নিরব সে,১৪দশ পর্ব,১৫

নিরব সে,১৪দশ পর্ব,১৫
সাদিয়া_সৃষ্টি
১৪দশ পর্ব

সূর্যের আলো চোখে পড়তেই চোখ ধীরে ধীরে খুলতে থাকে জিনিয়া। নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করতেই অবাক হয়। ধীরে ধীরে উঠে বসে। দুই হাত দিয়ে নিজের চোখের কাছে নিয়ে যায় চোখ মুছতে। তখন মনে পড়ে ওয়াফিফের কথা।

”অকারনে কখনো চোখে হাত দিবে, বিশেষ করে মোছার জন্য। জানো এতে করে কত জীবাণু চোখে পড়তে পারে। তাছাড়া আমাদের চোখ অনেক সেনসিটিভ জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। যদি নিজের খেয়াল না রাখতে পারো তাহলে পরে সমস্যা হবে। আমার মতো চশমাও পরা লাগতে পারে।”

কথাটা মনে পড়তেই আনমনে হেসে উঠল জিনিয়া। ওয়াফিফের বলা প্রতিটা কথা তার যেন মুখস্ত হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার হওয়ায় যতক্ষণ জিনিয়ার সাথে থাকে, উঠতে বসতে খেয়াল রাখে আর নানান কথা বলে। জিনিয়ার নিজের ইচ্ছা ছিল মেডিকেলে পড়ার। কিন্তু চান্স পায় নি। আর তখন টাকার অভাব ও ছিল তাদের পরিবারে। তাই সে আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করে আর পাশাপাশি টিউশনি করে। ইচ্ছা ছিল এমএ পাশ করে চাকরি খোঁজার। তবে তার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। আর ওয়াফিফের মতো মানুষের দেখা মিলে তার।

ওয়াফিফের কথা মনে আসতেই আবার মনে পড়ে কাল রাতের কথা। সে নিজের শাড়ি ঠিক করে একবার দেখে নিয়ে উঠে পড়ে। এতক্ষণ সে এক বারও পাশে তাকায় নি। কাল রাতে সে জানালার কাছে বসে থেকেই রাত কাটিয়ে দিয়েছিল কি না সেটাও মনে নেই। আবার মনে পড়ল রাতে ডাইনিং টেবিলের উপর খাবার রেখে দিয়েছিল। সেটাও সরানো হয় নি। বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল জিনিয়া? ভাবতেই নিজের অবাক লাগে । সে কখনো বসে বসে ঘুমায় নি। ছোট থাকতে চেষ্টা করেছিল ঠিকই। কিন্তু পারে নি। মায়ের বকা শুনে বিছানায় শুয়ে পড়তে হত। আর তারপর যত বড় হতে থাকে, এসব বিষয় মাথা থেকে ততই চলে যেতে থাকে। যেন অনেক দিনের বালু এসে জমে যায় সেসব স্মৃতির উপর। আবার যখন হঠাৎ তেমন একটি ঘটনা ঘটে তখন মনে হয়, এক জোর হাওয়া এসে সেই বালু উড়িয়ে নিয়ে যায়। তেমনটাই লাগল জিনিয়ার। সে ভাবনার মধ্যেই আগে রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে পা বাড়াল। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে সব ঠিকঠাক ভাবেই আছে। টেবিলে কিছুই নেই। ফ্রিজের কাছে গিয়ে সেটা খুলতেই রাতে রান্না করা খাবার গুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। তার মনে পড়ছে না যে রাতে সে কখন এসব কাজ করল? সে কি আদৌ ঘর থেকে বের হয়েছিল? কারণ অতো সকালে কেউ উঠে না। আর রাতে একবার সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর সে দেখে গিয়েছিল। সব ঠিকই ছিল সেখানে। নিজের মাথায় হাত দিয়ে হালকা মারে জিনিয়া। তবু কিছু মনে না পড়লে আবার নিজের রুমে ফিরে আসে। আসতেই চোখে পড়ে বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটাকে। এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে তার মুখে।

