নেশাক্ত_তোর_শহর পর্ব::১১,১২

নেশাক্ত_তোর_শহর
পর্ব::১১,১২
ইফা_আমহৃদ
পর্ব::১১

অম্বুর মাঝে চড়ের আঘাত অনুভব না হলেও তার গভীরতা ছিল ব্যাপক। শারীরিক ক্ষেত্রে কোনো রুপ প্রভাব না পড়লেও মানসিক ক্ষেত্রে ভেঙে দিয়েছিলো আয়াতকে। নিজেকে তৃষ্ণার কাছে ছোট মনে হচ্ছিল। তৃষ্ণার অনুমতি না নিয়ে তার হয়তো এমন কোনো কাজ করা উচিত হয়নি।
পুলের ভেতরে থেকে মাথা তুলে নত হয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকালো আয়াত। তখনও অনবরত বৃষ্টি হয়ে চলেছে। ওষ্ঠ যুগলের কামড়ে দীর্ঘক্ষণ আঁখি ঢেকে করুন সুরে বলল…

— “দুঃখিত তৃষ্ণা। আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি, তোমার খারাপ লাগবে। আমি আর কখনো পার্মিশন ছাড়া তোমার আশেপাশেও যাবো না। প্লীজ মন খারাপ করো না”।

আয়াতের শীতল কন্ঠে হুশে এলো তৃষ্ণার। নিজের কাজের জন্য কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। সে নিজেই এগিয়ে গিয়েছিল, তাহলে কেন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো। আয়াতকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলার আগেই আয়াত শার্টের কলার টেনে ঠিক করতে করতে বললো..

— “তোমার নত হওয়ার দরকার নেই। তোমার যেটা ঠিক মনে হয়েছে, সেটাই করেছ?
আজও তোমার মনে কোথাও না কোথাও রিজভী রয়ে গেছে। গভীরতম স্পর্শগুলো রিজভীর করার কথা ছিল। হয়তো, আজও তুমি আমার মাঝে তাকে খুঁজে বেড়াও। সত্যিটা কি জানো, আমি আয়াত। সারাজীবন আয়াত-ই থাকবো। রিজভী হতে চাই না, আর হতেও পারবো না”।

— “আসলে আপনি ভুল.

হাতের করতল দেখিয়ে থামিয়ে দিল তৃষ্ণাকে। ধীরে ধীরে পানির মাঝে হেঁটে পুলের কিনারে গিয়ে উঠে বসলো সে। পুলের দিকে মুখ করে পা দুলিয়ে বলল..

— “এখানে কোনো আসলে নকলে নেই, আর না তোমাকে ভুল বুঝছি তৃষ্ণা। বাড়ির ভেতরে যাও, ঠান্ডা লেগে যাবে”!

বাক্য উচ্চারণ করার সাহস হয়ে এলো না তৃষ্ণার ভেতরে। ওরনা দিয়ে শরীর পেঁচিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
তৃষ্ণার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসলো আয়াত। তৃষ্ণার প্রতি করা অভিমান-টাও সে বুঝলো না। এমন একজনকে ভালোবাসলো যাকে দেখার অধিকার নেই, ভালোবাসার অধিকার নেই, ছুঁয়ে দেখার অধিকার নেই। কারণ, সে অন্য আরেকজনের নেশায় নেশাক্ত। হয়তো এমনই হয়, নেশাক্ত শহর-গুলো।
টান টান হয়ে পুলের পাড়ে শুয়ে পড়লো সে। চোখ জোড়া সোজা মেঘলা আকাশের মাঝে বন্দী। বৃষ্টির ঝিরিঝিরি ধারা-গুলো ঠোঁটের সামান্য ফাঁক দিয়ে মুখে প্রবেশ করছে।
.
চোখ মেলতেই সূর্যের তীর্যক রশ্মিতে কুঁচকে এলো আয়াতের চোখ। মাথাটা কেমন ভাড়ভাড় হয়ে এসেছে। দুহাতে মাথা চেপে উঠে বসলো সে। প্রথমে পুল পাড়ে দেখে চমকালেও, পরক্ষণে কালকের কথা মাথায় আসতেই তব্ধ নিঃশ্বাস ছাড়ল। জামা কাপড় শরীরে শুকিয়ে আছে। শক্তিহীন শরীর নিয়ে এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে।
রুমে প্রবেশ করতেই সবার প্রথমে তৃষ্ণার ঘুমন্ত মুখটা ভেসে উঠলো। তৃষ্ণা ফ্লোরে বসে, সোফায় মাথা রেখে, দরজার দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে আছে। হয়তো আয়াতের অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে গেছে। কালো রঙের থ্রী পিস-টা বেশ মানিয়েছে তৃষ্ণার গাঁয়ে। চুলের পানি মোছার অভাবে একত্রে ধলা পাকিয়ে আছে। না চাইতেও এগিয়ে গেল আয়াত। নিজের দেওয়া কথা ভেঙ্গে তৃষ্ণাকে অতি সাবধানে কোলে তুলে নিল। বেডের মাঝ বরাবর শুইয়ে দিল। পায়ের কাছে গুটিয়ে রাখা ব্যাঙ্কেট খানা টেনে গলার পর্যন্ত থেকে দিল তৃষ্ণার। কাবার্ড থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মনিকা আর তৃষ্ণার কন্ঠস্বর ভেসে এলো আয়াতের কানে। দু’জনের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে চুল মুছতে লাগলো সে। আয়াতের ধ্যান ভাঙল মনিকার কথায়..

