#প্রেম_ফাল্গুন
#পর্ব_১৯
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)
“কারণটা তোমাকে মন থেকে বুঝে নিতে হবে লিলি। সব কারণ এক্সপ্লেইন করে বুঝানো যায় না। আমি অপেক্ষায় থাকব লিলি। একদিন তুমি ঠিক কারণটা বুঝতে পারবে।”
লিলি মাথা নিচু করে আপন মনে বিড়বিড় করে বলল,,
“আমি কারণটা জানি ববি। তবে এখনই আমি কারণটা আপনাকে জানাতে চাই না। আপনার মুখ থেকে আমি প্রথমে কারণটা শুনতে চাই। আপনার মনের সমস্ত অনুভূতি জানতে চাই। দেন, আমি কারণটা আপনাকে এক্সপ্লেইন করতে চাই।”
লিলিকে ছেড়ে ববি বালিশের তলা থেকে ফোনটা নিয়ে জুবায়ের আহমেদের নাম্বারে ডায়াল করল। অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলেন জুবায়ের আহমেদ। ববির কলটা পাওয়া মাএই উনি কলটা রিসিভ করে উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন,,
“ঐদিকে সব ঠিক আছে তো ববি?”
ববি কপাল ঘঁষে চোখ, মুখ কুঁচকে বলল,,
“সব ঠিক আছে আঙ্কেল। তবে রিফাত আপনার সাথে তর্ক করেছে। বিষয়টা আমি মোটে ও নিতে পারছি না।”
“শান্ত হও ববি। রিফাত আমার সাথে তেমন খারাপ ব্যবহার করতে পারে নি। আমার শ্বশুড়, শ্বাশুড়ী, সোনিয়া পাশে ছিলো তো তাই।”
ববি মাথা নিচু করে অনুতপ্ত স্বরে বলল,,
“আমার জন্য আপনাকে অনেক অপদস্ত হতে হলো আঙ্কেল। আ’ম সো স্যরি।”
“এসব তুমি কি বলছ ববি? লিলি এবং আমার জন্য উল্টে তুমি এবং তোমার ফ্যামিলি অপদস্ত হয়েছ। এলাকার লোকজনদের সামনে তোমার পরিবারের সম্মান হানি হয়েছে৷ খায়রুল ভাই এলাকার একজন সম্মানিত চেয়ারম্যান। আমাদের জন্য উনার কতো অসম্মান হলো বলো? স্যরি তো আমি তোমার কাছে চাইব ববি। তুমি কেনো চাইছ?”
“আসলে আঙ্কেল এখানে কারো দোষ ই নেই। এই যে একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা গুলো ঘটছে, সব আমাদের ভাগ্যে লিখা ছিলো। উপর ওয়ালা যা ভেবে রেখেছেন আমাদের সাথে ঠিক তাই হচ্ছে৷ আমরা চাইলে ও এসব অপ্রীতিকর ঘটনা এড়িয়ে যেতে পারব না। যা হওয়ার তা হবেই। তার মানে এই না যে, খারাপ সময় সর্বদা থাকবে৷ ভালো সময় নিশ্চয়ই আসবে৷ দুঃখের পরে স্বস্তি নিশ্চিত। আপনি অযথা টেনশান করবেন না আঙ্কেল। আগামীতে যা হবে ভালো হবে৷ তাই কেউ কারো কাছে ক্ষমা চাওয়ার ও কোনে প্রয়োজন নেই।”
“হ্যাঁ বাবা। তুমি একদম ঠিক বলেছ। এখন আল্লাহ্ই আমাদের একমাএ ভরসা। আল্লাহ্ যা করবেন নিশ্চয়ই সবার ভালোর জন্য করবেন। সত্যিই আগামীতে সব ভালো হবে।”
ববি জিগ্যাসু স্বরে জুবায়ের আহমেদকে বলল,,
“লিলির আব্বু, আম্মুর সাথে আপনার কোনো যোগাযোগ হয়েছে আঙ্কেল? মানে, উনারা কেমন আছে, কোন পরিস্থিতিতে আছে জানেন কিছু?”
