প্রার্থনায়_তুমি #পর্ব-০৭

#প্রার্থনায়_তুমি
#পর্ব-০৭
#Tahmina_Akther

৭.

পৃথিবীর সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো সূর্যোদয়।
আকাশের কালো বর্ন মুছে গিয়ে যখন ধীরে ধীরে সারা ভূবনে আলোয়ে ভরিয়ে দেয় সূর্যের আগমনে। চারপাশে পাখিদের কলরব শুনতে বেশ ভালো লাগে। সকালের বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিলে অন্তরখানি শান্তিতে জুড়িয়ে যায়।

অরুণিমার নিত্যদিনের অভ্যেস ভোরে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে ছাঁদে চলে আসা এবং ততক্ষণ অব্দি অপেক্ষা করবে যতক্ষণ না সূর্য মামার দেখা পাওয়া যায়।

নিচ থেকে আয়মানের ডাক শুনতে পেয়ে তড়িঘড়ি ছাঁদ থেকে নেমে এলো অরুণিমা। রুমে গিয়ে দেখতে পেলো আয়মান কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।
অরুণিমা রাগী ভাব নিয়ে এগিয়ে গিয়ে আয়মানের গায়ের কাঁথা টান দিয়ে সরিয়ে ফেললো।এরপর, আয়মানকে উদ্দেশ্য করে জোর গলায় বলল,

– তুমি জানো না, প্রভাতের প্রথম সময়ে আমার ছাঁদে থাকতে ভালো লাগে। তারপরও, কেন প্রতিদিন এভাবে ডেকে নিয়ে এসো আমাকে,বলো তো?আমাকে ডেকে আবার কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর ভান ধরে আছো কেন? কি চাই তোমার?

আয়মান অরুণিমার কথাগুলো শোনার পর চোখ খুলে তাকালো,দেখলো অরুণিমা ওর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আয়মান অরুণিমার হাত ধরে খাটের কিনারায় টেনে বসিয়ে দিলো। অরুণিমার উরুতে মাথা রেখে শুয়ে ওর হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বললো,

– তুমি না আমার একটা কথাও শুনো না। এই যে প্রতিদিন রাতে তোমাকে ঘুমানোর আগে বলি,তোমাকে সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠলে যেন তোমাকে দেখতে পাই। কিন্তু, না তুমি কি করো প্রতিদিন আমি ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই তুমি চলে যাও ছাঁদে। এমনিতেই সারাদিন তোমাকে দেখতে পাই না। ভেবেছি সকালবেলা মিষ্টি বৌটার মুখখানা দেখে জেগে উঠবো;কিন্তু, তা আর হলো কই?

কথাগুলো বলেই অরুণিমার কোমরে মুখ গুঁজে পরে রইল আয়মান।অরুণিমা ওর রাগের ভান ভেঙে দিয়ে ওর প্রাণপল্লভের চুল গুলো এলোমেলো করে আবারও গুছিয়ে দিচ্ছে।

কিছু সময় অতিক্রম হবার পর অরুণিমা আয়মানকে অফিসে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিতে লাগলো। আয়মানকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়ে অরুণিমা চলে এলো রান্নাঘরে। একে একে সব রান্না শেষ করে সব টেবিলে সাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো আয়মানের জন্য।

আধঘন্টা বাদে আয়মান এসে দেখতে পেলো ওর গিন্নি টেবিলে বসে আছে খাবার নিয়ে নিশ্চয়ই তারই অপেক্ষায় বসে আছে। আয়মান চেয়ার টেনে বসে পড়লো অরুণিমার পাশের চেয়ারটায়।অরুণিমা, আয়মানকে চেয়ারে বসতে দেখে প্লেটে নাশতা সাজিয়ে এগিয়ে দিলো আয়মানের । এবার অরুণিমা প্লেটে নাশতা নিয়ে খেতে শুরু করেছে।

