নিরবতার_ছুটি (৫ম পর্ব শেষ)

গল্পঃ #নিরবতার_ছুটি (৫ম পর্ব শেষ)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

___দেয়ালে যার ছবি দেখছো সে আমার ছেলে। আর মেয়েটাও আমার, তবে মেয়েটা আমার পেটের সন্তান নয়। মেয়েটাকে আমি দত্তক এনেছিলাম,আর ছেলেটাকে দিয়েছিলাম।

শায়লা আঞ্জুমের কথায় এবার আদীলের টনক নড়লো। উনি আসলে কি বলতে চাচ্ছে? আদীলের বুকের মধ্যে মূহুর্তে তোলপাড়, কতোদিনের জমানো ঘৃণার নতুন উপস্থিতি সে টের পাচ্ছে। তার ঠোঁট কাঁপছে কিন্তু কেন জানি কিছু বলতে পারছেনা।
আদীল নিজের হাত মুঠো করে নিজেকে সংযত করলো। দরজার সামনে পা রেখে বললো,
___ কাল আমাকে একটা কাজে ঢাকার বাইরে যেতে হবে। পরশুদিন আমি আমার মা’কে নিয়ে আসবো।
আজকে আপনি আমার কারণে আঘাতপ্রাপ্ত, অসুস্থ তাই আমি কিছু বলতে চেয়েও পারছিনা। আপনার সাথে অনেক বুঝাপড়া আছে আমার!

বলেই আদীল রুম থেকে বের হয়ে গেলো। শায়লা আঞ্জুম এখনো কেঁদে চলেছে। তার পালিত মেয়েটা এসে বারবার তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।

আদীলের রাগ জেদ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। এক তো তাকে ছোট বেলায় ফেলে চলে গিয়েছিল, এরপর তাকে চিনেও এতদিন সামনে আসেনি। আজকে উনি অনিচ্ছায় সামনে এসেছে নাকি ইচ্ছে করে এসেছে কে জানে! কিন্তু এতো বছর পর উনি এখন কেন আসলো? কি করতে চাইছে? কিন্তু উনার চেহেরাটা সামনে ভাসতেই আদীল কেমন গলে যাচ্ছে! মনে হচ্ছে তার চোখ দুটোতে কোনো রকম স্বার্থ নেই, সন্তানের জন্য সেখানে শুধুই অগাধ ভালোবাসা। নিজের মা বলে এমন লাগছে নাকি? কিন্তু এমন হলে তো হবেনা, উনাকে সবকিছুর জবাব দিতে হবে। দামী বাংলোতে ঘুমুচ্ছে,অন্য জায়গা থেকে দত্তক এনে সন্তান পালন করছে অথচ নিজের ছেলেকে সেদিন একটা এতিমখানায় ফেলে চলে গিয়েছিল !

বাসায় পৌঁছাতেই আদীলের মা দরজা খোলে ছেলের চেহেরার দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয়ে বললো,
___আদীল কোনো সমস্যা? অফিসে কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলা? এমন লাগছে কেন তোমাকে?

আদীল কোনো কথা বললো না, কিছুক্ষণ তার মায়ের দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইলো। আদীলের চোখ দেখে বুঝা যাচ্ছে এখনি এখান থেকে বৃষ্টি শুরু হবে। আদীল চোখ লুকানোর চেষ্টা সেখান থেকে চলে গেলো। তিনি ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলোনা।
আদীল ফ্রেশ হয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে নিজের ফোনটা তুলে দেখলো অন্তি কয়েকবার ফোন দিয়েছে। অন্তি ভালো করেই বুঝতে পারছে আদীল সব জেনে যাবে। তার ভীষণ চিন্তা হচ্ছিলো।
কিন্তু আদীলের কেন জানি এখন কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। এমন একটা জায়গায় চলে যেতে ইচ্ছে করছে, যেখানে এসব মায়া, মাতৃত্ব, অনূভুতি কিচ্ছু নেই। এগুলো ভীষণ ভয়ানক, সবসময় সহ্য করার ক্ষমতা হয়ে উঠে না।