“গতকাল রাতে কথা হয়েছিলো। ঝুলির শ্বশুড় বাড়িতে আছে ওরা। পরিস্থিতি শান্ত হলে নিজেদের বাড়ি ফিরে আসবে। লিলিকে বলে দিও দুঃশ্চিন্তা না করতে। লিলির মা-বাবা ভালো আছে।”
ববি একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলল,,
“থ্যাংকস গড। লিলি খুব টেনশান করছিলো!”
“পাগলী মেয়ে। টেনশান করতে বারণ করো।”
“বলছি আঙ্কেল।”
“তাহলে রাখছি ববি। অফিস টাইম পাড় হয়ে যাচ্ছে।”
ববি কলটা কাট করে অধীর আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লিলির কৌতুহলী চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“টেনশানের কিছু নেই। উনারা ভালো আছেন।”
লিলি চোখ জোড়া বুজে বুকে হাত দিয়ে দীর্ঘ একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলল,,
“থ্যাংকস গড।”
ববি ফোনটা বেডের উপর ছুড়ে মেরে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। লিলি বিছানা গুছিয়ে ওয়াশরুমের দরজার দিকে পা বাড়াতেই রুমের দরজায় টোকা পড়ল। ববি চেঁচিয়ে বলল,,
“কে?”
জিনিয়া আহমেদ দরজার ওপাশ থেকে বললেন,,
“ববি আমি জিনিয়া। তোমার মামানী। লিলিকে একটু কিচেন রুমে পাঠাও তো।”
ববি দরজাটা খুলে দিতেই জিনিয়া আহমেদ শান্ত স্বরে ববিকে বললেন,,
“লিলিকে এভাবে রুমে আটকে রেখে কোনো লাভ নেই ববি। রুম থেকে বের করো, সবার সাথে মিশতে বলো, সবার কাছাকাছি যেতে বলো, কথা বলতে বলো, সবার ভালো, মন্দের খেয়াল রাখতে বলো। তবেই না সবাই লিলিকে চিনতে পারবে, জানতে পারবে, লিলির মায়ায় পড়বে, আস্তে ধীরে লিলিকে মেনে নিবে।”
ববি আমতা আমতা করে বলল,,
“একচুয়েলি মামানী, একটু ভয় কাজ করে। তুমি তো জানোই লিলি খানিকটা বোকা স্বভাবের। যদি কোনো কারণে বাড়ির সবাই লিলির সাথে রেগে রুড বিহেভ করে? লিলির গাঁয়ে হাত তুলে? তাই আমি রিস্ক নিতে চাই না। তাছাড়া, আপু তো অলরেডি লিলির গাঁয়ে হাত ও তুলেছে। আম্মু ও যদি রেগে লিলির গাঁয়ে হাত তুলে?”
“সাহেরাকে আমি চিনি ববি। সাহেরা হাজার কটু কথা বললে ও লিলির গাঁয়ে হাত তুলবে না। বুদ্ধি, বিবেক, বিবেচনা সবই আছে সাহেরার। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। আর হেমা যা করেছে এর জন্য সাহেরা হেমাকে খুব বকেছে। অনেক ধমকিয়েছে। আশা করছি, পরবর্তীতে হেমা এমন ভুল করবে না।”
ববি ম্লান হেসে বলল,,
“সিরিয়াসলি মামানী? আম্মু আপুকে বকেছে?”
“হুম। খুব বকেছে। এখনো রুমে বকছে।”
জিনিয়া আহমেদ প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললেন,,
“দেরি না করে লিলিকে দ্রুত কিচেন রুমে পাঠাও। আমি এবং লিলি মিলে সকালের ব্রেকফাস্টটা বানিয়ে নেই। হেমা একটু পরেই শ্বশুড় বাড়ি চলে যাবে। মেয়েটাকে তো খেয়ে যেতে হবে।”
“লিলি আসছে মামানী। তুমি যাও।”
জিনিয়া আহমেদ প্রস্থান নিলেন। ববি রুমের দরজাটা ভেজিয়ে ম্লান হেসে লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আম্মু আপুকে বকেছে, তোমার গাঁয়ে হাত তুলাতে।”
“হুম। আপনার আম্মু আমার সামনেই আপনার আপুকে বকেছে।”
ববি হঠাৎ ভীষণ রেগে লিলির হাত চেঁপে ধরে বলল,,
“আপনার আম্মু, আপনার আপু কি এসব? উনারা কিছু হয় না তোমার?”
