গল্পঃ #নিরবতার_ছুটি (২য় পর্ব)
লেখায়ঃ#তাজরীন_খন্দকার
অন্তি ঘাড় বাঁকাতে বাঁকাতে বললো,
___ আমি ফেঁসে যাওয়ার মেয়ে নই জানিস না তোরা? ফাঁসবে তো ওই আদীল! তাও খুব কঠিনভাবে! সে বুঝতেই পারবেনা তার জন্য কি অপেক্ষা করছে!
বলেই অন্তিসহ এখানে সবাই জোরে হেসে উঠলো।
অন্যদিকে আদীল তার কাজ শেষ করে বসে ভাবতে লাগলো, কলেজে কোনো প্রোগ্রাম থাকলে অবশ্যই বাইরের দিকটা সুসজ্জিত থাকতো কিংবা অনেক ছেলেমেয়ে এখানে ঘুরাঘুরি করতো। কিন্তু সে যেটুকু খেয়াল করেছে সেখানে তেমন সরবতা ছিল না।
আর মেয়েটাকে অনার্সপড়ুয়া বলে মনে হয়েছে, আবার বলছে তার গাড়ীটা খারাপ হয়ে গেছে, বুঝা যাচ্ছে উচ্চবিত্ত চলাফেরা, কিন্তু ওই কলেজটা ইন্টারমেডিয়েটের জন্য ভালো হলেও অনার্স করার জন্য এতটাও ভালো না। সে এখানে না পড়ে ভালো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ার কথা। মেয়েটার আচরণ সর্বোপরি সন্দেহ লাগছে! তাকে কোনো মিথ্যে বলেনি তো? কিংবা এমনও হতে পারে ইচ্ছে করেই অজুহাত দিয়ে গাড়ীতে উঠেছে। নয়তো মেয়েটা বোরকা পরে গাড়ীতে উঠে পরবর্তীতে গাড়ীতেই কেন বোরকা খুললো? সেটা তার দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা ছিল নিঃসন্দেহে,!
কিন্তু মেয়েটাকে ভীষণ সহজ সরল বলে মনে হয়েছে। আদীল আর কিছু ভাবতে পারছেনা। ফোনটা বের করে সে ওই কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে ফোন দিলো আর বললো,
___ আমি সরফরাজ আদীল বলছি, আপনাদের কলেজে আজকে কোনো প্রোগ্রাম আছে?
___ জ্বী জ্বী আমি আপনার নাম্বার চিনতে পেরেছি। এর আগে আপনার কোম্পানিতে আমার একটা আত্মীয়ের চাকরির ব্যপারে আপনার সাথে কথা বলেছিলাম। তাই নাম্বারটা সেইভ করা ছিল। তবে আমাদের কলেজে আজকে কোনো প্রোগ্রাম নেই। কে বললো আপনাকে এই কথা?
___না পথের মধ্যে কেউ… আচ্ছা সে থাক। এটা জানতেই ফোন দিলাম। এখন রাখছি।
বলেই আদীল ফোন কেটে দিলো। তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে এটা ভেবে যে মেয়েটা মিথ্যা কেন বললো? কিছু চাওয়ার থাকলে সরাসরি বলতে পারতো! কেউ সাহায্য চেয়েছে আর আদীল তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে এমন কখনো হয়নি। তাহলে মেয়েটার মিথ্যার পেছনে কি কারণ আছে?
কি কারণ? কি কারণ, ভেবে পেরে উঠছেনা আদীল।
আর তাছাড়া তার কতো শত্রুই তো থাকতে পারে। এসব ভাবলে তো চলবে না। এটা ভেবেই নিজেকে আস্বস্ত করলো।
তারপর সে নিজের কাজে মন দিলো।
কিন্তু মেয়েটার চেহেরা ভোলার মতো না। না চাইতেও বারবার মেয়েটার চোখ, হাসি তাকে টানছে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়। কাজের তেমন প্রেসার ছিল না বলে তারাতাড়িই বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। সে মনে মনে দোয়া করছিল মেয়েটার সাথে যেন আর দেখা না হয়। এমনিতেই ভুলতে পারছিলোনা। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে। পথিমধ্যে ওই মেয়ে বোরকা পরা অবস্থাতেই আবার দাঁড়িয়ে আছে। এতো রিকশা,অটো,টেক্সি যাচ্ছে কিন্তু কোনোটাতেই ভ্রুক্ষেপ করছেনা। আদীল দেখেই বুঝতে পারলো তার আসার টাইম সে কোথাও থেকে জেনে ইচ্ছে করেই এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। কোনো গন্ডগোল তো আছে এর পেছনে। গাড়ীটা মেয়ের সামনে আসতেই সে দুহাত নাড়িয়ে থামতে বললো।
