নিরব সে,১৬শ পর্ব,১৭
সাদিয়া_সৃষ্টি
১৬শ পর্ব
রাউন্ড থেকে ফিরে এসে ওয়াফিফ নিজের কেবিনে ঢুকল। নিজের সাদা এপ্রোন টা চেয়ারে রেখে গলা থেকে স্টেথোস্কোপ টা নামিয়ে টেবিলের উপর রাখল। তখন চোখ পড়ল টেবিলে রাখা ফোনটার দিকে। ফোনের উপরে নোটিফিকেশনের আলো জ্বলছে, নিভছে। ফোন অন করলে হয়তো মিসড কলের ম্যাসেজ ও পাবে। ওর মা বার বার বলে দিয়েছিল যাতে পারলে বাড়ি ফিরে আসে আর মামার সাথে দেখা করে যায়। কিন্তু ওয়াফিফ প্রতিবারের মতো এড়িয়ে যেতে চায়। ও জানে, ওর মামা আজ রাতে সেখানে থাকবেন। তাই ও ভেবে রেখেছে সব কাজ শেষ করে একেবারে বাড়ি ফিরবে। কাজ ফেলে রেখে সে বাড়ি ফিরবে না। এতে করে ততক্ষনে মামারা ঘুমিয়ে পড়বে। আর দেখা হলে হবে সোজা সকালে। ওয়াফিফ যে আত্মীয় সামলাতে পারে না, এমনটা না। সবার সাথে ওর ভালোই মেলামেশা আছে। কিন্তু ও মুখোমুখি হতে চায় না। সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা থেকেই। এই ইচ্ছার আলাদা কোন কারণ নেই। শুধু চায় না তাই এসব ফ্যামিলি গ্যাদারিং এড়িয়ে চলে। না চাইতেও ফোন অন করে দেখল। মায়ের মিসড কল। জানা কথা। তাও একটা ম্যাসেজ পাঠাল,
”আমি হাসপাতালে আছি, বাড়ি ফিরে দেখা করব একেবারে।”
লিখেই পাঠিয়ে দিল তার ক্ষুদে বার্তা। তারপর ফোন বন্ধ করে নিজের কেবিনে থাকা বেডের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। এক হাত বুকে আর এক হাত কপালে রেখে নিজের চোখ ঢেকে। আর ভাবতে থাকল তার জীবনটা সত্যিই যদি পরিকল্পনা অনুসারে হত তাহলে কেমন হত? জিনিয়ার জায়গায় হয়তো অন্য কেই থাকত, তার জীবনটাই একেবারে অন্য রকম হত। এতো বছরে হয়তো তারও একটা সন্তান থাকত। এমন হাজার চিন্তা এসে জমা হল তার মস্তিষ্কে। আর সাথে সাথে চোখে জড়ো হল ঘুম। কিন্তু তন্দ্রায় থাকা অবস্থায় ডাক পড়ল এক নার্সের।
–ড. রহমান, রুম নং *** এর পেশেন্ট এর অবস্থা দেখতে বলেছেন ড. রায়।
–ওকে আমি আসছি।
ভেতর থেকেই জবাব দিল ওয়াফিফ। ফোনের দিকে একবার তাকিয়ে সেটা নিতে গিয়েও নিল না। নিজের এপ্রোন পরতে পরতে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।
।
জিনিয়া নিজের ঘরে বসেই ভাবছে আজ ভেবেছিল মামা আসায় ওয়াফিফ ও দ্রুত বাড়ি ফিরবে। আর তার সাথে কথা বলাও হয়ে যাবে। জাবিরের কথা জানাতে চায় সে। অন্তত জাবিরের বাহানায় হোক, তাও ওয়াফিফের সাথে ১ বার তো কথা হোক। আজকাল তো কথাই হয় না। ডাক্তার সাহেব ব্যস্ত মানুষ। তার থেকে ব্যস্ত মানুষ যেন পৃথিবীতে খুব কম পাওয়া যাবে। কিন্তু ওয়াফিফের কথা না বলার কারণ কি? কোন কারণে ওয়াফিফ এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে? হাসপাতালের কাজে? জিনিয়ার ইচ্ছা করছে ওয়াফিফের হাসপাতালের মালিক নিজে হয়ে ওয়াফিফকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করতে। কিন্তু না পারছে সে মালিক হতে, আর না পারছে ওয়াফিফ এর চাকরি খেতে।
