নিরবতার_ছুটি,প্রথম পর্ব

গল্পঃ #নিরবতার_ছুটি,প্রথম পর্ব
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

আমাকে একটা এতিমখানা থেকে তুলে আনা হয়েছিল, আমার বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ী আর কোটি কোটি টাকার বিজনেস সম্পর্কে জানার আগে এটা জানেন তো আপনারা?
পাত্রের মুখে এমন কথা শুনে পাত্রীপক্ষ হতভম্ব হয়ে গেলো। এই ছেলেকে নিয়ে এতক্ষণ সবার ভেতরের কৌতূহল নিমেষেই শূন্য মাত্রায় চলে গেলো। শহরের একজন সফল শীর্ষ ধনীদের একজন সে, আর এমন কোটিপতি টগবগে তরুণের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে পাগল কতো কতো উচ্চবিত্ত পরিবার, শিকদার পরিবারও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। কিন্তু এই মূহুর্তে তাদের সব চিন্তাভাবনা উল্টো মোড় নেওয়ার উপক্রম। এদিকে সবার চোখের দিকে তাকিয়ে ছেলেটা মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে গেলো,আর নিজের দিকে দেখিয়ে বললো,
___এই যে আমি আজকের সরফরাজ আদীল! শহরে গঞ্জে আমার এতো সুখ্যাতি! তার পেছনের গল্পটা নিচু মানের লাগছে? অবাক হলেন আপনারা? আমার মৃত পিতা আরমান তালুকদার যাকে আমার বাবা বলে সারা শহর জানে তিনি আমার জন্মদাতা বাবা নন, সেটা বিশ্বাস হচ্ছেনা? আপনাদের বিশ্বাস কিংবা চিন্তার বদল হোক এতে আমার কিছু যায় আসেনা! তবে আপনাদের হয়তো একটা জন্মপরিচয়হীন ছেলের সাথে নিজেদের মেয়ের বিয়ে নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে! সেটা একান্তই আপনাদের ব্যপার। আমার দায়িত্ব ছিল জানিয়ে দেওয়া এবার আপনারা সবকিছু ভেবে সীদ্ধান্ত নিয়ে সেটা আম্মুকে জানিয়ে দিবেন। আমার আম্মুর রিকুয়েষ্ট আর আমার সাথের এই আঙ্কেল আমাকে জোর করে অফিসের একটা মিটিং থেকে অন্যকিছু বলে এখানে নিয়ে এসেছে! আর হ্যাঁ পাত্রীকে আমি দেখবো না আপনারা রাজী থাকলে আমার আম্মু এসে দেখবে। এখন আমি যাচ্ছি!

আদীল তার সাথে আসা আঙ্কেলের উঠে আসার অপেক্ষা না করেই বেড়িয়ে গেলো, এদিকে পাত্রী সেজেগুজে হাজির হয়েছে মাত্র! দেখলো পাত্র ততক্ষণে চলে গেছে। সবার মুখ চুপসানো।
নিরবতার প্রহর কাটিয়ে পাত্রীর বাবা বলে উঠলো,
___ আমার মেয়ে রূপেগুণে ১০০/১০০, আমাদের মতো একটা পরিবার শুধুমাত্র টাকাপয়সার খাতিরে জন্মপরিচয়হীন একটা ছেলের সাথে আমাদের মেয়ের বিয়ে দিতে পারিনা। আমাদের কি কোনো কিছু কম আছে নাকি? এরকম অনেক পাত্র আসবে!এই বিয়ে নিয়ে আর কোনো কথা হবে না। এটা এখানেই স্টপ এবং আমি এই সমন্ধে ডিরেক্ট না করে দিবো।

পাত্রীর সামনেই কথাগুলো বললো তার বাবা৷ তার বাবার কথাগুলো যেন তার বুকে তীরের মতো বিঁধলো। এই প্রথমবার বিয়ের কথা হচ্ছে তার। অজানা একটা অনূভুতি কাজ করছিলো কিন্তু সেটা যে এভাবে নিঃশেষ হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি। দেখাও হলোনা তাকে, কথাও হলোনা তবু কেন জানি ভেতরে অদ্ভুত ক্রন্দন সৃষ্টি হচ্ছিলো।



