ভালোবাসা_ফিরে_আসে,পর্ব ৬

#ভালোবাসা_ফিরে_আসে,পর্ব ৬
লেখা : মান্নাত মিম

‘বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছে করে এমনটা করিনি।’

দ্রুত শ্বাসের ওঠা-নামার সহিত ভীত হওয়া ভঙ্গি নিয়ে নিজেকে সত্য প্রমাণের দাবি করে লিলি। কিন্তু শাহেদ যেন অনড় লিলির দাবিকে মিথ্যে প্রমাণের ভিত্তি করে প্রশ্ন তুলে ধরে,

‘তাহলে কি আমি ইচ্ছে করে তোমার সাথে এমনটা করেছি? আমাকে এতটাই নিচ মনের ভাবো তুমি?’

এবার হেঁচকি তুলে কান্না করতে করতে লিলি বলল,

‘আপনাকে কী করে বুঝাই? আমি শাড়িতে অভ্যস্ত নই। তাই এমন হয়ে গেছে।’

‘অভ্যাস করতে হবে। সারা অঙ্গে জড়িয়ে রাখতে হবে। বিয়ের পর মেয়েদের এটাই আগে শিখে নেওয়া উচিত।’

শাহেদের দিকে তাকাল এবার লিলির নত হয়ে থাকা মুখখানা। অশ্রু বৃষ্টিতে ভিজে আঁখিযুগল রক্তাভ ধারণ করেছে। ঘন পাপড়িগুলোও ভিজে জুবুথুবু হয়ে আছে। শাহেদের বুকে বয়ে গেল মৃদু কম্পন। শাড়ি নিয়ে মজা করাটা বোধহয় একটু বেশিই হয়ে গেছে বুঝি ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিলিকে নিজ বাহুবন্ধনে আঁকড়ে ধরে বলল,

‘আচ্ছা থাক হয়েছে এবার। আমি আবারও বোধহয় দুষ্টুমি করতে গিয়ে তোমার মনে আঘাত দিয়ে ফেললাম।’

‘আপনি বিয়ের প্রথম দিনও এমন একটা জঘন্য মজা করতে পারলেন। ছাড়েন, ছাড়েন বলছি। থাকব না আমি চলে যাব।’

অভিমানের ক্লেশে ক্লেশিত হয়ে রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ফোঁপাতে শুরু করে দেয় লিলি। বিছানার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় কথাবার্তা চলছিল বিধায় লিলির মোচড়ামুচড়িতে শাহেদ তাকে’সহ বিছানায় শব্দ করে পড়ে গেল। বিছানাতে পড়েও লিলির ধাক্কাধাক্কি গেল না। বাধ্য হয়েই তার দু’হাত বিছানাতে শক্ত করে চেপে ধরল শাহেদ আর তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে আবেগি কণ্ঠে বলল,

‘তোমাকে যে কান্না করলে এত মোহনীয় লাগে! কী করব বল তো? তোমাকে কাঁদাতেও মন চায়, আবার কাঁদলে বুকের মাঝে ব্যথারও আভাস পাই। এজন্য একটু মজা করে কাঁদাই। তবে তুমি তো দেখছি একেবারে কান্না করে বুক ভাসাও।’

বলে ফিক করে হেসে ফেললে লিলি আবারও ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না করে দেয়। তা দেখে শাহেদ বিড়বিড় করে বলে,

“নাহ এভাবে আর থামানো যাবে না, আর না সে আমাকে সংযত থাকতে দেবে।”

চোখ বোজা অবস্থায় কান্না করতে থাকা লিলি নিজের অধরে অপর অধরের বিচরণ পেয়ে যেন শিহরিত হয়। সারা শরীরে বয়ে গেলে শিরশির করা ভাব, যেমনটা ঠান্ডা বাতাসের পরশে এলে অনুভব হয়। এটা তার কাছে প্রথম ও নতুন অনুভূতি, তাও স্বামী নামক পুরুষের কাছ থেকে পাওয়া। কিছুক্ষণ আগের রাগ-কান্নার সময়কাল ভুলে কখন যেন সে নিজ হাত ডুবায় শাহেদের চুলে। শাহেদও ভুলে গেল নিজ দেয়া বাসর রাতের সেই অঙ্গীকারকে। আদরে আদরে লেপ্টে দিলো প্রিয়তমা’কে নিজ ভালোবাসার পরশে। লিলির বাঁধাগুলোও যেন হারাল অচিন কোন এক পথধরে।