নিজের মাথায় নিজের হাত দিয়ে হালকা মারল জিনিয়া। আজকাল ও কি সব ভাবতে শুরু করেছে। এই জিনিয়া আগে পেটে বোম ফাটালেও কথা বের করা যেত না। সে আজকাল ওয়াফিফের জন্য নিজের মনে হাজার চিন্তা করে। নিজে নিজেই বিড়বিড় করে কথা বলে। নিজের পরিবর্তনে নিজের হতবাক। ওয়াফিফের চাকরি খাওয়ার কথা ভাবছে সে। ভাবতেই নিজে নিজেই হাসা শুরু করল। আচ্ছা, এমন হলে কি হত না যে জিনিয়াও ডাক্তার। তাহলে ওয়াফিফের সাথে একই হাসপাতালে কাজ করত আর যখন ইচ্ছা, তখন দেখা করতে পারতো। কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়। সে তো আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করেছে। ডাক্তার হওয়া থেকে হাজার মাইল দূরে সে। হতাশার সুরেই কথাটা মনে মনে আওড়াল সে।
ওয়াফিফের কথা ভাবতে ভাবতে জিনিয়া জাবিরের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছে। এমনটা হয় তার সাথে প্রায়ই। ওয়াফিফের চিন্তায় এতই মগ্ন থাকে যে সব কিছুই ভুলে যায় যেন। তবে ওয়াফিফকে নিয়েই ভাবতে বেশ ভালো লাগে তার। কখন সময় কেটে যায় , বোঝাই যায় না। ওয়াফিফের প্রতিটা কাজ সম্পর্কে বারবার ভাবে। যেন সে ”ওয়াফিফ” নামক বইটা মুখস্ত করছে।
।
ওয়াফিফ বাড়ি ফিরে দেখল আজও লাইট বন্ধ সব ঘরের। সে সাবধানে দরজা বন্ধ করল যাতে শব্দ না হয়। তারপর কিছু একটা মনে পড়তেই দ্রুত নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। গিয়েই আগে নিজের দৃষ্টি জানালাতে আটকাল। জিনিয়াকে না পেয়ে আশেপাশে চোখ বুলাল। লাইট জ্বালাতেই নিজের বিছানায় জিনিয়াকে আবার ঘুমন্ত অবস্থায় পেল। শান্ত হল সে। আগেরবার জিনিয়া জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছিল। সেই চিন্তায় এতো দ্রুত নিজের রুমে আসা ওয়াফিফের। জিনিয়ার দিকে তাকাতেই তার মনে পড়ল আজ জিনিয়া তাকে প্রথমবার ফোন করেছিল। বিয়ের পর ৩ মাসে ১ম। তার এখন অদ্ভুত এক ইচ্ছে হল। জিনিয়ার কল দেওয়ার ছবি প্রিন্ট করে নিজের ঘরে ঝুলিয়ে রাখার। তাছাড়া একটা রেকর্ডিং থাকলে বেশি ভালো হত। কিন্তু রেকর্ড করা হয় নি। ছবি প্রিন্ট করার বিষয়টা সম্পর্কে পরে ভাবা যাবে এই ভেবে সে ফ্রেশ হয়ে নিল। খাওয়া দাওয়া করে একেবারে এদিক ওদিক না তাকিয়ে নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দিল। সারাদিন সে দাঁড়িয়ে ছিল আর নাহয় বসে ছিল। তাই এতক্ষণ ক্লান্তি টের পায় নি। বিছানায় শুতেই পিঠে ব্যথা চাড়া দিয়ে উঠল। সারাদিনের ব্যথা এক বারে আঘাত করল তাকে যেন। সে ব্যথা কমাতে পাশ ফিরতেই জিনিয়ার মুখ নজরে পড়ল। কিছু চুল তার মুখের উপর এসে পড়েছে। ঘুমের ঘোরেই হয়তো ফুঁ দিয়ে চুল সরানোর চেষ্টা করছে আর ব্যর্থ হয়ে মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলছে। ওয়াফিফের খেয়াল হল এই কয়দিন কাজের চাপে জিনিয়া আর বাকি সবার সাথে কথাই বলা হয় নি। বিশেষ করে জিনিয়ার সাথে কথার ‘ক’ বলাও হয় নি। অন্যদের সাথে হলেও। আর তখন সাথে সাথে মাথায় এলো জিনিয়ার ফোন দেওয়ার কথা। তাহলে জিনিয়া কি এজন্যই সাহস করে ওয়াফিফকে কল করেছিল তখন? ভাবতেই মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠল। তবে বেশি সময় না যেতেই আবার চিন্তা ভর করল সেখানে। জিনিয়া কি ভাবছে যে ওয়াফিফ অন্য কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছে? না কি এমন ও ভাবতে পারে ও জিনিয়াকে ইগনোর করছে? এমন ভাবতে তো তার সংসার ভাঙবে।
ভাবতেই এক লাফে বিছানায় শোয়া থেকে বসে পড়ল। আর এক হাত মাথায়। এখন কি তার সংসার ৩ মাস ও টিকবে না?
