#ভালোবাসা_ফিরে_আসে,পর্ব ৫
লেখা : মান্নাত মিম
লিলির জন্য প্রস্তাব আসছে বিয়ের। তাতে অবশ্য লিলির কোন ভাবগতির পরিবর্তন হয় না, যেমনটা অন্যসব মেয়েদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। কারণ একে তো মেয়ে হয়ে জন্ম তার, উপরন্তু বাবা নেই মাথায় ছায়া দেয়ার জন্য। সে বুঝে বাবাবিহীন জীবনের কতটুকুই বা অগ্রগতি হয়। আর মা’য়ের ওপরে বোঝা হয়ে অভিশাপ কুড়ানোর চেয়ে বিয়ে করে নেওয়াটাই শ্রেয় মনে হলো তার কাছে। অন্তত তার মা তো প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারবেন। অগত্যা বিয়ে নামক পিড়িতে যখন বসতেই হবে, তখন এত গড়িমসি করে লাভ কী? এসব নানাবিধ জল্পনা-কল্পনা করে ছেলে পক্ষকে আসার অনুমতি দিয়ে দেয় লিলি৷
শুক্রবার হিসেবে ভালোদিন দেখে ছেলে পক্ষরা আসে লিলিকে দেখতে। মিলিরা-ও আসে পরিবার মিলে। সাথে আসে লিলির সকল বান্ধবীরা। ইমু এসে সাজিয়ে নিয়ে যায় লিলিকে ছেলে পক্ষের সামনে। ছেলে পক্ষ থেকে শুধু ছেলের দুই মামা ও মামিরা এসেছে। ছেলের বাবা-মা নেই। তবে ছেলে শিক্ষিত, চাকরিও করে এক প্রাইভেট কোম্পানিতে। এমন ছেলে পাওয়া বেজায় মুশকিল বাবাহীন মেয়েকে পার করাতে। তাই তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল লিলির মা। এতক্ষণ যাবৎ লিলি একবারও মুখটা উঁচু করে তাকায়নি কারো দিকে। এদিকে ছেলে-মেয়ে’কে একত্রে কথা বলতে পাঠায় লিলির রুমে।
বসে থাকা মুখ নত করা লিলির। অপরপাশের ব্যক্তিটি আগে নত হওয়া মুখখানা চোখ জুড়িয়ে দেখে নিলো। মনে হয় বেচারা যেন কতকাল থেকে তৃষ্ণার্থ ছিল, আজ তৃষ্ণার অবসান ঘটল। এরইমধ্যে গুমোট হওয়া পরিস্থিতিতে ব্যক্তিটির কণ্ঠ হতবিহ্বল ও বিস্ফোরিত চোখে তাকায় তার পানে লিলি।
‘মুখ কি নিচ দিকে করেই রাখবে? তাহলে বুঝবে কীভাবে ছেলে অন্ধ না-কি খোঁড়া?’
বিস্মিত হওয়ার রেশ চোখে ঠায় বজায় রেখল লিলি জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি! আপনি এখানে কি করে?’
‘কি অবান্তর কথা জিজ্ঞেস করছ? এখানে আমি ছাড়া আর কে থাকার কথা? আজব!’
বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল শাহেদ লিলির কাছে।
‘মানে আপনিই আমাকে দেখতে এসেছেন?’
তবুও যেন লিলি বিশ্বাস যাচ্ছে না শাহেদের বিরক্তিতে ছেয়ে যাওয়া মুখের কথা। এখনও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে হতভম্ব হওয়া তার মুখমণ্ডল জুড়ে।
‘কেন কোন সমস্যা আছে কি?’
শাহেদের প্রশ্নের উত্তরে এবার দায়সারা ভাব নিয়ে কাঠখোট্টা গলায় উত্তর দিলো,
‘হ্যাঁ, অবশ্যই আছে।’
শাহেদ যেন সেটা আমলে নিলো না উলটো সে আরো আগ্রহ নিয়ে সমস্যার কথাটা জানতে চাইল।
‘তা সেটা কী জানতে পারি?’
