এস_এল_আর ( শেষ পর্ব )

#এস_এল_আর ( শেষ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র

আর ছোট থেকেই তো এরকম ছেলেরই স্বপ্ন দেখেছিল ভ্রমর। এরকম একটা মানুষই তো খুঁজেছিল নিজের জন্য! আর কি অদ্ভুতভাবে আলাপ ওদের দুজনের। দার্জিলিং এ ঘুরতে এসে একই হোটেল, পাশাপাশি রুম! আচ্ছা, সবই কি এমনি! কোন কারণ ছাড়া। না কি কিছু লেখা আছে আলাদা করে! শুধু ওদের দুজনের জন্য। কথাগুলো এরপরের দিন গাড়িতে আসতে আসতে, ট্রেনে, সারাক্ষণ ভাবছিল ভ্রমর। আর আজ অচিন্তও তো ফিরছে ওদের সাথে! একই ট্রেনে। যদিও কম্পার্টমেন্ট আলাদা ছিল। কিন্তু অচিন্ত টিটি কে বলে ম্যানেজ করে নিয়েছে একটা সিট ওদের সাথে। সেদিন রাতে এরপর ভ্রমর ঘুমন্ত অচিন্তকে উল্টো দিকের বার্থে শুয়ে দেখছিল অপলকভাবে। আর নিজেকে আটকাচ্ছিল না কোনভাবে। যা প্রেমে পড়ার তো পড়েই গেছে! কেস খাওয়ার কিছু বিশেষ বাকি নেই এখন। আর এটাই হয়তো শেষ দেখা! কলকাতায় ফিরে আর হয়ত কখনো এই চিন্তাহীন ছেলেটাকে দেখতে পাবে না কোনদিন! এইসবই ভাবছিল ভ্রমর আনমনে। আর সত্যি অবাক হয়ে যাচ্ছিল নিজের ওপর! এই দু বছর বাদে, রন যে হঠাৎ করে ওর ডিভাইস থেকে ডিলিট হয়ে যাবে একেবারে, আর নতুন একটা অচিন্ত নামের প্রোগ্রাম কেউ ইনস্টল করে দেবে! ভাবেনি কখনো। আসলে সত্যি, লাইফটা ভীষণ আনপ্রেডিকটেবল। কখন যে কিভাবে গল্পটা বদলে যাবে, আর নতুন কোন চ্যাপ্টার এসে হাজির হবে; বোঝা যায় না কিছু আগে থেকে!
<১০>
এই গল্পের ভিড়ে সাতটা দিন কেটে গেছে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে। তবে বাড়ি ফেরার পর থেকে বার বার শুধু ভ্রমরের চোখটা ফোনটার দিকে চলে যাচ্ছে এই কটা দিন। আসলে ভ্রমরের কাছে একটা মেসেজও আসেনি অচিন্তর এতদিনে। ফোন নাম্বারটা ওদের সেই দার্জিলিংএ এক্সচেঞ্জ হয়েছিল। কিন্তু না, আজ অব্দি একটা মিস কলও আসেনি সেই নাম্বার থেকে ভ্রমরের কাছে। কথাটা যতবার ভাবছে, কেমন যেন মন খারাপ ঘিরে ধরছে ওকে সারাক্ষণ। সত্যি ভাবেনি, ফিরে এসে এতটা মনে পড়বে অচিন্তকে! ছেলেটা যে এতটা বেশি করে মনে জায়গা করে ফেলেছে, বোঝেনি এটা ভ্রমর। আর ও নিজে যেচে পরে মেসেজ করতেই পারে; কিন্তু ভয় একটাই! হয়ত কোন রিপ্লাই করলো না অচিন্ত! কলকাতায় ফিরে ভুলেই যেতে পারে ওকে! আর আসলে এরকম ঘুরতে বেড়াতে গিয়ে হয়ত হাজার জনের সাথে আলাপ হয়েছে। তখন টাইম কাটানোর জন্য ভালোভাবে মিশেছে, কথা বলেছে; তারপর বাড়ি ফিরে ভুলে গেছে। আর এটাই তো স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক জিনিসটা তো ভ্রমরের সাথেই হয়েছে। অচিন্তর তো কোন দ্বায় নেই আর যোগাযোগ রাখার! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে নিল ভ্রমর। মনটা যদিও তখন মোবাইলে ওই না আসা ফোন কলটার দিকেই পরে আছে! তবে এই মন খারাপের ভিড়েও আজ একটা ঝামেলার দিন। পাত্র দেখতে আসবে। মা সেই নিয়েই মেতে আছে সকাল থেকে! নানা রকম মিষ্টি আনা, ঘর সাজানো করেই যাচ্ছে দিন রাত। তারপর বেছে বেছে আলমারি ঘেঁটে এই লাল শাড়ীটা বার করে দিয়েছিল ওকে, পরার জন্য। ভ্রমরের রূপে গুনে যেভাবেই হোক পাত্রকে ইমপ্রেস করতেই হবে! যত সব। যেন ও ঘরে সাজিয়ে রাখার মতন একটা শো পিস! যাইহোক, এসব তো আর মা বাবাকে বোঝানো যাবে না! কিন্তু এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য অচিন্ত ওকে বুদ্ধি দিয়েছিল মনে আছে। ‘ পাত্র ভেজিটেরিয়ান ‘। ব্যাস, এই একটা ডায়লগই যথেষ্ট সম্বন্ধটাকে কেঁচিয়ে দেয়ার জন্য। কথাটা ভেবেই বেশ একটা হাসি চলে এলো ভ্রমরের মুখে হঠাৎ।