ওয়াফিফ কাৎ হয়ে শুয়ে ছিল। এবার তার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে উঠে। কে করেছে এসব কাজ বা করতে পারে? সে হাসি মুখে এগিয়ে যাওয়ার আগে চোখে পড়ে টেবিলে রাখা বাটি আর রুমালের দিকে। যেটা তখনও পানিতে ডুবানো। আর পাশে কিছু ওষুধ রাখা। সাথে সাথে চিন্তার রেশ ফুটে ওঠে তার মুখে হাসি সরে গিয়ে। সে নিজের এক হাত কপালে গালে আর গলায় ঠেকিয়ে নিজের তাপমাত্রা মাপার চেষ্টা করে। শরীরের তাপমাত্রা হালকা বেশি দেখতেই খারাপ লাগা কাজ করে তার মধ্যে। ওয়াফিফ সারাদিন কাজ করে এসে তার যত্ন করেছে রাতে আবার? তাও ক্লান্ত শরীরে? এরপর খাবার ও সরিয়ে দিয়েছে। নিজে খেয়েছে কিনা তার কোন ঠিক নেই। নিজেরই খারাপ লাগে জিনিয়ার। সে ওয়াফিফকে ডাকতে গিয়েও ডাকে না। ওয়াফিফ কত রাত করে ঘুমাতে গিয়েছে কিংবা আদৌ রাতে ঘুমিয়েছে কি না – সেই চিন্তায় আর ডাকল না তাকে। সে সোজা বাথরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।

ওয়াফিফের ঘুম ভাঙল তার কিছুক্ষণ পরেই। সে মাথা থেকে হাত সরিয়ে আশেপাশে তাকাল। নিজের পাশে জিনিয়াকে না পেয়ে আশেপাশে খোঁজ চালায়। বাথরুম থেকে পানির শব্দ আসতেই শান্ত হয়ে উঠে বসে। দুই হাত দিয়ে সে তার মাথা চেপে ধরে। ঘুম ঠিক মতো হয় নি কয়েকদিন ধরে। তার উপর গত রাতেও ঘুম হল না তার। ভোরের দিকেই ঘুমিয়েছিল। কিন্তু অভ্যাস বশত বেশি সময় ঘুমিয়ে থাকতে পারল না। তাই দ্রুতই উঠে পড়ল সে। কিন্তু গত কয়েকদিনে ক্লান্তির পর এই কম পরিমাণ ঘুম তার জন্য সুবিধার ঠেকল না। সে নিজের মাথা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরল। আর গত রাতের কথা মনে করার চেষ্টা করল।

গত রাতে বাড়ি ফিরতেই সে সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে এই ভেবে চাবি দিয়ে দরজা খুলেছিল। ভেতরে ঢুকে দেখল সব রুম অন্ধকার। তাই ভেবেছিল সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে। নিজের ঘরে গিয়ে লাইট জ্বালাতে গিয়ে থেমে গেল সে। জিনিয়া তখনও জানালার কাছে বসে ছিল। চাঁদের আলোয় তার মুখটা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও ভালোই লাগছিল দেখতে। রাস্তার লাইটের আলো কিংবা আশেপাশের বাড়ির সিঁড়ি ঘরের আলোয় ওয়াফিফের পুরো রুমে এক আলাদা পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। নিজের হাত থেকে এপ্রোন টা বিছানায় ফেলে দিয়ে সে জিনিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াল আর যেই না কপালে হাত দিল ছোট চুল গুলো সরাতে, অমনি সে বুঝে গেল জিনিয়ার হালকা জ্বর এসেছে যেটা বাড়তে পারে। তাই তখন জিনিয়াকে সেখান থেকে সরাতে নিজের কোলে তুলে বিছানায় ঠিক মতো শুইয়ে দেয় আর চাদর দিয়ে ভালো করে মুড়ে দেয় তাকে। রান্নাঘর থেকে একটা বাটি আনে আর নিজের ড্রয়ার থেকে একটা রুমাল বের করে সেটা দিয়েই জল পট্টি দিতে থাকে আর কিছু সময় পরপর জিনিয়ার শরীরের তাপমাত্রা দেখতে থাকে। অনেকটা সময় পর জিনিয়ার তাপমাত্রা কমলে সে অনুভব করে তার ক্ষুধা লেগেছে। আর সে হাসপাতাল থেকে ফিরে হাত মুখ ও ধোয় নি। তাই ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে লাইট জ্বালাতেই খাবার গুলো দেখতে পায়। কিছু সময় ভাবতেই বুঝতে পারে যে জিনিয়া কেন তার অপেক্ষা করছিল। তবে সেদিন যে জিনিয়ার জন্ম দিন ছিলে সেটা ওয়াফিফ জানত না। সে ভেবেছিল জিনিয়া হয়তো আবার কোন নতুন রান্না শিখেছিল। সেটা টেস্ট করাতেই ওয়াফিফের অপেক্ষা করছিল। তাই সে নিজের মতো একটু খেয়ে বাকি সব গুছিয়ে রাখে। তারপর নিজেও ঘুমাতে যায়।