‘আপনাকে আমি বিয়ে করব না।’
কিন্তু লিলির বজায় রাখা শুষ্ক ও লাবণ্যহীন কঠোর জবাব। সে বিয়ে করবে না, ব্যস এটুকুই। আগে-পিছের কারণ জানাতে অনাগ্রহ দেখা গেল। কিন্তু শাহেদ-ও কম যায় না। জানবেই এই কাঠখোট্টা মেয়েটার কেন এত অমত তাকে বিয়ে করার?
‘কেন আমার মাঝে কোন কমতি আছে কি?’
এত চাপাচাপির শেষে মুখ খুলল লিলি।
‘নাহ, তবে আপনার আচরণ আমার কাছে ভালো লাগেনি। যার অন্যের অনুভূতি নিয়ে মজা করার স্বভাব, তাকে বিয়ে করা মানে নিজের জীবনকে মজা বানানো। এমন ব্যক্তির সাথে বিয়ে করা যায়; আপনিই বলুন তো?’
লিলিকে নেহাতই ছোট ভেবেছিল শাহেদ। অথচ জ্ঞান-বুদ্ধি ভালোই তার প্রেয়সীর। জীবনকে উপলব্ধি জ্ঞান, ভালো-মন্দ কীসে জ্ঞান আছে বলতে হয়। সেসব ভেবে স্মিত হাসল শাহেদ। অতঃপর লিলির প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে ক্লিয়ারেন্স দিয়ে সে বলল,
‘আসলে আমি তখন তোমার সাথে কথা বলার জন্য এমন করেছিলাম। তোমাকে আমি প্রথম দেখেছি ইমনের বাড়িতে। তারপরই তোমার পিছু নিয়েছি একটু কথা বলব ভেবে। কিন্তু কী বলে কথা শুরু করব খোঁজে না পেয়ে চুরির কথাটা বললাম। তবে এখনো বলব তুমি আমার মূল্যবান জিনিস চুরি করেছ। আর সেটা আমি ফিরত চাই।’
আবারও কাঁদিয়ে দিলো তার প্রেয়সীকে শাহেদ। তবে মিটিমিটি হাসছে এবার সেটা দেখে। মেয়েটা যতই বুদ্ধির ধারী হোক না কেন বাচ্চামো আছে বলতে হয়। আসলে সকল মানুষের ভেতরেই বাচ্চামোর একটা স্বভাব-আহ্লাদ রয়েছে। যেটা প্রকাশ পায় ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্নতা নিয়ে। লিলি পুরো কথাটার তাৎপর্য না বুঝে শেষের কথাটাই আঁটকে ধরে কান্না করে বসল, আর ক্রদনরত অবস্থায় বলল,
‘সত্যি বলছি আমি আপনার কিছু চুরি করিনি। আর চুরি করে থাকি যদি তাহলে বলুন, কী চুরি করেছি? আমার কাছে না থাকলেও যেভাবে হোক আপনাকে সেটা ফিরিয়ে দেব।’
ক্রদনরত মুখে নাক টেনে টেনে বলা লিলির মুখ পানে শাহেদের চক্ষু বাঁধনহারা হয়ে অবাধে ঘুরে-ফিরে চলছে। চোখ-মুখ অল্পতেই ফোলে ফেঁপে উঠছে কানৃনার ফলে। লালচে আভা ছড়িয়ে নাকের ডগায়। দ্বিরুক্তি করে শাহেদ বলল,
‘নাহ তুমি সেটা এখন দিতে পারবে না। অবশ্য তোমার কাছেই আছে জিনিসটা৷ তবে আমাকে বিয়ে করার মাধ্যমে দিতে পারবে সেটা।’
‘বিয়ে করার সাথে চুরি করা জিনিসটার সম্পর্ক কী?’
