পূর্ণিমা সন্ধ্যায়,সূচনা পর্ব
Tithee Sarker
এক পায়ের উপর ভর দিয়ে কান ধরে দাড়িয়ে আছে শক্তি। আর তার সামনে চেয়ারে বসে আছে রক্তিম, হাতে একটা কাঠের রুলার । কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে শক্তির দিকে। শক্তি পারছেনা শুধু কেঁদে দিতে তবে তার চোখে স্পষ্ট জল চিকচিক করছে।এরই মাঝে রক্তিমের দাঁতে দাঁত চাপানো আওয়াজ,
“কিরে এখন কথা বলছিস না কেনো?স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে তো বেশ দাঁত কেলিয়ে কথা বলছিলিস লিমনের সাথে।তো এখন আওয়াজ বের হচ্ছে না কেন?”
বলেই সামনে থাকা টেবিলে জোরে বারি দেয় রুলার দিয়ে।
ভয়ের চোটে শক্তি মাটিতে পড়ে যায় আর তার চোখে জমা জল গুলো টুপটাপ ঝরে পড়ে গাল বেয়ে।
কিন্তু শক্তির চোখের জল কোনো প্রভাব ফেলে না রক্তিমের উপর।
“হাত সামনে আন।”
রক্তিমের এই কথা শুনে রীতিমতো ফুপিয়ে কান্না শুরু করে দেয় শক্তি।
“কিরে শুনতে পাস নি।” কিছুটা চিল্লিয়ে বলে রক্তিম।
শক্তি খুব ভালোভাবেই জানে এই পাষাণের সামনে কেঁদে কোনো লাভ নেই।আর এটাও জানে যে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে রক্তিমের দেয়া শাস্তি ভোগ করে এর আগে সে এই ঘর থেকে বেরুতে পারবে না।তাই উপায় না পেয়ে নিজের হাত দুটো বাড়িয়ে দেয় সে।রক্তিম সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তার দুই হাতে আঘাত করে।
শক্তি ব্যাথায় ঠোঁট চেপে রাখে।শব্দ করে কান্নাও করতে পারেনা।কারণ সে জানে এখন যদি সে কাঁদে তো তার কপালে আরও মাইর আছে।
রাগের জোটে দরজায় দড়াম করে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যায় রক্তিম।
শক্তি এবার শব্দ করে কাদতে শুরু করে।আর ভাবে যে দোষটা হয়তো তারই ছিলো। এই বাড়িতে আসা থেকেই সে দেখতো যে বাড়ির মেয়েদের বাইরের মানুষদের সাথে বেশি কথা বলা পছন্দ করে না রক্তিম। আর এই বিষয়ে অন্যরা কিছু ছাড় পেলেও তার ব্যাপারে একটু বেশিই কঠোর এই নিয়ম।কিন্তু সে কি করতো।
আজ তাদের এস এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট পাবলিশ হয়েছে আর স্কুলে সেই একমাত্র ছাত্রী যে কিনা গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে।তাই সবার সাথেই টুকটাক কথা বলছিলো।কেউ কিছু জিগ্যেস করলে তো আর চুপ করে থাকা যায় না।তারই ক্লাসমেট লিমন।তাকে জিগ্যেস করছিলো যে এবার সে কোন কলেজে ভর্তি হবে।উপজেলা সদরের কলেজে নাকি শহরের কোনো কলেজে। সে শুধু এইটুকু কথারই জবাব দিচ্ছিলো আর যমদূত এসে হাজির। রক্তিমকে সে যমদূতই মনে করে।
