পূর্ণিমা সন্ধ্যায়,পর্ব-৭
Tithee sarker
ওর জন্য ধুকে ধুকে মরছে রক্তিম!
জয়ার এই কথা শুনে দড়জার সামনে থমকে দাঁড়ায় শক্তি। এই কথার মানে কি?জয়া তো বিনা কারণে এমন কথা বলার মানুষ না।।
ভেতর থেকে আবার পীযূষ বাবুর আওয়াজ পাওয়া যায়, “আমি বলেছিলাম ওকে শক্তিকে ভালোবাসতে।কেনো বাপ মা মরা মেয়েটার জীবন নরক করতে উঠে পড়ে লেগেছো তোমরা।”
“ভালোবাসা কি কারো বলা কওয়ায় হয়!কি এমন অপরাধ করেছে আমার ছেলে,সারা জীবন কি ও এইভাবেই থাকবে?”
একদমে কথা গুলো বলে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে জয়া।
“মা,বাবা, চুপ করো তোমরা। ওরা হয়তো এক্ষুনি এসে যাবে।”
“রিদ্ধি, তোমার ভাইকে বলে দেবে শক্তির থেকে যেনো দূরে থাকে।আমি কিছুতেই ওর এই অন্যায় আবদার মেনে নেবো না।”
এই বলে বিছানায় থুম মেরে বসে রইলেন পীযূষ বাবু।
এদিকে শক্তি টলতে টলতে নিজের বিছানায় এসে বসে।পাশ থেকে রুশা বলে,”দাদাভাই তোমাকে নিয়ে কোথায় গেছিলো গো?বাবা শুনে অব্দি চিৎকার চেচামেচি করছেন।”
শক্তি রুশার প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না।সে ভাবতে থাকে যে, তার মানে এই বিষয়ে সবাই সবকিছু জানে।একমাত্র সে নিজেই কিছু জানতো না।কিন্তু বাবু, মামনী, রিদ্ধি দি সবার কথা তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই তার জীবনে এতো কমপ্লিকেশনস কেনো আসছে?কিছুই বুঝতে পারছে না শক্তি।আর এসব কথার মানে কি?বাবু রক্তিমকে পাগল কেনো বলছে।মূহুর্তেই সারা সন্ধ্যার ভালো লাগার অনুভূতি ভয়ে বদলে গেলো শক্তির ।মনটা কেমন বিষন্ন হয়ে উঠলো। তার জন্য বাড়িতে এতো ঝামেলা হচ্ছে!
ভাবতে থাকে শক্তি।
শক্তির ধ্যান ভাঙ্গে রিদ্ধির ডাকে,
“কি রে কখন ফিরলি?কোথায় গেছিলি তোরা?”
শক্তি রুশার দিকে তাকিয়ে বলে,
“একটু বাইরে যা তো বনু।আমার রিদ্ধি দির সাথে কথা আছে। ”
অন্যদিন হলে রুশা বলতো যে না আমি যাবো না।তোমরা কোনো কথা আমায় বলো না।কিন্তু আজ তেরো বছরের রুশাও বুঝতে পারছে যে বাড়িতে সিরিয়াস কিছু হয়েছে।তাই সে কোনো কথা না বলে চুপচাপ বেরিয়ে যায়।
“কি হয়েছে রিদ্ধি দি?বলো।”
“আমিও তো সেটাই জানতে চাইছি।রক্তিম কি তোকে বেশি ঝেড়েছে?এতো চুপচাপ কেন তুই?”
“আগে আমার একটা কথার উত্তর দাও।তার আগে বলো যা জিজ্ঞেস করবো তার সত্যি উত্তর দেবে?”
শক্তির এমন কথা শুনে বার কয়েক ঢোক গেলে রিদ্ধি। জোড় করে হাসার চেষ্টা করে বলে,
“কি জানতে চাস?”
“আমার কাছ থেকে কি লুকাচ্ছো তোমরা?”