ভ্রু কুঁচকে অবাকান্বিত হওয়া চক্ষুদ্বয় ছোটো ছোটো করে জিজ্ঞেস করে লিলি।
‘আছে আছে তবে সেটা এখন বলব না। সময় হলেই নিজেই জানতে পারবে। আসি এখন।’
লিলির কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল শাহেদ। আর তার যাওয়ার পানে একধ্যানে তখনো ভ্যাবলাকান্তের মতো চেয়ে লিলি।
______
কোনভাবেই বিয়েটা আটকাতে পারল না লিলি। আটকাবেই বা কীভাবে? কোন দাবি-দাওয়া না চেয়ে নির্বিঘ্নে লিলি ও শাহেদের বিয়েটা সম্পন্ন হলো। যেখানে বাপ ছাড়া মেয়েকে কেউ নিতে চায় না, মেয়ে যত সুন্দরীই হোক না কেন, সেখানে এমন দাবী বিহীন মেয়ে পার করাতে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন লিলির মা। দোতলা অট্টালিকার পুরোটাই শাহেদের। সে একা থাকাতে বেশি একটা আসবাবপত্র ছিল না বাড়িতে। তবে এখন নতুন সদস্য সঙ্গিনী হিসেবে লিলি এসেছে। তাই রুমটাকে সুন্দর করে নতুন আসবাবপত্রে সাজিয়েছে৷ এতে অবশ্য মামার ছেলে-মেয়ে’রা সাহায্য করেছে, যারা সবাই তার ছোটো। বাবার আত্মীয় বলতে কেউ-ই নেই। যাও অল্পসল্প ডালে-খালে আছে, অর্থাৎ সকলে বিদেশে অবস্থানরত, কেউ-ই কারো দিকে নজর দেয়ার সময় পায় না।
বাসর ঘরে বসা লিলির মন দুরুদুরু করে কাঁপছে। না জানি তার মতবিরুদ্ধ হয়ে জোর খাটায় শাহেদ। তার ওপর স্বামীর অধিকার দাবি আদায় করতে চড়াও হয়। প্রতিটি মেয়েরই এই সময়টা নিয়ে শতশত জল্পনা-কল্পনা থাকে মনে মনে। অনেকের সেটা বাস্তবিত হয় কিংবা জলাঞ্জলি দিতে হয়, এই মধুর ফুলশোভিত শয্যাতে। এমন সময় শাহেদের আঘমন ঘটায় নড়েচড়ে বসে সে। বাড়িতে কেউ নেই, সকলে চলে গেছে তাদের একান্ত সময় উপভোগ করতে দিয়ে। লিলি বিছানা থেকে নেমে এসে শাহেদকে নিচু হয়ে সালাম করতে নিলে তখন শাহেদ হালকা ধমকে ওঠা গলায় বলল,
‘এত জ্ঞান ভরা মাথায় অথচ এটা নেই যে, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে নেই।’
এই হালকা ধমকেই লিলি খানিকটা কেঁপে উঠল। এমনিই বুক কাঁপছে আবার গুমোট বাঁধা পরিবেশে শাহেদের ধমক বেশ কঠোর শোনাল। আর সালামকরার বিষয়টা অবশ্য লিলি জানে। তবে পাশের বাড়ির ময়মুরুব্বি দাদী তাকে এটা করতে বলেছেন। এখন তো আর শাহেদের সাথে তর্ক করতে পারে না, আর দাদির বলা কথাটাও বলতে মন সায় দিচ্ছে না। তাই তার হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলানোর প্রেক্ষিতে চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করল লিলি। এদিকে লিলিকে চুপ থাকতে দেখে শাহেদ ভাবল; আবার মনে হয় লিলির মন খারাপ করে দিলো সে। তাই মন ভালো করতে বিছানায় নিয়ে বসিয়ে বলল,
‘আচ্ছা, আমার সম্পর্কে কী কী জানো তুমি?’
একে তো বিয়েটা লিলি করতে চায়নি। অন্যদিকে বিয়ে না করতে চাওয়ায় শাহেদের বিষয়ে জানার আগ্রহও হয়নি তার। তাই শুধু এতটুকুই জানে ছেলে চাকরি করে। লিলিকে চুপ থাকতে দেখে শাহেদ নিজেই নিজের সম্পর্কে তুলে ধরল,
‘তুমি কি জানো আমার বাবা-মা নেই?’
