে আজকে একজনের কথায় কিভাবে শাস্তি দিবে তাকে তুমি?”

মেয়ের কথা শুনে জাকির হোসেন যেনো থমকে গেলেন। চোখে মুখে তার প্রচুর চিন্তার ভাব। আমতা আমতা করে মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন

“কার কথা বলছিস তুই মা”

মুনিয়া নাহিদের নাম বলতেই দাঁড়ানো থেকে বসে যান জাকির হোসেন। জাকির হোসেনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আনাগোনা। জাকির হোসেনের এই অবস্থা দেখে ভীষণ ভালো লাগছে জান্নাতের। জাকির হোসেন তাদের তিনজনকে নিয়ে নাহিদের বাসায় যান এবং তাদের সামনে নাহিদকে গ্রে’প্তার করেন। কিন্তু নাহিদ কিছুতেই ধরা দিতে ইচ্ছুক নয় কারণ সে মুনিয়ার কোনো ক্ষতি করেনি। তবুও জাকির হোসেন এবার টাকার প্রতি কোনো লোভ লালসা না করে নাহিদকে পুরো এলাকার মানুষের সামনে টেনে হিঁচড়ে থানায় নিয়া যান। বাবা বলে কথা, কোনো বাবাই তার মেয়ের এমন করুণ অবস্থা সহ্য করতে পারবেনা।

নাহিদকে কারাগারে বন্দি করার পর মুনিয়া নিজের মুখের মেকআপ তুলে তার বাবার সামনে দাঁড়ালো, জাকির হোসেন অবাক হয়ে নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন আর বললেন

“তুই আমার মেয়ে হয়ে আমাকে এতো বড় ধোঁকা দিতে পারলি”

“হ্যাঁ পেরেছে কারণ আপনি বাবা নন, আপনার মতো একজন মানুষ কখনো বাবা হতেই পারেনা। একজন বাবা আর যাই হোক তিনি কখনো নিজের মেয়ের আর অন্য বাবার মেয়ের মধ্যে পার্থক্য খুঁজেননা, আপনি একজন প্রকৃত বাবা নন।”

জান্নাতের কথাগুলো শুনে জাকির হোসেন ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালেন ওর দিকে। জাকির হোসেন আশ্চর্যজনক কন্ঠে বলেন

“তুমি কে?”

তারপর জান্নাত আবার বলতে শুরু করলেন।

“আমি সেই জান্নাত যাকে আপনি দু’বছর আগে ন্যায়বিচার দিতে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু আজকে নিজের মেয়ের এই করুণ অবস্থা দেখে ঠিকই তাকে ন্যায়বিচার দেওয়ার জন্য ছুটে গেছেন ওই নাহিদের বাসায়, আজকে আপনি সব লোভ লালসা ভুলে গেছেন। আমি খেয়াল করেছি নাহিদের বাবা আপনাকে টাকার অফার দিয়েছিলেন আজকেও তবে আপনি আজকে টাকা নেননি কারণ আজ প্রশ্ন আপনার মেয়ের বলে কিন্তু সেদিন ঠিকই হাত বাড়িয়ে টাকা টা নিয়েছিলেন, কেনো নিয়েছিলেন সেদিন টাকা? আমি আপনার মেয়ে নয় বলে? আপনি সেদিন আমার ন্যায়বিচার করেননি, আপনি সেদিন টাকার কাছে বিক্রি হয়েছিলেন তাই আজকের এই নাটক। আমি চাইলে নিজ হাতে ওই নরপশুকে শাস্তি দিতে পারতাম তবে তা আমি করিনি কারণ আমি চাইনা আমার কোনো ভুলের জন্য আমার পরিবারের ক্ষতি হোক। আপনার মেয়ে মুনিয়ার সাহায্য না থাকলে আমি এতদূর আসতে পারতাম না, আপনাকে ধন্যবাদ এমন একজন সৎ মেয়ের জন্ম দেওয়ার জন্য, আমি আসলে বুঝতেই পারছিনা যে আপনার মতো কুলাঙ্গার একজন বাবার ঘরে এমন মেয়ের জন্ম হলো কীভাবে। আর কিছু বলতে চাচ্ছিনা শুধু এইটুকুই বলবো নাহিদের কঠোর শাস্তি চাই আমি।”

জান্নাত কথাগুলো বলে আর এক মিনিটও সেখানে না দাঁড়িয়ে বের হয়ে যায় সেখান থেকে। মুনিয়া আর নয়নাও জান্নাতের সাথে বেরিয়ে আসে। জান্নাত এখন নিজেকে আঁটকাতে পারছেনা নয়নাকে জড়িয়ে ধরে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে।

তার কয়েকদিন পরই ঘোষণা হয় নাহিদের শাস্তির। যাপতজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় নাহিদকে। আর মুনিয়ার বাবার চাকরিও চলে যায় ঘুষ খাওয়ার অপরাধে।
জান্নাত আজ প্রাণভরে শ্বাস নিচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসি দিয়ে জান্নাত বলে

“আজ আর কোনো আফসোস নাই জান্নাত, চেহারার সৌন্দর্যের চেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো মনে সৌন্দর্য। যার মন সুন্দর সে কখনো কুৎসিত হতেই পারেনা।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here