#অগত্যা_তুলকালাম,পর্ব ৪২,৪৩
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ৪২
ব্রেকফাস্ট শেষে দোতলার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়েছি। নিচের কথোপকথন কানে আসছে। খালামণি বলছেন,
“মেয়ে তো অনেক বড় হলো তোর। এবার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। আমার ছেলেটাও তো বুড়িয়ে যাবে কদিন পর।”
মা হাসলেন। কি হাসি! দীর্ঘ সময় নিয়ে হাসলেন।
“কি যে বলো বুবু। আমি তো মেয়ে দেওয়ার জন্যই বসে আছি। ওর মত নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিছুদিন আগেই মত দিয়েছে আমাদের পছন্দেই সে বিয়ে করবে। এখন আর বাঁধা নেই।”
নিজের বলা কথায় নিজেই ফেঁসে গেলাম মনে হচ্ছে। তানভীর ভাইয়াকে না করার মতো কোনো অপশন আমার কাছে নেই এটা সত্যি। আর না করবোই বা কেন? কোন উদ্দেশ্যে? কোন আশায়? রাফিনের আশায়? সেই আশা আমি কখনোই করি না। সে সম্পর্ক শেষ হয়েছে বহু আগেই। আর কখনোই সম্ভব না সেই সম্পর্ক জোড়া লাগানো। রাফিন তো বলেছেই, ও জানে না ওর বাবা আদৌ কখনো আমাকে মেনে নিবে কিনা। ধুর! আমি রাফিনের কথা ভাবছি কেন? সেই অধ্যায় বন্ধ হয়েছে বহু আগেই। আর কখনো সেই অধ্যায় বর্তমান হবে না। অতীত ছিল অতীতই থাকবে।
তানভীর ভাইয়া একঝলক তাকালেন দোতলায়। সাথে সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। তিনি মুচকি হাসলেন। আমি চুপচাপ রুমে চলে এলাম। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না।
নাকীব এলো খানিকবাদেই। এসেই বললো,
“তোমার বিয়ের কথা তো একদম পাকাপোক্ত হয়ে গেল।”
“কার সাথে?”
“এই বাড়ির ছেলের সাথে।”
“আমার কোনো মতামত ছাড়াই?”
“মত নেওয়ার তো প্রয়োজন নেই। তুমিই বলেছিলে বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করবে।”
“তাই বলে…?
”কেন তোমার পছন্দ আছে?”
আমি খানিকটা ইতস্তত করে বললাম,
“আচ্ছা, রাফিনের কোনো খোঁজ জানিস?”
নাকীব সটান দাঁড়িয়ে বললো, “না।”
“ওহ।”
“এই বিয়েতে তোমার মত আছে?”
“মত না হওয়ার কোনো কারণ তো নেই তাই না?”
“কিন্তু আমার মত নেই।”
“কেন?”
“আমি চাই না আত্মীয়ের ভেতর আবার আত্মীয়তা হোক। আত্মীয়ের মধ্যে আত্মীয়তা হলে আগের সম্পর্কটা ফিকে হয়ে যায়।”
“এত লেইম যুক্তি দিয়ে বিয়ে আটকানো সম্ভব না।”
“আমি বিয়ে আটকাতে চাইছি তোমায় কে বললো? আমি চাইছি না এতদূরে তোমার বিয়ে হোক। হেই আপু, তুমি না বলেছিলে কাছেই বিয়ে করবে? এখন রাজি হচ্ছো কেন আবার?”
“রাজি না হওয়ার মতো কোনো কারণই তো পাচ্ছি না এজন্য।”
“তুমি এখানে বিয়ে করছো না ব্যস! এখানে বিয়ের মত দিলে তোমার আমার সম্পর্ক এখানেই শেষ।”
কথাটা খুব চেনা আমার। খুব পরিচিত একটা ডায়লগ। কয়েকবছর আগে রাফিনের মুখে শুনেছিলাম। সম্পর্ক শেষ হওয়া এত সহজ? রাফিনকে পেরেছি আজও ভুলতে? সময়ের ব্যাপ্তিকালে হয়তোবা ভুলে থেকেছি কিন্তু মন থেকে তো একেবারে মুুছে যায়নি। হয়তো ওর প্রতি কোনো অনুভূতি নেই কিন্তু সম্পর্কের ঘটনাগুলো তো ভুলে যাইনি। স্মৃতির তীক্ষ্ণ কাটা হয়ে আজও বিঁধছে মনে।
“তোর আমার সম্পর্ক কি এতটাই ঠুনকো? আমাদের তো রক্তের সম্পর্ক। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের আত্মার সম্পর্ক। নাহয় আমার মনের কথা বলার আগেই তোকে বুঝে নিতে হবে কেন?”
