প্রিয়_অভিমান🥀🥀পর্ব-৩
#ফাবিহা_নওশীন
||
মাগরিবের আজান শেষ হয়েছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে। আলোক সজ্জিত বাড়িতে রুহানি সোফায় বসে ক্যানে চুমুক দিচ্ছে আর দৃষ্টি নুশার দিকে। তায়েফ, তুরানি হাতে হাত ঘষছে। ওদের মধ্যে টানটান উত্তেজনা। নুশা ফালাকের নাম্বারে ফোন করছে।
তায়েফ এরি মধ্যে বলল,
“আগামীকাল দেখবি এই নাম্বার কি করে ছড়িয়ে দেই। শহরের অলিতে-গলিতে সব জায়গায় ফালাকের নাম্বার। উফফ! কি যে মজা হবে! ব্যাট শায়েস্তা হবে খুব।”
তুরানি ওর কথা শুনে বলল,”ভাবতেই শান্তি লাগছে। দেখ কি করে হয়রানি করি। পাগল করে ছাড়ব।”
নুশা হুট করে মুখ কালো করে ফেলল। রুহানি নুশার মুখের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। নুশা ফোনের স্কিনে তাকিয়ে ঠোঁট নাড়াচ্ছে।
তারপর রুহানির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাদের বোকা বানিয়েছে।”
তারপর ফোন রেখে ফ্লোরের দিকে চেয়ে আছে চোখমুখ শক্ত করে।
রুহানি ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। তায়েফ আর তুরানির উত্তেজনা নিমিষেই উবে গেল। এখন নতুন কৌতূহল জেগেছে।
তায়েফ নুশার আরেকটু কাছে গিয়ে বলল,
“বোকা বানিয়েছে মানে কি? ভুল নাম্বার দিয়েছে?”
নুশা তায়েফের দিকে চেয়ে বলল,
“ভুল নাম্বার কি-না জানি না। তবে ১০ডিজিট। একটা ডিজিট মিসিং।”
রুহানি ঠাস করে ক্যানের বোতল টেবিলের উপর রাখল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“যা এবার শহরের অলিতে-গলিতে গিয়ে ছড়িয়ে দিয়ে আয়। যত্তসব! যখন নাম্বার নিয়েছিস দেখিস নি?”
নুশা দাঁড়িয়ে বলল,”আমার উপর রাগ করছিস কেন? আমি কি জানি দশ ডিজিটের নাম্বার দিয়েছে?”
রুহানি ভেবে পাচ্ছে না ফালাককে কি করে শায়েস্তা করবে। ফালাক একের পর এক বাজিমাত দিয়ে যাচ্ছে।
“এভাবে হার মেনে নেব?”
ওরা সবাই মাথা নিচু করে নিল। ফালাক যে এভাবে বোকা বানাবে ভাবনার বাইরে।
।
রুহানি মা-বাবার রুমের পাশ দিয়ে যেতেই বাবার উচ্চ কন্ঠস্বর শুনে থমকে গেল। কথা শুনে যা বুঝলো তা হলো মামা কোন গন্ডগোল করেছে। যার কারণে বাবা ক্ষেপে গেছে। ওর মা ফোন হাতে ভাইয়ের সাথে কথা বলছে।
রুহানি নিজের রুমে যেয়ে যেতে ভাবছে,
“এই মামার আবার কি সমস্যা? মনে তো হচ্ছে বিশাল ঝামেলা করেছে। বাবার টাকায় বড়লোক হয়ে বাবাকেই চিনছে না। অকৃতজ্ঞ।”
।
রুহানি দলের মাঝে বসে ব্যাগ থেকে সরঞ্জাম বের করছে। চাকু, বড় পিন, ছোট প্যারেক। এ-সব দেখে কেউ অবাক হয় নি। কারণ মেয়েদের ব্যাগে সাজগোজের জিনিস থাকলেও রুহানি ব্যাগে এসব নিয়েই ঘুরে। মাঝেমধ্যে দু’একটা বই আনে।
“কোনটা ব্যবহার করা যায় রে?”
“এগুলো দিয়ে কি করবি? খুন করবি না কি?”