ওর ভাবনার মাঝেই দরজা খোলার আওয়াজ পায় ওয়াফিফ। জিনিয়াকে অনেক দিন পর এভাবে ভেজা চুলে দেখল সে। আগের কয়েক দিনে সে জিনিয়ার সাথে ঠিক মতো দেখা করতে পারে নি। আর না পেরেছে কথা বলতে। কাজের চাপ বেশি ছিল এমনটা বলা যায় না। তবে সে নিজে অনেক ব্যস্ত ছিল। তাই জিনিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন পর দেখল সে। অবাক হয়েই সেদিকে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটাকে সে ভালোবাসে কি না জানা নেই ওয়াফিফের। তবে সে রোজ নতুন করে এই মেয়ের মায়ায় জড়িয়েছে। নতুন করে জিনিয়াকে চিনেছে। নতুন করে অবাক ও মুগ্ধ হয়েছে জিনিয়াতে।

–আপনি উঠে পড়েছেন? আরেকটু ঘুমাতেন।

জিনিয়ার ডাকে চিন্তার জগত থেকে বেরিয়ে এসে ওয়াফিফ উত্তর দেয়,

–হ্যাঁ হ্যাঁ। এখনই উঠলাম।

–ওহ, আমি আপনার কফি এনে দিচ্ছি।

বলেই জিনিয়া চলে গেল। এক কাপ কফি বানিয়ে ফিরে এসে সে দেখল ওয়াফিফ ঘরে নেই। হয়তো বাথরুমে ভেবেই কাপ টা টেবিলে রাখতে গিয়ে দেখল টেবিলের উপর একটা ছোট বক্স রাখা। খুশিতে তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে ভাবল ওয়াফিফ হয়তো তার জন্যই এনেছে সেটা। না চাইতেও সে বক্সটা খুলে দেখল। বক্সে একটা নেকলেস রাখা। সে সেটা ধরতে গিয়েও ধরল না। মনে সংকচ নিয়ে সে বক্সটা বন্ধ করে আগের মতো রেখে দিল। আর মনের খুশিতে রান্না ঘরে চলে গেল। জিনিয়া সকালে নাস্তা নিজেই বানায়। আর দুপুরে আর রাতের রান্নায় ভাবিকে সাহায্য করে। মাঝে মাঝে নিজেই রান্না করে তবে সেদিন ওয়াফিফের কাছে বকা খেতে হয়। কিন্তু জিনিয়া এই বকাটাও অনেক মনোযোগ দিয়ে শোনে। যেন ওয়াফিফ কোন গুরুতেপুরন লেকচার দিচ্ছে তাকে। জিনিয়া পারে না ওয়াফিফের বলা সব কথা নোট আকারে লিখে রাখতে !

ওয়াফিফ অন্যান্য দিনের মতো সেদিন ও হাসপাতালে ঠিক সময়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে জিনিয়াকে বলে গেল অপেক্ষা না করতে। আগের বার অপেক্ষা করতে গিয়ে জ্বর বাঁধিয়েছিল। আর যেন তেম না করে। আর ওর কাজের চাপ একটু বেশি। তাই তার বাড়ি ফিরতে দেরি হতে পারে।