“আজও তোমার মনের কথা বুঝছি বলেই বিয়েতে মত না দিতে বলছি। আমরা দুজন কালই ফিরবো। বাবা-মায়ের থাকতে হয় তো থাকুক।”
“কি বলছিস এসব? আর তুই এভাবে না করছিস কেন?”
“কারণ আছে বলেই।”
“কি কারণ?”
”বলা যাবে না।”
“আচ্ছা।”
দুজন দু’পাশ ফিরে বসে আছি৷ ভেতরে চলছে টানাপোড়েন। নাকীব বললো,
“হয়েছে ভাবনায় বসো না আর। আমরা বেরুবো, রেডি হও। কুইক!”
আমি উঠে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। বেরুনোর মুখে দেখা হলো খালুর বড় ভাইয়ের সাথে। ভদ্রলোক খুবই নিরীহ টাইপের। অথচ ওনাকে দেখে মনে হয়, জীবনের একটা সময় খুবই দাপটের সাথে পৃথিবী কাঁপিয়েছেন।
আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে বললেন,
“কোথায় যাচ্ছো মা?”
মহা সমস্যা! এতগুলো গায়রে মাহরামের ভীড়ে পাগল হয়ে যাব আমি।
“এই তো বাইরে…”
“খুবই সাদাসিধে একটা মেয়ে। যাও, সাবধানে যেও।”
আমরা কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম। বেরুনোর সময় নাকীব শুধু বলেছিলো, “আসি আঙ্কেল?”
ভদ্রলোক স্মিত হেসে মাথা নাড়লেন। আমরা নদীর পাড়ে চলে এলাম। রাফিনও আমাকে প্রথমবার দেখে বলেছিলো, “খুবই সাদাসিধে, ঠিক আমার পছন্দের।” উফ! সবখানে রাফিন চলে আসছে কেন?
কয়েকটা নৌকা বাঁধা আছে। একটা নৌকায় লোক পারাপার করছে। মাঝি একবার এদিক থেকে লোক নিয়ে ওপারে রেখে আসে আবার ওপার থেকে কিছু লোক নিয়ে আসে। এভাবেই চলছে তার জীবনধারা৷ মাঝিকে নাকীব জিজ্ঞেস করলো নৌকা ভাড়া নেওয়া যাবে কিনা। মাঝি জানালো তার নৌকা সারাদিনের ভাড়ায় যায় না। পাশে একটা নৌকা দেখিয়ে বললো সেই নৌকার মাঝিকে ডেকে আনতে। সে ভাড়া খাঁটে।
“তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?” নাকীবের প্রশ্ন।
“ঐ যে বস্তি দেখতাছো? ঐখান দিয়ে ঢুইকা তিন নম্বর ঘরটায় হেই থাহে। ডাইকা লইয়া আহো।”
মাঝি নৌকা বাওয়া শুরু করলো। নাকীব আমাকে রেখেই বস্তির দিকে হাঁটা শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর একজন লোককে সাথে করে নিয়ে এলো। লোকটা এসেই বাঁধা নৌকার বাঁধন খুলতে লাগলো। এরপর আমরা নৌকায় উঠে রওনা দিলাম।
পানি ধরতে ধরতে যাচ্ছি। মনটাই ফুরফুরে হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছে পানিতে পা দোলাই, নদীতে নেমে সাঁতরাই। নদীর মাঝামাঝি যেতেই নাকীবের ফোনে কল এলো। কল রিসিভ করে উত্তেজিত হয়ে পড়লো ও। নাকীব বিষম খেলো ভীষণ। পানি খাচ্ছিলো, মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল সেগুলো। হঠাৎ কি হলো?
আমার বুকের ভেতর ধুকপুকানি শুরু হলো। আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি হয়েছে?”
