পলাশ_ফুলের_বসন্ত,পর্ব-১২,১৩
কলমে -দেবিকা_সাহা
ভোরের নরম আলোটা চোখে পড়তেই ঘুমটা আলতো ভেঙে গেলো পৌষালির। পাশে থাকা চশমাটা চোখে দিয়ে টেবিলের উপর রাখা এলার্ম ক্লকটার দিকে তাকাতেই পৌষালির চক্ষু চরকগাছ।
একি!! নটা বেজে গেছে!! আর আমার এখন ঘুম ভাঙলো?মানে এটা কি করে সম্ভব হলো? আমার দিব্যি মনে আছে আমি সাতটার সময় এলার্ম দিয়েছিলাম।তবে??
পৌষালি এখন আর এলার্ম না বাজার তদন্ত না করে এটা চিন্তা কর যে তোর এখন কি হবে।কি হবে আবার কি।একেবারে সাড়ে সর্বনাশ কান্ড বেঁধে যাবে।ইস্,,আজ আর অফিস যাওয়া হলো না।কপালে নির্ঘাত আমার শনি নাচছে।
কিন্তু মা-এরই বা আক্কেল কেমন!! ডাকবে তো আমাকে একবার।এমনিতে তো ঘড়ির কাঁটা আটের ঘর ক্রশ করলেই একেবারে দক্ষযজ্ঞ শুরু করে দেন উনি।আর আজ দেখো।কি যে করি আমি এখন? ঘুমের আর কি দোষ!! কাল রাতে অতো দেড়ি করে ঘুম আসলো যে উঠতে উঠতে এতোটা দেড়ি হয়ে গেলো।
কথাটা ভাবতে ভাবতেই পৌষালি আর দেড়ি না করে একেবারে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমের উদ্দেশ্যেই নিজের আপাতত গন্তব্যস্থলটা সেট করে নিলো।
কিন্তু মেয়েটার অবাক হওয়ার সীমাটা হয়তো আরো একটু বাকি ছিলো।আর সেই সীমাটা পূরন হলো ডাইনিং টেবিলে পৌঁছে।।
একি?? টেবিলের এরকম অবস্থা কেনো? কোথাও অর্ধেক সব্জি কেটে রাখা।কোথাও আবার পনিরটা এবড়ো খেবড়ো ভাবে টুকরো করে রাখা,আবার টেবিলের একটা কোনায় সোয়াসস,চিলিসস সহ রাজ্যের যত সস আছে,,সবগুলো সারি দিয়ে সাজিয়ে রাখা।এসব দেখে পৌষালির তো মাথায় হাত।
আর সবথেকে আশ্চর্যজনক বিষয়টা হচ্ছে মা আর আন্টি মানে আকাশের মা ডাইনিং রুমের পাশে রাখা সোফাটাতে বসে মনের সুখে গল্প করছেন আর চা খাচ্ছেন।
এসব কি হচ্ছে ভগবান? ঘরের এরকম অবস্থা আর ওদিকে মায়ের কোনো হেলদোলই নেই এই ব্যপারে!!
আর কাকিমাই বা কখন এলেন? হচ্ছে টা কি এসব??
পৌষালিকে এরকম অদ্ভুত আর বড়ো বড়ো বিস্ফোরিত চোখে ঘরের চারদিকটা পর্যবেক্ষন করতে দেখে ওর মা বেশ মিষ্টি গলাতেই বললো —
— গুড মর্নিং বেটা।এ ভেরি গুড মর্নিং।
কি হলো ব্যপারটা? একে তো কাল অতোবার ডাকার পরেও দরজাটা খুলিনি।তার উপর আবার আজ এতো দেড়ি করে ঘুম থেকে উঠলাম।এতো কিছুর পরেও মায়ের মুখ থেকে আমার উদ্দেশ্যে এতো মিষ্টি মিষ্টি কথা বেড়োচ্ছে কি করে? এখন তো বরং ঝালের ওভারডোস হওয়ার কথা।আর আমি তো প্রিপেয়ার-ই ছিলাম তার জন্য? তবে….
কোনোভাবে আমি আবার স্বপ্নটপ্ন দেখছি না তো??
কথাটা ভাবতে ভাবতেই পৌষালি ওর হাতে নিজে নিজেই একটা চিমটি কেটে অস্ফুটেই চিৎকার করে উঠলো।
— এই কি হলো? কোথায় লাগলো তোমার পৌষালি?
নাহ্,, তাহলে স্বপ্ন নয়।সত্যি সত্যিই হচ্ছে ব্যপারটা।কিন্তু এর পিছনের কারনটা কি? ডালমে জরুর কুছ কালা তো হে।।মুঝে হি ঢুন না পড়েগা।
— নাহ্ আন্টি কিছু হয়নি। কিন্তু আপনি এখন এখানে??….. না মানে….
— কেনো আসতে পারিনা আমি তোদের কাছে? আমার বুঝি আমার এই মেয়েটাকে একটুও দেখতে ইচ্ছে করে না??
— না না আন্টি আমি সেভাবে বলতে চাইনি।আমি তো আসলে…..