আয়মান খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ওর বৌ টাকে দেখছিলো।নাকে ছোট নাকফুল,হাতে চিকন স্বর্ণের চুরি, চুলগুলো হাত খোপা করা, কপালের উপর কিছু জুলফি এলোমেলো হয়ে পরে আছে,পরনে মেরুন কালারের সুতি শাড়ি। ব্যস এতটুকুতেই ওর বৌটাকে বেশ চমৎকার লাগছে।

আয়মান অরুণিমার দিকে মনে মনে বলছে,

-তোমাকে পাবার আশা কবেই ছেড়ে দিয়েছিলাম, হয়তো বিধাতা চেয়েছেন বলেই মা আমাদের এক করে দিয়ে গেলেন।

– কি ভাবছেন আপনি খাওয়া বাদ দিয়ে? ক’টা বাজে খেয়াল আছে তারাতাড়ি খাবার খেয়ে শেষ করুন।

অরুনিমার কথা শুনে আয়মান সোজা হয়ে বসে বললো,

– বৌ তোমাকে যখন দেখি তখন কি সময়ের জ্ঞান থাকে বলো?

– আচ্ছা আমার কি নাম নেই! কেন বারবার বৌ বৌ বলে ডাকেন?

– তুমি তো আয়মান না, তুমি হচ্ছো অরুণিমা। তাহলে, আমি যে কেন তোমাকে বৌ বলে ডাকি, তুমি কি করে বুঝবে ? আচ্ছা, বৌ তুমি আজ যাবে না আর্ট সেন্টারে?

– না, আজ ভালো লাগছে না যেতে। রাতে কি সব স্বপ্ন দেখি জেগে গেলেও শরীরের মাঝে স্বপ্নের রেশ থেকেই যায়।

– আচ্ছা,একদিন সময় করে আরিফের সঙ্গে দেখা করে এসো, ঠিক আছে। আমি আসছি; আল্লাহ হাফেজ, আমার মিষ্টি বৌ। বলেই অরুণিমার ঘর্মাক্ত কপালে চুমু দিয়ে এলোমেলো ছোট চুল গুলো কানের পাশে গুজে দিয়ে বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশ্য বের হয়ে গেলো আয়মান।

অরুণিমা আয়মানকে হেসে বিদায় জানিয়ে বাকি কাজগুলো শেষ করে হালকা বিশ্রাম করার জন্য রুমে গিয় শুয়ে পড়লো।

অরুণিমা ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারছে না। মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ওর ঘুম ভেঙে গেলো। মোবাইল হাতে নিয়ে চেক করতেই দেখতে পেলো আননোন নাম্বার। কল রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে শুনতে পেলো ভয়াবহ এক দুর্ঘটনার খবর। অরুণিমা কোনো ভাবে গায়ে বোরকা জরিয়ে বের হয়ে পড়লো গাড়ি নিয়ে, উদ্দেশ্য হাসপাতাল।

****************

তীব্র বেগে ছুটে চলেছে বাস। জানালার বাইরে তাকালেই দেখা যাচ্ছে সবুজে ঘেরা পাহাড়। রাস্তার পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো উল্টো দিকে চলে যাচ্ছে।ঠিক আমাদের জীবনের মতো। আমরা ঠিক যতটুকু সামনে এগিয়ে চলতে থাকি ঠিক ততটাই পেছনে ফেলে আসি।

অংকন সেদিন বাড়ি থেকে চলে যাবার সপ্তাহখানিক পরে নিশুকে কল দিয়ে গাড়ির মালিকের সন্ধান পেয়েছে বলে জানায়। রোকেয়া মির্জা নামের এক নারীর নামে গাড়ি রেজিষ্ট্রেশন করা।গাড়িটি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনের আর সেই
নারীর বাড়িও চট্টগ্রামে।অংকন সব তথ্যগুলো ইমেইল করে পাঠিয়ে দেয় নিশুর কাছে। তাই নিশু আর দেরি না করে রওনা দেয় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য।

বাসে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে নিশু, মনোরম দৃশ্য গলো দেখছে আর ভাবছে,