কান থেকে ফােন নামিয়ে বললো,
“অনেক বড় গন্ডগোল হয়ে গেছে আপু। আমাদেরকে মনে হয় ফিরতে হবে, এক্ষুনি।”
“কোথায় ফিরতে হবে? কি হয়েছে?” ভীষণ অবাক হয়ে বললাম।
“আপু, শান্তি কুঠিরে জাফর দলবল নিয়ে হামলা চালাচ্ছে। মাহফুজ বললো এক্ষুনি।”
“কিহ?” বিস্ময়ের সীমা রইলো না আমার। এত বছর পর জাফর কোত্থেকে?
মাঝিকে নৌকা ঘোরাতে বললো নাকীব। কিছুদূর আসতেই আবার কল এলো নাকীবের ফোনে।
“থ্যাঙ্ক ইউ ভাইয়া। জাফর আর অ্যাটাক করতে পারবে না তাই তো?”
–
“অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। আমি এতদূর থেকে গিয়ে কিছুই করতে পারতাম না হয়তো। আপনি ছিলেন বলে।”
–
“আচ্ছা। ইন শা আল্লাহ যত দ্রুত সম্ভব ফিরে যাবো আমরা।”
–
“সিকিউরিটি গার্ড?”
–
“শুকরিয়া। অনেক শুকরিয়া আপনাকে।”
নাকীব ফোন রেখে দিলো। বললো,
“আপু, আর চিন্তার কিছু নেই। আমার অতি প্রিয় একজন সোশ্যাল ওয়ার্কার ভাইয়া আছেন ওখানে। তিনি শান্তি কুঠিরে সিকিউরিটি গার্ড রেখেছেন যতদিন আমরা ফিরছি না ততদিনের জন্য। তিনিও নাকি কাজে বেরিয়ে যাচ্ছেন তাই তাড়াহুড়ো করে ফোন রেখে দিলেন।”
“সোশ্যাল ওয়ার্কার ভাইয়া? তাও আমাদের উচিত তাড়াতাড়ি ফেরা।”
”তা তো ঠিক। চলো বাড়ি ফিরে বাবা-মাকে বলি।”
তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরে গেলাম। মাকে বলতেই বললেন,
“কোথায় যাচ্ছিস এত দ্রুত? আর বললো না সিকিউরিটি গার্ড রেখেছে? তাহলে এত চিন্তা কিসের? এমনিতেই আমরা সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ফিরে যাবো আশা করি।”
“সপ্তাহখানেক? ততদিন… মা, ওরা সেইফ না ওখানে।”
“হ্যাঁ, তোরা গেলেই সেইফ হয়ে যাবে না?”
“উফ মা! ওরা সবাই বাচ্চা আর দাদু বৃদ্ধ। কারো সাথে মোকাবেলা করার শক্তি ওদের নেই। বুঝছো না কেন?”
“এতদূরে এসেছি আমার মন ভালো করতে। মন ভালো করার কাজটা এখনো হয়নি৷ সেটা হোক তারপর যাবো।”
“কি কাজ সেটা?”
মা বলার আগেই খালামণি বলতে শুরু করলেন,
“আজ এই বাড়ির ছোট ছেলে ফিরছে। কত বছর সে এখানে আসে না তার হিসেব কারোর নেই। তার ফেরার আনন্দে আমরা সবাই মাতোয়ারা। আহারে! মা মরা ছেলেটা..!
বিরক্তির শ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে বললাম,
“আপনাদের ছেলে আপনারা খুশিতে মাতোয়ারা হোন। আমার জন্য সে পরপুরুষ আমি মোটেও খুশি হতে পারছি না। একদমই না৷ যত্তসব!”
রেগেমেগে ওখান থেকে চলে এলাম। ওদের বাড়িতে আবার ছোট ছেলেটা কোথা থেকে আমদানি হলো কে জানে! খালামণির তো দুটো ছেলে। এটা আবার কে? ধুর জ্বালা! আমার হয়েছে যত যন্ত্রণা।
রুমে এসে ঝটপট দাদুকে ফোন দিলাম। দাদুর মুখেই শুনলাম সবটা।
দাদুর কাছে জানতে পারি জাফরের লোক এসেছিলো। অথচ মাহফুজ বলে, তাদের নেতা আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা ছিল ওগুলো। মাথায় সহজে ঢুকছিলো না ব্যাপারটা। পরে দাদু বললেন,
“জাফরই ছিল ওদের নেতা। ওদের বস্তির ঘর ভেঙ্গেছিলো যে সে জাফর-ই ছিলো।”
শুনে আমার তো মাথায় হাত। এতকিছু! এসব কিছু এতবছর ধরে আমাদের অজানা রয়ে গিয়েছিলো? আমাদের সবার শত্রু ঘুরেফিরে ঐ একজনই। তৎক্ষনাৎ ঝিলি দিলো আরেক চমকপ্রদ তথ্য।
ঝিলি চেঁচিয়ে বলতে থাকে, “ভালো ভাইয়া আমাদের বাঁচিয়েছে, ভালো ভাইয়া।”
ঝিলির কাছে ফোন দিতে বলায় দাদু দিলো। ঝিলি ফোন কানে ধরতেই বললাম,
“ভালো ভাইয়া?”