“হ্যাঁ, খুন করব। খুন না করা পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছি না।”
“মাথা ঠান্ডা কর। উল্টা পাল্টা কথা বলিস না। এগুলো ব্যাগে রাখ। কেউ দেখলে সমস্যা হবে।”
রুহানি ব্যাগ গোছালো। তখন তুরানির চোখ গেল সামনের দিকে। সেই মেয়েটা যার মাধ্যমে নাম্বার নিয়েছিল।
তুরানি মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটা ওকে দেখেই ভয়ে চুপসে গেল। দাঁড়িয়ে কাচুমাচু করছে।
“ভুল নাম্বার দিয়েছো কেন? ফাজলামি করেছো? আমাদের সাথে?”
মেয়েটা কাচুমাচু করতে করতে বলল,
“আমি কিছু জানি না। আমার হাতে যা লিখে দিয়েছিল তাই দিয়েছি। আপু আমি কি করে বুঝব ভুল না-কি ঠিক।”
রুহানি দূর থেকে বলল,
“ওকে ছাড়। ওর উপর রাগ দেখিয়ে কি হবে? যদি পারিস আসল মানুষের সাথে লাগ।”
তুরানি রুহানির কথা শুনে ছেড়ে দিল। মেয়েটাও দ্রুত চলে গেল আর মনে মনে দোয়া করছে এদের সাথে যেন ভুল করেও দেখা না হয়।
রুহানি উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ কাঁধে নিল। তারপর ক্লাসরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কোথায় থেকে ফালাক এসে হাজির।
রুহানিকে আশ্চর্য হওয়ার সুযোগটাও দিল না। এসেই ঝাড়তে শুরু করল,
“এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার? তোমাকে তো বলেছি মেন্টাল হসপিটালে যাও আর ভালো থাকো। বাকিদেরও ভালো থাকতেও দেও।”
রুহানির এই ঝাঁঝালো কথাগুলো সহ্য হচ্ছে না। ফালাকের সাথে এই মুহুর্তে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবে জবাব দেওয়া জরুরী কিন্তু কি জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছে না।
“এই স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে? না, আমার সাথে কথা বলার অজুহাত খুঁজছ? দুম করে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো যা খুশি বলে যাচ্ছো আর আমাকে পাগল বলা হচ্ছে। পাগল তো তুমি।”
“আমার সবই ঠিক আছে। ঠিক নেই তোমার। গতকাল আমার গাড়ির চাকার হাওয়া কে ছেড়েছে?”
রুহানি চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
“আমি কি তোমার এসিস্ট্যান্ট? গাড়ির পাহারাদার? না সিসি ক্যামেরা? আমার কি ঠেকা পড়েছে তোমার গাড়ির দেখভাল করা? হাহ!”
ফালাক আঙুল তুলে বলল,
“একদম ড্রামা করবে না। আমি জানি তুমি করেছো।”
রুহানি হেসে বলল,
“প্রমাণ কি? প্রমাণ দেখাতে হবে ভাইয়া।”
ওর কথা শুনে ফালাকের গা জ্বলে যাচ্ছে। “ভাইয়া” শব্দটাও ব্যাপকভাবে বিঁধছে। রাগে গজগজ করতে করতে ফালাক চলে গেল। রুহানি মুখ ভেংচি কেটে ক্লাসের দিকে গেল।
ক্লাসের দিকে রুহানির মন নেই। লেকচার চলছে আর ও ওর মতো নুশার সাথে গল্প করছে আর ফোন ঘেটে কি জানি দেখাচ্ছে। হটাৎ রুহানির মনে হলো পুরো ক্লাস হুট করেই শান্ত হয়ে গেছে।
আর মোটাসোটা কেউ ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বইয়ের উপর তা ছায়া পড়েছে। চোখ গেলে সামনের মানুষের দিকে। স্যারকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল রুহানি।
স্যার ধমক দিয়ে বলল,
