আমি_জান্নাত #পর্বঃ-১

#আমি_জান্নাত
#পর্বঃ-১
#ফারজানা_আক্তার

আমার বিয়ের দিনেই আমার মুখে এসিড ছোঁড়া হয়। মুহুর্তেই থমকে যায় আমার জীবন। গ্রামের বখাটে ছেলেটার প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় সে এই জগন্য কাজ টা করেছে। আমার বয়স যখন ১৪বছর মাত্র তখন থেকেই নাহিদ নামের গ্রামের বখাটে ছেলেটা আমার পিঁছু লাগে, স্কুলে যাওয়া আসা করতে প্রচুর অসুবিধা হতো আমার। আমার পরিবারের সবাই এমনকি এলাকার সবাই-ই জেনে গিয়েছিলো বিষয়টা। তাই এসএসসি পরিক্ষার পর আর পড়ালেখা করার সুযোগ হয়নি আমার। আর এখন মাত্র ১৮বছর বয়সেই আমাকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে কিন্তু বিয়ের ঠিক ১ঘন্টা আগেই জোরপূর্বক পার্লারে প্রবেশ করে নাহিদ নামের নরপশু টা এই জগন্য কাজ টা করেছে। নববধূ সেজে বসে ছিলাম, হৃদয়ে ছিলো হবু বরকে নিয়ে হাজারটা স্বপ্ন, লজ্জা পেয়ে পেয়ে কিছুক্ষণ পর পর মুসকি হাঁসছিলাম আয়নার সামনে বসে ঠিক তখনই নাহিদ পার্লারে প্রবেশ করে একদল লোক নিয়ে আর আমার মুখে এসিড ছোঁড়ে মুহুর্তেই পালিয়ে যায় সেখান থেকে। যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম আমি, ছটফট করতে করতে একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আমি।

যখন জ্ঞান ফিরে আমার তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম হসপিটালের বেডে। মিটিমিটি করে চোখ খুলে দেখি আমার পাশে আমার মা বসে কাঁদছে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার মায়ের কান্নার কারণ। হয়তো বরপক্ষ বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে। এটাই তো স্বাভাবিক, একটা কুৎসিত চেহারার মেয়েকে কে বা জেনেশুনে বিয়ে করবে? কেউ করবেনা। নাহ আমি কুৎসিত ছিলাম না, গ্রামের সব মেয়েদের মধ্যে আমার সৌন্দর্য ছিলো সবার অধিক, আমি জানি এসিড আক্রান্ত হওয়ার পর আর সেই সৌন্দর্য থাকবেনা আমর মাঝে। কিন্তু কেনো জানি মায়ের কান্না দেখেও আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো না, কিছুতেই নাহ। আমি শুধু অবাক হয়ে আম্মুর কান্না দেখছিলাম। আম্মু এখনো খেয়াল করেনি তার রাজকন্যা জেগেছে, তাকে প্রাণভরে দেখছে। মাথা নিচু করে কাঁদছে আম্মু, এমন সময় রুমে আব্বু প্রবেশ করলো। আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে একপ্রকার তাড়াহুড়ো করে আব্বু আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে জিজ্ঞেস করে

“কেমন আছিস মা? এখনো কী যন্ত্রণা করছে তোর? জ্বালাপোড়া কমেছে?”

আম্মু তখন মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে আমার জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে মা আবারও কান্না করে দিলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আম্মু বলল

“কেনো এতো সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে ধারণ করলাম আমি আমার গর্ভে,, আমার জন্যই আজকে আমার মেয়ের এতো জ্বালা যন্ত্রণা। শেষ হয়ে গেলো আমার মেয়ের জীবনটা মুহুর্তে ”

