পূর্ণিমা সন্ধ্যায়,পর্ব-২০অন্তিম পর্ব

পূর্ণিমা সন্ধ্যায়,পর্ব-২০অন্তিম পর্ব
Tithee Sarker

“আমি কি সত্যি তোর সাথে অন্যায় করে ফেলেছি?
চুপ করে থাকিস না,কথা বল আমার সাথে। তুই কিছু না জানালে আমি বুঝবো কিভাবে?”

পীযূষ বাবু অপরাধী ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে শক্তিকে।তিনি আবার বলেন,

“তোর আট বছর বয়সে যখন তোর বাবা -মা চলে গেলেন,মৃত্যুর আগে তাদের আমি কথা দিয়েছিলাম তোকে নিজের সন্তানের মতো করে রাখবো আজ তুই বল,আমি কি কোনো অন্যায় করছি তোর প্রতি?”

পীযূষ বাবুর কথার বিপরীতে কি বলবে কিছু ভেবে পায় না শক্তি। সত্যিই তো,উনি তো শক্তির সুখের ব্যবস্থাই করতে চেয়েছিলেন। তবে শক্তির সুখের ঠিকানাটা হয়তো উনার জানা নেই।

“বাবু,আমি জানি তুমি সবসময়ই আমার ভালো চাও কিন্তু এর জন্য ওনাকে এমন ভাবে কথা শোনানোও তো ঠিক নয়,তাই না?”

“উনিটা আবার কে?”

“ম.মানে,,তোমার ছেলে। ”

পীযূষ বাবু অবাক হন শক্তির কথায়। তবু্ও বলে,

“তুই কি মনে করিস?রক্তিমের সাথে এমন ব্যবহার করে আমি খুব আনন্দ পাই?আমি চাই না,ওর কারণে তোর কোনো ক্ষতি হোক।”

“উনি আমায় ভালোবাসেন,উনি আমার কি ক্ষতি করবেন?”

আচমকা বলেই জিহ্বায় কামড় দেয় শক্তি। ইশশ,,,সে এটা কি বলে ফেলেছে!!!

“দেখ,শক্তি, আমি সবটাই জানি।কিন্তু তুইও তো সব জানিস।ও একটা পাগল,রাগলে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে যায়।কতবার তো তোর উপর হাত তুলেছে। কিভাবে থাকবি তুই ওর সাথে? শুধুমাত্র আমার ছেলে বলেই ওর সাথে তোর বিয়ে আমি দেবো না।”

পীযূষ বাবুর স্বাভাবিকভাবে,ফ্রীলি কথা বলাতে শক্তিও সাহস পায়।সে বলে,

“ওনাকে পাগল বলো না।উনি তো পাগল না!হ্যাঁ,উনি একটু ওভার থিংকিং করেন।একটু বেশি পসেসিভ।তাই বলে তুমি পাগল বলবে?আর কি নিশ্চয়তা আছে যে অন্য জায়গায় বিয়ে দিলে আমি সুখী হবো,আর এমন কি নিশ্চয়তা আছে যে উনি আমার বিয়ে অন্য কোথাও হতে দেবেন?”

শক্তির কথায় অবাক হয় পীযূষ বাবু। শক্তি রক্তিমের জন্য এতোটা চিন্তা করে।ও কি তবে রক্তিমকে ভালোবাসে?
কয়দিন আগেও তিনি রক্তিমের সমস্যাটা নিয়ে তার এক ডাক্তার বন্ধুর সাথে কথা বলেছিলেন।উনি বলেছিলেন যে রক্তিমের জন্য শক্তিই পারফেক্ট।শক্তিকে সারা জীবনের জন্য পাশে পেলে হয়তো রক্তিম চেঞ্জও হয়ে যেতে পারে।কিন্তু পীযূষ বাবু শক্তির সাথে কোনো রিক্স নিতে চাননি।নিজের ছেলেকে ঠিক করতে গিয়ে তো এই মেয়েটাকে তিনি শাস্তি দিতে পারেন না
কিন্তু আজ শক্তির কথা শুনে মনে হচ্ছে তিনি ভুল করে ফেলেছেন। তার আরও আগে শক্তিকে এই কথা জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো।
তাই তিনি এবার জিজ্ঞেস করেই ফেললেন,