আরও বেশ কিছু দিন এইভাবেই চলল। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে যে কেউ বলবে জিনিয়া আর ওয়াফিফের ভেতরে কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু আসলে তেমন কিছুই না। সেই নেকলেস আর জিনিয়া পায় নি। প্রথম দিকে এই নিয়ে ভাবলেও পরে ভুলে গিয়েছে। হয়তো অন্য কারো জন্য কিনেছি ওয়াফিফ। কিন্তু কার? এই চিন্তা করতে গিয়েও করে নি সে। বিনা কারণে এই চিন্তা করলে সে কি থেকে কি ভাববে আর ওয়াফিফ কে ভুল বুঝে বসবে। এর থেকে চিন্তা না করাই ভালো। তবে ওদের মধ্যে কথা খুব কম হয়। আগের মতো একদমই না। ওয়াফিফ জিনিয়ার খেয়াল ঠিকই রাখে কিন্তু কথা টা। এই এক জায়গায় সব আটকে যায়। জিনিয়া যখন মনে করে যে ওয়াফিফ তাকে ইগনোর করেছে তখনই তার জাবিরের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু পরে নিজেকে নিজেই বলে সে- ওয়াফিফ এমন করতেই পারে না।

কিন্তু হঠাৎ করে জাবিরের আগমন ঘটে। শেষ কয়েক দি ধরে জাবির জিনিয়ার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। ফোন নাম্বার আগে থেকেই ছিল। আর কোন এক ভাবে ওয়াফিফের বাড়ির ঠিকানাও বের করেছে সে। জিনিয়া এসব কথা ওয়াফিফ কে চাইলেও জানাতে পারছে না। পারবে কি করে? ওদের মধ্যে তো তেমন কথাই হয় না।

চলবে।

”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
১৫শ পর্ব

হাতে ফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জিনিয়া। একবার নেড়েচেড়ে দেখছে। একবার ফোন অন করছে, আবার অফ করে রেখে দিচ্ছে। আবার সেটা হাতে নিয়ে ঘরের এ মাথা থেকে ওমাথা হেঁটে বেড়াচ্ছে। একই কাজ বার বার করছে। বার বার ভেবে চলেছে ওয়াফিফ কে ফোন দিবে কি না। আজ পর্যন্ত একবারও সে ওয়াফিফকে কল দেয় নি। দরকার পড়লে মিলা মিনা আরিফ ফোন দিত, আর এদের কাউকে না পেলে সুফিয়া ভাবি তো আছেই। সে কল করে। কিন্তু ওয়াফিফের সাথে গত কয়েক দিন ধরে ঠিক মতো কথা না হওয়ার আজ তার মাথায় এই কথাই আসলো। ওয়াফিফের সাথে ফোনে কথা বলার। কিন্তু দিবে কি না এটাও চিন্তার বিষয়। হাতে নিয়ে এদিক ওদিক হেতেও শান্তি পাচ্ছে না সে। তাই হাতে নিয়ে ফোন দিতে যাবে এমন সময় একটা নাম্বারে ফোন এলো তার মোবাইলে। সে নাম্বার টা দেখেই চিনতে পারল। যার কথা সে ওয়াফিফকে জানাতে চাচ্ছিল, সে নিজেই ফোন করেছে। ফোন টা তুলতে চাইছে না জিনিয়া। আবার কাটতে গিয়েও দ্বিধায় পড়ছে। কল কেটে দেবে না কি দেবে না। যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকে। এই ভেবে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। যেন আপনাআপনিই কল কেটে যায়। তাই হল। জিনিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেও আবার সেই নাম্বারে কল এলো। জিনিয়া আর না পেরে কল রিসিভ করল। ফোনের ওপাশ থেকে ধীর আওয়াজ ভেসে এলো তার কানে। জাবিরের কণ্ঠে অনুতাপ স্পষ্ট। কিন্তু সেদিকে খেয়াল করল না জিনিয়া।