‘মোহ ভুলানো ভালোবাসা,
আদরে করা ঘোরের নেশা,
মেতে থাকতে চায় অঙ্গ জুড়ে,
বিচরণরত স্পর্শের গভীরে।’
______

কথায় আছে – ‘পশুর সাথে থাকলেও একটা মায়া জন্মে যায়। সেখানে যদি মানুষ হয় তাহলে তো তার প্রতি জন্মায় ভালোবাসা, আবেগ।’

শাহেদের কেয়ার, ভালোবাসা সবকিছুই খুব তাড়াতাড়ি লিলির মনে জায়গা করে নিলো। শ্বশুর-শাশুড়ির আদর বিহীন সংসারে একাকীত্বটা শাহেদ বুঝতে দিলো না। মাঝেমধ্যে মামা-মামী সাথে দূর সম্পর্কের আত্মীয় স্বজন দেখা করে যেত এই-ই। এদিকে কখন যেন মায়া থেকে ভালোবাসা হয়ে গেল সময়ের স্রোত ধরে, সে-কথা শাহেদকে আর বলা হলো না। প্রথম বছর পেরিয়ে দ্বিতীয় বছরে যখন তাদের বিবাহবার্ষিকী দিনের পদার্পণ ঘটবে তখনই ঘটল অঘটন! তাও আবার একসাথে দু’টো!

দিনটি ছিল বাঁধনহারা বাদল দিন। বৃষ্টিস্নাতে ব্যস্ত লিলির চিবুক বেয়ে প্রতিটি ফোঁটারা নিম্নে স্পর্শ করার আগে তাদের লুফে নিচ্ছে শাহেদের ওষ্ঠ। লিলির লজ্জিত দৃষ্টি তখন ইতি-উতি করছে। নরম হাতে ছোট ছোট ধাক্কায় সরানোর বৃথা চেষ্টা করতে যেয়ে আঁটকে যায় তারা শাহেদের বলিষ্ঠ হাতে। দু-হাত পিছনে মুচড়ে রেখে, পিঠে চলছে ভালোবাসার অবাধ স্পর্শ। আচমকা তখন শাহেদ লিলির কানে ফিসফিস কণ্ঠে অধৈর্য গলায় বলল,

‘আজ কেন জানি তোমার ওষ্ঠে নিজেকে ভালোবাসার কথা শুনতে ইচ্ছে করছে? জানি না মন কেন এত উত্তাল হয়ে আছে? বলবে কি সেই অমৃতবাণী?’

শাহেদ কী শুনতে চাচ্ছে, সেটা জানে লিলি। আর সে-ও তো বলবে বলবে করে আর বলার সুযোহ পায়নি হয়তো বা সেটা হয়ে ওঠেনি। তবে অপেক্ষারত ছিল তো সে তার স্বামী নামক প্রেমিক পুরুষটাকে ভালোবাসার মধুর বাক্যটা শোনাবে। কিন্তু আজ কাঁপা কাঁপা গলায় একবার বলতে যেয়েও বলল না সে-কথা লিলি। মনে মনে ছক কষল তাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার। ঘুরে তার বুকে মুখ লুকিয়ে উলটো বলল,

‘তোমার মনে আছে, তোমার একটা জিনিস চুরি করার অপবাদ দিয়েছিলে আমাকে। সেই জিনিস বলেছিলে, বিয়ে করার মাধ্যমে তোমাকে ফেরত দেওয়া যাবে। সেটা আমি ফেরত দেব, তাও সুদ-আসল সমেত।’

মায়া-মহব্বতের সাথে এখন আপনি থেকে তুমি’তে পরিণত হয়েছে সম্মোধন।

‘আরেহ আমি তো আসলে সেদিন….।

লিলি নিজ ওষ্ঠ দ্বারা বন্ধ করে দিলো শাহেদের অব্যক্ত বাণী। হয়তো শেষ স্পর্শ তার মায়াবিনীর তাই সে-ও আর ব্যক্ত করার আগ্রহ দেখাল না। ব্যস্ত হয়ে গেল চাওয়া-পাওয়ার মাঝে এক ডুব সমুদ্রে যেখান থেকে সাঁতরে বেঁচে ফেরার আসা থাকে না, থাকে তলিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
_______