কিছুক্ষণ পরে আদীলের মা খাবারের জন্য ডাকতে লাগলো। আদীল চোখমুখ মুছে মা’য়ের সামনে হাসিমুখে গেলো, তার ভেতরে যতোই কষ্ট থাকুক এই মানুষটাকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা, তাহলে উনি তার চেয়েও বেশি কষ্ট পাবেন। কিন্তু তার মা ভালো করেই বুঝতে পারছিলো কিছু একটা হয়েছে যা আদীল লুকাতে চাইছে।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে আদীল অন্তির সাথে একটু কথা বলে ঘুমিয়ে যেতে চাইলো।
আদীলের কথার ধরনে অন্তি ভালো করেই বুঝতে পারছে সে কেমন অস্বস্তির মধ্যে আছে। তাই সেও তাকে বিরক্ত করলোনা। তবে সে ভাবছে, আদীলের কাছ থেকে তার মায়ের সত্যটা গোপন করেছে বলে আদীল তাকে ভুল বুঝবেনা তো? শায়লা আঞ্জুম তার ব্যপারে যদি কোনো কিছু বলে দেয়?


পরেরদিন আদীল ঢাকার বাইরে যায়, সারাদিন শেষে ফিরতে প্রায় মধ্যরাত হয়ে যায়। যার জন্য অন্তিরও সাথেও কথা হয়নি।
এরপরেরদিন সকাল সকাল অফিসে গিয়ে সবাইকে সব বুঝিয়ে দিয়ে দুপুরের দিকেই বাসায় চলে আসে।
এর মধ্যে অন্তির সাথে সকালে মেসেঞ্জারে কেমন আছে, কি করছে এইটুকুই কথা হয়েছে।
আদীল বাসায় এসেই তার মা’কে বললো,
___আম্মু চলো তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবো।

আদীলের মা কিছুটা হতভম্ব হয়ে, তারপর তৈরি হয়ে তার সাথে রওয়ানা দেয়।
আদীল শায়লা আঞ্জুমের বাসার কাছে আসতেই তার মা’র চেহেরাটা একদম কালো হয়ে যায়, তিনি বুঝতে পেরে গেলেন বিরাট গোলমাল পাকিয়ে গেছে। ছেলের সাথে সাথে এখন যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। তিনি আস্তে আস্তে তার পেছনে গেলেন। আদীল গিয়ে দেখলো দরজা খোলা।
শায়লা আঞ্জুম যেন আগে থেকেই জানে এই টাইমেই আদীল আসবে। কিন্তু সেখানে অন্তি এবং তার মা-বাবাকে দেখে আদীল আরো অবাক হয়।
শায়লা আঞ্জুম আদীলের মা’র কাছে এসে করুণ স্বরে বললো,
___আপা মাফ করবেন, এতকিছু হয়ে যাওয়ার জন্য!

আদীল তার মা’য়ের দিকে একবার তাকালো তারপর অন্তির দিকে তাকালো তার মাথা ঘুরছে, অন্তি তাহলে শিকদার পরিবারের মেয়ে যাকে সে কয়েকদিন আগে দেখতে গিয়েছিল কিন্তু জন্মপরিচয়ের জন্য তার বাবা বিয়েটা বাতিল করেছে। সে কিনা আবার এই মেয়েরই প্রেমে পড়ে গেলো। আদীল এই মূহুর্তে এই ব্যপারটা নিয়ে না ভেবে তার মা এবং অন্তির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,
___তাহলে সবাই-ই সবকিছু জানে? মা তুমি আগে থেকেই উনাকে চিনতে আজ পর্যন্ত বলোনি কেন? আর অন্তি তুমি পরশুদিন এক্সিডেন্টের পরও কিছু বলোনি কেন?

সবাই চুপ করে আছে, শায়লা আঞ্জুম বলে উঠলো,
___আদীল আমিই তাদের বারণ করেছিলাম।

আদীল রেগে গিয়ে বললো,
___আপনি কোনো কথা বলবেন না। আমি আপনাকে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি। আপনি সবচেয়ে নির্দয় আর প্রতারক। সমাজ,শাস্ত্র, পন্ডিত, গুরুজন সবাই মিথ্যা বলে, মায়েরা নাকি মমতাময়ী, তারা নাকি সন্তানের জন্য সব করতে পারে। কিন্তু আপনি কি পেরেছেন? অমানুষের মতো আমাকে ছেড়ে নিজের সুখের চিন্তা করেছেন৷ দূরে সরিয়ে দিয়ে দিনের পর দিন নিজেকে নিয়েই ভেবে চলেছেন। আপনি এতো বছর পর কেন তাহলে মায়ের অধিকার নিয়ে আমার সামনে এসেছেন? কি চাই আপনার? কেন আমার সুখের জীবনের মধ্যে প্রবেশ করে আমাকে আবার যন্ত্রণা দিতে চাইছেন?