— “আজকে তুই ইউ-কে যাচ্ছিস। কথাটা ভুলে গেছিস? ভালোভাবে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখ নয়টা পঁচিশ বাজে। তোর ফ্লাইট বারোটা পঁয়তাল্লিশে। দুইবার তোকে খুঁজে গেছি, কোথায় ছিলিস তুই।”
খক খক করে কেশে উঠলো আয়াত। কালকের শোক দিবস পালন করতে গিয়ে সব ভুলে গেছে। আয়না থেকে চোখ সরিয়ে দেয়াল ঘড়িটার দিকে দিল। টাওয়াল টা ছুঁয়ে ট্রলিটা বের করলো। চেইন খুলে বেডের উপর তুললো। কাবার্ড থেকে গোছালো জামা কাপড় গুলো ধরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে। তার ফলস্বরূপ গোছালো কাপড়গুলো অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি জিনিস নিখুঁত ভাবে নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল..

— “মা খাবার সাজাও। আমি খেয়েই বেরিয়ে পড়লো। নাহলে ফ্লাইট মিস করবো”।

মনিকা শব্দহীন পায়ে দরজা পর্যন্ত গিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো। দুজনকে কিছুক্ষন সূক্ষ্মভাবে পরিক্ষা করে আঁচল চেপে মৃদু হাসলে। কিছু একটা ভেবে বললেন..

— “আয়াত তুই চাইলে আরো দিন পরে যেতে পারিস। সবে বউমার সাথে তোর ভাব হলো আর এখনই চলে যাবি। আমি বরং তোর বাবার সাথে কথা বলছি”?

অবিশ্বাসের মলিন কন্ঠে আয়াত বলল..

–” মা, বাবাকে কিছু বলো না। আমি যাবো”।

মনিকা যেতেই পূর্ণরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আয়াত। তৃষ্ণা যেন আকাশ থেকে পড়ল। আয়াত কোথায় যাচ্ছে, সেটাই বুজতে পারছে না। পেছন থেকে শক্ত করে আয়াতকে জড়িয়ে ধরে হতাশাগ্রস্থ কন্ঠে বলল…

— “আপনি আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবেন”?

তৃষ্ণার কথা তীরের মতো এসে লাগল আয়াতের বুকে। মেয়েটার মলিন কন্ঠে ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে তৃষ্ণার দুগালে হাত রেখে বলতে, “তৃষ্ণা আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না”
কিন্তু বলা হলো না আয়াতের। তাকে যেতেই হবে। তৃষ্ণার কন্ঠস্বর মাদকতার মতো কাজ করছে, না জানি মুখের ভঙ্গিমা দেখতে পাগল হয়ে যাবে আয়াত। তৃষ্ণার হাত স্পর্শ করতে গিয়েও করলো না, বলল.