ড্রাইভার আদীলের দিকে তাকিয়ে বললো,
___ভাইজান কি করুম?
আদীল কিছু একটা ভেবে বললো,
___আচ্ছা উঠতে বলো।
অন্তি গাড়ীতে উঠেই বোরকার নিকাব খুলে নড়েচড়ে বললো,
___ আচ্ছা আপনারা কোথায় যাবেন?
ড্রাইভার জবাব দিলো,
___কনে আবার ভাইজান তার বাসায় যাইবো। আপনি কি তানারে চিনেন না?
অন্তি চেহেরাটা একটু ভাঁজ করে বললো,
___ হ্যাঁ তাতো চিনি। কিন্তু জানতাম না আসলে বাসায় যাচ্ছে কিনা।আর আমি সামনেই নেমে যাবো। আর আপনি কি পড়ালেখা করেন নি? না মানে উনার মতো কোটিপতিদের ড্রাইভার অবশ্য শিক্ষিত থাকার দরকার ছিল। যার ড্রাইভার হওয়ার জন্যও লোকেরা ইন্টারভিউ দিবে!কিন্তু আপনাকে অশিক্ষিত মনে হচ্ছে!
এবার আদীল পেছনে তাকিয়ে রাগী সুরে বললো,
___কারো সামনে তার যোগ্যতার প্রসঙ্গ তুলে অপমান করতে হয়না, শিখেননি আপনি? আমার কাছে শিক্ষিত মডার্ন ড্রাইভারের চেয়ে উনি অনেক বেশি সম্মানের। আমি উনার কথা এবং কাজ দুটোকেই পছন্দ করি।
অন্তি বললো,
___ ও আচ্ছা এবার বুঝেছি উনি নিশ্চয়ই বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছিল। আপনি তাকে নিজের বিশ্বস্ত ড্রাইভার বানিয়ে নিয়েছেন৷ আপনার এরকম মহান কাজের কথা সবাই জানে।
আদীল এবার একটু নরম স্বরেই বললো,
___ না উনি বিপদে পড়ে আসেনি বরং আমাদের বিপদে উনি সাহায্য করেছেন। আমার মা দুই বছর আগে একটা এক্সিডেন্ট করেছিল, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল, সেসময় যে ড্রাইভার ছিল উনিও অল্প আঘাত পান কিন্তু আমার মায়ের অবস্থা খারাপ ছিল। ওই ড্রাইভার সাহায্য না করে ভয়ে পালিয়ে গেলো। রাস্তায় মানুষজন বলাবলি করছিলো পরিচয় নিয়ে, কে কিংবা কোন পরিবারের, উনার আত্মীয় আছে কিনা কিন্তু কেউ সাহায্য করতে এলোনা। কিন্তু এই মানুষটা তৎক্ষনাৎ দেখে এবং এসব না ভেবে মা’কে হাসপাতালে নিয়ে যায় তারপর জরুরী ভিত্তিতে রক্ত দেয়। সেসময় ‘ও নেগেটিভ’ রক্ত পাওয়াও হয়তো সম্ভব ছিল না। ভাগ্য ভালো এই মানুষটার সাথে মায়ের রক্তেরও মিল ছিল। তার ঘন্টাখানেক পরে আমি জানতে পেরে ছুটে আসলাম। পরে জানতে পারলাম উনি গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে শহরে এসেছেন। কোম্পানির ভালো পোস্টে যুক্ত করতাম কিন্তু উনি এসব কিছু বুঝেন না। উনি সেচ্ছায় ড্রাইভার হতে চান তারপর থেকে উনি আমার এবং আমার মায়ের কাছাকাছিই থাকেন, আমি এবং মা কখনো মনে করিনা উনি ড্রাইভার, উনি আমাদের পরিবারের একজন। যেখানে শিক্ষিত ড্রাইভাররাও আমাকে স্যার বলে ডাকতো সেখানে উনি আমাকে ভাইজান বলে ডাকে। কারণ উনি আমার ভাইয়ের মতো। পরবর্তীতে কারো সম্পর্কে না জেনে যোগ্যতা নিয়ে ঠাট্টা করবেন না।
আদীল কথা থামিয়ে ড্রাইভারের কাঁধে হাত রাখলো। খেয়াল করলো মানুষটার চোখ ভেজা।
অন্তি নিরব হয়ে আছে, বুঝতে পারছে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছে। আর কিছু বললো না সে। একটু সামনে গিয়েই গাড়ী থামাতে বললো। এবং চুপচাপ নিকাব পরে সে এখান থেকে নেমে চলে গেলো। সামনে একটা মোড় থাকায় আদীল ঠিক বুঝতে পারলোনা সে কোনদিকে যাচ্ছে।
চলে যাওয়ার পরে সে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললো,
___আচ্ছা তুমি কি বুঝতে পারছো মেয়েটার উদ্দেশ্য কি হতে পারে? কেমন যেন অন্য রকম লাগছে সব।
ড্রাইভার তখন হেসে ফেললো। আদীল অবাক হয়ে বললো,.