শায়লা আঞ্জুম আদীলের মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। এটা তার সত্যিই প্রাপ্য ছিলো। কতো বড় হয়ে গেছে, তার সাথে রাগগুলোও কতো ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।

আদীলের মা আদীলের হাতে ধরে বললো,
___আদীল মায়ের সাথে এভাবে কথা বলতে হয়না। শত হোক উনি তোমাকে জন্ম দিয়েছে।

আদীল তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
___ মা তুমিও এই কথা বলছো? উনি কি করে আমার মা হতে পারে? মা হওয়ার কি যোগ্যতা আছে উনার? জিজ্ঞাসা করো উনি কোন অধিকারে নিজেকে মা প্রমাণ করতে চাইছে?

অন্তি এবং তার বাবা-মা চুপ করে দু পক্ষের কথা শুনে যাচ্ছে৷ তারা বুঝতে পারছেনা এমন একটা পরিবার সংক্রান্ত ঝামেলায় শায়লা আঞ্জুম তাদেরকে কেন আমন্ত্রণ করেছে।
সবাই চুপ করে আছে। শায়লা আঞ্জুমের বুক ফেটে যাচ্ছে তাও কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা৷
এর মধ্যে পাশের রুম থেকে আস্তে আস্তে একজন বৃদ্ধা এগিয়ে এসে শায়লা আঞ্জুমের হাতে ধরে বসে পড়লো। চোখভর্তি পানি নিয়ে আস্তে আস্তে বললো,
___শায়লা আজকেও নিরব থাকবি তুই? কিছু বলবিনা নিজের ছেলেকে?

শায়লা আঞ্জুম তার মা’কে জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বললো,
___মা ওকে বলতে দাও। তার অভিযোগ শেষ হতে দাও। আমার মতো হতভাগী নিজের ছেলের অভিযোগগুলোকেই না হয় ভালোবাসার পরশ দিয়ে বুকে আগলে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবে!

এবার আদীলের মা আদীলের দিকে তাকিয়ে বললো,
___আদীল বাবা, আমাকে তুমি ভুল বুঝোনা। তোমার
মা তোমাকে এতিমখানাতে রেখে গিয়েছিল আমার জন্যই। তিনি সেদিন আমার কাছে অনুনয় করেছিলেন তোমাকে যেন আমাদের ভালোবাসায় মানুষের মতো মানুষ করি। তিনি সরাসরি আমার কাছে রেখে যাননি কারণ এতে তুমি আমাদের প্রতিও একটা ক্ষোভ নিয়ে বড় হবে, তুমি ভাব্বে কোনো চুক্তিতে হয়তো আমরা তোমাকে তোমার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে আসছি। তিনি চেয়েছেন তোমার পরিপূর্ণ সম্মানবোধ আমাদের দিকে থাকুক, আর মা’কে ঘৃণার ভীড়েই ভুলে যাও৷ আমি জানিনা উনি কেন নিজের ছেলেকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি সেদিন একটা শর্ত দিয়েছিলেন, যদি কখনো তোমার জন্মপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠে মানুষ যদি জন্ম নিয়ে নানান কথা বলে, আর তুমিও যদি সেদিন নিজেকে এইদিক থেকে ছোট ভাবো তাহলে তিনি তোমার আসল পরিচয় নিয়ে সামনে আসবেন। আর এটাও বলেছিলেন তিনি যেখানে থাকেন সবসময়ই তোমার খোঁজ রাখবে। আমি জানতাম না উনি অন্তিদের পরিবারের না সম্মতির কারণটাও জেনে গিয়েছেন৷ তারাও শুধুমাত্র জন্ম পরিচয়ের জন্য বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিলো । আমি বুঝতে পারছি এই জন্যই এখন তোমার সামনে তোমার পরিচয় নিয়ে আসছে।

আদীল কিছুটা সরে গিয়ে বললো,
___ মা এতদিন আমাকে কেন বলোনি এসব? আর এসব জেনেও কি হবে ? উনি তো ইচ্ছে করলেই পারতো আমাকে নিজের কাছে মানুষ করতে। পারতোনা? সন্তানকে মানুষ করতে গিয়ে মায়েরা কামলা পর্যন্ত খাটে। সেখানে উনি তো আমাকে নিয়ে বেঁচে থাকার কথা কখনো চিন্তাই করেনি।

এবার শায়লা আঞ্জুম জোরে জোরে কেঁদে উঠে, আর তার বৃদ্ধ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
___ মা আদীল কি বলছে শুনো? আমি সারাজীবন আমার চিন্তা করেছিলাম? আমি তাকে নিয়ে বাঁচতে চাইনি? বলো না তুমি? আদীল কি বলছে মা?

