নিরবতার_ছুটি (৩য় পর্ব)

গল্পঃ #নিরবতার_ছুটি (৩য় পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

___অন্তি, আদীল আমার ছেলে! আমি তাকে পেটে ধরেছিলাম!

শায়লা আঞ্জুমের এই কথা শুনে অন্তি চমকে উঠে, চোখ বড় করে বলে,
___ মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার? তার প্রোপার্টির লোভ আপনাকে সত্যিই পাগল করে দিয়েছে? আপনি শুনেছিলেন আদীলকে আরমান তালুকদার দত্তক এনেছিল, আপনি সেজন্য মিথ্যা মা সাজার সুযোগটাই নিতে চাইছেন?

অন্তির কথা শুনে শায়লা আঞ্জুমের কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। হাত দিয়ে নাড়িয়ে বললো,
___ না না এমনটা বলোনা, আমি সত্যিই ওর মা! আমি ওকে যেখানে রেখে এসেছিলাম সেখান থেকেই খোঁজ পেয়েছিলাম তালুকদার পরিবার তাকে নিয়ে গেছে। অনেক চেয়েছি সেই তালুকদার পরিবারকে খুঁজে বের করতে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি কোনো খোঁজ পাইনি। কারণ এই শহরে অসংখ্য তালুকদার পরিবার আছে, আর আদীলকে ওরা দত্তক এনেছে সেটা তাদের পরিবার ছাড়া অন্য কাউকে জানতে দেয়নি। ১০ বছর দেশের বাইরে ছিলাম, ফিরে আসার এসে কয়েক বছর পর আদীলকে আরমান তালুকদারের সাথে একদিন শপিংমলে দেখেই আমার সন্দেহ ছিল আরমান তালুকদারের পুত্র আদীলই হয়তো আমার সন্তান। কিন্তু তার কোনো প্রমাণ ছিল না। আমি গোপনেই তার খবরাখবর নিতাম। এতদিন পর্যন্ত আমি কোনো হদিশ পাইনি। পরশু যখন তোমাকে দেখতে এসে আদীল নিজে জানিয়ে গেলো তাকে এতিমখানা থেকে তুলে আনা হয়েছিল, আর সেই সংবাদ যখন আমার কাছে আসে আমি তখনই বুঝতে পারছি সে আমার ছেলে। তুমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখো, ওর চোখ ভ্রু ঠিক আমার মতো।

___প্লিজ থামুন। আপনার এসব ন্যাকা কথা সত্যিও যদি হয় তাহলেও আদীল কখনো আপনাকে মেনে নিবেনা। জন্ম দিয়েও আপনি মা হতে পারেন নি। শুধু শুধু মা শব্দটাকে কলঙ্কিত করবেন না প্লিজ। আর হ্যাঁ আমাকে আপনি ২০ লক্ষ টাকা দিয়ে ওর সাথে এক্টিং করতে বলেছিলেন। বিনিময়ে শুধু আপনি আমার মা হন সেটা বলতে হবে। আমি রাজী হয়েছিলাম কারণটা আপনিও জানতেন, টাকাটা আমার দরকার ছিল কারণ আমি এইদেশে থাকতে চাইছিলাম না। এদিকে আমার বাবা দেশে রাখার জন্য আমাকে বিয়ে পর্যন্ত দিতে চাইছে। কারণ আমার বড় ফুফুকে বাবা নিজের ইচ্ছেতে পড়ালেখার জন্য পাঠিয়েছিলো কিন্তু লন্ডনে তিনি স্থায়ী হয়ে গেছেন, আমার দাদা মৃত্যুকালেও আসতে পারেনি। বাবা চান না আর কেউ বেঁচে থেকেও এভাবে হারিয়ে যাক! অন্তত দেশে থাকি যেন মরার সময় কমপক্ষে মুখটা দেখে যেতে পারি!
মানছি কাল পর্যন্তও আমি আমার সিদ্ধান্তে ছিলাম,আপনার কথা মানতে চাইছিলাম কারণ আপনি আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য সম্পূর্ণ খরচ পর্যন্ত দিবেন বলেছেন।
আমি ভেবেছিলাম আপনি আদীলের বিজনেসের সাথে কোনো প্রকার লেনদেন সংক্রান্ত কিছু করতে গিয়ে তার কাছাকাছি যাওয়ার জন্য এসব করছেন ৷ এসবে আমার মাথা ব্যথা ছিল না, আমার বাবা টাকা দেওয়ায় রাজী ছিল না বলেই আপনার কথায় চুক্তি করেছি। আর আমার পরিবার যাতে বুঝতে না পারে তার জন্য বোরকা পরে বের হয়েছি। কিন্তু আজকে এই মূহুর্তে আপনাকে আমি বলছি, আমি সত্যিই আদীলকে ভালোবেসে ফেলেছি, তাই আপনার টাকা আমার চাইনা আর। সেদিন অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি সেজেগুজে হাজির হয়েছিলাম কিন্তু আদীল ততক্ষণে চলে গিয়েছিল, অজানা একটা কারণে কেন খারাপ লাগছিল সেই প্রশ্নের উত্তরও আমি কাল পেয়ে গেছি। এখন আদীলকে আমার বাবা মানুক না মানুক আদীলকেই আমার চাই। কাল সকালে আপনার টাকা ফেরত পাবেন। আমার নিজের স্বার্থের জন্য আমি এতো ভালো মানুষটাকে ঠকাবো না। বুঝেছেন?