— “অনেকবার চেয়েও বলতে পারিনি”।

আয়াতের উত্তর মোটেও পছন্দ হলো না তৃষ্ণার। আয়াত আগে একবার যাওয়ার কথা বলেছিলো, কিন্তু কবে যাবে সেটা বলেনি।
— “বলতে পারেন নি তাহলে আমাকে ছেড়ে থাকবেন কিভাবে। প্লীজ যাবেন না”।

পেছনে না ফিরেই বলল.
— “তৃষ্ণা আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না। আমার বুকের ভেতরে তোমাকে যত্ন করে নিয়ে যাচ্ছি”।

________________________
আকাশের পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলেছে। ছোট ছোট ছানাগুলো আগে আগে আর বড় বড় পাখিরা পিছু পিছু। তার থেকে অনেক উপর দিয়ে উড়ে চলেছে আয়াত। বাইরের প্রকৃতির পরিবেশ অনুভব করা না গেলেও অদ্ভুত এক অনুভূতির লুকিয়ে থাকে সবার মাঝে। আয়াতের মাঝে তেমন কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না। তার কাছে এমন অনুভূতি নতুন কিছু নয় বরং বেশ পুরোনো। আগেও অনেকবার সে বিমানে চড়ে এদেশ থেকে সে-দেশে পাড়ি জমিয়েছে। তার নিশ্চুপ মনটা তৃষ্ণার কাছে রেখে এসেছে। শুধু দেহটাই বয়ে নিয়ে চলেছে অন্য-দেশে।
তৃষ্ণার সাথে শেষবার কথা হয়েছে দুঘন্টা আগে। একবারের জন্যও মুখটা দেখেনি সে। নিজেকে আর দূর্বল প্রমাণ করে কি লাভ, যদি ছেড়েই যেতে হয়।
জানালার ফাঁক দিয়ে ছোট ছোট ঘরবাড়ি গুলো ম্যাচের মতো লাগে। যেন উপর থেকে এক দৃশ্য আঁকা হয়েছে। ইচ্ছে করছে, সেই দৃশ্যের ভেতরে তৃষ্ণাকে নিয়ে থাকতে। ফোনটা বের করে স্কিনে জুম করে তৃষ্ণার নক কামড়ানো পিকটা দেখলো। পিকটা বেশ পুরনো। তৃষ্ণার সাথে পরিচয় হওয়ার পর তুলেছিল, আর ডিলেট করা হয়নি।
ভাবতে লাগলো সেই দিনগুলো কথা, যখন তৃষ্ণার সাথে তার পরিচয়।

ফ্ল্যাসব্যাক_______

পুরো শহর খুঁজে রক্ত জোগাড় করতে ব্যর্থ হলো আয়াত। বোনের হাসৌজ্জ্বল মুখটা তখন বারবার আয়াতের সামনে এসে হাজির হতো। নিজেকে অক্ষম মনে করে প্রাণমন অস্তিত্বহীন ভারী দেহটা নিয়ে হসপিটালের ফিরে গেল সে। কেবিনের সামনে সিটে বসতেই, ভেতর থেকে পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো। যেন এই কন্ঠস্বর শোনার অপেক্ষায় রয়েছিল সে। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই বোনের মুখটা দেখে শব্দ করে কেঁদে দিল আয়াত। আয়াতের কান্নার শব্দে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলো সকলে। আরোহী স্যালাইন ক্যানেল একটানে খুলে আয়াতের দিকে ছুটে গেল। দুই ভাই বোনের কষ্টের সাথে কম্পিত হয়েছিল পুরো হসপিটাল।

বোনের অসুস্থতার জন্য রক্তের জোগাড়ের কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তার। দুদিন পর যখন জানতে পারল তৃষ্ণা নামক কোনো মেয়ে রক্ত দিয়েছিলো। তড়িঘড়ি করে হসপিটালের ছুটল মেয়েটার নাম, পরিচয় যোগার করতে। ছোট করে একটা ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য। মেয়েটার নাম পরিচয় জানতে ব্যর্থ হলো সে। বেশ কয়েকদিন পর একজন নার্সের কাছ থেকে জানতে পারল, মেয়েটি তাহসানের ছোট বোন।
সময় নষ্ট না করে ভার্সিটিতে গেল দেখা করতে। রাস্তায় ফ্লোয়ার সপ থেকে বড় সাইজের একটা বু-ফে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে ঘটালো অঘটন।

(চলবে)

#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১২

আয়াত তৃষ্ণা ভার্সিটির সামনে রাস্তার উপর পড়ে আছে। আশে পাশে সবাই কটু চোখে দুজনার দিকে তাকাচ্ছে। ধুলি কণা ঝেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো তৃষ্ণা। হুট করে আয়াতের বাইকের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছিল। রাস্তার মাঝে এমন পরিস্থিতিতে পরাতে বিরক্তকর হয়ে উঠেছিল তৃষ্ণা। তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল.