সন্ধ্যার পরে আদিল বাসায় যেতেই তার মা দরজা খোলে মন খারাপের দৃষ্টি নিয়ে তাকালো, তার মায়ের তাকানোতে বুঝতে অসুবিধে হলোনা এর পেছনের কারণটা কি! আস্তে করে সে তার মা’র মাথায় হাত রাখলো, এমনি উনি কেঁদে উঠলেন। আদীল উনাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে চাইলে তিনি দূরে সরার চেষ্টা করে কেঁদে কেঁদে বললো,
___ আমি তোকে ভালোবাসি না? মা মনে হয় না আমাকে? তোর বাবা কি তোকে ভালোবাসে নাই? আর কতটা ভালোবাসলে তুই বিশ্বাস করবি তুই অনাথ নস! কেন বলতে গেলি তুই আমাদের নিজের সন্তান না, কেন এমন করছিস। কেন মা’কে কষ্ট দিচ্ছিস আদীল? শহরে জানাজানি করবি এখন? আমরা নিঃসন্তান, তোকে আমরা এতিমখানা থেকে এনেছি! সবাই জানবে আরমান তালুকদারের সম্মানকে বহুগুণে উজ্জ্বল করা তার পুত্র আসলে তার পুত্রই না! বাবার অসম্মান চাস?

___মা বুঝার চেষ্টা করো, আমি শুধু আমার সত্যটা জানাতে চেয়েছি, কারণ কিছু পরিবারের কাছে মানুষের জন্মপরিচয়টা অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট, ওই পরিবারও এমন ছিল দেখেছো? আচ্ছা ওরা যদি পরে বিষয়টা জানতো তাহলে ঠকানো হতোনা বলো?
কিংবা আমাদের উপরে রেগে যেতোনা?
তবে আমি কখনোই ভাবিনা আমার বাবা মা নেই। আমি যা পেয়েছি, এবং পাচ্ছি তা সবাই পায়না মা। আমি তোমাদের আদর্শ নিয়ে আজ এতো বড় হতে পেরেছি। আমি সত্যিই ভাগ্যবান! খুব ভালোবাসি তোমাদের,প্লিজ ভুল বুঝোনা। তুমি রাগ করে থাকলে কিন্তু আমি এখন কেঁদে ফেলবো।

মা’কে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বললো আদীল। এক নিমিষেই তা মা ভুলে গেলো সব কষ্ট । মুচকি হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর আদীল হাতমুখ ধুতে চলে যায়।

আদীলের পালিত মা-বাবা কখনোই মানতে চাননি আদীল তাদের সন্তান নয়, কখনো মা হতে পারবেনা জেনেও তার মাকে তার বাবা ছেড়ে দিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ের চিন্তা করেনি, তারা সিদ্ধান্ত নেয় বাচ্চা দত্তক নিবে, তাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার দেওয়ার জন্য ছেলে সন্তানের সন্ধান করছিলো, অনেক খোঁজে তারা আদীলকে পায়। ৫ বছরের ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে তারা সেদিনই তার মধ্যে স্নেহের মহিমা খুঁজে পেয়েছিলো। তাকে এনে এতো ভালোবাসতো যে তারা চাইতোই না যে ছেলেটা বড় হয়ে তার সত্যটা জানুক। কিন্তু আদীলের এখনো মনে আছে তার জন্মদাত্রী মা কতটা নির্দয় হয়ে সেদিন ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তবে তালুকদার পরিবারে এসে তাদের ভালোবাসায় তাদের আদর্শে সে সেই অভাব ভুলে গিয়েছিল, সে তাদেরকেই পূর্ণাঙ্গভাবে মেনে নিয়েছিল মা-বাবা হিসেবে। তাইতো আরমান তালুকদার মৃত্যুর আগে নিজের সবকিছু ছেলের নামে করে গিয়েছেন। বাবার মৃত্যুর পর আদীল নিজের সততা আর চেষ্টায় বাবার ব্যবসাতে ১০ গুণ বেশি উন্নতি ঘটিয়েছে। শহরে এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম,দরিদ্রদের জন্য বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থান তৈরি করেছে। আদীলের ছোট বেলার পুরো কথা মনে না থাকলেও তাকে এতিমখানায় ফেলে যাওয়া আর তালুকদার পরিবারে উঠে আসার কথা সে এখনো মনে করতে পারে। তবে তাকে যে মা জন্ম দিয়েছে তার চেহেরা মনে নেই। তার জন্মদাতা বাবা কে ছিল কিংবা দেখেছিল কিনা এসব সে মনে করতে পারে না।