লিলি শুকনো ঢোক গিলে বলল,,
“হয় তো। উনারা আমার শ্বাশুড়ী মা এবং ননশ হয়।”
“আমার আম্মুকে তুমি ও আম্মু বলে ডাকবে। আর আপুকে আপু বলে ডাকবে। মনে থাকবে?”
লিলি ভয়ার্ত চোখে মাথা নাড়িয়ে বলল,,
“হুম। মনে থাকবে।”
ববি সামনের চুল গুলো হালকা টেনে ক্ষীণ স্বরে বলল,,
“হুম। কিচেন রুমে যাও। মামানীকে হেল্প করো।”
ববিকে পাশ কাটিয়ে লিলি রুম থেকে প্রস্থান নিতেই ববি পেছন থেকে লিলির হাতটা টেনে ধরে বলল,,
“এদিকে এসো।”
লিলি মাথা নিচু করে ববির মুখোমুখি দাঁড়ালো৷ লিলির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে ববি তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,,
“শাড়িটা ও পড়তে পারো না? কুচির জায়গাটা কুচকে আছে কেনো? আর আঁচলের কাপড়টা এতো কম কেনো?”
লিলি চোখ উঠিয়ে আমতা আমতা করে বলল,,
“কাপড়টা বেশি বড় তো। তাই ঠিকভাবে পড়তে পারি নি।”
ববি তিক্ততা নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে লিলির কাপড়ের কুচিতে হাত দিতেই লিলি পিছু হটে কপাল কুঁচকে বলল,,
“ছিঃ ববি! আপনি আমার কাপড়ে হাত দিচ্ছেন কেনো? পায়ে ও তো হাত লাগবে। প্লিজ এটা করবেন না। আমার পায়ে টাচ করবেন না।”
ববি চোখ লাল করে চোয়াল শক্ত করে বলল,,
“এদিকে এসো বলছি।”
লিলি জেদ দেখিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ববি বসা থেকে উঠে লিলির ডান হাতটা চেঁপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,,
“আমার কথা গাঁয়ে লাগে না না?”
লিলি কাতর চোখে ববির দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আপনি আমার পায়ে টাচ করবেন না প্লিজ ববি। স্বামীরা স্ত্রীর পায়ে টাচ করে না।”
“কোন হাদিসে পেয়েছ এই ভ্রান্ত নিয়ম? স্বামীরা ভালোবেসে অফকোর্স ওয়াইফের পায়ে টাচ করতে পারে। আর আমি তো ডিরেক্টলি তোমার পায়ে টাচ করছি না। জাস্ট শাড়িটা ঠিক করে দিচ্ছি।”
“তবু ও।”
“জাস্ট শাট আপ। শাট আপ স্টুপিট গার্ল। জায়গা থেকে যদি এক পা ও নড়ো তো দেখবে ববি তোমার কতোটা ভয়ঙ্কর অবস্থা করে।”
লিলির হাতটা ছেড়ে ববি খুব নিঁখুতভাবে লিলির কাপড়ের কুঁচিগুলো উঠিয়ে দিলো। লিলি আশ্চর্যিত চোখে ববির দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আপনি কুচি উঠাতে পারেন ববি?”
“হুম৷ মাঝে মাঝে আম্মুর কাপড়ের কুঁচি উঠিয়ে দিতাম।”
আচমকা ববি বাঁকা হেসে লিলির ডান পায়ের পাতায় দীর্ঘ একটা চুমো এঁকে দিলো। লিলি তাড়াহুড়ো করে ববিকে উপেক্ষা করে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। ববি হু হা করে হেসে বেডে গাঁ এলিয়ে দিলো। কিছুক্ষনের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে লিলি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ববির দিকে না তাকিয়েই রুম থেকে বের হতেই ববি ফট করে চোখ জোড়া খুলে লিলিকে পেছন থেকে ডেকে বলল,,
“চুলটা আঁচড়ে যাও লিলি। একটু সেজে গুজে থাকতে পারো তো নাকি? তোমাকে এই অগোছালো অবস্থায় দেখলে বাড়ির লোকরা কি ভাববে?”