”বউয়ের সাথে ৩ মাসের মাথায় কোন কথা না হওয়ায় স্ত্রী ডিভোর্স ফাইল করেছেন”
শিরোনাম টা মাথায় আসতেই নিজেকে গালি দিতে ইচ্ছে করল তার।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার খেয়াল হল যে সে কি পরিমাণে বাচ্চামো করছে এই রাতবিরাতে। মাঝ রাতে সে নিজের ঘুম কে বলি দিয়ে কি না একটা ফালতু কথা ভাবছে? ভাবতেই নিজেকে আরও ২ দফা বকাবকি করল মনে মনে। কয়েক বার মুখ দিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তা ত্যাগ করল।
নিজের মাথা থেকে সব আজগুবি চিন্তা বের করে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। তখন আবার জিনিয়ার মুখের দিকে চোখ পড়তেই চাঁদের আলোয় দেখতে পেল জিনিয়ার মখে তখনও বিরক্তির ছোঁয়া লেগে আছে। সে কিছুক্ষণ ভেবে জিনিয়ার কপালের সামনে থাকা ছোট চুলগুলো দেখে মাথা থেকে এর কিছু ছোট চুল সাবধানে টেনে বের করল। তারপর মুখের উপর রেখে দিল। আবার সেই চুল গুলো ধরে জিনিয়ার মুখের সামনে নাড়াল কিছুক্ষণ। এতে জিনিয়ার ঘুম না ভাঙলেও বিরক্তির মাত্রা দ্বিগুণ হল। এবার ওয়াফিফ জিনিয়াকে আর না জ্বালিয়ে সেই চুলগুলো সরিয়ে দিল। জিনিয়া মুখে তখন এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল ঠিকই। কিন্তু ওয়াফিফের বোঝার আগেই জিনিয়া ওয়াফিফের হাত ধরে সেখানে এক কামড় বসিয়ে দিল 🙂 ।
ওয়াফিফ চিৎকার করতে গিয়েও পারল না। কিছুক্ষণ ভেবেও এই কামড়ের কুল কিনারা না পেয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল। আরও কিছুক্ষন গয়েন্দাগিরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু সারাদিনের ক্লান্তি তাকে চোখ খুলে রাখতে দিল না আর।
।
সকালে ঘুম ভাঙতেই জিনিয়ার ঘুমন্ত মুখ দেখল ওয়াফিফ কিন্তু রাতেই কথা মনে পড়তেই আর সেই মুখ দেখতে ইচ্ছে হল না তার। বিনা অপরাধে কামড় খেয়েছে সে। কি করে চুপ থাকতে পারে? এতটাই সহজ?
সে জিনিয়াকে জাগিয়ে দিল। জিনিয়া নিজের হাত দিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাতেই নিজের এতো কাছে ওয়াফিফের মুখ দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠল। আর সাথে কেপেও উঠল। জিনিয়া কেঁপে উঠা দেখে ওয়াফিফ নিজের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে না পেরে সাথে সাথে জিনিয়ার উপর পড়তে নিলে নিজেই সরে গিয়ে খাটের নিচে পড়ে গেল। তখনও তার মাথায় চলছে জিনিয়ার ব্যথা লাগে নি তো? তার পেটে চাপ লাগে নি তো। সে নিজে কোন মতে উঠে জিনিয়াকে দেখতে লাগল সব ঠিক আছে কি না। জিনিয়া ওয়াফিফের এহেন কাজে বোকা বনে গেল। আসলে কি হচ্ছে সকাল সকাল?