লিলির নরম তুলতুলে দু’হাত বন্দি শাহেদের পুরুষালী দু’হাতে। শাহেদের বাবা-মা না থাকা যেন তার হৃদয় পোড়াচ্ছে। কেমন যেন এক মায়া অনুভূত হচ্ছে তার জন্য! দু’চোখ বোধহয় ভিজেও উঠেছে। শাহেদ তার অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে দু’হাত ছেড়ে নিজের বুকের সাথে লিলির পিঠ ঠেকিয়ে চিবুক রাখল লিলির কাঁধে। অতঃপর বলতে লাগল,
‘আমার বাবা-মা মারা যায়, আমি যখন কলেজে উঠেছি; তখন এক্সিডেন্টে। তাও আমি অন্যের মাথায় বোঝা হইনি। বাবার ব্যাংকে আমার জন্য রেখে যাওয়া অর্থ দিয়ে লেখা পড়া শেষ করি। মাঝে মাঝে মামা-মামী আসতো দেখে যেত আমাকে। কখনো কখনো রান্না করেও যেত। আমি রান্না জানি বলে তারা বলত; ছেলে হয়েও রাঁধতে পারি খুবই কষ্টের দৃশ্য। আরো বলত জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। কিন্তু আমি তখন বলতাম কষ্টগুলো একদিন সকল সুখের উৎস আমার জীবনে সুখ বয়ে আনবে। আর সেই সুখ আমি এখন পেলাম তোমায় পেয়ে।’
লিলির কাঁধ ভিজে গেছে শাহেদের অশ্রুতে। ছেলেরাও কান্না করে, হয়তো সকলের সামনে সেটা প্রকাশে পায় না। কেবল নিজের একান্ত মানুষটার কাছেই সেটা দৃশ্যত হয়। শেষ কথায় লিলি তার দিকে ঘুরে তাকায়। শাহেদের দু’হাতে এতক্ষণ যাবৎ পেট আঁকড়ে ছিল, তারা এখন লিলির কটিদেশে বিচরণ করছে। দু’চোখের শুভদৃষ্টিতে এক প্রগাঢ় ভালোবাসার বিচ্ছুরণ ঘটল। লিলি নিজের সাথে হওয়া প্রতিজ্ঞা ভুলে শাহেদের দৃষ্টিতে আটকা পড়ে। নিজ হাতে মুছে দেয় শাহেদের অশ্রুসিক্ত চক্ষুদ্বয়। লিলির নরম হাতের স্পর্শে শাহেদের ভেতরে লুকায়িত থাকা এতদিনের নিষিদ্ধ চাওয়ার বিচ্ছুরণ ছুটে যায় রক্তকণিকায়। শাহেদ তার একহাত নিয়ে নিজের ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয়। আন্দোলিত হয়ে ওঠে লিলির বক্ষপিঞ্জরে তার ছোঁয়ায়। লজ্জিত চোখ নামিয়ে আনে শাহেদের দিক থেকে। তার লজ্জা পাওয়া দেখে নিজের ভেতরকার চাওয়াগুলো দমিয়ে রেখে শাহেদ স্মিত হেসে বলল,
‘আজ নাহয় গল্প হলো। তোমার অজানাকে জানা হলো, সাথে আমারটাও। দু’জনের অনুভূতি, আত্মা যখন এক হবে তখন নাহয় শরীরেরও মিলন হবে।’
মায়ার পারদ বোধহয় বাড়াতেই থাকবে শাহেদ। এত সুন্দর করেও কী কেউ বুঝায়! সেই কথার আর ভাবানুবাদে গেল না লিলি। এই গল্প, সেই গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে গেল লিলি তার প্রেমিক পুরুষের বুকে।
_______
পাখির কিচিরমিচির সুরেলা সঙ্গীত যেন ঘুম ভাঙার আহবান জানান দিচ্ছে। সকালে নিজেকে স্বামীর বুকে আবিষ্কার করে যেন স্বর্গসুখ পেল লিলি। মিষ্টি হাসি দিয়েই সকাল শুরু হলো। আর সেই হাসিতে শাহেদকে অপলক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে লিলি তাড়াহুড়ো করে উঠতে গেলে নিজের শরীরের আঁচল শাহেদের পিঠের নিচে পায়। লিলির অসহায় করা মুখ দেখে নিজের হাসিটা কোনমতে চাপিয়ে রাখল শাহেদ। অথচ রাগী কণ্ঠে বলল,
‘কেমন মেয়ে তুমি নিজের শাড়িটাও সামলে রাখতে পারো না?’
এবার বোধহয় হাসি করা মুখটা অমাবস্যার গুমোট অন্ধকারে ছেয়ে গেল। কথায় আছে না, ‘যত হাসি তত কান্না বলে গেছেন রাম সন্না।’
চলবে…..