“হ্যাঁ।”
“কোন ভালো ভাইয়া? সেদিন যে রাস্তায়…”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঐ ভাইয়াটাই। এসে ঢিশুম-ঢুশুম এমন মারলো নেতা একদম পালিয়ে গেছে আপু৷”
আমি দাঁড়িয়ে দেয়ালে হাত রেখে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম। লম্বা একটা শ্বাস বেরিয়ে এলো। আর মুখ দিয়ে অস্ফুটে উচ্চারিত হলো, “রাফিন?”
“আপু, ভালো ভাইয়াকে তো দাদু চিনে। কত আদর করলো দাদু। আপু, এখন থেকে মনে হয় ভালো ভাইয়াও দাদুর কাছে গল্প শুনতে আসবে। কি মজা! আমি ভালো ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসি আপু।”
”উফ ঝিলি! চুপ করো তুমি। কুলসুমকে ফোন দাও।”
“আচ্ছা।”
কুলসুম ফোন নিতেই বললাম,
“কুলসুম, তুই বলতো, শুরু থেকে কি হয়েছে?”
নাকীব জিজ্ঞেস করলো, “কি করেছে ভালো ভাইয়া?”
কুলসুম বললো, “উনি কিছু করেননি। একগাদা ছেলেপিলে এসে এখানে ভাঙচুর করতে চাইলো আর তখনই ওনাকে দেখতে পেয়ে পালালো সবক’টা। তবে পালানোর সময় ধরতে গিয়ে উনি গুন্ডাগুলোকে কতগুলো ঘুষি-টুষি মারলো। উনি এই এলাকার বেশ নামকরা কেউ মনে হয়৷ আমাদেরকে বললেন, “সাবধানে থাকতে।”
“তারপর?”
“তারপর চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর এখানে ইয়া মোটা মোটা চারজন লোক রেখে গেলেন। হাতে মস্ত বড় পিস্তল। দুজন সামনের দরজায় আর দুজন বাড়ির পেছনে দিনরাত পাহারায় থাকবে বললো। আপু, তোমরা একটু তাড়াতাড়ি চলে আসো।”
“আসতেই তো চাচ্ছি। পারছি কই? এজন্যই তোদের রেখে আসতে চাইনি আমি। এখন গল্প শোন ভালো করে।”
“আপু, আমি না। ওরা কেউ যায়নি বলে আমি যাইনি।”
“আচ্ছা শোন, সবার খেয়াল রাখিস। কেউ বাইরে যাবি না একদম। বাগানেও না। যতই সিকিউরিটি গার্ড থাকুক কেউ বাইরে যাবি না৷ বাইরে গেলে ঘটনা লম্বা হয়ে যাবে। আমি চেষ্টা করবো ৩/৪ দিনের মধ্যে চলে আসার। সাবধানে থাকবি। সবাইকে দেখে রাখবি।”
“আচ্ছা আপু। তুমি অত চিন্তা করো নাতো। বেড়াতে গিয়েছো বেড়াও।”
“আর আমার বেড়ানো। যন্ত্রণায়, অস্থিরতায় আর টেনশনে পাগল হয়ে যাব আমি। উফ!”
মেজাজটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ওদেরকে বিপদে রেখে আমি শান্ত থাকি কি করে? কোন ছাতার মাথা ছেলে আসছে আল্লাহ মালুম। এখন আবার ঐ ছেলের সামনে পড়ার জন্য আমাকে থেকে যেতে হবে। অসহ্য! হুট করে মনে হলো নাকীব নৌকায় কোনো একজন সমাজসেবকের সাথে কথা বলছিলো। আমি ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললাম,
“তোর ঐ সোশ্যাল ওয়ার্কার ভাইয়াটার নাম কি?”