“লুকাচ্ছি মানে,কি লুকাবো তোর থেকে?” কিছুটা বিব্রত ভাবে বলে রিদ্ধি।
“দেখো রিদ্ধি দি,আমায় একদম ভুজুংভাজুং বোঝাতে এসো না। এখন আমি আর ছোটো নই তাছাড়া তুমি বলেছে যে সত্যি কথা বলবে।”
এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে শক্তি।
“শক্তিরে,আমাদের জীবনে এমন কিছু সময় আসে যখন কি করণীয় আর কি করণীয় নয় সেটা আমরা গুলিয়ে ফেলি।আমার অবস্থা হয়েছে এখন এমন।মন বলছে তোকে সবটা বলে দেয়া উচিত। কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে তোকে এই বিষয় থেকে দূরেই রাখতে।”
শক্তি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রিদ্ধির দিকে। রিদ্ধি আবার বলে,”বুঝতে পারলি না,তাই না?”
শক্তি মাথা নাড়ায় যে সে সত্যিই বুঝতে পারেনি।
“দেখ,শক্তি, রক্তিম আজ তোকে কি বলেছে তা সম্পূর্ণ না জানলেও কিছুটা হয়তো আমি জানি।তোকে আমি একটা কথাই বলতে পারি যে এটা ও আজ থেকে নয় বরং আরো অনেক দিন আগে থেকেই তোকে বলতে চায়।কিন্তু ওর স্বভাব তো তোর অজানা নয়।নিতান্তই বাধ্য না হলে তোকে ও এই কথা বলতো না।”
রিদ্ধির কথা শুনে বলে শক্তি, “আমায় সত্যিটা বলো প্লিজ। আমি সবটা শুনতে চাই।আর হ্যা,আমি সবটা শোনার জন্য মেন্টালি প্রিপেয়ার্ড।”
“তার আগে তুই আমায় একটা কথা বল,ভালোবাসিস রক্তিমকে?”
রিদ্ধির এই প্রশ্নের কি জবাব দেবে শক্তি? সত্যি বলতে তো কোনো দিন রক্তিমের ব্যাপারে এভাবে ভেবেই দেখেনি ও।কিন্তু রক্তিমের এই ছয় মাসের অনুপস্থিতি যেনো শক্তিকে নতুন করে কিছু অনুভব করালো যে রক্তিম তার জীবনে কতটা জায়গা জুড়ে ছিলো।তার সব সময় ধমকানো,শাসন করা এগুলো যেনো তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিলো।বিশেষ করে আজ সন্ধ্যার পর থেকেই শক্তি এটা বেশি করে অনুভব করছে।
শক্তির চুপ থাকা দেখে রিদ্ধি বলে,”আমার মন কি বলে জানিস? তুইও রক্তিমকে ভালোবাসিস।নয়তো ওর করা এই ব্যবহার গুলো তুই কখনোই মেনে নিতিস না।তোর জায়গায় আমি হলেই এগুলো মেনে নিতাম না।।”
একটু থেমে শক্তির দিকে তাকিয়ে আবার বলতে থাকে রিদ্ধি, “তুই যদিও ভালোবেসে থাকিস,তবুও রক্তিমের ভালোবাসার গভীরতা হয়তো মাপতে পারবি না।ছেলেটা পাগলের মতো ভালোবাসে তোকে।আর এই ভালোবাসাটাই ওর কাল হলো!”
শক্তি কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে,”প্লিজ আমাকে বলো সবকিছু। এভাবে অন্ধকারে রেখো না আমায়।”
শক্তির মুখ দেখে রিদ্ধি বুঝতে পারছে সবটাই।হাজার হোক সেতো বড়ো বোন। ভাইয়ের মন সে যেমন বোঝে শক্তিরটাও তেমনি বুঝতে পারছে।তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো সবটা পুরোপুরি শক্তির কাছে খুলে বলার।
“শক্তি, তুই এই বাড়িতে ছোট থেকে আছিস।তুই জানিস যে রক্তিমের কথার বাইরে এই বাড়িতে কিছুই হয় না।ও আর আমি সমবয়সী হলেও ওই আমাকে কন্ট্রোল করে।আর এটাও দেখেছিস যে,ও যেটা চায় ওকে সেটা দিতেই হয়।তুই কি জানিস এর কারণ কি?”