মুখটা কালো করে লিলি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ববির প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আমার সাজ গোজ এতো পছন্দ না। নরমাল থাকতেই আমি পছন্দ করি।”
“আমি তো তোমাকে আহামরি সাজতে বলি নি। জাস্ট বলেছি চুলটা সেট করে যেতে।”
“ঐটাই, পারব না।”
ববি শোয়া থেকে উঠে তেড়ে এসে লিলির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,
“পারবেটা কি? কি পারবে তুমি?”
লিলি মাথা নিচু করে বলল,,
“কিচ্ছু পারব না। আমি এভাবেই কিচেনে যাবো।”
ববি চিরুনিটা হাতে নিতেই লিলি এক ভ্রু উঁচু করে বলল,,
“কি করতে চাইছেন আপনি?”
“বি কোয়াইট৷ দেখো কি করছি।”
লিলিকে পেছনের দিকে ঘুড়িয়ে ববি লিলির চুলের ভাজে চিরুনি ডুবিয়ে দিলো। লিলি মুখে হাত দিয়ে অতি আশ্চর্যিত হয়ে বলল,,
“ববি আপনি আমার চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন?”
“হ্যাঁ দিচ্ছি৷ সো হোয়াট?”
“আপনি পারবেন খোঁপা করে দিতে?”
“ট্রাই তো করতেই পারি।”
লিলি মুখ চেঁপে হাসল। ববি চুলটা ভালো করে আঁচড়ে অনেক চেষ্টার পর ও ঘুড়িয়ে পেঁচিয়ে খোঁপাটা বাঁধতে পারছে না। কপাল কুঁচকে ববি চোখে, মুখে তুখার বিরক্তি নিয়ে চেষ্টা করেই চলছে। লিলি এক ধ্যানে ববির প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছে। আনমনে লিলির চোখের কোণে এক ফোঁটা জল জমে এলো। ববির এতো কেয়ার, পজেটিভনেস, ভালোবাসা, ভালো রাখা সমস্তটা লিলির কাছে নীলচে কোনো স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। গলা ছেড়ে তার গাইতে ইচ্ছে করছে,,
“কেচে মুঝে তুম মিল গায়ি!
কিচমাত পে আয়ি না একিন!”
উতার আয়ি ঝিলমে,
জেচে চান্দ উতারতা হে কাবি
হলে হলে, ধিরে চে!”
ববি রীতিমতো ডিসপারেড হয়ে উঠেছে। কিছুতেই খোঁপাটা বাঁধতে পারছে না। বার বার চুল গুলো খোঁপা থেকে খসে পড়ছে। চোখের কোণে জমে থাকা জলটা মুছে লিলি মৃদ্যু হেসে ববির হাত থেকে চিরুনিটা কেড়ে নিয়ে চুলটা আবার আঁচড়ে চুলটা গুটিয়ে খোঁপা করে ববির দিকে তাকিয়ে বলল,,
“এসব আপনার দ্বারা হবে না বুঝেছেন?”
ববি অন্য পাশ ফিরে বলল,,
“একদিন ঠিক হবে ওকে? আজ পারি নি তো কি হয়েছে? ফিউচারে ঠিক পারব।”
লিলি আচমকা ববির নাক টেনে বলল,,
“ওকে। দেখা যাবে।”
ববি মোহনীয় দৃষ্টিতে লিলির দিকে তাকিয়ে আচমকা লিলি ঘাঁড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো। সমস্ত শরীর জুড়ে লিলির অদ্ভুত শিহরণের সৃষ্টি হলো। বুকটা ধুকপুক করে কাঁপতে আরম্ভ করল। ঘটনার আকস্মিকতায় লিলি পরম আবেশে চোখ জোড়া বুজে নিলো। নিজেকে সংযত করতে না পেরে ববি হঠাৎ লিলির কোমড় আঁকড়ে ধরে লিলিকে তার শরীরের সাথে এডজাস্ট করে নিলো। লিলি চোখ জোড়া প্রকান্ড করে ববির দিতে তাকাতেই ববি লিলির ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরল। লিলি হাজার ঠেলে ও ববিকে ছাড়াতে পারছে না। অস্বস্তিতে লিলির পুরো শরীর কাঁপছে। ঠোঁট নেড়ে সে কথা ও বলতে পারছে না। তার অস্থিরতার