জিনিয়া ঠিক আছে দেখে সে আবার জিজ্ঞেস করল,
-তুমি ঠিক আছো তো জিনিয়া, কোথাও লাগে নি তো? ব্যথা করছে না তো? করলে আমাকে বল। কি হল কথা বলছ না কেন?
–লাগে নি আমার। আপনি এখানে কিভাবে? কখন এলেন?
–সেটা বড় কথা না , আগে বল কাল রাতে কি তুমি স্বপ্ন দেখেছিলে?
–জ্বি , দেখেছি। আপনি জানলেন কি করে?
–কি দেখেছিলে আগে সেটা বল।
–ওহ, কাল রাতে দেখলাম আমি … আমি আমার বাড়ি গিয়েছি, সেখানে আমার এখাতে মেহেদি দেওয়া আর আরেক হাত দিয়ে আমি খাচ্ছি। বারবার চুল উড়ে এসে মুখের উপর পড়ছিল। হঠাৎ করে একটা চিকেন লেগপিস নিয়ে যেই না কামড় দিয়েছি, সাথে সাথে আমার একটা দাঁত ভেঙে গিয়েছে।
–কি?
–হ্যাঁ তো, তারপর আপনিই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন, আর বার বার বলছিলেন যে তোমার মুরগি খাওয়া বন্ধ, একেবারে দাতের ব্যবহার হবে এমন খাবার খাওয়া বন্ধ, তারপর শুধু সুপ খেতে দিবেন আমাকে। কত বকেছিলেন আপনি। স্বপ্নেও বোকা দিয়েছেন আমায়।
বলেই মুখ লটকাল জিনিয়া। জিনিয়া মুখ দেখে ওয়াফিফ সাথে সাথে বলে উঠল,
–আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি কিছু বন্ধ করব না, আর বকাও দিব না। দরকার হলে আজই তোমাকে মুরগি খাওয়াবো, রান্না না করেই। ঠিক আছে?
–আপনি কি আমাকে আদিম কালের মানুষ পেয়েছেন যে রান্না না করেই খাওয়াবেন?
–আচ্ছা, ঠিক আছে রান্না করাই খাওয়াবো।
–ঠিক আছে, আমি এখন যাই।
বলেই জিনিয়া উঠে সেখান থেকে চলে গেল বাথরুমে। ওয়াফিফের মাথায় আসতেই সে আবার নিজেকে কয়েক দফা বকল। জিনিয়ার উপর কোথায় রাগ দেখাবে বলে আসলো। শেষে নিজেই কি না ভুলে গেল রাগ দেখানোর কথা? তখন জিনিয়ার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল একটা বাচ্চা ওর উপর রাগ করেছে। এটা দেখে নিজের রাগের কথাই ভুলে গিয়েছিল সে। বাচ্চা একটা। কিছুদিন পর নিজেই বাচ্চার মা হবে কি না সন্দেহ ।
ওয়াফিফ নিজে ফ্রেশ হয়ে জখন খেতে বের হল তখন নিজের মামা মামীকেও দেখল। তাদের সাথে কথা বলায় লেগে পড়ল সে।
চলবে।
”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
১৭শ পর্ব
ক্যাফের একটা চেয়ারে বসে আছে জিনিয়া। উদ্দেশ্য আজ একেবারে জাবিরের সাথে শেষ দেখা করবে। সামনের নীল টেবিলের দিকেই দৃষ্টি আটকে আছে। এখানে সে আগেও এসেছিল। ৪ মাস আগে। সেদিনের পর তার জীবনটাই বদলে গিয়েছিল। ওয়াফিফের সাথে দেখা হওয়াটা তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত গুলোর মধ্যে একটি। ওয়াফিফের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে যদি পর্যবেক্ষণ করা হয় পরের সময় গুলো তাহলে দেখা যাবে জিনিয়ার জীবন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। ওয়াফিফের কথা , যত্ন নেওয়া, কিংবা পরিবার মানিয়ে নেওয়ায় দেওয়া উপদেশগুলো। মাঝে মধ্যে মনে হয়েছে ওয়াফিফ নিজে অন্য কোন বাড়ির ট্রেইন্ড বউ ছিল। তার কাছে যেন সব সমস্যার সমাধান আছে। অবশ্য নিজের পরিবারকে ওয়াফিফের থেকে ভালো কেই বা চিনবে?