নাকীব আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো।
“সে কোনোভাবে রাফিন না তো? তুই ওর সাথে এত ইজিলি কিভাবে কথা বললি? তোর সাথে ওর কন্ট্যাক্ট হলো কি করে? তোর সাথে কি ওর আগে থেকেই যোগাযোগ আছে?”
–
“কি হলো কথা বলছিস না কেন? বল, তোর অতি প্রিয় সোশ্যাল ওয়ার্কার ভাইয়া কি রাফিন? কথা বলছিস না কেন তুই? রাফিন তোর অতি প্রিয় হলো কবে থেকে? ওর সাথে তোর যোগাযোগ হলো কি করে?”
নাকীব আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার একটাও প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমাকে রেখে গেল একগাদা প্রশ্নের ভীড়ে। আমি হা করে ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম।
#Be_Continued_In_Sha_Allah 🥀
#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ৪৩
প্রাণহীন, নির্জন এই প্রাসাদে সময় একেবারেই কাটছে না আমার। ঘরের বাইরে যাওয়ার জো নেই। দিন কেটে যাচ্ছে ভীষণ বিরক্তিতে। দিনরাত জানালার কাছে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। পশ্চিমের জানালা দিয়ে রোজ সূর্যাস্ত দেখি। রুমের বাহিরের লম্বা করিডোর। কিছুদূর গিয়ে পূর্বদিকে মোড় নিয়ে করিডোর শেষ হয়েছে। করিডোরের শেষ প্রান্তে একটা রুম। শেষ রুমটা তালাবদ্ধ। করিডোরের শেষ প্রান্তে গিয়ে জানালা দিয়ে তাকালে সূর্যোদয় দেখা যায় ভীষণ সাবলীলভাবে।
এশার নামাজ শেষ করে লম্বা সময় কাটাতে ডায়েরি নিয়ে বসলাম। পশ্চিমের জানালার ধারেই বসেছি। মৃদু আলোর একটা লাইট জ্বলছে ডায়েরির সামনে।
“প্রাণহীন স্মৃতি”
“যতই প্রেয়সী দূরে যেতে লাগলো ততই ওর স্মৃতিরা এসে আমায় আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলতে থাকলো। দিন পেরুলো, রাত পেরুলো, সপ্তাহ পেরিয়ে মাস শেষ হলো। ওর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। কাশবনের গহীনে রেললাইনে বসে নিজের মনে আবৃত্তি করি আজকাল। ফেসবুকে আগে চোখের সামনে ঘুরঘুর করতো হাজার কবিতা, কখনো পড়তাম না৷ আজকাল দেখি সব কবিতাই মিলে যায় আমার ভেতরের অন্য এক আমি’র সাথে। আজও একটা কবিতা পেয়েছিলাম “অদেখার অসুখ।” আসলেই আমাকে অদেখার অসুখে পেয়েছে। বড্ড অসুখ। তাকে না দেখার অসুখ। কবিতাটা এমন—
এইযে এতগুলো দিন গত হয়ে গেল
আমি আপনাকে দেখি না,
আপনি দেখেন না আমায়!
আমার কিন্তু খুব পোড়ে, পুড়ে যায়।
রাত শেষে ভোর এলে—
আমার ইচ্ছে করে সকালের সাথে সাথে
আপনাকেও দেখতে, প্রিয় নাম ধরে ডাকতে।
সন্ধ্যা হলেই মনে হয়;
নীড়ে ফেরা পাখির মতোন
আপনিও ফিরে আসুন।
অদেখার অসুখে ভুগতে থাকা
আমার আমিটাকে সারিয়ে তুলুন।
আপনার ওখানে কি
রাত শেষে সকাল আসে না?
আঁধার কেটে গিয়ে ভোর হাসে না?
সকালের সাথে সাথে আপনারও কি
আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না?