কথা ববিকে বলতে পারছে না। উত্তেজনায় ববি ক্রমশ তীব্রভাবে লিলিকে আঁকড়ে ধরছে। শেষ পর্যন্ত ববির শক্তির সাথে না পেরে লিলি চোখের জল ছেড়ে কান্না জুড়ে দিলো। লিলির হেচকি তুলার আওয়াজে ববির ঘোর কাটল। তড়িঘড়ি করে ববি লিলিকে ছেড়ে অপরাধবোধ নিয়ে লিলির দিকে তাকালো। লিলি মাথা নিচু করে চোখের জল ছাড়ছে। ববি লিলির চোখর জল গুলো মুছে দিয়ে অনুতপ্ত স্বরে লিলির দিকে ঝুঁকে বলল,,
“আ’ম স্যরি লিলি। সো স্যরি। একচুয়েলি আমি বুঝতে পারি নি হঠাৎ এই ভুলটা হয়ে যাবে।”
ববিকে ছেড়ে লিলি দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ববি কপাল চাঁপড়াতে চাঁপড়াতে বেডের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে বিড়বিড় করে বলল,,
“ধ্যাত। ঝোঁকের বসে কি করে বসলাম আমি? এই গম্ভাট মেয়েটা তো আমাকে এখন ভুল বুঝবে! হয়তো আমার থেকে দূরে দূরে থাকবে। উফফ কেনো যে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না।”
লিলি কিচেনে জিনিয়া আহমেদের সাথে হাতে হাত লাগিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরী করছে। লিলি পরোটা বেলে দিচ্ছে আর জিনিয়া আহমেদ তেলে ভাঁজছে। লিলির বিষন্ন মন দেখে জিনিয়া আহমেদ কৌতুহলী হয়ে বললেন,,
“কি হয়েছে লিলি? তোমার মন খারাপ?”
লিলি জোরপূর্বক হেসে বলল,,
“না মামানী।”
জিনিয়া আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,,
“আমি জানি তোমার মন খারাপ। সকালের বিষয়টা নিয়ে এখনো মন খারাপ করে আছো।”
“না মামানী। সকালের বিষয়টা তো আমি অনেক আগেই ভুলে গেছি। আপনি ভুল বুঝছেন। আমার মন ভালোই আছে।”
জিনিয়া আহমেদ হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে লিলির দিকে তাকিয়ে বললেন,,
“তোমাকে একটা কথা বলি লিলি? সাংসারিক সব বিষয় ববিকে জানাতে যেও না। সংসারের অনেক খুঁটি নাটি ব্যাপার আছে, যা নিজের মধ্যে রেখেই সংসারে শান্তি বজায় রাখতে হয়। কোনো ঝামেলা ছাড়াই সংসারকে আগলে রাখতে হয়।”
“চড়ের ব্যাপারটা আমি ববিকে বলতে চাই নি মামানী। ববি জোর করাতে আমি মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছি।”
“ঠিকাছে৷ কিন্তু, পরবর্তীতে এসব বিষয় নিয়ে একটু সতর্ক থাকবে। জানোই তো ববি অনেক রাগী। তোমার মুখ থেকে বেফাঁস কোনো কথা বের হয়ে গেলেই ববি ক্ষুব্ধ হয়ে কি না কি করে বসবে। তখন বাঁধবে আরেক অশান্তি। বাড়ির লোকরা তোমাদের উপর এমনিতেই খুব ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। আর একটু লেশ পেলেই বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে যাবে। সাংসারিক এই বিষয় গুলো তোমাকে বুঝে চলতে হবে।”
লিলি ম্লান হেসে বলল,,
“ঠিকাছে মামানী। নেক্সট টাইম আমি যথেষ্ট সর্তক থাকব। আপনি অহেতুক চিন্তা করবেন না।”