সামনে টেবিলে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে জিনিয়া। একটাই অপেক্ষা, ওয়াফিফের কল বা ম্যাসেজের। সে ওয়াফিফকে নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর কথা ভেবেছিল। সে চেয়েছিল ওয়াফিফের সাথে কথা বলার। কিন্তু পারে নি। কোন সুযোগ ই পায় নি। আগে যখন ওয়াফিফ সব সময় ওর সাথে কথা বলত, তখনই জিনিয়া একটা কথা বলতে বেশ সময় নিত। কিন্তু এখন ওয়াফিফ বেশ ব্যস্ত মানুষ। তাকে বলবে কি বলবে না এটাই ভাবতে ভাবতে অনেকটা সময় পার করে ফেলেছে। ওয়াফিফের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু একেক বার একেক সমস্যা হত, একবার পরিবারের কেউ ডাকত, তো অন্যবার কেই কল করত। কোন সময় ওয়াফিফের হাসপাতালে যেতে দেরি হয়ে যেত। তো রাতে জিনিয়া নিজেই ঘুমিয়ে পড়ত। কিন্তু কথা ঠিক মতো হত না। ”আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।” এই টুকুতেই আটকে যেত জিনিয়া। ওয়াফিফ ও রে শুনব, পরে শুনব করে ১ সপ্তাহ পার করে দিয়েছে। কিন্তু এখনো শোনে নি। তাই জিনিয়া এখানে আসার আগে ছোট একটা ম্যসেজ পাঠিয়েছে ওয়াফিফকে।
”আমি আজ জাবিরের সাথে দেখা করতে *** ক্যাফেতে যাচ্ছি। আপনাকে অনেক বার বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারি নি। সরি। আপনাকে অনেক কিছু বলার ছিল। ”
এইটুকু লিখেও পাঠাবে কি না এই নিয়েই সে ২০- ৩০ মিনিট ভেবেছে। একবার ম্যাসেজ মুছে ফেলেছে তো আবার লিখেছে। তারপর ভুল করে চাপ লেগে যখন ম্যাসেজ চলে গেল তখন ডিলিট করার কোন সুযোগ নেই বিধায় আর কিছু ভাবে নি।
জাবিরের সাথে দেখা করার ইচ্ছা জিনিয়ার ছিল না। কিন্তু জাবির রোজ ওয়াফিফের বাড়ির সামনে এসে জিনিয়াকে ফোন করে। সব সম্পর্ক ঠিক করতে চায়। কয়েক বার জিনিয়ার বাড়িতে বেল ও বাজিয়েছে। দরজা খোলার সময় জিনিয়া খুলেছিল। তাই আর অন্য কেউ জানতে পারে নি। কিন্তু প্রতিবার ভাগ্য সাথে থাকবে না। আর এটা বেশি বাড়তে দেওয়াও উচিত না। তাই সে চেয়েছে সব কথা একদিনে শুনে শেষ করতে সব কিছু। আর কোন দেখা বা কথা হবে না। আর না জাবির বার বার দাবি করতে পারবে যে জিনিয়া তার কথা শোনে নি। অনেক ভাবার পর জিনিয়ার কাছে এটাই ঠিক লাগল। সে এর জন্য তার বান্ধবী রাইসার সাথেও কথা বলেছে। আর ঠিক করেছে সে রাইসার সাথে ক্যাফেতে যাবে। রাইসাও এখন তার পাশেই বসে আছে আর নিজের ফোন চালাচ্ছে। রাইসা বলেছিল ওদের মধ্যকার সমস্যা একদিনে কথা বলে সব শেষ করতে। জাবির যা বলতে চায় ওকে তাই বলতে দেওয়া হোক। আর তারপর সব ঠিক করতে। কিন্তু জিনিয়ার জোর করায় সেও এখানে এসেছে। রাইসা জাবির আর জিনিয়া সম্পর্কে সব ই জানে। তাই ওকে এখানে এনেছে জিনিয়া। রাইসাও কোন কাজ না পেয়ে এখন বসে বসে ফোন চালাচ্ছে।
জিনিয়া এখনো ভেবে যাচ্ছে তার এখানে আসা কি ঠিক হয়েছে কি না, তবে পাশে রাইসা বসে থাকায় তার একটু ভালো লাগছে। ভয়টা কমেছে তার।
কিছু সময়ের মধ্যে জাবির ও এসে গেল। সে এসে জিনিয়াকে দেখে যেমন খুশি হল , তেমনই রাইসাকে দেখে একটু অবাক হল। তাদের মাঝে রাইসার আসা নিয়ে কোন কথা হয় নি। অবশ্য কথা হয়েছে মাত্র ২ লাইন। যার মধ্যে জিনিয়া বলেছিল যে ওর সাথে দেখা করবে। আর জাবির ওকে বলেছিল। তারপর এই ক্যফেতেই দেখা। কিন্তু নিজের অনুভূতি প্রকাশ না করে সে সেখানে গিয়ে জিনিয়ার বরাবর সামনের চেয়ারে বসে পড়ল। আর জিজ্ঞেস করল,
–কেমন আছো তোমরা?