পরেরদিন সকাল ১০টায় আদীল জরুরী একটা কাজে খুব তাড়া করে বাসা থেকে বের হয়ে ড্রাইভারকে গাড়ী স্টার্ট করতে বললো। আদীল ফোনে দরকারী কথা বলছিল আর জানাচ্ছিল তার পৌঁছাতে মাত্র ১০ মিনিট লাগবে। গাড়ী খুব স্পিডে চলছিলো কিন্তু মাঝপথে হঠাৎ করে গাড়ী থেমে গেলো। ফোন রেখে সে সামনে দেখলো কালো বোরকা পরিহিত একটা মেয়ে একদম গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ী থামতেই মেয়েটা এগিয়ে বললো,
___ কলেজে একটা প্রোগ্রাম, কিন্তু আমার গাড়ীটা খারাপ হয়ে গেছে। প্লিজ আমাকে একটু নামিয়ে দিবেন।

আদীল উঁকি দিয়ে দেখলো, আর ড্রাইভারকে বললো,
___ উনাকে তুলো গাড়ীতে।

গাড়ীতে উঠার পরে আদীল আবারও ফোনে কি জানি কতক্ষণ বললো,তারপর হুট করে সামনে তাকিয়েই পেছনে বসা অচেনা মানুষটাকে লক্ষ্য করে বললো,
___ চাচী আপনার মেয়ে আছে ওই কলেজে? কি জানি প্রোগ্রামের কথা বলছিলেন, সে অংশ নিচ্ছে?
ওই কলেজে তো…

বলতে গিয়েই আদীল থেমে গেলো। গাড়ীর উপরের আয়নায় তাকিয়ে সে কি বলছিল ভুলে গেছে। আর কাকে সে চাচী ডাকছে? এ তো একটা ২১-২২ বছর বয়সী এক সুন্দরী তরুণী! আদীল তৎক্ষনাৎ পেছনে তাকালো। গাড়ীতে উঠে সে ইতোমধ্যে বোরকা খোলে ফেলেছে। তার দিকে তাকিয়ে আদীল বিশ্বাস করতে পারছিল না এতো সুন্দর মানুষ হতে পারে! এটা নিঃসন্দেহে কোনো ভুল। আদীলের ভাবনার ঘোর কেটে গেলো মেয়েটার হাসিতে। মেয়েটা হাসতে হাসতে বললো,
___বোরকা পরলে আমাকে চাচী মনে হয়? আমার মেয়ে আসবে কোথা থেকে? আমার তো বিয়েই হলোনা ভাইয়া। ওয়েট ওয়েট কলেজ এসে গেছে আমাকে নামিয়ে দেন।

ড্রাইভার গাড়ী থামালো, মেয়েটা ধন্যবাদ দিয়ে নেমে গেলো। কিন্তু যতক্ষণ দেখা যায় আদীল চুপ করে তাকিয়েই আছে। তার মধ্যেই ড্রাইভার বলে উঠলো,
___ভাইজান মাইডা দেখতে এক্কেরে পরীন লাহান না?

আদীল তার কথাকে পাত্তা দিলোনা। তার মধ্যে এখনো একটা ঘোর লেগে আছে। সে এই চেহেরার মায়া থেকে বের হতে পারছেনা। সবকিছু এতো দ্রুত হয়ে গেলো সে ভালো করে কিছু আঁচই করতে পারেনি। এই প্রথম তার কাছে কাউকে এতো ভালো লেগেছে।

এদিকে মেয়েটা গাড়ী থেকে নামতেই তার বান্ধবীরা ঘিরে ধরে হাততালি দিতে দিতে বললো,
___ আরে অন্তি তুই এইটা কি দেখালি। মিস্টার সরফরাজ আদীলকে তো একদিনেই ফিদা বানিয়ে ফেলেছিস! তোর পুরো পরিকল্পনা তো মিসেস শায়লা আঞ্জুমকে একদম চমকিয়ে দিবেরে ! তবে সাবধান! নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করতে গিয়ে ওই স্মার্টের কাছে ফেঁসে যাস না যেন!

অন্তি ঘাড় বাঁকাতে বাঁকাতে বললো,
___ আমি ফেঁসে যাওয়ার মেয়ে নই জানিস না তোরা? ফাঁসবে তো ওই আদীল! তাও খুব কঠিনভাবে! সে বুঝতেই পারবেনা তার জন্য কি অপেক্ষা করছে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here