শায়লা আঞ্জুম জোর গলায় বললাম,
___অন্তি দাঁড়াও। তোমার বাবা বিয়েতে রাজী ছিল না তার জন্ম পরিচয় নেই বলে তাইতো? এখন তুমি তো জানো তার মা আমি। এটা ঠিক আমি সেদিন নিজের সুখের জন্য সন্তানের কথা ভাবিনি। তার শাস্তি আমি পেয়েছিও। আমি দ্বিতীয়বার ধনি পরিবার দেখে বিয়ে করেছিলাম ঠিকি কিন্তু আর কোনো সন্তানের মুখ দেখতে পারিনি। দেখো আমি চাইলে অন্য কোনো মেয়েকেও এই এক্টিংয়ের জন্য আনতে পারতাম,টাকা থাকলে এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই অসম্ভব না। কিন্তু তোমাকেই কেন আনলাম জানো? কারণ তুমি আমার চোখে খুব ভালো, নম্র,ভদ্র এবং সুন্দরী। আদীল যদি আমার কাছে মানুষ হতো তাহলে নিশ্চিত তোমাকেই বিয়ে করাতাম। আমি জানতাম ভালোবাসার কোনো অভিনয় হয়না, একজন পারলেও অন্যজন অভিনয় করতে পারবেনা। তাই আমি চেয়েছি সত্যিই তুমি আদীলকে ভালোবাসো, আর সেও তোমাকে ভালোবাসুক। শুধু কিছু মিথ্যা দিয়ে আমি ওর কাছাকাছি যেতে চাই। সে আমাকে হুট করে মা হিসেবে কখনোই মেনে নিবেনা, শতকোটি অভিযোগ তুলবে, হয়তো ঘৃণা করবে। তাই আমি সবকিছু না বলে হলেও ওর থেকে অন্য সুযোগে মা ডাক শুনতে চাইছিলাম। প্লিজ অন্তি তুমি এখন এসব বলে আমাকে নিরাশ করো না।

অন্তি দরজা খোলে সামনে পা বাড়িয়ে বললো,
___ সে যদি আপনার সন্তানই হয়, তাহলে তার কাছেই প্রমাণ করুন আপনি ওর মা। তার মধ্যে আপনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আপনিই ফিরিয়ে আনুন। আমাকে জড়াবেন না। আমি কোনো মিথ্যা বলতে পারবোনা।
আদীল আমার জন্য অপেক্ষা করছে। দেরি হচ্ছে আমার। আপনার সাথে এই মূহুর্ত থেকে আমার কোনো চুক্তি নেই মনে থাকে যেন।

বলেই অন্তি সেখান থেকে চলে গেলো। শায়লা আঞ্জুম মাথায় হাত দিয়ে সেখানেই বসে পড়লেন। নিজের ভুলগুলো একত্রিত হয়ে এখন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ছেলেকে একটু কাছে পাওয়ার আর কি কোনো পথ রইলো না?



অন্তি তারাহুরো পৌঁছেই দেখলো আদীল গাড়ীর দরজার উপর হেলান দিয়ে রাস্তায় তাকিয়ে আছে।
অন্তি কাছে এসেই একনাগাড়ে বলতে শুরু করলো,
___ সরি সরি সরি আপনার মতো এতো ব্যস্ত একটা মানুষকে অপেক্ষা করলাম। আসলে হয়েছে কি জানেন…

___আরে না না। আমিও মাত্র আসলাম। আজকে কাজের চাপ ছিল। আমার মনে হয়েছে আপনি হয়তো অনেক্ষণ ধরে অপেক্ষা করেছেন।

অন্তি হেসে বললো,
___তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আমি আপনার থেকে অনেক ছোট না? তুমি করে বলবেন!

আদীল অন্তির দিকে একটু তাকিয়ে বললো,
___ কিছু ক্ষেত্রে তুমি বলার জন্য অধিকার প্রয়োজন। আচ্ছা আজকে আপনার বোরকা কোথায়?

অন্তি হেসে ফেললো, একটু থতমত খেয়ে কানের কাছে চুলগুলো ঠিক করতে করতে বললো..
___না মানে আসলে আমি,

আদীল তার আগেই হেসে বললো,
___আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে। আসেন কোথাও বসি।

তারা গিয়ে একটা ক্যাফেতে বসলো। আদীল কিছু অর্ডার করে এসে অন্তির সামনে বসলো। আদীলের চোখের দিকে তাকিয়ে অন্তি চমকে উঠলো। সত্যিই তো শায়লা আঞ্জুম একদম ঠিক বলেছে, আদীলের চোখের ভাঁজ, ভ্রুর ধরন একদম উনার মতো। তাহলে সত্যিই কি শায়লা আঞ্জুম আদীলের মা?