সন্ধ্যা পাখির নীড়ে ফেরা দেখে—
আপনারও কি ইচ্ছে করে না;
আমার কাছে ফিরে আসতে? [১]
আমি মৃদু হেসে মনে মনে বললাম, “আমার কখনোই ইচ্ছে করে না আপনার কাছে ফিরতে৷ আপনাকে হারিয়ে আমি আল্লাহকে পেয়েছি। আল্লাহকে আর হারাতে চাই না। যখন সময় ছিল তখন আপনি আমায় সত্যিটা জাননানি, জানাননি আপনার অপারগতার কথা। সেটা আমার ভুল নয়, আপনার ভুল। সেই ভুলের দায় আমি কখনোই নেবো না। সকাল হলে আমার আর আপনাকে দেখার ইচ্ছে জাগে না, সকাল হতেই এখন মেসেজ চেক করি না, সকাল হলেই এখন আর ফেসবুকে আপনার প্রোফাইলে ঢু মারি না। এসব বদঅভ্যাস আমি ত্যাগ করেছি বহুবছর আগে। এখন আমার সকাল হয় স্নিগ্ধ ভালোলাগায়৷ রাতভর আমার প্রিয় রবের সাথে কথোপকথনের পর আমার মনটা অন্যরকম বিশুদ্ধতায় ছেঁয়ে যায়৷ তখন আর আপনার সাথে কাটানো অবৈধ মুহুর্তগুলো মনে আসতে চায় না। তবে হ্যাঁ, আপনাকে একেবারেই মনে পড়ে না বললে ভুল হবে। আপনাকে আমার মনে পড়ে মধ্যরাতে। যখন আমি আল্লাহর সাথে কথা বলি তখন আপনাকেও স্মরণ করি। স্মরণ করে অবৈধ সেই মেলামেশার জন্য পরম করুণাময়ের কাছে পানাহ চাই। আর চাই আপনার জন্য হেদায়েত। আপনাকে যেন আল্লাহ হেদায়েত দান করে একজন পরিপূর্ণ মুসলিমরূপে কবুল করেন তাঁর দরবারে। এরবেশি কিছু আপনাকে নিয়ে আমার ভাবা হয় না আর।
কথাগুলো চট করে একটা কাগজে টুকে নিয়ে ডায়েরির ভাঁজে রেখে দিলাম। বাসায় গিয়ে সরিয়ে ফেলা যাবে।
ডায়েরিতে মনোযোগ দিলাম আবার।
“বড় আপ্পিকে আগেই ওর কথা জানিয়েছিলাম। সম্পর্কের শেষ দিন যখন বলেছি, ও হারাম সম্পর্কের ইতি চায় তখন বড় আপ্পি বললো, যে যেমন থাকতে চায় তাকে তেমনই থাকতে দেওয়া উচিত। তাই আমিও ওর মতের বিরুদ্ধে যাইনি। আল্লাহর ওপর ভরসা করে ওর হাত ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জানি না কখনো পাবো কিনা। বড্ড ভয় হচ্ছে।
ও আমার কাছে নেই। কখনো আমার বাড়িতেও আসেনি। কিন্তু আমার বাড়িভর্তি ওর স্মৃতি। ওর সাথে যেখানে যেখানে ফোনে কথা হয়েছে সেখানে গেলেই আমার ওকে মনে পড়ে বুক ভেঙ্গে আসে। ইদানিং রাতে বারান্দায় যেতে পারি না। ওখানে বসেই যে প্রায় রাতে আমাদের কথা হতো। একটা বাস হর্ণ বাজিয়ে গেলে পর্যন্ত আমার ওকে মনে পড়ে। আমরা যখন রাতে কথা বলতাম তখন দূর থেকে বাস ও গাড়ির আওয়াজ আসতো। মাঝেমধ্যে রেল যাওয়া-আসা করতো হুইসেল বাজিয়ে। স্মৃতিতে সেসব গেঁথে গেছে, চাইলেও ভুলতে পারি না। সম্পর্কের শুরুতে কত স্বপ্ন বুনেছিলাম। এমনও একটা দিন ছিল আমার মনে আছে, আমরা রাত দুটোর সময় কথা বলছিলাম ফোনে। হঠাৎ দূর থেকে রেলের হুইসেল শোনা গেল। আমি বললাম, চলো আমরা দুজন রেলের ছাদে উঠে পড়ি। শুধু আমরা দুজন আর কেউ না৷ ফোনের ওপাশে ও লজ্জায় লাল হচ্ছিল আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সেই স্মৃতিটা আমার বুকে, ব্রেইনে এমনভাবে গেঁথে গেল যে ইদানিং রেলের হুইসেলের শব্দ কানে আসলেই আমি ধড়ফড় করে উঠি। হাত দিয়ে কান চেপে রাখি। এত অসহ্য ব্যাথা কেন?