‘তুমি না আমাকে ভালোবাসো। এ তোমার ভালোবাসার নমুনা! এ ভালোবেসে আবার আমার মুখে তোমাকে ভালোবাসার কথা শুনতে চাও। দিব না তোমায় চুরি করা জিনিস। সাথে সুদে-আসলে যে হার হয়েছে। দিব না কিছুই দিব না। চলে যাব, থাকব না তোমার মতো নাটক করা লোকের সংসারে।’

বলেই চিৎকার করা কান্না’রা এবার উচ্চস্বরে হাসিতে পরিণত হলো। হাসির মাঝেও ভিজে ওঠা চোখ খুব ভালোভাবে পরিলক্ষিত। তা দেখে সবাই ভয় দৃষ্টিতে তাকায় তার পানে। মেয়েটার যা মতিগতি পাগল না হয়ে যায় শেষে। তখন আবার অ্যাসাইলেমে কে দৌড়াদৌড়ি করবে। কথায় আছে, ‘হাতি যখন গাঁতায় পড়ে চামচিকাও লাথি মারে।’

‘কি এটাই মনে করেছ তো? উহুম, এত সহজে তোমাকে আমি মুক্ত করে দেব? আমার মনের মধ্যে যে ভালোবাসার বীজ বপন করেছ, তার ফল এখন কে ভোগ করবে? সেই ভালোবাসার বীজ যে আস্তে আস্তে আমার পেটে বেড়ে উঠছে। তাকে কে কোলে নিবে? কাকে বাবা বলে চিনবে সে? দাও সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও। তারপর না হয় মুক্তি মিলবে।’

বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে লিলিকে ধরে থাকা ব্যক্তিটি।

‘কিহ্! তুমি সত্যি বলছ? তুমি প্রেগন্যান্ট?’

নিজ উদরে হাত রেখে মাথা ঝাঁকায় লিলি যার অর্থ সে সত্যিই মা হতে চলেছে। শাহেদ আর তার ভালোবাসার চিহ্ন তার পেটে। অথচ সে-ই ব্যক্তিটি আজ কীভাবে এমন করতে পারল? যেখানে নিজের সন্তানের কথাটা শুনতে পারার জন্য থাকল না। অথচ সে সারাক্ষণ একটা বাচ্চার আশা করত। তার খুব শখ হতো তার সন্তানকে সে অনুভব করবে লিলির পেটে মাথা রেখে। জন্মানোর সময় দু’হাতে আগলে নিয়ে পিতৃত্বের স্বাদ নেবে। কোথায় সেই চাওয়া-পাওয়ার মানুষটা? যখন তার সন্তান জানবে, তার পিতা নেই কেমন অনুভব হবে তখন বাচ্চাটার? পিতার ছায়াহীন জীবন তো শাহেদ অনুভব করেছে, কত কষ্টের জীবন হয় সেটা! তবুও কীভাবে পারল সে তাদের এভাবে ফেলে যেতে? ভাবতে ভাবতেই আবার অশ্রু বিসর্জন দিয়ে চিৎকার করে লিলি বলতে শুরু করল,

‘এই আর কত মজা করবে বলো না? আমি আর নিতে পারছি না।’

শাহেদের লাশের পাশে ভিড় করা মানুষগুলো উদ্দেশ্যে এবার লিলি ক্ষেপাটে গলায় বলতে লাগল,

‘সরেন সবাই। কী পাইছেন হ্যাঁ কী পাইছেন? ও সার্কাস দেখাইতাছে দেখে আপনারাও ও’র সাথে তাল দেওয়া শুরু করছেন? যান, এখান থেকে। অসভ্য মানুষ কোথাকার, কই বুঝাইব ও’কে। উলটো মজা নিয়া উসকে দিচ্ছে।’

নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে শেষোক্ত কথাগুলো বিড়বিড় করে বলতে লাগে লিলি। আর বাড়িতে অবস্থান করা সকল মানুষগুলো অসহায় মুখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে লিলির পানে। সাথে তাঁদের-ও চোখে জল এসে পড়ে লিলির আর্তনাদ করা দেখে।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here