– যেই ঠিকানা দেয়া আছে সেই ঠিকানায় যাওয়ার পর দেখা পাবে তো মায়ার?নাকি মায়া সেদিনই দুনিয়ায় পাঠ চুকিয়ে চলে গিয়েছিলো পরপারে।
ধ্যাত, নিশু তুই এসব কি ভাবছিস? মায়ার কিছু হতে পারে না বি পজিটিভ ।
নিশু নিজেই নিজের মনকে কঠিন ধমক দিয়ে বোঝালো।

ঘন্টাখানিক সময় অতিক্রম হবার পর গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যায় নিশু। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে নেমে পড়ে বাস থেকে। একটা সিএনজি নিয়ে রওনা হয় ওর ছোট মামার বাড়ির উদ্দেশ্য। নিশুর ছোট মামা চাকরিসূত্রে চট্টগ্রামে থাকে স্বপরিবার নিয়ে।নিশুর মামাতো ভাই জিজ্ঞেস করেছিলো,নিশুকে বাস স্ট্যান্ড থেকে পিক করতে আসবে, কি না?কিন্তু, নিশু মানা করে দেয় এই বলে যে, ও মেনেজ করতে পারবে।

কিন্তু, পথিমধ্যে অঘটন ঘটিয়ে ফেললো সিএনজি চালক। সে একটি বাইককে পিছন থেকে ধাক্কা মেরে দেয়। বাইকের আরোহীর বেশ ভালো রকমের ইনজুরি হয়। মাথা ফেটে প্রচুর রক্ত পরছিলো হয়তো ডানহাতেও ব্যাথা পেয়েছে।নিশু বাইকের সেই আরোহীকে সিএনজিতে উঠিয়ে কাছের এক হসপিটালে নিয়ে যায়।

অপর দিকে
____________

অরুণিমা তারাতারি হসপিটালের সামনে গাড়ি থামিয়ে, কল করে সেই আননোন নাম্বারটিতে। অপরপাশে কল রিসিভ হতেই জানায়, কেবিন নং ৩০ চলে আসতে। অরুণিমা তড়িঘড়ি করে সেদিকে চলল।

অরুণিমার ভয়ে মনটা এটুকু হয়ে আছে। কাঙ্ক্ষিত কেবিনের সামনে এসে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো। আয়মানের মাথায় ব্যান্ডেজ করা, হাতে প্লাষ্টার করানো, ঠোঁটের একপাশে রক্ত জমে গিয়ে কালসিটে হয় আছে।

অরুণিমা এগিয়ে গেলো আয়মান কাছে। ধীরপায়ে আয়মানের বেডের পাশে রাখা টুলে বসে পরলো। অরুণিমার চোখদুটোতে জলেরা ভিড় জমাচ্ছে। ডানহাতটি এগিয়ে স্পর্শ করলো আয়মানের মাথায় ব্যান্ডেজ করা অংশটিতে।আয়মান ব্যাথার যন্ত্রনায় কুকিয়ে উঠলো।অরুণিমা ওর হাতটি পেছয়ে নিয়ে বললো,

– প্রতিদিন অফিসে কার নিয়ে যাও, তাহলে আজ কেন বাইক নিয়ে বের হলে?দেখলে তো কি হয়েছে?আমার তো জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো, যখন কল করে তোমার এক্সিডেন্টের কথা আমাকে বলেছে। কিভাবে হলো এইসব?

– আসলে, চালক মামার কোনো দোষ নেই। আমি ব্যালেন্স রাখতে না পেরে একটু একপাশে কাত হয়ে গিয়েছিলাম আর ওমনি মামার সিএনজি এসে পেছন থেকে ধাক্কা দিলো।এখানে আমাদের কারোই গাফিলতি নেই। জাস্ট, একটু ভুলের কারণেই এমনটা হয়েছে।

– তোমাকে কে নিয়ে এসেছে এখানে? আর, আমাকে কল করে কে বলল, তোমার এক্সিডেন্টের কথা?