শায়লা আঞ্জুমের মা মেয়ের গালে হাত রেখে বললো,
___ আর কতো লুকাবি মা? কতো নিরব থেকে থেকে নিজে কষ্ট পাবি আর এতোশত অভিযোগগুলোকে হজম করবি। তুই আজকেও এটাই চাইবি আদীল নিজের বাবার সম্পর্কে কিচ্ছু না জানুক? এই নিরবতা তো বহুবছর চলছিল, প্লিজ এবার এগুলোকে ছুটি দে মা! সব বল ওদের।

শায়লা আঞ্জুম মায়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে আদীলের দিকে তাকালো আর বললো,
___ আদীল তুমি তোমার জন্মদাতা বাবাকে ঘৃণা করো না কেন?

আদীল কিছুটা চুপ থেকে বললো,
___ আমার উনার কথা মনে নেই। শুধু মনে আছে আমি চিৎকার করে সেদিন আপনার সাথে যেতে চাইছিলাম কিন্তু আপনি নিষ্ঠুরের মতো ফেলে চলে গিয়েছিলেন।

শায়লা আঞ্জুম একটু দম নিয়ে বললো,
___আদীল, আমি শুধু তোমাকে নয় তোমার বাবাকেও ফেলে চলে আসছিলাম। একটা নরক জীবন থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি পারিনি বাবা!
মা-বাবার ইচ্ছেতে সম্পূর্ণ অচেনা একটা মানুষকে বিয়ে করেছিলাম, বিয়ের পর থেকেই বুঝতে পারি উনি স্বাভাবিক নন। প্রতিদিন পার্টি করে মাতাল হয়ে করে বাসায় ফিরেন, কিছু বললেই গায়ে হাত তুলেন। তারপরও আমি সহ্য করে ছিলাম, কারণ কয়েকমাসেই বুঝতে পারি আমার গর্ভে তুমি আছো। শুধু তোমার কথা ভেবে, তোমার পিতৃ পরিচয়টার লোভে আমি তখনো দাঁত কামড়ে ওই সংসারে পড়ে ছিলাম। তোমার বাবা আমার পুরো প্রেগ্ন্যাসির সময়ে একটাবার জানতে চায়নি আমার কি দরকার, আমি কেমন আছি! কিন্তু উনার বান্ধবীদের সাথে ঘুরাফেরা, তাদের নিয়ে রাতের পর রাত পার্টি করা,শপিং করে দেওয়া এগুলো মিস হতোনা। আমার তখন আট মাস চলে, তোমার বাবাকে কোথাকার একটা মেয়ে এসে বাসায় দিয়ে যায়, আমি জবাবদিহি করতে গেলে উনি আমার গায়ে হাত তুলে। ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়,আমি অচেতন হয়ে পড়ি। তোমার দাদাভাই ছিল শুধু, তিনি বুঝতে পেরে দৌঁড়ে আসে আর আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। জরুরী অবস্থায় অপারেশন হয়, কেউ বলেনি বাচ্চা এবং মা দুজনেই বাঁচতে পারবে। সময়ের আগে সিজার হওয়ায় তোমাকে নিয়ে অনেকদিন পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতে হয়। তারপর বাবার বাড়ি ছিলাম। বাবা অসুস্থ ছিল, মা আমাকে পূণরায় সেই নরক সংসারে না যাওয়ার জন্য হাত জোর করে। কিন্তু আমি শুধু তোমার কথা ভেবে তোমার চারমাস বয়সে আবারও ফিরে ওখানে যাই।
তারপর থেকে উনি আমার সাথে থাকা বন্ধ করে দিয়েছিল, তোমার কান্নাকাটি এসব উনার বিরক্ত লাগতো। আলাদা থেকেও তিনি আমার সাথে বাজে ব্যবহার করতো। তোমার দুই বছর বয়স তখন, তুমি নিজে থেকে তোমার বাবার কাছে গিয়ে উনাকে বাবা বলে ডেকেছিলে, সেদিন আমি দেখেছিলাম উনি দুই মিনিট একটু কোলে নিয়ে আদর করেছিল। কিন্তু তুমি প্রসাব করে দেওয়ায় উনি তোমাকে এক ঝাড়ি দিয়ে বিছানার উপর ফেলে দেয়, তুমি ভয় পেয়ে জোরে কেঁদে উঠেছিলে। সেদিন তোমাকে বুকে জড়িয়ে বলেছিলাম আর যেতে দিবোনা ওই অমানুষটার কাছে..