অন্তিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদীল সামনে হাত নেড়ে বললো,
___কিছু ভাবছেন? নাকি আমাকে দেখছেন?

অন্তি লজ্জা পেয়ে গেলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে লাগলো। আদীল আবার বললো,
___আচ্ছা এখন সরাসরি বলে ফেলুন আমাকে এখানে ডাকার কারণ কি ছিল? কিছু বলতে চান?

অন্তি আদীলের কথাটার প্রাসঙ্গিকতা ছাড়িয়ে হুট করেই অন্য বিষয়ের ভাবনা থেকে বলে ফেললো,
___আপনি কাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করেন?

আদীল হেসে বললো,
___প্রশ্নটাতে ঘৃণার বদলে ভালোবাসা শব্দটাও বসতে পারতেন! সেটা হলে বলতাম আমাকে যারা মানুষ করেছে তাদেরকে ভালোবাসি। এরপর যে আমার জীবনে আসবে!

অন্তি আর কিছু জিজ্ঞাসা করলো না। কথাটাকে আদীলের আগের প্রশ্নের মোড়ে নিয়ে বললো,
___আপনাকে এখানে ডাকার কারণ আসলে আপনাকে আমার ভালো লাগে। বলতে পারেন তুমি ডাকার অধিকার আপনি চাইলেই পেতে পারেন৷ সোজাসুজি বলে দিয়েছি মাইন্ড করবেন না।

বলেই অন্তি ফোনের দিকে তাকিয়ে অজুহাতের ছলে সেখান থেকে উঠে বাইরে চলে গেলো।
আদীল হাসছে, সে বুঝেছে অন্তি এভাবে বলে ফেললেও ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। এর মধ্যে খাবার চলে আসছে। সে ওয়েটারকে ইশারা করলো গ্লাসের বাইরে একটা বাচ্চা সাহায্য চাইতে দাঁড়িয়ে আছে তাকে যেন খাবারগুলো দিয়ে দেয়।
তারপর বিল দিয়ে সেও বাইরে চলে আসে।
গিয়ে দেখে অন্তি অযথা বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
আদীল গিয়ে আস্তে করে অন্তির হাতে ধরে বললো,
___চলো তোমাকে নিয়ে আমার আম্মুর কাছে যাবো।

অন্তি বড় ধরনের শক খেয়ে চমকে উঠে। এক তো আদীল তার হাতে ধরেছে অন্যদিকে সে তুমি করে বলছে। অন্তিরও কিছু বুঝতে বাকি রইলোনা।
আদীল তাকে নিয়ে গাড়ীতে উঠে। আদীল ড্রাইভ করছে দেখে অন্তি আস্তে করে বললো,
___ওই ভাইয়াটা আসেনি?

___ নাহ তাকে আজ ঘুমিয়ে থাকতে বলেছি। কিছু জায়গায় একান্তই আসা লাগে, জানোনা এটা?

অন্তি আদীলের দিকে তাকিয়ে আবারও হাসলো।

আদীল তার দিকে তাকিয়ে বললো,
___এতো হেসোনা। তোমার হাসি আবার আমার মৃত্যুর কারণ হতে পারে!

বলেই আদীল জোরে হেসে উঠলো সাথে অন্তিও। অন্তি ভীষণ চিন্তায় আছে, কারণ আদীলের মা তাকে দেখলেই চিনে ফেলবে সে শিকদার পরিবারের। কারণ তাকে দেখেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। আদীল এটা জেনে কিছু যদি মনে করে, এর আগেই তাকে তার পক্ষ থেকে সত্যটা জানানো দরকার, অন্তি নিজের পরিচয় দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আস্তে করে বললো,
___শুনুন..

আদীল অন্তির দিকে তাকিয়ে বললো,
___ হ্যাঁ বলো,

___আপনি কিছুদিন আগে যে মেয়ে দেখতে…

বলার আগেই একটা বিকট শব্দে গাড়ী থেমে গেলো। আদীল তারাহুরো করে নেমে গেলো, অন্তি তাকিয়ে দেখলো গাড়ীর সামনে একজন মহিলা আহত অবস্থায় পড়ে আছে। তার মানে এক্সিডেন্ট!
অন্তিও নেমে গেলো, আদীল মহিলাকে কোলে করে গাড়ীতে তুললো আর অন্তিকে পেছনে উনাকে নিয়ে বসতে বললো। ডক্টরের কাছে যাওয়ার জন্য গাড়ী ঘুরালো। সবকিছু এতো তারাতাড়ি হয়ে গেলো যে অন্তি কিছুই বুঝতে পারছেনা।
অন্তি মহিলাটাকে শক্ত করে ধরে হঠাৎ তার দিকে তাকাতেই লাফিয়ে ছিটকে যাওয়ার উপক্রম! শায়লা আঞ্জুম! উনি কি করে আদীলের গাড়ীর সামনে পড়লেন?
আদীলকে কাছাকাছি পাওয়ার জন্য নিঃসন্দেহে এটা উনার নতুন কোনো ফন্দি!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here