জিনিয়া কোন ভণিতা না করে সরাসরি জবাব দিল,
–যেটা বলতে এসেছ সেটা বল।
–এখন কি আমার সাথে কথা বলতেও তোমার ভালো লাগে না জিনিয়া।
পাশ থেকে রাইসা একটু কঠোর সুরেই উত্তর দিল,
–জাবির, যেটা বলতে এসেছিস, সেটা বলে ফেল, আমার এখনো অনেক কাজ আছে। তাই যা বলার তাই বল, কোন ফালতু কথা না।
রাইসার এমন কথায় অবাক হল না জাবির। জাবির জানে, রাইসা জিনিয়ার সব কথা জানে। জিনিয়া শুধুমাত্র রাইসাকেই সব কথা বলে। কাউকে কিছু না বলতে পারলেও। আর রাইসা আগের ৫ মাস জিনিয়ার সাথে জাবিরের কথা চিন্তা করলেও তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। রাগে তার মাথা গরম হয়ে যায়। তাই জাবির কে এখন সে একদম পছন্দ করে না। জাবিরের চেহারা দেখার ইচ্ছে তার ছিল না। এক সময় ভালো বন্ধু হলেও এখন আর নেই। কিন্তু জিনিয়াকে আবার একা সে জাবিরের কাছে পাঠাবে না। আগের বার ও সে পাঠিয়েছিল আর সেজন্য আজও নিজেকে দোষী ভাবে সে। না সে জিনিয়াকে জাবিরের সাথে কথা বলতে বলত আর না জিনিয়া আজ এই অবস্থায় থাকত। জাবিরের থেকে ওয়াফিফ অনেক বেশি ভালো এটাই মনে করে রাইসা।
–আমি নিজেকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ চাচ্ছিলাম জিনিয়া, এতদিন আমি কেন তোমার সাথে এমন ব্যবহার করেছিলাম, সেটাই।
–জলদি বলে ফেল, আমি তোর জন্য অপেক্ষা করতে পারব না, আর জিনিরও কাজ আছে।
রাইসার ব্যবহারে মলিন হাসল জাবির। অবশ্য এর থেকেও খারাপ ব্যবহার আশা করেছিল সে। নিজেকে শান্ত করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করল,
–এর শুরুটা হয়েছিল আমার থেকেই। আমার সাথে তরুণের একটা সমস্যা হয়েছিল অনেক আগে। কিন্তু তারপর আমি নিজেই তার সাথে সব ঠিক করে নিয়েছিলাম। আর আমরা ২ জন বন্ধু হয়ে যাই, বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু এসবই ওর অভিনয় ছিল এটা আমি জানতাম না। তোমার সাথে আমার রিলেশনের পর হঠাৎ একদিন তরুণ আমাকে তোমায় নিয়ে অনেক কথা বলে। আমাদের রিলেশন ঠিক না, কিংবা তুমি আমাকে নিয়ে সিরিয়াস না। আমার কি হয়েছিল জানি না, তবে ওর কথায় পড়ে গিয়েছিলাম। শুধু এগুলই না। আরও অনেক কথা বলেছিল। ওর কথা গুলো এমন ছিল যে প্রতিটা কথা ঠিক বলে মনে হচ্ছিল। ওর লজিক গুলো আমি কোনটাই না করতে পারছিলাম না। ওর কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল আমার তোমার প্রতি কোন ফিলিংস নেই। আমি নিজেই নিজের অনুভূতি নিয়ে চিন্তায় ছিলাম যে আমি নিজে কি তোমার প্রতি সিরিয়াস? এই নিয়ে আমি তরুণের সাথে আরও কথা বলি। রোজ বলতাম। আর ওর বলা প্রতিটা কথা আমার সত্যি মনে হত। নিজের দ্বারা দাঁড় করানো সব যুক্তি যেন ভুল প্রমাণিত হত। আমি যেখানে নিজেই কনফিউস ছিলাম, সেখানে তোমাকে কি করে আমার নিজের সাথে জড়াতাম, এটাই মনে করতাম। নিজের যোগ্যতায় নিজে প্রশ্ন করতাম। আমি তোমার যোগ্য কি না। কিন্তু উত্তর না পেয়ে আরও নতুন প্রশ্নের দেখা পেতাম। নিজে এক অনিশ্চয়তায় পড়েছিলাম, যার সাথে তোমাকে জড়াতে চাইছিলাম না। আমার অজান্তেই আমার মস্তিষ্ক অন্য কেউ চালাচ্ছিল। নিজের মতো করে। আমি তার কথা মতই চলছিলাম। এক সময় মনে হল তরুণ ই ঠিক। আর আমার করা সব কিছুই ভুল।