আজকাল বারান্দায় গেলেই শুধু সেসব স্মৃতি মনে পড়ে। আফসোসও হয়, কেন ওর সাথে বাড়াবাড়ি করতে গেলাম? খুব কড়া শাসনে রাখতে গিয়েছিলাম কেন? অন্যদের মতো প্রেম করে না বেড়ালেও একটু তো ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারতাম। অতটা বাড়াবাড়ি না করলে হয়তো আমাকে ছেড়ে যেতে ওর অনেকখানি কষ্ট হতো। হয়তো ছেড়েই যেতো না। আবার মনে হয়, ও তো আল্লাহর জন্য ছেড়েছে আমাকে। যদি আমাদের ভালোবাসা সৎ হয় আল্লাহ নিশ্চয়ই মঙ্গলজনক কিছুই ঘটাবে আমাদের জীবনে। ওকে এখন রবের কাছে চাওয়া ছাড়া আর কোনো অপশন আমার কাছে খোলা নেই। মেসেজ দিয়েছিলাম, সিনও করেনি। কতদিন ফেসবুক মেসেঞ্জারে ঢোকে না কে জানে? আইডিটাও মৃতপ্রায়। আমাকে কি একটুও মনে পড়ে না ওর? নাকি আমাকে ভুলতেই ফেসবুকে আসে না? আগে তো রোজ একটিভ থাকতো। আমাকেই জোর করে অফলাইনে যেতে বাধ্য করতে হতো। ওহ, ও তো এখন আল্লাহর প্রেমে মত্ত হয়েছে। হয়তো ইবাদত-বন্দেগিতেই ভালো আছে।
ওকে যেসব সাইকোলজিক্যাল কাজ করতে বারণ করতাম সেসব না চাইতেই আমি করে ফেলছি। কি আজব দুনিয়া। ভেবেছিলাম ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। অথচ আমিই পারছি না, ও দিব্যি ভালো আছে আমাকে ছাড়া।
প্রিয়তমা একসময় আমায় একটা কবিতা শুনিয়েছিলো। তখন তেমন পাত্তা দিইনি৷ কারণ তার অজান্তে তখনও আমি তাকে গভীরভাবে ভালোবাসতাম কিন্তু বুঝতে দিইনি কখনো। কবিতাটা মেসেজেও লিখে পাঠিয়েছিলো সে। পুরোনো কনভারসেশন ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎ কবিতাটা চোখে পড়লো। যেটা আজকের আমি’র সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায়। কবিতাটার নাম ‘পালাবদল’।
তারপর আপনার অবসরে দেখবেন;
ব্যস্ততায় ডুবে গেছে সে!
এখন যেমন আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকে,
এমন করে আপনিও তখন অপেক্ষা করবেন।
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস
এইভাবে বছর কেটে যাবে।
আপনাদের কথা হবে না।
প্রথম প্রথম অপেক্ষারা অভিমান হবে।
তারপর উপেক্ষা, তারপর অভিযোগ।
একটা সময় হয়তো অপেক্ষা করতেই ভুলে যাবে।
ভুলে যাবে পরিচিত ‘হ্যালো’ বলার শব্দটাও।
হঠাৎ কালেভদ্রে ফোন এলে,
ওপাশ থেকে সালাম দিলে—
কিংবা উত্তরে হ্যাঁ এর জায়গায় ‘হ’ বললে
অতীতের অদৃশ্য সুতায় টান পড়বে।
কিন্তু ততদিনে যুগ পেরিয়ে যাবে,
পেরিয়ে যাবে সময়ের ব্যাপ্তিকাল।
আপনার তখন—
কিছুই মনে পড়বে না।
হয়তো তারও! [২]
আজ আসলেই সময় পেরিয়ে গেছে। সময় থাকতে তার কাছে আমি ভালোবাসার কথা প্রকাশ করিনি৷ নিজেকে আজ এই ভেবে স্বান্তনা দিই যে, সে তো আল্লাহর জন্য আমায় ছেড়েছে। কালেভদ্রে কখনোই আর আমাদের কথা হবে না৷ যে দুনিয়া ছেড়ে আল্লাহকে সত্যিকারের ভালোবাসে সে আর আল্লাহকে ভুলে দুনিয়াকে ভালোবাসতে পারে না৷ যে আল্লাহকে ভুলতে পারে সে পুরো দুনিয়াকে ঠকাতেও পারে৷ তার আমাকে ভোলা কোনো ব্যাপার না। কেউ যদি আল্লাহকে ভুলে আল্লাহর সৃষ্টির কাছে আসে তাহলে সেই সৃষ্টিকেও সে স্বার্থে আঘাত লাগলে ভুলতে দেরী করবে না। এসব আমার কথা না। আমার প্রেয়সী একটা সময় বলেছিলো আমায়।