“কি হচ্ছে এ-সব রুহানি? ক্লাসে কি করছো? ক্লাসের দিকে তো মনোযোগ নেই-ই গল্প করছো আবার ফোন ইউজ করছো? দু’জন দাঁড়াও।” নুশাও দাঁড়িয়ে গেল।
রুহানি দ্রুত বলল,
“সরি স্যার। আর এমন হবে না।”
স্যার আর আজকে রুহানির কথায় গলল না। ধমক দিয়ে বলল,
“তোমার এই নাটক রোজ রোজ চলবে না। কি রেজাল্ট করেছ তুমি ভুলে গেছো? কি বলেছিলে তুমি? তুমি ঠিক করে পড়াশোনা করবে। এই তোমার পড়াশোনার নমুনা? তোমাদের দুজনকে আমি এক সাথে বসতে যেন আর না দেখি।”
তারপর স্যার রুহানিকে ডেকে নিয়ে একটা ছেলের সাথে বসাল। তারপর এক প্রকার হুমকি দিয়ে বলল,
“তুমি প্রতিদিন রনকের সাথে বসবে। ওর সাথে থেকে যদি কিছু শিখতে পারো। যদি অন্য কোথাও বসেছো তো ক্লাস থেকে বের করে দেব।”
তারপর রনককে দেখিয়ে বলল,
“এই ছেলেটাকে দেখো। ওর তোমার বাবার মতো এত টাকা না থাকলেও সময়ের মূল্য দিতে জানে। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ, একাগ্রতা দেখে অবাক না হয়ে পারি না। জীবনে কিছু হওয়ার অদম্য ইচ্ছাশক্তি ওর আছে। আর তোমাদের টাকা থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনা করো না, অবহেলা করো সবকিছু। যথেষ্ট নম্র,ভদ্র একটা ছেলে। সব পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। ওর সাথে কথা বললে কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। কি সুন্দর করে কথা বলে। প্রতিটি কথা সম্মান, ভালোবাসা দ্বারা জড়ানো। ওর সাথে থেকে যদি কিছু শিখতে পারো। ”
রুহানি ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে গেলেও উপরে স্বাভাবিক আছে। এই গাইয়া ছেলের সাথে না-কি প্রতিদিন বসতে হবে। ওর কাছ থেকে না-কি শিখতে হবে। কি শিখবে? কিভাবে ধান লাগাতে হয়? অদ্ভুত!
ক্লাস শেষে রুহানি রনককে বলল,”চল।”
রনক রুহানির চল কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। রুহানি যে কি জিনিস সেটা তো জানেই।
“কোথায়?”
“ঘুরতে। ফ্রেন্ডশিপ যখন করেছিস পালন তো করতে হবে। চল চল।” (তাড়া দিয়ে)
রনক কিছু বলতে না পেরে রুহানির পেছনে পেছনে গেল। রুহানি অনেকগুলো খাবারের অর্ডার করল। একে একে খাবার আসতে লাগল। রুহানি বলল,
“নে খা।”
রনক ভয়ে ঢুক গিলছে। রুহানি কি ওকে খাইয়ে এ-সব খাবারের বিল ওকে দিতে বলবে? পুরো মাসের হাতখরচের টাকা দিয়ে দিলেও বিলের টাকা হবে না। এখন কি করবে?
রনকের কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। রুহানি ধমক দিয়ে বলল,
“কিরে? খাচ্ছিস না কেন? আরে ভয় পাস না বিল তোকে দিতে বলব না।”
রনক লাজুল ভঙ্গিতে বলল,
“না আসলে তা নয়। আমি খাব না। এসব খাবারে আমি অভ্যস্ত নই।”
“অভ্যস্ত হয়ে যাবি। নে খা। নয়তো সব বিল তোকে দিয়ে দেওয়াব।”
বিলের কথা শুনে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও খেতে শুরু করল। রুহানি মনে মনে হাসছে।
।
খাওয়া শেষে রুহানি বলল,
“তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুই গ্রাম থেকে এসেছিস।”
রনক মাথা নিচু করে বলল,
“হ্যাঁ।”
“তোর বাবা কি করে? ”
“গরিব কৃষক।”
“তা তোকে দেখেই বুঝা যায়। স্কলারশিপ পেয়েছিস তাই না?”