সেবার তুমি যখন বললে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, আমি গিয়ে প্রথমে তরুণের সাথেই কথা বলেছিলাম, ও বলেছিল তুমি মজা করছ। আমার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল। কি করা উচিতবুঝতে পারছিলাম না। তরুণ বলল তোমার থেকে আরও দূরে থাকতে। ও আমাকে বলল আমাকে একটা ওষুধ দিবে, যেটা আমার সব চিন্তা দূর করে দিবে। সেটাই দিত তরুণ। কিন্তু হঠাৎ করে তুমি চলে এলে। যার কারণে আমি নিজেও জানতাম না ওষুধ কোথায় আছে বা কিভাবে দিয়েছে। একসাথে থেকে সেদিন আমি তোমাকে যেই খাবার খেতে দিয়েছিলাম সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল যে সেটা তরুণের আনা খাবার ছিল। আমিও কিছু বুঝতে পারলাম না। আর না খাওয়ার পর নিজের হুঁশে ছিলাম। তারপর সকালে তোমাকে ওই অবস্থায় দেখে নিজের উপর রাগ উঠেছিল। কিন্তু তোমাকে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। কি হয়েছিল কিছুই মনে পড়ছিল না। আমি নিজেও সেটা জানতে অনেক দেরি করে ফেলেছিলাম।
তারপর আমার বন্ধু রবির কাছে জানতে পারলাম তরুণের এসব করার কারণ। সবাই জানত আমি তোমাকে কত ভালোবাসি। তাও ও তোমাকেই টার্গেট করেছিল। আমার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। আমার থেকে তোমাকে আলাদা করে আমাকে রোজ কষ্ট পেতে ও নিজের চোখে দেখেছি। রবি যখন সব খুলে বলল তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম প্রতি বারের মত তুমি আবার আমার সাথে কথা বলতে আসবে। কিন্তু তুমি আর এলে না। সেদিন যখন রিতিকা আপু ডাকল তখন প্রথম ধাক্কাটা খাই। জানতে পারলাম তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বিশ্বাস করতে পারি নি। ভেবেছিলাম আমার উপর রাগ করে এমন কথা বলছিলে তুমি। আপুকেও হয়তো তুমিই রাজি করিয়েছিলে এমন কথা বলানোর জন্য। তাই বার বার ছুটে গিয়েছি তোমার কাছে। কিন্তু সেদিন তুমি সত্যিই তোমার বরের সাথে আমার দেখা করালে। তখন বুঝতে পারছিলাম আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। আর আগের ৫ মাসে আমি তোমার পাশাপাশি নিজেকে কতটা ভুল বুঝেছিলাম। কিন্তু সব আমার হাতের বাইরে চলে এলো। তারপর আবার পরের দিন তোমার বাড়িতে গেলাম, কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম তুমি আবার নিজের শ্বশুর বাড়িতে ফিরে গিয়েছ। তারপর কি করব বুঝতে পারছিলাম না। তরুণের সাথে আর দেখা হয় নি। শুনেছিলাম ও না কি বিদেশে চলে গিয়েছে। আর ওখানেই নিজের পড়া কন্টিনিউ করবে। তাই নিজে ভালো চাকরি নিলাম, নিজের আলাদা ঘর কিনলাম। তারপর তোমাকে মানাতে আসলাম। আজও আমি তোমার অপেক্ষায় আছি জিনিয়া। আমি তখন আমার দিক দিয়ে কিন্তু সম্পূর্ণ ভুল ছিলাম না। আমিও পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম। যেখানে আমার চিন্তা ভাবনা আরেকজনের দখলে ছিল। ব্রেইন ওয়াশ করা হয়েছিল আমার।
বলার পর কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটল । ২ জনেই চুপ করে সব কথা শুনেছে। জিনিয়া আজ কাঁদে নি। সে ভেবে রেখেছে, সত্য যতই খারাপ হোক না কেন, আজ সে এদের সামনে কাঁদবে না। সে ওয়াফিফকে যখন সব বলবে তখন ওয়াফিফের বুকে মাথা রেখে কাঁদবে। ওয়াফিফ ছাড়া অন্য কারো সামনে নিজেকে দুর্বল হিসেবে প্রকাশ করবে না।
তাই নিজেই বলে উঠল,
–আর কিছু বলতে চাও তুমি জাবির?
