নেশাক্ত তোর শহর
পর্ব::০২
ইফা_আমহৃদ
সাজগোজহীন বাসর ঘরে বসে আছে তৃষ্ণা।মনের মাঝে অগোছালো স্বপ্ন গুলো হানা দিচ্ছে তার।
রুমটা বিয়ে উপলক্ষে ডেকরেশন করে নেই বটে তবে একদম পরিপাটি । ছেলেদের রুম এতো গোছালো হয় জানা ছিলো না তৃষ্ণার। ঘরের দেয়ালটা পিংক এন্ড ব্লু কালারের সংমিশ্রণে সাজানো। বিশাল জানালায় সাদা পর্দা টানায় ঘরের ভেতর শীতল শীতল ভাব বিরাজ করছে।ঘরের আলমারি, সোফা , ড্রেসিং টেবিল, ইভেন্ট বেডের পাশে রাখা ছোট সাইজের টেবিলটাও শুভ্র রঙের। সাইড টেবিলের উপর রাখা শুভ্র রঙের ফুলদানি টায় লাল সাদা দুটো গোলাপ । গোলাপ দুটো লুকিয়ে আছে ।দেখে বোঝা যাচ্ছে অনেকদিন আগের। ডান পাশের দেয়ালে চোখ আটকে গেল তৃষ্ণার ।দেয়ালে বড় করে বাঁধানো একটা ছবি।যেখানে একটি প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে হাতে থাকা একটা লাল গোলাপের দিকে তাকিয়ে আছে। ছবিটার নিচে ফ্রেমটাতে সোনালী অক্ষরে লেখা,,” তৃষ্ণার্থ আয়াত”। ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো তৃষ্ণার। ঠোঁট জোড়া প্রশস্ত করে শব্দহীন উচ্চারণ করলো “আয়াত”।
একটু পরপর দরজার দিকে তাকিয়ে আয়াতের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলো। এখন পর্যন্ত তার স্বামী নামক ব্যক্তিটিকে দেখা হয়নি। আসার সময় আয়াতের ছোট বোন আরোহী তার পাশে বসে ছিল। প্রথমবার ছবিতেই আয়াতকে দেখলো সে।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো তৃষ্ণা।ঘড়ির কাঁটা একটা ছুঁই ছুঁই । এতোক্ষণে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকতো সে।চরম বিরক্ত হলো তৃষ্ণা। চেয়েছিল আয়াত নামক মানুষটার থেকে কিছুটা সময় চেয়ে নিবে। কিন্তু তার চাওয়া টাকে চাওয়া রেখে ,এক টানে মাথার ঘোমটা খুলে নিল সে।দুহাতে শাড়ি পেঁচিয়ে উঠে দাঁড়ালো ।লাল রঙের শাড়ি বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল ।শাড়িটা পাল্টে চোখ মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে এলো । বেডের একদম কর্ণারে বালিশ চেপে শুয়ে পড়লো।।
তৃষ্ণা যখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন তখন শব্দ করে রুমে প্রবেশ করলো আয়াত। একপা বেডের উপর রেখে তৃষ্ণা দিকে তাকিয়ে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। পিঠ ছাড়া অন্য কিছু আয়ত্তে এলো না তার । কিন্তু কিছুতেই রাগ কমছে না। বরং বেড়েই চলেছে। নিজেকে সংযত করতে টেবিলের উপর রাখা ল্যাম্পটা ছুঁয়ে ফেলল। অতঃপর ফুলদানিটা। দুহাতে মাথা চেপে চেঁচিয়ে বলল…
— “কী মনে করে আমাকে ,, খেলার পুতুল। ইচ্ছে হলো জোর করে বিয়ে করিয়ে দিলো।এখন আবার বাসর ঘরে পাঠিয়ে দিল। আমার জীবনের কোনো ব্যালু নেই তাদের কাছে।
আজ সব শেষ করে ফেলবো”।
কিছু ভাঙ্গার শব্দে ধক করে উঠে বসলো তৃষ্ণা ।রুমের নাজেহাল অবস্থা ,, আয়াতের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। আয়াতের জন্য অপেক্ষা না করে ঘুমিয়ে ছিল, তাই এমন বিহেব করছে কিনা বুঝতে পারলো না। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো সে ।আয়াতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে , কাঁচ বিঁধে গেল তৃষ্ণার পায়ে ।মুখ থেকে আপনাআপনি বের হয়ে গেল “” আহহ””!
উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল আয়াত ।মেইলি কন্ঠস্বর শুনে পেছনে ফিরে তাকিয়ে থমকের গেল সে ।তার সামনে লাল শাড়ি পরিধিতা একজন অপুরুপ রমনী দাঁড়িয়ে আছে। ঘনঘন পলক ফেলে কৌতূহল নিয়ে বললো…
— “তুমি!! তুমি এখানে কি করছ”??
চরম বিদ্বিষ্ট হলো তৃষ্ণা। দাঁতে দাঁত চেপে বললো…
— “আমি ভূত ! বাসর রাতে দেরী করে এসেছেন, তাই আপনার ঘাড় মটকে দিতে এসেছি!! আশ্চর্য..
বিয়ের সময় দেখেননি না-কি ? এখন ভেজা বেড়াল কেন সাঝছেন”??
সময় নষ্ট করলো না আয়াত ।দুকদম এগিয়ে গিয়ে দৃঢ় বাধনে আবেষ্টিত করে নিল তৃষ্ণাকে। প্রথমবার অজানা পুরুষের সংস্পর্শে এসে স্তব্ধ হয়ে গেল তৃষ্ণা। ধীরে ধীরে পিনবিহীন শাড়িটা কাঁধ থেকে খড়ে পড়লো নিচে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কাঁপা হাতে স্পর্শ করলো আয়াতের চিবুক। মৃদু স্বরে বলল..
–” ক-কি ক-করছেন? পায়ে ব্যাথা পাচ্ছি” ।
সাথে সাথে দূরত্ব বজায় রেখে সরে এলো আয়াত । তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে খসে পড়া আঁচলটা টেনে পেঁচিয়ে দিলো সে । দুহাতে আলতোভাবে কোলে তুলে অতি সাবধানে বেডে বসিয়ে দিল আয়াত। হাঁটু গেড়ে নিচে বসে আঘাত প্রাপ্ত চরণটা হাঁটুর উপর তুলে নিলো ।
পায়ে স্পর্শে হুস ফিরলো তৃষ্ণার। আয়াতের হাঁটুর উপর থেকে পা নামিয়ে আনতে নিয়ে চাইলে চোখ গরম করে তাকালো আয়াত । চুপসে গেল তৃষ্ণা।
সাবধানতা অবলম্বন করে বিঁধে যাওয়া কাঁচটা বের করে আনলো। কাবার্ড থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করে স্বযত্নে পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিল।আস্তে আস্তে পা সরিয়ে এক প্রকার দূরত্ব বেগে রুম প্রস্থান করলো আয়াত।
সামান্য পরিমাণ ব্যাথায় ব্যথিত হলো না তৃষ্ণা। পুরোটা সময় এক ধ্যানে আয়াতের দিকে তাকিয়ে ছিল। ধীরে ধীরে পূর্ণরায় নিজের জায়গায় এসে চোখ জোড়া বন্ধ করে গভীর নিদ্রায় হারিয়ে গেল সে।
____________________
প্রত্যুষের সোনালী রোদের আভা দিগন্ত থেকে দিগন্তের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে । উষার দুষ্টু মিষ্টি রোদ হানা দিচ্ছে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে পুরো পৃথিবী জুড়ে। রোদের সাথে তাল মিলিয়ে মিষ্টি সুরে পাখিরা ডেকে চলেছে । জানান দিচ্ছে পৃথিবীর দিনের আলোয় আলোকিত হয়েছে ।
জানালার পর্দা ভেদ করে উঁকি দেওয়া সকালের রোদের রশ্মি এসে পড়ছে তৃষ্ণার মুখে। তির্যক আলোতে চোখ যুগল ধীরে ধীরে কুঁচকে এলো তার। হাত বাড়িয়ে নয়ন যুগল আড়াল করে নিল সে। তথাপি কোনো উন্নতি হলো না। উল্টো হাতটা গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। আশে পাশে হাতরিয়ে কোনো কিছু আয়ত্তে পেল না । শাড়ির বাজে হাত পড়তেই আতংকে উঠলো সে। অঙ্গরুহ সংস্পর্শে এলে ধক করে চোখে খুলে তাকালো সে । চোখজোড়া শাড়ির উপর যেতেই এক ঝোঁক বাদামি রঙের উপর চোখ আটকে গেল। এক চিৎকার দিয়ে শাড়িটা খুলে বিছানায় থেকে নেমে গেল সে ।
নিষুপ্তির উগ্রে নিস্বন ধ্বনি শ্রুবণপথে যেতেই আবদ্ধ নয়ন যুগল মেলে গেল আয়াতের । আচম্বিতে নিদ্রা বিচ্ছিন্ন হওয়াতে আঁখি জোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। চোখের সামনে তৃষ্ণাকে শাড়িবিহীন দেখে সশব্দে উঠে বসলো । দ্রুত তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে গিয়ে দিকে হতাশাগ্রস্থ কন্ঠে বলল…
— “কি হয়েছে তৃষ্ণা । দুঃস্বপ্ন দেখেছ?? শরীর খারাপ লাগছে?