জিনিয়া আহমেদ মলিন হাসলেন। ব্রেকফাস্ট তৈরী করে লিলি এবং জিনিয়া আহমেদ ডাইনিং টেবিলে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করে দিলেন। একে একে সবাইকে জিনিয়া আহমেদ ডাইনিং টেবিলে ডেকে দিলেন। তন্মধ্যে ববি মিসিং। রুমের দরজা আটকানো বলে লিলি এখনো রুমে যায় নি। খায়রুল আহমেদ, সাহেরা খাতুন, হেমা খড়তড় দৃষ্টিতে লিলির দিকে তাকিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলেন। লিলি মাথা নিচু করে জিনিয়া আহমেদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তুলে সবার দিকে তাকাতে কুন্ঠাবোধ করছে। হেমা ওমলেট মুখে দিয়ে জিনিয়া আহমেদের দিকে তাকিয়ে রূঢ় স্বরে বলল,,
“মামানী৷ ঐ মেয়েটাকে এখান থেকে যেতে বলো। আমি বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরই যেনো মেয়েটা এখানে আসে।”
জিনিয়া আহমেদ উঁচু আওয়াজে বললেন,,
“হেমা। তোমার ব্যবহার সংযত করো। মেয়ে মেয়ে করে তুমি কাকে সম্বোধন করছ? মেয়েটা তোমার ছোট ভাইয়ের বউ হয়। নাম আছে ওর। নাম ধরে ডাকবে।”
“মামানী প্লিজ। তুমি অন্তত এই মেয়ের হয়ে কথা বলতে এসো না। ববির মতো তুমি ও এই মেয়েটার সাফাই দিও না।”
জিনিয়া আহমেদ রাগী স্বরে কিছুর বলার পূর্বেই লিলি জিনিয়া আহমেদকে থামিয়ে হেমার দিকে তাকিয়ে ছোট আওয়াজে বলল,,
“আপু আপনি শান্ত হউন। আমি চলে যাচ্ছি এখান থেকে। দয়া করে আপনি শান্ত হয়ে খাবারটা শেষ করুন।”
“এই? তুমি কাকে আপু ডাকছ হুম? কাকে আপু ডাকছ?”
“আপনি আমার হাজবেন্ডের বড় আপু হোন। সম্পর্কে আপনি ও আমার আপু।”
হেমা চেঁচিয়ে কিছু বলার পূর্বে খায়রুল আহমেদ হেমাকে থামিয়ে বললেন,,
“হেমা প্লিজ চুপ করো। মেয়েটার সাথে এতো কথা বাড়ানোর কি আছে? কে হয় মেয়েটা আমাদের? জাস্ট নাথিং।”
লিলি মাথা নিচু করে রুমে চলে এলো। চোখের কোণে জমে থাকা জল গুলো মুছে লিলি বেডে নীরবে ঘুমিয়ে থাকা ববির দিকে তাকালো। ববির পাশে চুপ করে বসে লিলি আনমনেই ববির চুলে হাত বুলিয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে ববির দিকে তাকালো। লিলির হাতের স্পর্শ পেয়ে ববি চোখ খুলে তাকালো। পিটপিট চোখে ববি লিলিকে দেখা মাএই লিলিকে হেচকা টান দিয়ে তার বুকের সাথে মিশিয়ে ঘুম জড়ানো স্বরে বলল,,
“স্যরি পুতুল বউ। এক্সট্রেমলি স্যরি।”
লিলি ববির বুকের সাথে মিশে আস্তে করে বলল,,
“স্যরি কেনো?”
“একটু আগে যা হলো তার জন্য আ’ম স্যরি। প্লিজ আমার উপর রাগ করে থেকো না।”
লিলি প্রসঙ্গ পাল্টে ছোট আওয়াজে বলল,,
“ব্রেকফাস্ট টেবিলে চলুন। সবাই আপনার জন্য ওয়েট করছে।”
“কথা ঘুড়াচ্ছ, না?”.
” না তো!”
“মিথ্যে বলছ। আই নো তুমি রাগ করেছ।”
“করি নি। বললাম তো।”
“সিউর?”
“হুম সিউর।”
ববি বাঁকা হেসে বলল,,
“তাহলে আরেকটু আদর করি?”
“উফফ। বললাম তো। ডাইনিং টেবিলে সবাই আপনাকে ডাকছে।”
ববি লিলির মাথায় চুমো খেয়ে বলল,,
“তুমি খেয়েছ?”
“পরে খাবো।”
“পরে কেনো? এখনি চলো।”
“আমার এখন ক্ষিদে নেই। আপনি যান। খেয়ে আসুন।”
“ওকে ফাইন। পরে আমরা দুজন একসাথে খেয়ে নিবো।”
ববি হঠাৎ কপাল কুঁচকে লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আই হেভ এ্যা লিটল ডাউট।”
“কি?”