রক্তিমের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই শক্তির। বলতে গেলে এই বাড়ির কেউই তার রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়।কিন্তু আজ তারাই তার সবচেয়ে আপন।আট বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় শক্তির বাবা মা মারা যান।এই পৃথিবীতে আপন বলতে শক্তির কেউই ছিলো না।কারণ শক্তি ছিলো তার বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে।আর তাদের কোনো কাছের আত্মীয় স্বজনও ছিলো না, কেননা তার মা বাবা পালিয়ে বিয়ে করেছিলো আর কেউ এই সম্পর্ক মেনে নেয়নি।
মা বাবাকে হারিয়ে যখন ৮ বছরের শক্তি একা হয়ে যায় তখন তাকে সন্তান স্নেহে আপন করে নেয় তার বাবার সবচেয়ে কাছের বন্ধু পীযূষ সেন।তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং নিজের সন্তানদের সাথে মানুষ করতে থাকেন। রক্তিম ওনারই বড় ছেলে।
ছোট থেকেই রগচটা আর একরোখা স্বভাবের।তার এই মেজাজের কারণে তার বাবাও তাকে ভয় করে চলে।আজকের এই শাস্তি তার কাছে নতুন নয়।বাড়ির সবাই তাকে অনেক আদর করলেও তার মনে হয় রক্তিম তাকে দু চোখে দেখতে পারেনা।ছোট থেকেই পড়ানোর ছলে বহুত মাইর দিয়েছে। আর তাকে দিয়ে জামা কাপড় না ধোয়ালে নাকি রক্তিমের জামা পরিষ্কারই হয় না।
“খবিশ একটা!”ফুপাতে ফুপাতে বিরবির করে শক্তি।
এই সময় হাতে একটা অয়েন্টমেন্ট নিয়ে রুমে আসে রক্তিমের বোন রিদ্ধি।আদুরে ভাবে শক্তির মাথায় হাত বুলায়।রিদ্ধির উপস্থিতি টের পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে শক্তি।
” হাতটা দেখি দে,খুব লেগেছে তাই না,বনু?”এই বলে রিদ্ধি নিজেই হাতে ওষুধ লাগাতে লাগে আবার বলে,
“ইসস,হাতটার কি অবস্থা করেছে খবিশটা!”
“আমার দোষ কি ছিলো বলতো,রিদ্ধি দি?আমি কি যেচে পরে কথা বলেছি নাকি?কেউ কিছু জিগ্যেস করলে কি চুপ করে থাকবো,জিগ্যেস করে এসো গিয়ে তোমার ভাইকে।” কাঁদতে কাঁদতে কোনে ভাবে বলে শক্তি।
“তোর কপালটাই খারাপ রে,,,তাই দাদা তোর সাথেই এমন করে।”
“আমার কপাল খারাপ না আসলে তোমার ভাই আমাকে দেখতেই পারে না।তাই এমন করে। ”
“এখন নিচে চল,মা তোর জন্য তোর পছন্দের রসমালাই বানিয়েছেন। আজ কত ভালো একটা দিন।”
“আর ভালো দিন,তোমার ভাই আমার প্রতিটা দিনকেই খারাপ বানানোর জন্য তৈরি থাকে, তুমি যাও আমি আসছি।” এই বলে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গেলো শক্তি।
রিদ্ধি নিচে আসতেই রক্তিম জিগ্যেস করে,
“ওষুধ টা লাগিয়েছিস?”