কথাগুলো বলেই আম্মু আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। আব্বু আম্মুকে থামিয়ে আমার সাথে খোশগল্প শুরু করেন যাতে আমি কোনো কষ্ট অনুভব না করি।
একটুপরই আমার ভাই প্রবেশ করলো সেখানে। ভাই আমার খুব ইমোশনাল, একটুতেই কান্না করে দেয় কিন্তু আজ আমার ভাইয়ের চোখে জল নয় সাহস দেখতে পারছি। আমার জন্য আমার ভাই নিজেকে শক্ত করেছে।
ভাই আসতেই আব্বু আমার পাশ থেকে উঠে ভাইয়াকে বসার জন্য জায়গা করে দিলো। ভাইয়া প্রথমে আমাকে কেমন আছিস জিজ্ঞেস না করে বলে

“তোর জন্য এমন একটা খবর এনেছি যে তুই শুনলে লাফিয়ে নেচে উঠবি।”

ভাইয়ার কথা শুনে আমিও ঠোঁটে একটু হাসির রেখা টেনে বললাম।

“বলো ভাইয়া কি খুশির খবর”

“নাহিদের সাজা হয়েছে, ১৫বছর আর সূর্যের আলো সে পাবেনা। আমি জানি ওর পাপের শাস্তি এর চেয়েও ভয়ংকর হওয়া উচিত ছিলো কিন্তু তবুও আলহামদুলিল্লাহ। তুই খুশি হসনি বোন আমার?”

মাথা নাড়িয়ে ভাইয়াকে বললাম হুম খুশি হয়েছি।
একটু পর ডাক্তার এসে সবাইকে বাহিরে বের করে দিয়ে আমার মুখে কি কি জানি করলো কিন্তু আমার একটুও কিছু অনুভব হলোনা, হয়তো অবস করে দিয়েছে আমার মুখের সেই স্থান। আমি অনুভব করতে পারছি আমার মুখের ডান পাশ পুরোটা ঠিক আছে, বামপাশে ডাক্তার ঔষুধ লাগিয়ে দিচ্ছে হয়তো।
আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, চোখ বন্ধ করতেই নাহিদ নামের জানোয়ার টার চেহারা ভেসে ওঠে, ফট করে চোখ খুলে হাঁফাতে থাকি আমি, ডাক্তার আপু ভয় পেয়ে গেছে হঠাৎ আমার এমন কান্ডজ্ঞান দেখে।
ডাক্তার আপু আমাকে শান্তনা দিতে লাগলেন কিন্তু আমার তবুও বারংবার ওই নাহিদের কথা ভেবে ভয় ভয় লাগছে তবুও আমার চোখে কান্না জলের ছিটেফোঁটাও নেই। আমি বুঝতে পারছি আঘাত টা কোনো সাধারণ ছিলোনা, অতিরিক্ত আঘাতেই চোখের জল শুকিয়ে মরুভূমির সৃষ্টি করে মানুষের অন্তরে।
চোখের জলও ভীষণ অদ্ভুত, সেও বুঝে আমি কাঁদলে আমার পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, তাদের হতাশা কাটবেনা কিছুতেই।

ডাক্তার আপু যাওয়ার সময় আমাকে একটা ইনজেকশন দিয়ে যায়, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার চোখে রাজ্যের ঘুম ভীড় জমায়। খুব করে বুঝতে পেরেছি ঘুমের ইনজেকশন ছিলো ওটা।


*আমি নদীর পাড়ে বসে পেয়ারা খাচ্ছি বান্ধবীদের সাথে তখন বান্ধবী নয়না জিজ্ঞেস করলো

“আচ্ছা জান্নাত তোর সৌন্দর্য যদি কখনো হারিয়ে যায় তবে কি তুই খুব হতাশ হবি?”