আগে অনেক এমন হয়েছে জাবিরের কলের অপেক্ষা করেছে। রাএ জেগে অনেক গল্প করেছে। আগে অনুভূতিটাই এমন ছিল যে জাবিরের আওয়াজ শুনলেও মনে এক আলাদা অনুভূতি কাজ করত, যার নামকরণের চেষ্টা কখনই করে নি জিনিয়া। কারণ সে আওয়াজ সারাজীবন শুনতে পারবে – এমনটাই ভেবেছিল সে। কিন্তু এখন আর সেই আওয়াজে মনের মধ্যে সেই আগের মতো অনুভূতির সৃষ্টি হয় না। তবে বিরক্তিও কাজ করে না। যাই হোক না কেন, একটা সময় তাকে তো মন থেকেই ভালবেসেছিল। হয়তো এখনো মসেই অনুভূতি শেষ হয়ে যায় নি। মনের এক কোণে লুকিয়ে রয়েছে। যেটাকে চাপা দিয়ে রেখেছে জিনিয়া। বের করতে চায় না সে। নাহলে তো সে দুর্বল হয়ে পড়বে। আর সে আবার দুর্বল হতে চায়। আজ আবার যদি আবেগে ভেসে গিয়ে কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে তাহলে নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারবে না সে ।

–জিনিয়া, শুনতে পারছ আমার কথা?

–হ…হা… হ্যাঁ ।

–কেমন আছো জিনিয়া?

–আলহামদুলিল্লাহ্‌।

–আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে না? কথা বলছ না কেন? আমার সাথে কি এখন আর কথা বলতেও ইচ্ছে করে না তোমার? আমি কি সত্যিই তোমার মন থেকে একেবারে হারিয়ে গিয়েছি? সেদিন ও আমার পুরো কথা সুনলে না। এতদিন ধরে কথা বলার চেষ্টা করছি তাও ফোন ধরছ না। আমাকে একটি বার কি ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেওয়া যায় না?

–না, অনেক দেরি করে ফেলেছ তুমি।

–কিন্তু তুমি চাইলেই সব ঠিক করতে পারো। আমি নিজেই তখন নিজের মধ্যে ছিলান না জিনিয়া। দেখো তোমার কথা অনুযায়ী জান বলাটাও ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি এই ৩ মাসে। তোমার দায়িত্ব নেওয়ার মতো করে নিজেকে গড়ে তুলেছি । তুমি তো তাও আমার সাথে যোগাযোগ না রাখার চেষ্টা করো সবসময়। কিন্তু তোমার মনে কি আমি এখন আর একটুর জন্যও নেই?

–জা…জানি ন…না।

–আমি নিজেই ওই ৫ মাস নিজের মধ্যে ছিলাম না। জিনিয়া, আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারি নি, বিশেষ করে তরুণ এর কথায় আমি নিজেই হারিয়ে যাচ্ছিলাম, আমাকে অন্য কিছু বোঝানো হচ্ছিল, আমিই নিজেই সেই কথা ধরেই এগিয়ে চলেছিলাম। কিন্তু আমার ভালোবাসা মিথ্যে ছিল না, এটা তোমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না। গত ৩ বছরে কি আমার আচরণ দেখেও বুঝতে পারো নি তুমি যে আমি তোমাকে কত ভালোবাসি? তাও আমাকে সুযোগ দিচ্ছ না সব কিছু ঠিক করার, কেন জিনিয়া? সুযোগ তো মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামী কে ও দেওয়া হয়, তাহলে আমাকে কেন নয়? আমি নিজেকে বোঝাতে চাইছিলাম। একবার এক্সপ্লেইন করতে দিলে আমি সব ঠিক করে দিতাম। কিন্তু তুমি চলে গেলে। তোমার থেকে আলাদা থেকেও আমি ওই ৫ মাস ভালো ছিলাম না, আর না এখন আছি। আমি জানি তুমিও ভালো নেই, আমার থেকে বেশি তোমাকে আর কে চিনে বল? আমি জানি তুমি কেমন আছো, তোমার চেহারা দেখেই আমি সব বলে দিতে পারি। আমাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না? আমি সব ঠিক করে দি, কথা দিচ্ছি।