“তুইও কি রক্তিমকে ভালোবাসিস, শক্তি? মারে,আমিও তো তোর বাবা তাই না?তুই আমাকে তো সবকিছু বলতেই পারিস।”

শক্তি কি বলবে ওনাকে?এর উত্তর তো আজ পর্যন্ত রক্তিমকেই দিলো না সে।কিন্তু এখন তার চুপ করে থাকলে চলবে না।যাই হোক বিয়েটা তো হয়েই গেছে।এখন কিছু না বললে যদি বাবু বিয়েটা মেনে না নেয়।তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো সবকিছু বলে দেয়ার।

“হ্যাঁ,বাবু। ”

আস্তে করে বলে শক্তি।

পীযূষ বাবুর চেহারায় বিস্ময়ের সাথে একরাশ খুশির ঝলক দেখা দেয়।যেনো তিনি এটাই শুনতে চাইছিলেন।

————————–

বাড়িতে আবারও বিয়ের রেশ।শক্তি অবাক হয়ে ভাবছে তার বিয়েটা হয়েই গেলো?না,মানে এমন না যে সে চায়নি তার বিয়ে হোক। তাই বলে এতো তাড়াতাড়ি!!!

রক্তিমের এই হঠকারী সিদ্ধান্তটি তার জীবনটা এতো জলদি পাল্টে দিলো।

যদিও সবাই বলেছিলো যে শক্তির পরীক্ষার পর ধুমধামে বিয়ের আয়োজন করা যাবে খন।কিন্তু রক্তিম কি আর সেই কথা মানে?কে জানে তারপর কে না কে তার বিয়ে করা বউকে যদি আবার বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দেয়!!!

তাই ওই ঘটনার দু’দিন পর আবার বিয়ের আয়োজন করা হয় ঘরোয়া ভাবে।খবর পেয়ে ঢাকা থেকে বাড়ি আসে রিদ্ধি, অর্ক।এই বিয়েতে রুশা তো মহা খুশি। কেননা তার দিভাইয়ের মতো শক্তি আর বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেনা।

একদম সিম্পল ভাবে সাজানো হয়েছে শক্তিকে।জয়া নিজেই তার বিয়ের গয়না দিয়ে সাজিয়ে দেয় ওকে।জয়াও আজ খুব খুশি। রক্তিমের সাথে শক্তির বিয়ে! এটা তো তারও কতোদিনের স্বপ্ন ছিলো।

—————————

আজ ছিলো ওদের বৌভাত। রাতে রিদ্ধি ওকে রক্তিমের ঘরে নিয়ে যায়।আর সাথে তার গা জালানো কথা তো ছিলোই।

“কিরে,,,খুব তো সেদিন লজ্জা পেয়ে পালিয়ে ছিলি?এখন বল,যাবি নাকি হানিমুনে? ”

“উফফ,,,, তুমিও না দি!যাও তো।”

“বাহ্ রে বাহ্!বিয়ে করে এখন আমাকেই তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে? আচ্ছা, মনে থাকবে।” এই বলে চলে যায় রিদ্ধি।

শক্তি ওর দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙচি দেয়।রিদ্ধিও সেটা উল্টো ফেরত দিয়ে যায়।

শক্তি আর বসে না থেকে উঠে দাঁড়ায়। রক্তিম এখনও আসছে না।তাই সে ঘরের লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
এই বারান্দাটা বরাবরই ওকে বেশি টানে। কি সুন্দর সুন্দর ফুল গাছ লাগিয়েছে রক্তিম।কতো ধরণের ফুল! এগুলোর মধ্যে তার সবচেয়ে পছন্দের হলো এই সাদা জারবেরা।কি সুন্দর দেখতে।
হঠাৎই চারপাশে তাকিয়ে বিস্মিত হয় শক্তি। চারদিক চাঁদের আলোয় ঝলমলে। পূর্ণিমার দ্বিতীয় দিন হওয়ায় আকাশে পূর্ণচন্দ্র।
শক্তি ভাবছে তার জীবনের এতো বিশেষ দিনেও পূর্ণিমা।এটা কি তার প্রতি ঈশ্বরের আশীর্বাদ!