“হ্যাঁ।”
রুহানি ক্ষিপ্র হয়ে বলল,
“পেয়েছিস ভালো কথা। এত পড়াশোনা করার কি দরকার? নিজে পড়ছিস অন্যকেও জ্বালাচ্ছিস। তোর জন্য আমাদের প্যারায় পড়তে হয়। কই ঘুরাঘুরি করবি, মজ-মস্তি করবি তা না বই নিয়ে পড়ে থাকিস। এত পড়ে কি হবে? বিদ্যাসাগর হবি? একটা সার্টিফিকেট পাবি। তারপর কি হবে? তারচেয়ে শোন তোকে আমি রোজ এইসব খাবার খাওয়াব, আর তোর এই দু’টাকার জামাকাপড় পড়ে ভার্সিটিতে কি করে আসিস? আমি তোকে দামি দামি জামাকাপড় কিনে দেব। টাকা দেব, ভালো ফোন কিনে দেব। তুই আমাদের মতো আসবি, যাবি, খাবি, ঘুরবি ব্যাস। আজকের পর তুই আর এত পড়াশোনা করবি না।”
রনক মৃদু হেসে বলল,
“সব ছেড়ে দিতে পারি কিন্তু বাবার স্বপ্নটা ছেড়ে দিতে পারি না। তুমি আমাকে পুরো পৃথিবী এনে দিতে পারো কিন্তু আমার বাবার খুশি এনে দিতে পারো না। তোমার অনেক টাকা-পয়সা আছে, বাড়ি-গাড়ি আছে কিন্তু আমার এসব কিছু নেই যা আছে সেটা হলো সুন্দর একটা স্বপ্ন। বাবা-মায়ের দেখা স্বপ্ন। যাকে কেন্দ্র করে আমরা বেঁচে আছি। আমার বাবা অনেক কষ্ট করে আমাকে পড়াশোনা করিয়েছে। তার অনেক স্বপ্ন। আমি অনেক পড়াশোনা করব। বড় চাকরী পাব। আমার অনেক নাম হবে। আমি শহরের চাকচিক্যতায় গা ভাসিয়ে দিতে নয় পড়াশোনা করতে এসেছি। অনেক কষ্ট করেছি এই স্কলারশিপ পেতে। এই সুযোগটা আমি হাতছাড়া করতে পারব না। তোমার বাবার টাকা আছে। তোমার ভবিষ্যত তোমার বাবা গড়ে দেবেন কিন্তু আমার ভবিষ্যত আমাকেই গড়তে হবে। নয়তো বাবার মতো কৃষি কাজ করে আজীবন পাড় করতে হবে। আমি পারব না বাবার স্বপ্নটা ভেঙে দিতে, বাবার মুখের হাসিটা কেড়ে নিতে। তার মুখের হাসিটা আমার কাছে অনেক দামি। এই হাসির জন্য আমি সব করতে পারি। দিন-রাত এক করে খেয়ে না খেয়ে পড়াশোনা করি শুধু তার মুখে হাসি ফুটাতে। তুমি প্লিজ আমার বাবার সে হাসিটা কেড়ে নিও না।” (হাতজোড় করে)
রুহানি রনকের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর চোখ ছলছল করছে। রুহানির মায়া হলো। কেউ বাবার স্বপ্নকে, পরিবারের স্বপনকে এত প্রায়োরিটি দেয়?
রুহানিকে দূর থেকে ফালাক দেখছে। এমন গেটাবের একটা ছেলের সাথে এক সাথে বসে আছে দেখেই অবাক লাগছে। রুহানি অহংকারী একটা মেয়ে। যার তার সাথে মিশে না। ওর ক্লাস দেখে মিশে।
রুহানি রনককে বলল,
“যা পূরন কর তোর বাবার স্বপ্ন। কোন হেল্প লাগলে বন্ধু হিসেবে বলবি। আমি আমার বাবাকে অনেক ভালোবাসি। তাই কারো মুখে বাবাকে ভালোবাসার কথা শুনলে, সম্মান করার কথা শুনলে ভালো লাগে খুব।”
রনক রুহানির কথা শুনে মনে মনে খুশি হয়ে গেল।
চলবে…..