— থাক তোমাকে আর কিছু আসল নকল বোঝাতে হবে না।যাও তুমি গিয়ে কিচেন থেকে নিজের চা-টা বানিয়ে নিয়ে এসো।আমি কিন্তু এখন যেতে পারবো না।তোমার আন্টির সাথে আমার এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।আমি এখন কিছুতেই উঠতেই পারবো না।।
যাক বাবা আমি আবার কখন বললাম আমার জন্য চা বানিয়ে আনতে!! কি যে হচ্ছে কিছুই তো বুঝতে পারছি না। সবটাই যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
কথাগুলো মনে মনে ভাবলেও মুখে একটু সৌজন্যতার হাসি হেসে পৌষালি আর কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো।।
রান্নাঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই রান্নাঘরের ভিতরের দৃশ্য দেখে পৌষালি এবার ভীষণ রকমের ধাক্কা খেলো।
— আপনি?? এখানে? এরকম অবস্থায়? মানে কখন,কেনো, কীভাবে??
— আড়ে দাঁড়াও দাঁড়াও। অবশ্য তুমি দাঁড়িয়েই তো আছো।আচ্ছা বসো। ওহো তোমাদের রান্নাঘরে তো আবার বসারও জায়গা নেই।ঠিক আছে যেমন দাঁড়িয়ে আছো তেমনই দাঁড়িয়েই থাকো।আমি বরং তোমার চা-টা গরম করে দিই।মায়ের আর আন্টির টা তো আগেই দেওয়া হয়ে গেছে।সত্যি কি যে করো না,,একে তো এই নিরিহ ছেলেটা সকাল থেকে রান্নার চক্করে চক্করে পাগল হয়ে গেলো। তার উপর আবার একই কাজ দুবার।কোনো মানে হয় এসবের!! একটু আগে ঘুম থেকে উঠলে কি হতো কে জানে!!!
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে আকাশ একটু পৌষালির মুখের দিকে তাকালো। ওদিকে পৌষালি তো কটমট চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।পারলে তো মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই গিলে ফেলবে ছেলেটাকে।
আকাশ একটু ঢোক গিলে নিয়ে আবার বলা শুরু করলো–
— না মানে বলছিলাম কি আমার একটু কষ্ট কম হতো এই আর কি…. কোনো ব্যপার নয়।আমি নাহয় এক্ষুনি আবার চা বানিয়ে দিচ্ছি…..
— কষ্ট করতে কে বলেছে আপনাকে? আর আপনি এসব কি করছেন শুনি।রান্নাঘরটার কি অবস্থা হয়েছে!! আর কেনোই বা করছেন??
আকাশ হঠাৎ করে আচমকাই পৌষালির খুব কাছে এসে ওর চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।এই স্বচ্ছ আর স্থির দৃষ্টিকে অবহেলা করা বা ফিরিয়ে দেওয়া হয়তো পৌষালির পক্ষেও খুব মুশকিল। কিন্তু কিছু মুহূর্তের ব্যবধানে নিজেকে সামলে নিয়ে পৌষালি আবার বলতে শুরু করলো–
— কি..কি হলো। উত্তরটা দিন।
— সিম্পেল উত্তর। তুমি বুঝতে পারছো না?? দাঁড়াও বুঝিয়ে বলছি।
আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না ,
ইস্তাম্বুল গিয়ে জাপান কাবুল গিয়ে
শিখেছি সহজ এই রান্না ।।
না মানে শিখিনি এখনো। ইস্তাম্বুল, জাপান বা কাবুলও যাইনি। একচুয়ালি ইউটিউব দেখে শেখার চেষ্টা করছি।ব্যপারটা রিলেটেবেল।তাই বললাম আর কি। আর আজ আমার রান্নার এক্সপেরিমেন্টের সাহসটা নিয়েই নিলাম। আজকের স্পেপাল রেসিপি ” পনির রেজালা “। মেড বাই দ্য গ্রেট শেফ ওয়ান এন্ড অনলি আমি।
— কেনো করছেন এসব? আর আপনি হঠাৎ আমায় তুমি করে বলা শুরু করেছেন কেনো শুনি।
— এবাবা তুমিই তো বলেছিলে তোমার যে বর হবে তাকে নাকি রান্নায় পারদর্শী হতে হবে।তারপর আরো অনেক কিছুই বলেছিলে,, সেগুলোতে পরে আসছি।
আর কাছের লোকেদের তো মানুষ তুমি করেই সম্বোধন করে।তাই তুমি করেই বলছি।কঠিন প্রশ্নের সিম্পেল উত্তর।
— কাছের মানুষ? কে কাছের মানুষ? আপনার সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ।
— যাক বাবা,, সম্পর্ক শুরুই তো হলো না সেভাবে অফিসিয়ালি।না না এটা আমি মানতে পারছি না।আমার হাতে পায়ে ধরলেও মানতে পারছি না।আমি কোথায় একটা সুমধুর সম্পর্ক শুরুর আনন্দে আছি!!!!!