এরই মাঝে রুমে রক্তিমের পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো।রক্তিমের পায়ের আওয়াজও খুব ভালো করে চেনে শক্তি।

শক্তিকে রুমে না পেয়ে রক্তিমও বারান্দায় যায়।মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শক্তির দিকে। চাঁদের আলোয় কি অপূর্বই লাগছে ওকে!আচ্ছা, শক্তি কি সত্যিই এতো সুন্দর, নাকি তার চোখে সবসময় ওকে এমন মোহনীয় লাগে।

রক্তিম ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে থুতনি রাখে।শক্তি পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়।রক্তিম আস্তে করে বলে,

“কি করছিস এখানে, হুম? ”

“আজ কি বলো তো?”

“আমাদের ফুলসয্যা,আবার কি?কেনো তুই কি ভুলে গেলি নাকি? ” রক্তিমের মুখে দুষ্টু হাসি।

“ধ্যাত,আমি কি ওইটা বলেছি নাকি! ” কপট রাগ দেখিয়ে বলে শক্তি।

শক্তির লজ্জা দেখে রক্তিম ওকে আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে বলে,

“আচ্ছা, বল,কি আজকে? ”

“আজ পূর্ণিমা।”

“তো।” ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে রক্তিম।

“ওহ,তুমি ভুলে গেছো?”

“কি ভুলবো,কি ছিলো আজ?”

লম্বা একটা দম নিয়ে বলে শক্তি,

“এমনই এক #পূর্ণিমা সন্ধ্যায় তুমি আমায় প্রোপজ করেছিলে।অবশ্য ওটাকে প্রোপজ বলে না।”

বলে মুখটা ছোট করে ফেলে শক্তি।রক্তিমের দিক থেকে চোখ সরিয়ে বাইরে তাকালো।
রক্তিম কিছু না বলেই আচমকা কোলে তুলে নেয় শক্তিকে।

“এই,এই,কি করছো?নামাও নামাও।”

শক্তির কথা পাত্তা না দিয়ে রুমের বাইরে বের হয় রক্তিম। ছাঁদের সিড়িতে উঠতে উঠতে বলে,

“চল,আজ তোকে নিয়ে পূর্ণিমায় চন্দ্র বিলাস করবো।”

আস্তে আস্তে ছাঁদের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসে।শক্তিকে বসিয়ে দেয় দোলনাটাতে।আর নিজে বসে পরে ফ্লোরে, শক্তির কোলে মাথা রেখে।

শক্তির কোমর জড়িয়ে ধরে বলে,

“আজ জানিস,আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর সুখের দিন। তোকে আমি কত জ্বালিয়েছি,তাইনা?তুই আমায় ক্ষমা করবি না?”

“না,ক্ষমা তো করবো না।”

শক্তির কথায় চকিতে ওর দিকে তাকায় রক্তিম। দুচোখে অসহায়ত্ব।

“কেনো,কেনো করবি না।আমি স্যরি,অনেক স্যরি।”

রক্তিমের প্রায় কেঁদে দেওয়ার জোগাড়।

রক্তিমের এই মুখ দেখে শক্তি হাসতে হাসতে বলে,

“আরে,আমি ক্ষমা করবো কি করে?আমার তো কিছু মনেই নেই।”

শক্তির এই কথায় ওকে খুব টাইটলি জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রাখে।

শক্তি বলে,

“চারপাশটা কি সুন্দর! আমাদের জীবনটাও কি এমন সুন্দর হবে?”

“গান শুনবি শক্তি?”

শক্তি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাতেই রক্তিম গাওয়া শুরু করে,

পূর্ণিমা সন্ধ্যায় তোমার রজনীগন্ধায়

রূপসাগরের পাড়ের পানে উদাসী মন ধায়,

তোমার প্রজাপতির পাখা

আমার আকাশ চাওয়া মুগ্ধ চোখে

রঙিন স্বপন মাখা

তোমার চাঁদের আলোয়…

মিলায় আমার দুঃখ -সুখের সকল অবসান।।।।

রক্তিমের দিকে বরাবরের মতোই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে শক্তি। আজ থেকে তাদের নব জীবনের সূচনা।
শক্তির প্রতি এই ভালোবাসা, এই মুগ্ধতা যেনো আজীবনের অভ্যাশে পরিণত হয় রক্তিমের এই কামনাতেই,এই গল্পের ইতি টানি আমরা।আর ওরা প্রবেশ করুক ওদের ভালোবাসার জগতে।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here