এতটুকু বলেই শায়লা আঞ্জুম নিজের কান্না থামাতে পারছিলোনা। তিনি সোফার হাতলে ধরে হুমড়ি খেয়ে পড়েন।
সবার চোখ ভেজা এবং সবাই চুপ করে আছে। আদীল আস্তে আস্তে শায়লা আঞ্জুমের পাশে উনার মাথায় হাত রেখে ফ্লোরে বসে পড়ে। কান্না মধ্যে কিছুটা রাগ টেনে বলে,
___উনি এখন কোথায়?

শায়লা নিজের মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে আদীল কাঁদছে। ছেলের গালে হাত রেখে বলে,
___জানো? তারপরও আমি দুই বছর ওই সংসারে ছিলাম। তোমাকে উনার কাছ থেকে দূরে রাখতাম। আমাকে মারুক, বকুক আমি মেনে নিতাম কিন্তু তোমাকে কিছু বললে আমার কলিজা ফেটে যেতো। সেদিন রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলাম, হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখি তুমি তোমার খেলনা ফেলে কোথাও চলে গেছো, আমি দৌঁড়ে রুমে গিয়ে দেখি আমার রুমে তুমি নেই। তোমার বাবার রুমে যেতেই দেখি উনি বোতল থেকে এসব বাজে পানীয় খেয়ে মাতাল অবস্থায় তোমাকেও বলতেছে খাওয়ার জন্য। চার বছরের তুমি বাবার সোহাগ ভেবে হা করেছো খাবে বলে। আমি দৌঁড়ে গিয়ে একটানে তোমাকে কোলে তুলে নেই, তারপর উনাকে বলি, আপনি এইটুকু বাচ্চার সাথে এসব কি শুরু করেছেন, মেরে ফেলতে চান? তিনি বলেছিল হ্যাঁ সেটাই চাই। তোরা চলে যা আমার বাড়ি থেকে। আমাদের কথাবার্তায় আমার শ্বশুর আসে এবং এসব শুনে তিনিও কেমন যেন হয়ে যান। শুধু উনার জন্য আমাকে তালাক দিতে সাহস পায়নি। সেদিন আমি উনাকে বলেছিলাম, আমি জীবনের ৫ বছর এই সংসারে ছিলাম শুধু আমার ছেলের পিতৃ পরিচয়ের জন্য। কিন্তু এখানে থাকলে আমার ছেলে তার বাবার মতোই অমানুষ হয়ে যাবে, এটা আমি হতে দিবোনা, আমি আজই চলে যাবো। তারপর শুধু আমার স্নেহে আর শুধু আমার পরিচয়েই তাকে মানুষ করবো।
এটা শুনে তোমার বাবা আমার শ্বশুরের সামনেই আমাকে মারতে আসে। সেসময় উনি পরিস্থিতির চাপে অচেতন হয়ে নিচে পড়ে যান। স্ট্রোক করেছিলেন তখন, চিকিৎসার জন্য নেওয়া হলেও তিনি পথিমধ্যেই মারা যান। সেদিন মাঝপথ থেকেই চলে আসি বাবার বাড়ি। উনি নাকি দুইদিন পরেই বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছিলেন।