–তরুণকে দোষ দিও না । সব ঠিক ই আছে, আর ঠিক করার কিছু নেই, তুমি তোমার জীবনে ভালো আছো, আমিও আমার জীবনে ভালো আছি, এতে সুযোগ দেওয়ার কিছু নেই। আর ডাক্তার সাহেবের সাথে, মানে ওয়াফিফের সাথে আমি ভালো নেই সে কথা কে বলেছে তোমায়? উনি খুব ভালো মানুষ, আমাকে সব ভাবেই মেনে নিয়েছে, আমার যত্ন করে। তোমার কিছুই ঠিক করার দরকার নেই। আর হ্যাঁ, এখনো যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে বলে রাখি, আমি প্রেগন্যান্ট, আর আমাকে কল করো না এসব কথা বলতে। নিজে একটা ভালো দেখে মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিও আর সুখে জীবন যাপন করো। তবে কাউকে আর ঠকিও না।

–এবার ও আমার কথা পুরোটা সুনলে না। শুনলে হয়তো বুঝতে পারতে, আমার জায়গায় আমি ঠিক ছিলাম। সবটা আমাকে শুনিয়ে দিয়ে আমাকেই দোষী করে দিলে জা.. সরি, জিনিয়া। আমি অবশ্যই তোমাকে সব না জানানোর পর্যন্ত থেমে থাকব না। তোমার সাথে কথা বলার সুযোগের অপেক্ষায় থাকব, চেষ্টা করব। আমি জানি তুমি আমাকে এখনো ভুলে যাও নি। অমন মেয়ে তুমি না। আর তোমার এই গুনটাই আমাকে মুগ্ধ করেছিল আর এখনো করে।

–আমি কাউকে ম…মনে রাখি নি।

–সেটার উত্তর তুমি নিজেই জানো। নিজেকে ভুল বুঝিও না। পারলে নিজের মনের কথা শুনে আমার কাছে চলে এসো। এতে আমরা ২ জনই ভালো থাকব, দরকার হলে তোমার সন্তান কেও মানতে রাজি আছি আমি। ওকে আমার নিজের সন্তানের মতই বড় করব…

–রাখছি, আর কখনো কল করবে না।

বলেই জাবিরের আর কথা না শুনে ফোন কেটে দিল। আজও জিনিয়া কে বুঝতে পারল না ঠিক করে। এতটাই যখন জানে যে জিনিয়া জাবিরকে ভালোবাসে তাহলে জাবির কি করে বিশ্বাস করতে পারল যে জিনিয়ার গর্ভে ওয়াফিফের বাচ্চা। এতদিন না জাবির দাবি করত যে জিনিয়াকে সবচেয়ে ভালো করে চেনে জাবির, তাহলে কোথায় গেল তো চিন্তা শক্তি? বিশ্বাস টুকুও নেই তো আজ। আচ্ছা, জাবির তরুণের কথা কেন তুলল? তরুণ কি এমন করেছিল যে জাবির তরুণের কথায় জিনিয়ার থেকে দূরে ছিল?

এসব আর ভাবতে ইচ্ছা করল না জিনিয়ার। সে ফোন হাতে নিয়ে ওয়াফিফ কে ফোন করল। দুই বার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে ওয়াফিফের আওয়াজ ভেসে এলো।

–হ্যালো।

ওয়াফিফের এর কণ্ঠে ক্লান্তি প্রকাশ পাচ্ছে। জিনিয়া বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল,

–ডাক্তার সাহেব।

ওয়াফিফের কি হল জানা নেই, তবে ওর মুখে একটা বড় হাসি ফুটে উঠল, ওয়াফিফের সামনে বসে থাকা ৩ জন মানুষের মধ্যে এক জন বেশ অবাক হল ওয়াফিফের এই হাসি দেখে। ওয়াফিফ কার কথা শুনে এভাবে হেসে উঠল, ভাবতেই নিজের হাত মুঠোয় পুরে নিল সে। নিজের কিঞ্চিৎ লম্বা নখের কারণে হাতে দাগ বসে গেল। তবুও সে ওয়াফিফের দিকে তাকিয়ে রইল।