দুহাতে মুখ থেকে মলিন কন্ঠে বলল…
— “ঐ দেখুন । বেডের উপর ভুত”??
ঘাড় ঘুরিয়ে বেডের উপর আঁখি জোড়া দিতেই ঠোঁট দুটি চেপে হাসলো সে । দুহাত চিবুকে গুঁজে কৌতূহলী কন্ঠে বলল..
— “কালকে রাতে তো দিব্বি বলেছিলে ,, তুমি না-কি ভুত! তা কেমন ভুত শুনি ? যে ভুত ভুত কে ভয় পাচ্ছে? সাথে নিজের এই অবস্থা করলে “?
মুখশ্রী থেকে হাত নামিয়ে বেডের উপর দৃষ্টি দিতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল । বাদামী আর কালচে রঙের মিশ্রণে তৈরি মাঝারি সাইজের খরগোশ । খরগোশটা শাড়ির বাজে ঘুমিয়ে আছে ।খরগোশটা এতোটাই সুন্দর , তৃষ্ণার মন অনায়াসেই কেড়ে নিল। এগিয়ে গিয়ে খরগোশটাকে ছোঁয়ার আগেই চোখ গেল শাড়ির দিকে। শাড়ির খেয়াল হতেই নিজের দিকে তাকালো তৃষ্ণা। নিজেকে উদ্ভর অবস্থায় আবিষ্কার করে দ্রুত অন্য একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
তৃষ্ণার কান্ড দেখে মনে মনে হাসলো আয়াত । নিজের ব্যবহৃত তোয়ালে টা নিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় নক করলো । তৃতীয় বার নক করতেই ওপাশ থেকে তৃষ্ণার কন্ঠস্বর ভেসে এলো ..
— “নক করছেন কেন ? আমি এখুনি আসছ ..
পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে আয়াত বলল..
— “আসতে হবে না । শুধু দরজাটা সামান্য খুলে তোয়ালে টা নিয়ে নাও ।আর একবারে শাওয়ার শেষ করে বের হও । বেলা অনেক হয়েছে “।
ছিটকিনি টা সামান্য খুলে হাত এগিয়ে দিল তৃষ্ণা । তোয়ালে টা দিল না আয়াত ।বরংচ শুকনো হাতটার দিকে কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যেন প্রথমবার এই হাত জোড়া সে দেখেছে । হাতের রেখাগুলো হিজিবিজি । আঙুলের ডগায় থাকা নখগুলো ধবধবে সাদা। আর কিছু পর্যবেক্ষণ করার আগেই তৃষ্ণার বিরক্তিকর কন্ঠ ভেসে এলো..
— “মজা করছেন আমার সাথে । তোয়ালে দিলে দিন , নাহলে প্রয়োজন নেই “।
সময় নষ্ট না করে তৃষ্ণার হাতের বাজে তোয়ালে টা বন্দী করে দিল । হাতের আওতায় তোয়ালে টা আসার পরই মৃদু শব্দে দরজাটা লাগিয়ে নিল । মৃদু শব্দে হুঁশ ফিরল আয়াতের । ঘুমন্ত খরগোশটা দিকে তাকিয়ে নিচে নেমে এলো।
মায়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল আয়াত। নিজের যত্ন , খরগোশদের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো। দায়িত্ব টা আরোহীকে দিয়েছিলো । কিন্তু কালকে বিয়ের জন্য হয়তো খরগোশকে খাবার খাওয়াতে ভুলে গেছে ।
(চলবে)