–আমি আজও তোমাকে ভালোবাসি জিনিয়া, হয়তো আগের থেকেও অনেক বেশি। আমি এখনো তোমাকে নিয়েই বাঁচার স্বপ্ন দেখি। তোমাকে ভালো ভাবে রাখার জন্য আমি নিজেকে গড়ে তুলেছি। তোমার দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্য হয়ে তোমার কাছে আবার ফিরে এসেছি। এবার ও কি ফিরিয়ে দিবে আমায়?
–রাইসা, চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর জাবির, আশা করি তোমার সব কথা বলা শেষ। আমাকে আর ফোন করবে না। পারলে নিজে বিয়ে করে নিয়ে সুখে থেকো। আমি দোয়া করব তোমার সুখী জীবনের জন্য। আমি এখন অন্য কারো স্ত্রী, অন্য কারোর সাথে আমার জীবন জড়িয়ে গিয়েছে। তোমার সাথে সব আমার অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই আর বলার কিছু নেই। ভালো থেকো।
জাবির মলিন হাসল। সে ভাবতে পারে নি জিনিয়া এমন কথাও বলবে বা বলতে পারে। সে জানে তার ভালোবাসা হয়তো শেষ হয়ে যায় নি, কিন্তু জিনিয়া এখন অন্য কারো। জিনিয়ার ইচ্ছা থাকলে একটা কথা ছিল। একটা আশা ছিল। কিন্তু সেই জিনিয়াই মানা করে দিয়েছে। এখন তার করার কিছুই নেই।
রাইসা ওঠার সময় হাতের সাথে লেগে পানির গ্লাসটা তার জামার উপর পড়ে গেল। তাই সে ওদের বলে ওয়াশরুমে চলে গেল। জাবির আর জিনিয়া ওখানেই বসে রইল আর রাইসার অপেক্ষা করতে থাকল।
ওয়াফিফ আজ দুপুরেই নিজের বাড়ি ফিরছিল। যার জন্য এতো ব্যস্ততা সে আজ ফিরে যাচ্ছে। তাই তার আজ থেকে আর ব্যস্ততা নেই। খুব খারাপ লাগছে ওয়াফিফের। কিন্তু কিছি তার হাতে নেই। সে এলোমেলো কদম ফেলে হেঁটে চলেছে। মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছে। তাও নিজেকে সামলে নিয়ে সেই ভাবেই হাঁটছে। হঠাৎ সামনে চোখে পড়ল ক্যাফেতে বসে থাকা মানুষ দুটোকে। চিনতে কষ্ট হয় নি। জিনিয়া আর জাবিরকে মুখোমুখি বসে থাকতে দেখে তার অজানা রাগ উঠল। সে এতক্ষণ মন খারাপ করে থাকলেও এখন তার থেকে বেশি রাগটাই প্রকাশ পাচ্ছে তার মধ্যে। সে রেগে সেখান থেকে চলে গেল বাড়ির উদ্দেশ্যে।
রাইসা ঠিক হয়ে বের হয়ে এলো আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে জিনিয়ার হাত ধরে টানতে টানতে সেখান থেকে চলে গেল।
চলবে।