ওয়াফিফ সাধারণভাবেই জবাব দিল,

–বল, কি হয়েছে? আজ কিন্তু প্রথমবার তুমি আমাকে কল করলে।

জিনিয়ার এতক্ষণ যে চিন্তায় মাথা ব্যথা শুরু হয়েছিল সেটা মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল। তার জায়গায় মনে এক প্রশান্তি কাজ করল। তবে এর পাশাপাশি মনে চিন্তাও হানা দিল। ওয়াফিফের যে কতটা ক্লান্ত সেটা অয়াফিফের আওয়াজ শুনেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কেন? বুঝতে পারল না জিনিয়া। সামনের আয়নায় চোখ পড়তেই নিজেকে দেখে অবাক হল জিনিয়া। তার কান লাল হয়ে গিয়েছে। ওয়াফিফের সাথে ফোনে কথা বলাতেই এতো লজ্জা তার কোথা থেকে আসছে, বুঝতে পারল না সে কারণ সে ভেবেছিল সামনাসামনি কোথা বলার চেয়ে ফোনে কোথা বলা তুলনামূলক সহজ হবে। কিন্তু হল তার উল্টো। জিনিয়াসেসব চিন্তা বাদ দিয়ে অন্য চিন্তায় লেগে পড়ল। ওয়াফিফকে সাহস করে ফোন তো দিয়ে দিল, কিন্তু কি বলবে এখন।

–কি হল, চুপ করে আছো কেন? কিছু বলার থাকলে বলে ফেলো, আমার সামনে কাজ আছে অনেক। নেটওয়ার্ক প্রবলেম হচ্ছে না কি? আমি কি কেটে দিব?

–না না। আপনি কি খেয়েছেন?

–না, এখনো না।

–আজ বাসায় মেহমান আসবে। সেই নিয়ে মা কথা বলতে চায়। সময় পেলে মায়ের সাথে কথা বলে নিবেন।

–ঠিক আছে, আর কিছু?

–না।

–তাহলে রাখছি এখন।

বলেই কেটে দিল ওয়াফিফ আর কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর আবার সামনে বসে থাকা মানুষ দের সাথে কথা বলা শুরু করল।

জিনিয়া ও ফোনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সুফিয়া ভাবির ডাক শুনতে পেল। তাই সোজা তার কাছে চলে গেল।

সেখানে গিয়ে দেখল আফিয়া রহমান বসে আছেন আর সামনে টিভি তে কিছু একটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। সুফিয়া ভাবি রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত। আজ আফিয়া রহমানের ভাই আর তার পরিবার আসবে। সেই জন্য এতো আয়োজন। তারা মূলত আসবেন জিনিয়া কে দেখতে। ওয়াফিফের বিয়েতে আসতে পারেন নি বলে এখন দেখে যাবেন। জিনিয়া কে দেখে আফিয়া রহমান তাকে নিজের কাছে ডাকলেন। জিনিয়া সেখানে গেলে আফিয়া রহমান তাকে হাত ধরে নিজের কাছে বসিয়ে দিলেন। তারপর নিজের পরিবার সম্পর্কে সব বলতে থাকলেন, পরিবারে কে কে আছে? কে কেমন? কয়জন বাড়িতে আসবে – এসব। জিনিয়াও তার কথা মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকল। তবে তার মাথায় সেই পুরনো চিন্তা পড়ে আছে। নিজের বাচ্চার সম্পর্কে সব কিছু বলে দিতে চাচ্ছে সে কিন্তু সাহস করে বলতে পারছে না। নিজের নিরব স্বভাবের জন্য কখনো প্রতিবাদ করতে পারে নি সে। আর না পেরেছে কখনো কোন কথা খুলে বলতে। সব সময় চুপ করেই থেকে এসেছে। নিশ্চুপ থাকাই যেন তার এক মাত্র স্বভাব। যেই স্বভাবের জন্য সে নিজেই মনের মধ্যে দুঃখের পাহাড় জমিয়ে রেখেছে, কারো কাছে প্রকাশ করছে না আর না করতে পারছে। নিজেকে বার বার বুঝিয়েছে, বার বার চেয়েছে সব সত্য বলে দিতে, কিন্তু পারে নি, প্রতিবার শুধু কষ্টের পরিমাণ টাই বেড়েছে। নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকে তার সব সময়। তবু বলতে পারে না কিছু। নিরব হয়ে থাকে সর্বক্ষণ। কেউ জানতে পারে না তার এই নিরবতার পিছনে কত কিছু আছে। যেগুলো অপ্রকাশ্য।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here