___কি ব্যাপার হাসির কি বললাম?
___ না ভাইজান আমার মনে হইতাছে মাইয়াডা আপনারে ভালা পায়। বুঝলেন না, প্রেম করবার চায় আর কি। চোখের ভঙ্গি দেইখা আমার তাই মনে হইতাছিলো। তবে মাইয়াডা কিন্তু ঢের সুন্দর।
ড্রাইভারের কথায় আদীল একটু হাসলো। তারপর ভাবলো ঠিক তাই হতে পারে। হয়তো তার জন্যই সে মুখোমুখি হতে চাইছে। কিন্তু মেয়েটার এই মূহুর্তে করা আচরণে তাকে অহংকারী মনে হচ্ছে।
‘
‘
রাত এগারোটা। আদীল সব কাজের হিসাবনিকাশ শেষ করে শুয়ে কি ভেবে সে ফেইসবুকে ওপেন করলো। দেখলো অন্তিকা জেসমিন নামে একটা থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট সাথে ম্যসেজ রিকুয়েষ্ট।
চেক করে দেখলো সেখানে লেখা,
___ আজকে সকালে এবং বিকেলে আপনার গাড়ীতে যে বোরকা পরে উঠেছিলাম সেই আমি। আমার নাম অন্তি, জানেন না মনে হয়। আসলে অনেক খুঁজে আপনার আইডি বের করেছি। আজকে গাড়ীতে আসলে ড্রাইভারকে নিয়ে এভাবে বলা আমার উচিত হয়নি। আমি ভীষণ দুঃখিত।
আদীল হাসলো। তারপর মনে মনে ভাবলো মেয়েটা তার ভুল বুঝতে পেরেছে তাহলে। যাক বুঝতে পেরেছে এই অনেক। তাছাড়া হতে পারে মেয়েটা সত্যিই আদীলকে পছন্দ করে , তাই সামনে আসতে চাইছে এছাড়া আর অন্য কোনো বাজে উদ্দেশ্য থাকতে পারেনা।
আদীল রিপ্লে দিলো,
___আচ্ছা সমস্যা নেই।
সাথে সাথে অন্তি বললো,
___ আমার উপর আপনি সত্যিই রেগে নেই তো।
___না না রাগ নেই।
___কি করছেন?
___শুয়ে আছি ঘুমাবো।
___ কালকে বিকালে আপনার কাজ আছে? আমরা কোথাও দেখা করতে পারি?
আদীল কয়েক সেকেন্ড ভেবে দেখলো এবং রিপ্লে দিলো,
___আচ্ছা ঠিকাছে। আপনাকে সময় স্থান কাল জানাবো।
আরো টুকটাক অনেক কথা বললো তারা। তারপর ঘুমিয়ে গেলো।
পরেরদিন দেখার করার সময় বিকেল বেলা অন্তি প্রথম গেলো শায়লা আঞ্জুমের কাছে। আদীল দেখা করতে রাজী হয়েছে সেটা তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি। তারপর মেসেঞ্জারে তাদের কথাগুলো দেখানোর পরে তার চোখ চকচক করে উঠলো। তিনিও অন্তির সাথে যাওয়ার জন্য বায়না করলেন। অন্তি কিছুটা রেগে বললো,
___আপনি ভালো করেই জানেন আমি কেন আপনার এই কাজটা করতে রাজী হয়েছি। আপনি যতটা বলছেন ছেলেটা তার থেকেও বেশি ভালো! কেন এমন করতে চাইছেন আপনি? কেন তাকে ঠকানোর কথা চিন্তা করছেন? আমি সত্যিই বুঝতে পারছি তার সাথে অন্যায় হচ্ছে । আমরা ঠিক করছিনা এসব।
___ না না এমন বলোনা, আমার যে তাকে চাই। তুমি যতো তারাতাড়ি পারো তোমার মার সাথে দেখা করাবে বলে আমার বাসায় নিয়ে আসো। আমি ওর মুখে মা ডাক শুনতে চাই। যতো তারাতাড়ি পারো!
অন্তি শায়লা আঞ্জুমের কথায় অন্তি চমকে উঠে, বিরবির করে বলে,
___মা ডাক শুনতে চান মানে? আপনার তো ওর প্রোপার্টির দিকে নজর ছিল। এখন এসব কি বলছেন?
উনি চেঁচিয়ে বললো,
___মিথ্যা বলেছিলাম আমি। আমার কোনো প্রোপার্টি চাইনা। আমার শুধু ওকে চাই। আমি আমার চোখের সামনে ওকে রাখতে চাই! আমি তোমাকে আমার সব দিয়ে দিবো, তুমি শুধু ওকে আমার বুকে এনে দাও। আমি ওর মুখে মা ডাক শোনার জন্য অনেক বছর ধরে তৃষ্ণার্ত!
___পাগল হয়ে গেছেন আপনি? আপনার কোনো কথা আমি বুঝতে পারছিনা। তাকে আপনার চায়, তার থেকে মা ডাক, এসব কি?
শায়লা আঞ্জুম এবার বসে পড়লো আর কান্না করতে করতে বলতে লাগলো,
___অন্তি, আদীল আমার ছেলে! আমি তাকে পেটে ধরেছিলাম!
চলবে….