আমি নয়নার দিকে আঁড়চোখে তাকালাম কিন্তু কিছু না বলে পেয়ারা খাওয়ায় মন দিলাম আবার। সবাই হাঁসাহাঁসি বন্ধ করে এবার চুপ হয়ে গেলো কেননা সবাই ভেবেছে আমি রাগে চুপ হয়ে আছি কারণ তারা সবাই-ই জানে রাগলে আমি চুপ হয়ে থাকি। সবাইকে চুপচাপ দেখে আমি পেয়ারা এক কামড় মুখে নিয়ে চিবোতে চিবোতে বলি

“আমার সৌন্দর্য নিয়ে কোনো অহংকার নেই আমার। আমি চাই মানুষ আমার এই বাহ্যিক সৌন্দর্যকে নয় আমার মনের সৌন্দর্য কে ভালোবাসুক। আর একটা কথা না বললেই নয় যে বয়সের সাথে এই রুপ লাবন্য ঠিকই হারিয়ে যাবে একদিন কিন্তু মনের সৌন্দর্য শেষ নিঃশ্বাস অবধি বেঁচে থাকবে ছোট্ট মনকুটিরে।।”

নয়না আর বাকি সবাই মুচকি হেঁসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো আমিও তাদেরকে জড়িয়ে ধরে স্থির হয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ।। **

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যায় আমার। চোখ খুলে দেখি নয়না আর বাকি সব বান্ধবী এসেছে আমায় দেখতে। মনে মনে চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়লাম আমি “ইস্ আরো কিছুক্ষণ ঘুমালে স্মৃতিতে আঁটকে থাকা মুহুর্ত টি আরো কিছুক্ষণ উপভোগ করতে পারতাম। হোক স্বপ্ন তবুও তো তৃপ্তি আছে সেই স্বপ্নে।

আমি চোখ খুলে পিটপিট করে সবার দিকে তাকাচ্ছি। তাদের সবার চোখই প্রায় ভেজা, আমার বুঝতে বাকি রইলোনা না যে আর এতক্ষণ তারা কান্না করেছে সবাই। নয়না এখনো কান্না করছে আর আমার থেকে লুকিয়ে চোখের জল মুছতেছে। আম্মু আমার পাশে বসেছিলো, আমি আম্মু কে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম ওরা কখন এসেছে, আম্মু বললো ওরা নাকি ১ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে আমার ঘুম থেকে জাগার জন্য আর আমি নাকি প্রায় ৪/৫ ঘন্টা ধরে ঘুমাচ্ছি। আম্মুর কথায় আমি একটুও অবাক হয়নি কেননা আমি বুঝেছিলাম যে তখন ডাক্তার আপু আমাকে ঘুমের ঔষুধই দিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ ওদের সাথে টুকটাক কথা হলো আমার কিন্তু নয়না একদমই চুপ, কিছুই বলেছেনা সে, শুধু একনজরে তাকিয়ে আছে আমার মুখের বামপাশের এসিড আক্রান্ত স্থানটার দিকে আর চোখও কিছুটা ঝাপসা যা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। আমি হাতের ইশারাই নয়নাকে একটু কাছে ডেকে নিলাম আর বললাম

“তুই এভাবে ভেঙে পড়লে আমার শক্তি কে হবে? একমাত্র পরিবার আর তোরাই তো আমার শক্তি। ”

কান্নাজড়িতো কণ্ঠে নয়না বলে উঠে

“আমি ভেঙ্গে পড়িনি”

আর কিছু বলতে পারেনি নয়না, মুখ চেপে বাহিরে চলে যায় সে। তারপর ওরা সবাই একে একে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আমি একা শুয়ে আছি, আম্মু মনে হয় কোথাও গেছে, খানিক্ষন ধরে দেখতেছিনা আম্মুকে। আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে কিন্তু আমি প্রকাশ করতে চাচ্ছিনা সেই কষ্ট কারো সামনে, আমি কষ্ট পাচ্ছি জানলে সবাই আরো বেশিই ভেঙ্গে পড়বে।
আমি চোখ বন্ধ করে ৫মিনিটের মতো শ্বাস নিচ্ছিলাম কিছুটা জোরে জোরে। পাঁচ মিনিট পরে চোখ খুলে দেখি সামনে______

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here