শক্তি মাথা নাড়ায়। কারণ এই সবকিছুই তার জানা। এই বাড়িতে বাবু, মামনী সবাই রক্তিমকে সমীহ করে চলে।কিন্তু এর কারণ সে আজ পর্যন্ত জানে না।
“এর কারণ হলো রক্তিমের ওভার পসেসিভনেস।ওর যা চাই সেটা ওর লাগবেই। তুই যখন আমাদের বাড়িতে এলি তখন আমরা সবে ক্লাস এইটে।প্রথম দু’বছর কোনো সমস্যাই ছিলো না।কিন্তু আমরা যখন ক্লাস টেনে পড়ি,তোর প্রতি রক্তিমের বিহেভিয়ার চেঞ্জ হতে লাগলো।ও তোকে আলাদা নজরে রাখতো।তোর প্রতি একটা আলাদা কেয়ার,তোর পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে না পারা।এসব আমি লক্ষ করলাম।তুই তখন সবে ক্লাস ফাইভে।তোর মনে আছে কিনা জানি না।একবার তোর এক ক্লাসমেটকে ও খুব মেরেছিলো।এর কারণ ছিলো ও তোর পাশে বসেছিলো। ”
শক্তির মনে আছে এই ঘটনা। তখন থেকেই তার বাইরে কোনো ছেলেদের সাথে কথা বলা বন্ধ। কিন্তু এর পেছনে যে এই কারণ তা সে জানতো না।
রিদ্ধি আবার বলে,”ছোট থেকেই রক্তিমের স্বভাব, ও নিজের প্রিয় জিনিস কাউকে শেয়ার করে না।তখন পর্যন্ত এটা স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকায় মা,বাবা কেউ তেমন মাথা ঘামায় নি এই বিষয়ে।কিন্তু তোর ক্ষেত্রে রক্তিম মাত্রাতিরিক্ত করতে থাকে।ওর বিহেভিয়ার কেমন যেনো পাগল পাগল হয়ে যেতে থাকে।তাই বাবা ওকে কলেজে ওঠার পর এখান থেকে পাঠিয়ে দেয় শহরে। বাবা ভেবেছিলো হয়তো দূরে থাকলে রক্তিম সব ভুলে যাবে।কিন্তু তা আর হলো কই?চোখের সামনেই তো দেখছিস।”
বলে রিদ্ধি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
শক্তি ভাবছে তার পেছনে এই বাড়িতে এতো কিছু হচ্ছে আর সে কিছুই জানে না।তারচেয়েও বড়ো কথা,যে মানুষটা তাকে এতো ভালোবাসে তাকেই কিনা সে ভুল বুঝেছে এতোদিন যাবত।
————————————–
মাঝ রাতে চেঁচামিচির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় শক্তির। শব্দটা রক্তিমের ঘর থেকে আসছে।
পীযূষ বাবুর গলা শোনা যাচ্ছে। উনি সাধারণত বেশি জোরে কথা বলেন না।কিন্তু এখন গলা শুনে বোঝা যাচ্ছে উনি বেশ রেগে আছেন।
“কতোবার বলেছি তোমায় রক্তিম, যে তুমি শক্তির থেকে দূরে থাকবে।তোমার কথায় অবশ্যই আমি ওর জীবনের সবচেয়ে বড়ো সিদ্ধান্ত নেবো না।”
বিপরীত পাশে রক্তিমের গলাও শোনা যাচ্ছে,
“আমি তো ওর গা ঘেসেই থাকবে।দেখি কে আমার কি করে।আর ওর জীবনে আমার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। ”
শক্তি কপাল চাপড়ে বলে এ কেমন লাজলজ্জাহীনের পাল্লায় পরলো সে।বাবুর সামনে যা মুখে আসছে তাই বলছে।বেশরম!!!
(চলবে)