— “হ্যালো মি. চোখের মাথা খেয়েছেন না-কি। আমার মতো একটা মেয়েকে আপনার চোখে পড়লো না”।

তৃষ্ণার দিকে মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আয়াত। প্রথমবার কোনো মেয়েকে এতোটা মোহনীয় লেগেছে তার কাছে। চোখ মুখে বিরক্তিকর ভাবটা যেন সৌন্দর্য কয়েকশত বাড়িয়ে তুলেছে। হঠাৎ কেউ তৃষ্ণা বলে ডাক দেওয়াতে ততক্ষণাৎ খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছিলো। তার ফলস্বরূপ বাইকের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে।
তৃষ্ণার কথা মোটেও পছন্দ হয়নি আয়াতের। মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল..

— “আসলে বাইকের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছি”।

” যখন পারে-ই না। তাহলে চালাতে যায় কেন? অসহ্য” আয়াতের এমন উত্তর পছন্দ হলো না তৃষ্ণার! মাটি থেকে বই খাতা গুলো সাবধানে তুলে নিল। ভালোভাবে ঝেড়ে ভার্সিটির ভেতরে ঢুকে গেল।
সদর দরজা দিয়ে ভেতরে যেতেই হুশ ফিরল আয়াতের। নিজেকে হাজারটা কথা শুনিয়ে মাটি থেকে বু-ফে তুলে নিলো। প্রচন্ড জোরে দৌড়ে তৃষ্ণার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তৃষ্ণা পাশ কেটে যাওয়ার চেষ্টা করলে সেখানে এসে দাঁড়ালো আয়াত। যাতে চরম রেগে গেল তৃষ্ণা। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল.

— “কি সমস্যা কি আপনার হ্যা। বুঝলাম বাইকের কন্ট্রোল হারিয়েছে বলে, আমাকে এক্সিডেন্ট করতে বসেছিলেন। তো এখন কি.”

আয়াত যেন স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কেন ভার্সিটিতে এসেছে, সেই ভাবনা ভুলে চারপাশে তৃষ্ণা নামক মেয়েটিকে আবিষ্কার করছে। নিজের অজান্তেই হাতটা এগিয়ে তৃষ্ণার দিকে বাড়িয়ে দিল। তৃষ্ণা যেন অবাকের শেষ সিমানায় পৌঁছে গেল। তুরি বাজিয়ে অস্বাভাবিক কন্ঠে বলল..

— “আর ইউ ক্রেজি। ইউ হ্যাভ ওন আইডিয়া, ওয়াট আর ইউ ডুয়িং। একটা মেয়েকে দেখলেন আর ফুল দিয়ে দিলেন। সেইম.”

ইগোতে লাগলো আয়াতের। হাত থেকে ফুলটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। পকেট থেকে চেক বই বের করলো। হাঁটুর উপর রেখে সিগনেচার করে তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দিলো। অন্যদিকে মুখ করে বলল..
— “এই নিল আপনার দাম”।

চমকে উঠলো তৃষ্ণা। অজান্তেই হাতটা আয়াতের গালে চলে গেল। আঙুল তুলে বলল

— “আপনাকে ভালো মনে করেছিলাম। সাহস হয় কিভাবে আমার দাম দেওয়ার”।

তৃষ্ণার প্রতি যতটুকু রাগ হয়েছিল মুহুর্তের মিলিয়ে গেল। নিজেই নিজের কাজে হতবাক। মাথা নিচু করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মৃদু হেসে বলল.
— “মিস তৃষ্ণা। আপনি আমাকে ভুল ভাবছে? আমি আপনার দাম দেইনি। আমি রক্তের দাম দিয়েছি”।

— “কিসের রক্ত”

লম্বা শ্বাস নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল..
— “আমি আয়াত। মনে করে দেখুন, কিছুদিন পূর্বে একজন মেয়েকে আপনি ব্লাড ডোনেট করেছিলেন। আমি তার ভাই”।

ঘনঘন পলক ফেলে অপরাধী কন্ঠে বলল..