এদিকে আমি তোমার কথা ভেবে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিলাম। কিন্তু এর জন্য তোমাকে আমার মা’য়ের কাছে রেখে যেতে হতো। কয়েকদিন যেতে না যেতেই বাড়িতে আবারো বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। বিয়ে করবো না সাফ জানিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও রাতবিরাতে কয়েকজন বাড়িতে এসে ডিস্টার্ব করতে থাকে। তারপর আমি বাড়িতে না থাকলে ওরা তোমাকেও আজেবাজে কথা শিখিয়ে দিয়ে যেতে থাকে। যাকে তাকে দেখিয়ে বলে এটা তোমার বাবা।
আমার চরিত্র নিয়েও কথা উঠতে থাকে। আমি বুঝতে পারছিলাম এভাবে চলতে থাকলেও তুমি আমার কাছে থেকেই একটা সময় খারাপ হয়ে যাবে। আমার সম্পর্কে তোমার খারাপ ধারণা হবে। সেসময় আমার মায়ের দুঃসম্পর্কের আত্মীয় মানে সাঈদ সাহেব যাকে আমি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছি, তিনি প্রস্তাব পাঠান। সন্তান না হওয়ার জন্য উনার প্রথম স্ত্রী নিজে থেকেই চলে গিয়েছিল। আমার মা আমাকে রিকুয়েষ্ট করতে থাকে আবার বিয়ে করার জন্য। কিন্তু আমি সম্পূর্ণ অমত ছিলাম, তার পর পরেই আমার অফিসের হ্যাড মানে তোমার ডেকে আসা বাবা আরমান তালুকদার আমার কাছে এসে তোমাকে নেওয়ার জন্য অনুনয় করতে থাকে। অনেক ভেবে তখন আমি সিদ্ধান্ত নেই উনার কাছেই দিবো। নয়তো তুমি বড় হবে ঠিকই কিন্তু মানুষ হবে না। চোখ বন্ধ করে কলিজায় পাথর বেঁধে তোমাকে তুলে দিয়েছিলাম তাদের কাছে।
তারপর সাঈদ সাহেবকে বিয়ে করলাম, পরের বছর আমরা দেশের বাইরে চলে যাই। কয়েক বছর পর জানতে পেরেছিলাম উনি কখনো বাবা হতে পারবেনা৷ ১০ বছর ছিলাম একনাগাড়ে, এর মধ্যে আমার বাবাও দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। মা একা হয়ে গেলো। দেশে চলে আসলাম আর মাকে আমার কাছে নিয়ে আসলাম। কয়েক বছর পর আমরা সিদ্ধান্ত নেই একটা বাচ্চা দত্তক নিবো। তারপর নিয়ে আসলাম সুমিকে। সুমির মুখে বাবা ডাক শোনার আগে উনিও আমাদের ছেড়ে চলে যান। তারপর উনার যাবতীয়কিছু দেখাশোনার দায়িত্ব আর বাচ্চার দায়িত্বও শুধু আমার উপরে। সুমিকে একসাথে আমার আদর দিয়ে বড় করতে লাগলাম আর দূর থেকে দেখে আসছিলাম তালুকদার পরিবার আমার সন্তানকে কতটা যত্নে মানুষ করছে, আমার খুব ইচ্ছে করতো তোমার সামনে যাই, মাথায় হাত বুলিয়ে দেই, কিন্তু আমি বাঁধা ছিলাম। এরপর আমি নিজেকে বুঝাতাম আমি কেন এমন করছি? আমার কাছে থাকলে তো আদীল কখনোই আজকের এই আদীল হয়ে উঠতো না! আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার সন্তান আমার কাছ থেকে উনাদের কাছেই বেশি ভালো আছে।