“আজ হঠাৎ তুমি নিজ থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরলে কেনো?”
লিলি তাড়াহুড়ো করে ববিকে ছাড়তেই ববি আরো টাইট করে লিলিকে জড়িয়ে ধরে বলল,,
“প্লিজ মোডটা নষ্ট করো না। যেভাবে আছো সেভাবেই থাকো। খুব শান্তি লাগছে।”
লিলি নিশ্চুপ হয়ে গেলো। ববির বুকে মাথা রেখে দু ফোঁটা চোখের জল ছাড়ল। ববি এখনো লিলির মন খারাপের বিষয়টা আঁচ করতে পারে নি। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই লিলিকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। কিছু মুহূর্ত পর ববি আচমকা শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,,
“লিলি৷ তোমার কি একটু ও শিহরণ হচ্ছে না?”
লিলি মুখটা কালো করে বলল,,
“না!”
“সিরিয়াসলি?”
“হুম।”
“কিন্তু আমার তো খুব শিহরণ হচ্ছে।”
“ধ্যাত ছাড়ুন। বিরক্ত লাগছে আমার।”
ববি ক্ষুব্ধ হয়ে লিলির থুতনী চেঁপে ধরে লিলির ঠোঁটে দীর্ঘ একটা চুমো খেয়ে বলল,,
“রোমান্সের “র” ও তো জানো না। গম্ভাট একটা।”
লিলির থুতনীটা ছেড়ে ববি শোয়া থেকে উঠতে নিলেই পিছন থেকে লিলি তীক্ষ্ণ স্বরে ববিকে ডেকে বলল,,
“আপনি তো খুব রোমান্স জানেন তাই না? তাহলে একেবারেই আমাকে কেনো নিজের করে নিচ্ছেন না? কেনো জোর করছেন না? জোর খাটিয়ে কেনো আপনার অধিকার আদায় করে নিচ্ছেন না? কোথায় এতো সংশয় আপনার?”
ববি পিছু ফিরে তেড়ে এসে লিলির দিকে তাকিয়ে বলল,,
“সময় হলে ঠিক নিবো। জোর করে আমি তোমাকে নিজের করতে চাই না। স্ব-ইচ্ছায় তুমি আমার কাছে ধরা দিবে। আর আমি সে দিনটার অপেক্ষায়ই থাকব।”
নিজের রাগ কন্ট্রোল করে ববি লিলির হাত ধরে ড্রইং রুমে চলে এলো৷ হেমা রেডি হয়ে শ্বশুড় বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে সদর দরজা পাড় হচ্ছে। ববি এবং লিলিকে দেখা মাএই হেমা বেশ রাগান্বিত হয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি থেকে প্রস্থান নিলো। ববি অনেক ডেকে ও হেমাকে থামাতে পারল না। ববির কোনো কথাই হেমা শুনল না। সাহেরা খাতুন সদর দরজাটা লাগিয়ে আড়চোখে ববির দিকে তাকিয়ে বললেন,,
“ডেকে লাভ নেই ওকে। ব্রেকফাস্টটা করে নে তোর বউকে নিয়ে। এগারোটা বাজছে।”
ববি কিছু বলার পূর্বেই লিলি ম্লান হেসে সাহেরা খাতুনকে বলল,,
“আম্মু। আপনি খেয়েছেন?”
সাহেরা খাতুন শান্ত চোখে একবার লিলির দিকে তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে চোখ নামিয়ে নিজের রুমের দিকে এগুচ্ছেন আর ছোট আওয়াজে বলছেন,,
“খেয়েছি।”
লিলি মৃদ্যু হেসে সাহেরা খাতুনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। ববি ফিসফিসিয়ে লিলির কানে বলল,,
“থ্যাংকস লিলি।”
জিনিয়া আহমেদ সহ লিলি এবং ববি সকালের ব্রেকফাস্ট করে নিলো। জিনিয়া আহমেদের সাথে হাতে হাত লাগিয়ে লিলি দুপুরের রান্নার যোগাড় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
,
,
মাঝখানে কেটে গেলো দীর্ঘ ২৫ দিন। লিলি একটু একটু করে ববির কাছাকাছি আসছে৷ সবকিছুতে ববির খুব খেয়াল রাখছে।
#চলবে….?