— “সরি। আমি অন্যকিছু মনে করেছিলাম। তাছাড়া আমার টাকা পয়সা কম নেই। আপনাদের ভাই বোনের অফুরন্ত ভালোবাসা দেখে এইটুকু আমার উপহার ছিলো। আজ আমি দিয়েছি, কাল হয়তো আপনি দিবেন। তখন কি টাকা নিতেন। যদি টাকা দিয়েই সব পাওয়া যেত, তাহলে রক্ত কেন পেলেন না।
আমার ক্লাস আছে। আজ আসছি”।

আয়াতের উত্তরে অপেক্ষা না করে চলে গেল তৃষ্ণা। চোখের আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত সেদিকে তাকিয়ে রইল। শুধু তার মহত্ত্ব কিংবা সৌন্দর্যের প্রেমেই আয়াত পড়ে নি। তৃষ্ণার মধুর ব্যবহারই তাকে প্রধান আকৃষ্ট করেছিল।

সময় যতোই অতিবাহিত হচ্ছিল তৃষ্ণার প্রতি আয়াত দূর্বলতা ততই বেড়ে চলেছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে তৃষ্ণাকে ভার্সিটিতে দেখতে যাওয়া, অসংখ্য ছবিতে গ্যালারী ভর্তি করা রাখা। প্রতিটি দিন তৃষ্ণাকে ছাড়া দম বন্ধ হয়ে আসতো তার। সময় পেলেই তৃষ্ণার দেখা পেতে ছুটত সে।
একদিন আয়াত সাহস সঞ্চয় করে তৃষ্ণাকে প্রপোজ করেছিল। ততক্ষনে সবটা ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছিল। তৃষ্ণা তখন রিজভী নামক নেশায় নেশাক্ত হয়ে পড়েছিল। তৃষ্ণা সুন্দর ভাবে বুঝিয়েছিল তাকে। তারপর প্রতিটি মুহূর্তে তৃষ্ণাকে ভোলার অদম্য চেষ্টা করেছে আয়াত। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। তৃষ্ণা শারীরিক ভাবে উপস্থিত না থাকলেও মানসিক ভাবে উপস্থিত থাকত।
প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল সে। ছোট ছোট দুটো খরগোশ কিনে নাম রেখেছিল আয়াত, তৃষ্ণা।‌ অর্থাৎ তৃষ্ণার্থ আয়াত। কে জানতো, তৃষ্ণা ফিরে আসবে। মানসিক ভাবে নয় শারীরিক ভাবে। তাকে ছোঁয়া যাবে, কথা বলা, ব্যক্তিগত ভাবে শুধু তার।

হঠাৎ মায়ের মুখ থেকে বিয়ের কথা শুনে ভেঙ্গে পড়েছিলো আয়াত। অস্থিরতায় একবারও মেয়ের মুখ দেখেনি সে। বাসর ঘরে যখন তৃষ্ণাকে বউ বেসে দেখেছিল। জীবনটা তখন হঠাৎ করেই রঙিন প্রজাপতি মতো রঙিন হয়ে গেল।

এখনো মনের মাঝে তৃষ্ণাকে পাওয়ার হাজারো আকুতি। হঠাৎ হঠাৎ তৃষ্ণার যত্নগুলো যতোটা সুখের হয়, আঘাত গুলো তারচেয়ে বেশি যন্ত্রনাদায়ক হয়।

বর্তমানে__

— “স্যার, ইউ ক্যান হেয়ার। কিপ ইউর ফোন। আওয়ার প্লেন উইল ল্যান্ড এট দা এয়ারপোট সর্টলি। ফাস্টেন দা বেল্ট স্যার।” ( ফোনটা হাতে নিয়ে আয়াতকে ডাকতে ডাকতে বিমানকর্মী)

আধো আধো চোখ খুলে তাকালো আয়াত। তখনও এয়ার-হোস্টেজ ফোন এগিয়ে দিয়ে আয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণার কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। জানা নেই। হয়তো নিষুপ্তি উগ্ৰে হাত ফসকে ফোন পড়ে গেছে। মলিন হেসে ধন্যবাদ দিয়ে ফোনটা নিয়ে নিল আয়াত। চারপাশের লোকজন তখন সিট বেল্ট লাগিয়ে নিয়েছে। সময় অবিলম্ব না করে নিজেও সিটি বেল্ট লাগিয়ে নিল।

______________________

_____তুমি এমনই আমার এক অসুখ
আমি চাইনা সেড়ে উঠতে
যত ভালোলাগা তোমাকে ঘিরে
তুমি মিশে আছো, যেন আমাতেই 💓

বেলকেনিতে বসে খরগোশের ছানাটাকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে তৃষ্ণা। যেন তার ছোট একটা পুচটি। স্যাম্পু শেষ করে পানি ঢেলে পরিস্কার করে নিল সে। কাবার্ড থেকে হেয়ার ড্রায়ার বের করে খরগোশের অঙ্গরুহ শুকিয়ে নিল। ললিপপের খোসা ছাড়িয়ে খরগোশের মুখে পুড়ে দিল। ঝুড়িতে রেখে রুমে প্রবেশ করলো।