– চালক মামাকে আমি তোমার নাম্বার দিয়েছিলাম। আসলে, ভেবেছিলাম কি যদি আমি মরে টরে যাই তাহলে তো তুমি আমার খোঁজ পাবে না। ওনাকে তোমার নাম্বার দিয়ে বলে ছিলাম, তোমার কাছে কল করে আমার কি অবস্থা এই সংবাদটুকু জানাতে?

এরই মাঝে কেউ একজন আমাদের কেবিনে প্রবেশ করে। ভেতরে এসে আয়মানের ঔষধপত্র কখন কোনটা খেতে হবে বুঝিয়ে দেয় আর বলে হসপিটালের বিল নাকি উনি পরিশোধ করে দিয়েছেন। আয়মান উনার সাথে রাগ দেখাচ্ছেন কেন হসপিটালের বিল এবং ঔষধ আনতে গেলেন। ভদ্রলোকটি বললেন,

– আমি সেই সিএনজির যাত্রী ছিলাম আর চালকের দোষে যেহেতু হয়েছে তাই আমি দিলাম। আমি এইসব আপনাকে বন্ধু ভেবেই দিয়েছি।
আপনি ঠিক একঘন্টা পর বাড়িতে চলে যেতে পারবেন। আমি তাহলে আসি আল্লাহ চাইলে পরে দেখা হবে।

– আচ্ছা, আপনার নাম কি? এবং আপনার মোবাইল নাম্বারটা যদি দিতেন?

– আমার নাম ইশফাক রহমান নিশু। ছোট করে সবাই নিশু বলেই ডাকে। আর এই যে আমার কার্ড এখানে আমার নাম্বার আছে। আসছি তাহলে, খেয়াল রাখবেন নিজের প্রতি। আরও একবার দুঃখিত আয়মান সাহবে।

– দুঃখিত বলার প্রয়োজন নেই, মি. নিশু। আবার দেখা হবে আল্লাহ হাফেজ।

নিশু নামটা মনে হচ্ছে কোথাও শুনেছি তাও বহুবার। এতক্ষণ নিচে তাকিয়ে তাদের কথাগুলো শুনছিলো অরুণিমা। চলে যাবে কথাটি শুনার পর মাথা উঁচু করতেই অরুণিমা দেখতে পেলো, পরিচিত একটি মুখ। সেই স্কেইচের মুখটা,দুদিন আগে আয়মানকে দেখিয়ে ছিল,অরুণিমা।

অরুণিমা মনে মনে ভাবছে

-তবে কি উনার সাথে আমার পূর্বপরিচিতি আছে?

আমি উঠে নিশু সাহেবের পিছু যেতে চাইলাম কিন্তু আয়মান আমার হাত ধরে আটকে ফেললো।
আমি আবার ও বসে পরলাম।এবার, আয়মান আমাকে জিজ্ঞাসা করছে,

– কি হয়েছে অরুণিমা? হঠাৎ, এভাবে উঠে কোথায় যাচ্ছো?

– আরে নিশু সাহেবের চেহারা তুমি দেখোনি? উনার সাথেই তো আমার করা স্কেইচের চেহারার সাথে মিলে যায়। আমি নিশ্চিত উনার সাথে যোগাযোগ করলে আমি হয়তো আমার পুরনো সব,আমার পরিবার, সবকিছু ফিরে পাবো। তাছাড়া, আমার তো নিকাবে মুখ ঢাকা তাই হয়তো আমাকে চিনতে পারেনি?

– তাই তো, আমারও বারবার মনে হচ্ছিল উনাকে কোথাও যেন দেখেছি। তবে নিশ্চিত হতে পারছি না যতক্ষন না উনার সাথে এই ব্যাপারে আলাপ করতে পারছি। আগে বাড়িতে যাই তারপর নাহয় উনার সাথে যোগাযোগ করবো। তুমি চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।

অরুণিমাকে এইসব বলে সান্ত্বনা দিলেও আয়মান ভিতরে ভিতরে কিছু হারানো শঙ্কায় ব্যাথায় বারবার কুকিয়ে যাচ্ছিলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here