আকাশের মুখে কথাটা শুনে পৌষালি আবারো বেশ বড়ো বড়ো চোখে তাকালো ছেলেটার দিকে।।
ওদিকে আকাশ বেশ ভ্রূ কুঁচকে হাসি হাসি মুখে দিব্যি তাকিয়ে আছে পৌষালির দিকে। ভাবখানা এমন যেনো পৌষালির রাগের কি কারন সেটা ও জানেই না।।
………( চলবে )………
#গল্প- #পলাশ_ফুলের_বসন্ত ( পর্ব-১৩ )
#কলমে – #দেবিকা_সাহা
— দেখুন আকাশ, আপনার কি হয়েছে হঠাৎ করে আমি সত্যিই জানিনা।এভাবে হঠাৎ করে রূপবদলের কারনটা কি তাও জানিনা।তবে এটাই বলবো,, যাই হয়ে যাক না কেনো,,আমি আর এই সম্পর্কটা নিয়ে ভাবতে পারছি না।আর কি বা ভাববো বলুন তো!! বন্ধুত্বের ভিত্তিই নেই যে সম্পর্কে সেটা নিয়ে কি আর ভাবা যায়? এগোনো যায় কি সেই অবলম্বনটাকে নিয়ে? যায় না।
যাই হোক,,আপনি যা করছেন করুন।আমি আসছি।
কথাটা বলেই আর এক মিনিট-ও ওখানে না দাঁড়িয়ে জায়গাটা ছেড়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে যাচ্ছিলো পৌষালি। কিন্তু তেমনটা হওয়ার আগেই একটা শক্ত বাঁধন উপলব্ধি করলো মেয়েটা নিজের হাতটাকে ঘিরে।
— গভীর বাঁধনে বেঁধেছো আমাকে। তুমি চাইলেই আমি ছেড়ে যেতে দিচ্ছি নাকি!!
কথাটা পৌষালির চোখে একদম চোখ রেখে বললো আকাশ।
আকাশের মুখে এমন কথা শুনে পৌষালিও কয়েক মুহূর্তের জন্য একেবারে থমকে গেলো।
আপনার সাথেই তো নিজের জীবনটাকে বাঁধতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম কোথায় আর!! বন্ধনটা দৃঢ় হওয়ার আগেই আলগা হয়ে গেলো যে।
মনে মনে কথাগুলো ভাবলেও মুখে আর এই কথাগুলো বলার ঠিক সাহস বা ইচ্ছেটা হলো না মেয়েটার। এদিকে আকাশ পৌষালির একদম কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।আকাশকে নিজের এতোটা কাছে দেখে এই বসন্তের হালকা শীতল আবহাওয়াতেও অল্প অল্প ঘেমে উঠলো মেয়েটা।ও নিজেও যেনো একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে।
হঠাৎ করে নিজের মুখে পরিচিত কারোর হাতের স্পর্শে ভাবনার ঘোর থেকে বেড়িয়ে এলো মেয়েটা।
আকাশ খুব যত্ন সহকারে পৌষালির মুখে ঘিরে থাকা ওই বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটাগুলোকে মুছিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে অবাঞ্ছিত ভাবে মুখের উপর উড়ে আসা চুলগুলোকেও যত্ন করে তাদের নিজস্ব স্থানে সড়িয়ে দিচ্ছে।।
ঘটনার আকষ্মিকতায় পৌষালি কিছুক্ষন একটা নাম না জানা ভালোলাগার ঘোরের মধ্যে থাকলেও সেখান থেকে বাস্তবে ফিরে এলো খুব তাড়াতাড়ি।
— এটা… এটা আপনি কি…. করছিলেন?
— প্রেম.. প্রনয়…আবেগ.. ভালোবাসা…. এই সব কিছুরই প্রতিফলন।।
আকাশের মুখ থেকে একদম অপ্রত্যাশিত ভাবে কথাটা শুনে পৌষালি কেমন যেনো হকচকিয়ে গেলো।আর একপ্রকার বড়ো বড়ো চোখ করেই তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে।
ওদিকে আকাশকে আবারো নিজের দিকে তাকিয়ে ওরকম মুচকি মুচকি হাসতে দেখে পৌষালি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করলো।
আরে আরে চা-টা তো নিয়ে যাও।কতো কষ্ট করে বানালাম।
পৌষালিকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথাটা বলতে বলতেই একটা নিষ্পাপ নিষ্কলুষ হাসির রেখা ফুটে উঠলো ছেলেটার মুখে।
তোমার রাগ আমি ভাঙিয়েই ছাড়বো ম্যাডামজি। দোষ যখন করেছি,,ভুলটাও ঠিক শুধরে নেবো।কিন্তু তোমাকে আমি হারিয়ে যেতে দেবো না আমার জীবন থেকে। সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে তোমাকে যে আমার কাছে ধরা দিতেই হবে। মিলিয়ে নিও এমনটাই হবে।ভরসা আছে যে।নিজের উপর।তার থেকেও বেশি তোমার উপর।।
ওদিকে পৌষালি একছুট্টে নিজের ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনায় বারেবারে কেমন যেনো শিহরিত হয়ে উঠছে মেয়েটা।।
©দেবিকা..
চলবে