আয়াতের অনুপস্থিততে দিনগুলো অতিবাহিত করতে অবুঝ প্রানীদের সাথে কাটিয়েছে। আয়াত সত্যি বলেছিল, মানুষ ধোঁকা দিলেও, তারা দেয় না।

বিগত মাসগুলোতে আয়াতকে প্রচন্ড মিস করেছে সে। আয়াতের অনুপস্থিতিতে অনুভূতি গুলো ডাইরির পাতায় বন্ধ করে রেখেছে। হয়তো মুহূর্তগুলো ব্যাখা দিতে পারে নি, কিন্তু আয়াতকে ঘিরে স্বপ্ন গুলোর রুপ দান করতে পেরেছে। বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে আয়াতকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছে।

বড় করে বাঁধাই করা ছবিটার দিকে এগিয়ে গেল তৃষ্ণা। দুহাতে ছবিটায় হাত বুলিয়ে আয়াতে বুকে মাথা রেখে তৃপ্তিকর নিঃশ্বাস ছাড়ল। নয়নজোড়া অম্বুতে পূর্ণ হয়ে গেল তার। কতোদিন আয়াতকে দেখা হয় না তার। সারাদিনের ব্যস্ততার মাঝে গভীর রাতে ২-৩ মিনিট আয়াতের সাথে করা হয় তার। অনুরাগী কন্ঠে বলল..

— “আয়াত। এই আয়াত। কেন আমার কাছে আসো না তুমি। তোমাকে কতোটা মিস করি ভাবতে পারবে না। আমিও যে তৃষ্ণার্থ আয়াতে পাগল হয়ে গেছি। তোর শহর এতো নেশাক্ত কেন? প্রচন্ড “”নেশাক্ত তোর শহর””।

রিংটোনের আওয়াজে ছলছল চোখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো তৃষ্ণার। আয়াত ফোন করছে ভেবে দ্রুত ফোনের কাছে এগিয়ে গেল তৃষ্ণা। স্কিনে চোখ যেতেই রুদ্ধ হলো তৃষ্ণা। সিম কার্ডের অফিস থেকে ফোন এসেছে। ইচ্ছে করছে, কয়েকটা বাজে কথা শুনিয়ে দিতে। দিনের ভেতরে দুই থেকে তিনবার ফোন না দিলে এদের চলে না। এরা কি বোঝে না, তৃষ্ণার কষ্টটা না-কি তাকে জ্বালাতে এমন করে। ফোনটা রিসিভ করে মিনিট খানেক নিজের রাগ ঝেড়ে নিল তৃষ্ণা 😂। দুজন পাগল দুদিকে বকবকানি করছে। তৃষ্ণা রাগ ঝেড়ে ফোন কেটে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে। অতঃপর আয়াতের নাম্বারে ডায়াল করলো। একবার আয়াত রিসিভ করুক, তাহলে আয়াতের একদিন, তৃষ্ণার যে-কদিন লাগে। কিন্তু তৃষ্ণাকে নিরাশ করে আয়াত ফোন রিসিভ করলো। একরাশ অভিমানে মন ভেঙ্গে গেল তৃষ্ণার।

কাবার্ড খুলে মেরুন রঙের আয়াতের শার্ট বের করে নিল। পাশের তাকে চোখ পড়তেই একটা প্যাকেট নজরে এলো। এতো গুলো দিন ভালোভাবে খেয়াল করা হয়নি। কৌতূহল নিয়ে প্যাকেট-টা বের করে খুলে দেখলো সে। কালো রঙের সিল্কের শাড়ি। যে কারো মন কেড়ে নিতে পারবে। প্যাকেটের ভেতরে ছোট একটা রিসিট চোখে পড়লো তৃষ্ণার। বছর আগে শাড়িটা কেনা হয়েছে। বুকের মাঝে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে তার। তাহলে কি সেদিনের পর আয়াত অন্য একজনের..
আর ভাবতে পারছে না তৃষ্ণা। মুখ ভেংচি কেটে শাড়িটা খুলে পড়তে ব্যস্ত হয়ে গেল। যার হয় হোক, এখন আয়াতের সব জিনিসের উপর একমাত্র তৃষ্ণার অধিকার।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here