শায়লা আঞ্জুমের কথার মধ্যে অন্তি আস্তে করে বললো,
___আপনি তো বলেছিলেন আদীলকে কারা নিয়ে গেছে জানতেন না। সেদিন আমাকে দেখতে এসে সে জন্মপরিচয় নিয়ে জানায় বলে কনফার্ম হয়েছেন সেই আপনার ছেলে।

অন্তির কথায় এখানের সকলের দৃষ্টি চলে যায় ওর দিকে, সবার প্রশ্ন এখন, অন্তি কি করে শায়লা আঞ্জুমকে আগে থেকে চিনে। কিন্তু কেউ মুখ ফুটে এই মূহুর্তে প্রশ্নটা করছেনা। শায়লা আঞ্জুম আদীলের দিকে তাকিয়ে অন্তিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
___অন্তি তোমাকে আমি মিথ্যে বলেছিলাম। আমি একটু আগে পর্যন্ত চাইনি আদীলের বাবার সম্পর্কে কেউ জানুক। আমি একা একা সারাটা জীবন উনার দেওয়া কষ্টগুলো পেয়ে আসছি সাথে ঘৃণাগুলোও যেন আমারই থেকে হয়। কারণ শত খারাপ হোক উনি আদীলের বাবা ছিলেন। তোমাকে যদি বলতাম আমি জেনেশুনে তাদের কাছে তুলে দিয়েছি তুমি অবশ্যই এর পেছনের কারণটা জানতে চাইতে, আর সেটাই আমি বলতে চাইনি। কিন্তু এখন দেখো, সবকিছু বলতেই হলো। হয়তো এতো বছরের নিরবতার ছুটি আজকেই হওয়ার ছিল। আর আদীল জানতে চেয়েছিল উনি এখন কোথায়? বলেছিলাম তোমার দাদার মৃত্যুর দুইদিন বাদেই আবার বিয়ে করেছিলো, সেই বউ কয়েক বছরে পুরো সম্পত্তি হাতিয়ে উনাকে ফেলে চলে যায়। তার পর পরেই উনার মধ্যে রক্ত ক্যান্সার বাসা বাঁধে, আমি দেশ থেকে যাওয়ার ৫ বছরের মাথায় উনি বিনা চিকিৎসায় মারা যান।

এবার শায়লা আঞ্জুম জোরে একটা দম নিয়ে দুইহাত নিজের কপালের উপর রেখে হাঁটুতে মাথা ঠেকান। আদীল তাকিয়ে দেখলো অন্তির মা-বাবাও চোখের পানি মুছতেছে, আদীল তার মায়ের দিকে তাকাতেই উনি চোখ দিয়ে ইশারা করলেন উনাকে শান্ত করতে।
আদীল শায়লা আঞ্জুমকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই উনি মাথা তুলে অন্তির বাবার উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
___শিকদার সাহেব, আপনি জেনেছেন তো আমার আদীল রাস্তা থেকে তুলে আনা কোনো অপবিত্র মায়ের সন্তান নয়। এটা নিয়েই তো আপনার দ্বিমত ছিল, এখন আরো ভালো করে জেনে নিন, হাজার ঝড়ের মধ্যেও আদীল পবিত্র, তাকে খারাপ কিছু স্পর্শও করতে পারেনি। আজীবন মা হিসেবে আমি সন্তানের জন্য এটাই চেয়ে এসেছি, আলহামদুলিল্লাহ আমি নিজে না পারলেও তালুকদার পরিবারের জন্য আজ সেটা সার্থক।
আদীল তোমার মায়ের কাছে যাও, মা ডাক শোনার সাধটা অপূর্ণ থেকে যাক। আমার সুমি আছে তো।

আদীল সাথে সাথে উঠে মা বলে শায়লা আঞ্জুমকে জড়িয়ে ধরলো। সন্তানের স্পর্শে তিনি ডুকরে কেঁদে উঠেন! সাথে আদীলও মা’কে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে! আজ কতো বছর পেরিয়ে সেই ছোট্ট সন্তানটাকে আজ কতো বড় হওয়ার পরে আবার তার মায়ের বুকে তার শীতল ছোঁয়া দিয়েছে! এ খুশি যেন আজকে উনার মৃত্যু আসলেও মনে কোনো আফসোস রাখবেনা।
আদীল শায়লা আঞ্জুমের দিকে তাকিয়ে নিজের ভুলের জন্য মাফ চাইতে লাগলো। না জেনে মানুষটাকে কতোই না খারাপ কথা বলেছে।
কিন্তু ছেলেকে পেয়ে তার অন্য কোনোদিকেই যেন ভ্রুক্ষেপ নেই, আর আদীলের রাগটা স্বাভাবিক ছিল এটাও কারো বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

আদীল তার দুই মা’কে একসাথে ধরে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
___আমি বড় ভাগ্যবান, আমার দুইটা মা। আমরা আজ থেকে একসাথে থাকবো, নানু আমার বোন সুমি আমরাও একসাথে থাকবো।

মাঝ থেকে অন্তির মা বলে উঠলো,
___ আদীল বাবা, আমাকে তোমার মা বানাবেনা।

আদীল হেসে বললো,
___আরে আমার তো এখন তিনটা মা।

অন্তির বাবা এবার বললো,
___তাহলে আমি?

এবার উপস্থিত সবাই জোরে হেসে উঠলো। আজ হাসিতে হাজারখানেক প্রাপ্তি মিলিত হয়েছে। মিলিত হয়েছে এক মায়ের বহুবছর ধরে ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করার তীব্র বাসনা! সব নিরবতাকে ছুটিতে পাঠিয়ে আজকে এই আনন্দ কে বেঁধে রাখে?

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here