তবে এরপর এক ঘন্টা বাদে পাত্রপক্ষ যখন ভ্রমরদের বাড়ি এসেছিল, তখন ছেলেকে দেখে ভ্রমরের চোখ কপালে উঠেছিল! কিছুক্ষণ স্ট্যাচুর মতনই দাঁড়িয়েছিল ও মিষ্টির প্লেট হাতে ড্রয়িং রুমে। অচিন্ত! এখানে কি করছে! তার মানে ও ই পাত্র! ব্যাপারটা হজম করতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগেছিল ভ্রমরের। কিন্তু দুজনের কেউই বাড়ির লোকের সামনে এটা বুঝতে দেয়নি যে ওরা একে অপরকে চেনে। তবে এরপর ওই বাড়ির লোকের তরফ থেকে একা কথা বলার সুযোগটা আসায় ভ্রমর ছাদে গিয়ে বেশ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
—-” তুমি জানতে এইসব আগে থেকে?”
অচিন্ত এর উত্তরে সেই শান্ত গলাতেই বলেছিল,
—-” না, কলকাতায় এসে জানলাম, ফটোটা দেখে।”
এটা শুনে ভ্রমর আরো উত্তেজিত হয়ে বললো,
—-” তাহলে! আমাকে একবার মেসেজ করেও বললে না ব্যাপারটা?”
অচিন্ত এর উত্তরে অল্প হেসে বললো,
—-” ইচ্ছে করেই বলিনি। আমি যখন দেখলাম সাত দিনেও কোন মেসেজ, কোন কল নেই, তখন বুঝলাম যে তুমি সিওর ফটোটা দেখোনি। আর আমি তোমার এই এক্সপ্রেশনটা মিস করতে পারতাম না!”
কথাগুলো শুনে ভ্রমর অল্প অভিমানের সুরেই বললো,
—-” বুঝলাম। আমি তো ভাবছিলাম তুমি এই সাতদিনে ভুলেই গেছ আমাকে! ঘুরতে গিয়ে তো এরকম কত লোকের সাথেই আলাপ হয়!”
এই কথায় অচিন্ত হঠাৎ ভ্রমরের চোখে চোখ রেখে কিছুটা স্থির গলায় বললো,
—-” সবাই আর ভ্রমর বসু কি এক?”
কথাটায় ভ্রমর এক সেকেন্ড থমকে গেল কেমন। অচিন্ত কি কিছু বোঝাতে চাইলো ওকে! ভ্রমর কি তার মানে আলাদা অন্যদের থেকে অচিন্তর কাছে! প্রশ্নটা মনে আসতেই ভ্রমর বলে উঠলো,
—–” কেন? ভুলে যেতেই পারতে। আমি আর এমন কি!”
অচিন্ত এই কথায় ধীর স্বরে বললো,
—–” সেটা আমার মনেই থাক।”
কথাটায় ভ্রমর কিছুক্ষণ যেন চুপ হয়ে গেল। এই উত্তরটা যেন কিছু না বলেই বুঝিয়ে দিল সবটা। তার মানে একটা ফাঁকা জায়গা আছে তাহলে, যেটা পূরণ করা যায়। কথাটা ভাবতেই অচিন্ত এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেই বললো,
—–” যাইহোক, চলো এবার নিচে। নইলে কাকু কাকিমা এতক্ষণ ছাদে কথা হচ্ছে দেখে ভাববে পাত্র সত্যি বোধ হয় পছন্দ হয়ে গেছে তোমার! তার আগেই নিচে গিয়ে ডায়লগটা বলে দাও, যেটা শিখিয়েছিলাম।”
কথাগুলো বলে অচিন্ত চলে যেতে যাচ্ছিল, কিন্তু থমকে গেল ভ্রমরের কথায়। ভ্রমর এই মুহূর্তে একটু ঘুরিয়ে বলে উঠলো,
—-” আর যদি ডায়লগটা না বলি তাহলে? বিয়েতে মত আছে তো?”
এই প্রশ্নে অচিন্ত কেমন থতমত খেয়ে গেছিল যেন। ও একটু এলোমেলো ভাবেই বলে উঠেছিল,
—–” হ্যাঁ ! মানে! তোমার আমাকে পছন্দ!”
এই কথায় ভ্রমর একটু হেসে উত্তর দিয়েছিল,
—–” আসলে আমার এখন এসএলআর ক্যামেরা পছন্দ। বুঝলে?”
এই কথাটা শুনে অচিন্তর মুখেও হাসি। এখানে এসে যে এরকম একটা উত্তর পাবে ভ্রমরের কাছ থেকে, ভাবেনি আসলে। এখানে এসেছিল তো শুধু আর একবার দেখা হবে; এই ভেবে! একটা অজুহাতই বলা যায়।
এইসবই ভাবছিল আনমনে, তখনই ভ্রমর বলে উঠলো একটু গম্ভীর মুখে হঠাৎ,
—–” কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”
এটা শুনে অচিন্ত কেমন চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, —-” শর্ত! কিসের শর্ত?”
এই প্রশ্নে ভ্রমর আলতো হেসে উত্তর দিল,
—–” ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি কিন্তু কখনো রাখলে চলবে না। আমার পছন্দ না।”
কথাটায় অচিন্ত হেসে ফেললো জোরে। আর একটা পাহাড়ি রূপকথার গল্প এই শেষ বিকেলে তিলোত্তমায় এসে পূর্ণতা পেল, দুজনের জীবনে।

সমাপ্ত

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here