“তোর ব্যাপার স্যাপার আমি বুঝিনা রক্তিম।কেনো মারতে গেলি ওকে ওই ভাবে!আবার দরদ করে ওষুধ পাঠিয়েছিস।তোর এই রাগের কারণে একদিন না তোকে পস্তাতে হয়।” গলায় ঝাঁঝ নিয়ে বলে যায় রিদ্ধি।
“তোর গন্ডিটা আমি আমাতেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।এই গন্ডি টপকে বের হওয়া তোর সাধ্য নয় শক্তি। ”
শক্তির রুমের দিকে তাকিয়ে নিজের মনে কথাগুলো বলে যায় রক্তিম।
রুমে এসে নিজের বিছানায় শুলো রক্তিম। আর ভাবতে থাকে আজকে দুপুরের ঘটনা।
আজ শক্তির রেজাল্ট হবে বলে সে নিজে ওকে আনতে যায় স্কুল থেকে। আর ভাবে নিশ্চয়ই শক্তি অনেক ভালো রেজাল্ট করবে।ওকে নিয়ে আজ সদরের দয়াময় থেকে রসমালাই খায়িয়ে আনবে।ওই দোকানের রসমালাই শক্তির ফেবারিট। কোনো দিন তো কোথাও নিয়ে যায়নি ওকে।শক্তি নিশ্চয়ই খুব অবাক হবে।কিন্তু স্কুলের সামনে গিয়ে ওর মাথাটা গরম হয়ে যায়।দেখে যে শক্তি এক ছেলের সাথে কথা বলছে।আর ওর ড্রেসের বিভেলটা সরে যাওয়ায় ছেলেটা ওই দিকে তাকিয়ে আছে। এটা দেখার পরই রাগের জোটে ওই ঘটনা। রক্তিমও জানে এতে শক্তির কোনো দোষ নেই। তবুও তার রাগটা গিয়ে ওর উপরই পরছে।কেনো ও ওই ছেলের সাথে কথা বলতে গেলো।এই ভেবে জোরে নিজের হাত দিয়ে দরজায় আঘাত করে।কাঠের দরজায় পেরেক লাগানো থাকায় ওই পেরেক রক্তিমকে হাতের তালুতে ঢুকে যায়।ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে নেয় সে।
নিচ থেকে শুনতে পায় তার বাবার গলা।তিনি জোরে জোরে ডাকছেন,
“শক্তি মারে,এদিকে আয়,দেখ তোর জন্য কি এনেছি। ”
বাবার ডাক শুনে রক্তিমও নিচে যায়।
গিয়ে দেখে তার বাবা হাসি মুখে একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। ওনার মুখ দেখই বোঝা যাচ্ছে উনি কতটা খুশি। আর খুশি হবেন নাই বা কেনো?উনাদের গ্রামটা বলতে গেলে অজপাড়াগাঁ। এখানে না আছে ভালো কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা আর না আছে ভালো রাস্তা। আর এখানে থেকেই নিজে পড়ে এতো ভালো রেজাল্ট করেছে শক্তি। এর আগে এই গ্রাম থেকে শুধু রক্তিমই এমন রেজাল্ট করেছিলো। আজ আনন্দে,গর্বে ওনার মনটা ভরে উঠছে।
একটু পর শক্তি, রুশা ওরা নিচে নেমে আসে।রুশা হলো রক্তিম আর রিদ্ধির ছোট বোন।
ওরা তিন ভাইবোন। রক্তিম আর রিদ্ধি জমজ।আর রুশা ওদের ছোট।
শক্তি কাছে এসে ওনাকে প্রণাম করে।আস্তে করে বলে,
“আমায় ডেকেছিলে,বাবু?” শক্তি ছোট থেকেই ওনাকে বাবু বলে ডাকে।
উনি এক গাল হেসে বলে,
“হ্যা রে মা,ডেকেছি।আজ তো তোরই দিন। কত ভালো রেজাল্ট করেছিস তুই। আজ আমার খুব গর্ব হচ্ছে। ”
“এদিকে আয় তো,শক্তি। ”
এই বলে রক্তিমের মা জয়া তাকে নিজের দিকে টেনে নিলো।আবার বললো,
“আজ তোর জন্য রসমালাই বানিয়েছি। যদিও রিদ্ধি বলছিলো বানানোর দরকার নেই।রক্তিম নাকি,,,,
এরই মাঝে বলে ওঠে রিদ্ধি,
” মা বেশি বকবক না করে নিয়ে এসো রসমালাই। বাবা, ওই ব্যাগে কি আছে? ”
“এতে আছে আমার মা টার জন্য একটা জিনিস। দেখতো না পছন্দ হয় কিনা? ”
রিদ্ধি প্যাকেটটা খুলে ভেতরে একটা স্মার্টফোন পায়।
“ওয়াও,,বাবা স্মার্টফোন! শক্তির জন্য? ”
“হ্যা,মা তো এখন আমার বড় হয়ে গেছে। এখন তো লাগবেই। ”
শক্তি হ্যা না কিছু বলার আগেই শোনা গেল রক্তিমের গম্ভীর আওয়াজ,
“না,ওর এখন ফোনের দরকার নেই।”
চলবে