একদিন এই তীক্ষ্ণ ব্যাথা-বেদনা আর সইতে না পেরে ওকে ফোন দিয়ে বসলাম। ভাবলাম যে, আমার লুকানো সব কথা বলে দিবো অনায়াসে। ও আর ভুলের মাঝে না থাকুক। জানুক, আমি ওকে কতটা ভালোবাসি। ভালোবেসে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। প্রথমে অনেকক্ষন রিং হওয়ার পরও ফোন রিসিভ হলো না। একদম শেষ মুহুর্তে, লাইন কেটে যাবে এমন মুহুর্তে ফোনটা রিসিভ হলো। আমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। একদম বোবাবনে গেলাম। অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম কবে সে কথা বলবে। কিন্তু সে আগে একটা কথাও বললো না। আমিই প্রথমে সালাম দিলাম। তারপর তার কাঁপা কন্ঠ শোনা গেল। গলা যেন জমে বসে গেছে। প্রথমে খুব আনন্দ হলো এই ভেবে যে, সে এতদিন পর আমার ফােন পেয়ে উত্তেজনায় কাঁপছে। পরমুহুর্তেই মনে পড়লো, সে আল্লাহর ভয়ে কাঁপছে। সেদিন আমি ষোলো মিনিট কথা বলেছিলাম। হ্যাঁ, ষোলো মিনিট আমি একাই কথা বলেছি। সে শুধু চুপচাপ শুনেছে। মাঝে শুনছে কিনা জিজ্ঞেস করায় শুধু হু, হা করছিলো। দাঁতের ব্যাথায় তখন আমার নাজেহাল অবস্থা। আমি সেসব কথা ওকে বলেছিলাম। অথচ ওর কোনো ভাবান্তর নেই। আগে আমি অসুস্থ জানলে ছটফট করতো, কবে ভালো হবো সেই নিয়ে টেনশন করতো, সময়ে সময়ে ঔষধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতো। অথচ আজ যেন শুনেও শুনছে না কিছুই।
শেষে বললাম, “তুমি আমার ওপর রাগ করে নেই তো?” ও বললো, “রাগ করার তো কোনো কারণ নেই।” সব শর্টকাট জবাব। তারপর থেকে আর কোনোদিন আমি ওকে কল দিইনি। ভালোই একটা শিক্ষা হয়েছে আমার।”
ডায়েরি বন্ধ করে রুমে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা আলোটাও নিভিয়ে দিলাম। ডায়েরিটায় আর মন বসছে না। একদমই পড়তে ইচ্ছে করছে না আমার৷ পড়ছি কয়েকটা কারণে। প্রথমত, ডায়েরিটায় আর মাত্র কয়েকটা পৃষ্ঠা বাকি। এতদূর পড়ার পর সেগুলো না পড়ায় কোনো ফায়দা নেই। বরং পুরোটা পড়ে নেওয়াই উচিত আমার মনে হয়। দ্বিতীয়ত, গতকাল পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়ে শেষ পেইজে অসম্পূর্ণ একটা লেখা পেয়েছি। লিখতে গিয়ে হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে পড়লে বা ভয় পেলে যখন কলম নড়ে গিয়ে খাতায় লম্বা দাগ পড়ে যায় সেরকমই লম্বা একটা দাগ ঐ লেখাটার শেষে। এরপর আর কোনো লেখা নেই। আমি ধাপে ধাপে পড়ে সেই অসম্পূর্ণ লেখাটায় যেতে চাই। আর আমার স্মৃতি কিভাবে শেষ হলো তাও জানার আছে। এছাড়া ডায়েরিটার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। অবৈধ পুরোনো স্মৃতিকে চাঙ্গা করে কোনো লাভ নেই।
রেফারেন্স:
[১] কবিতা: অদেখার অসুখ। লেখা: সালমান হাবীব
[২] কবিতা : পালাবদল। লেখা: সালমান হাবীব
#Be_Continued_In_Sha_Allah 🥀