নেশাক্ত_তোর_শহর পর্ব::০৩,০৪

নেশাক্ত_তোর_শহর
পর্ব::০৩,০৪
ইফা_আমহৃদ
পর্ব::০৩

বিয়ের প্রথম সকালেই সময় নিয়ে শাওয়ার নিচ্ছে তৃষ্ণা। কালকে রাতে তেমন কিছুই হলো না ,অথচ..! যদি কিছু হতো, তাহলে হয়তো আজ ওয়াশরুম থেকে বের হতো না।
লেটুস পাতা আর গাজর নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো আয়াত । ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে তৃষ্ণার অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে নিল । দরজা ভেতর থেকে বন্ধ অর্থাৎ এখনো ওয়াশরুমের ভেতরে । দৃষ্টি সরিয়ে বেডের উপর দিল। খরগোশ টা তৃষ্ণার আঁচল জুড়ে ঘুমিয়ে আছে । বড্ড হিংসা হচ্ছে আয়াতের । যার বিয়ে করা বউ সে এখনো ছুঁয়েও দেখলো না আর খরগোশটা বিনা বাঁধায় শাড়িটা নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছে ।
লেটুসপাতা আর গাজর গুলো একহাতে নিয়ে, অন্যহাতে খরগোশ টাকে তুলে বেলকেনিতে নিয়ে গেল।

দরজা খুলে বেরিয়ে এলো তৃষ্ণা ।ভেজা চুলে তোয়ালে না পেঁচিয়ে, কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। চারদিকে আয়াতের উপস্থিতি অনুভব না করে বেলকেনিতে পা বাড়ালো । বেলকেনির মনোরম দৃশ্য দেখে ওষ্ঠ যুগল একে অপরের থেকে সামান্য ফাঁক হয়ে গেছে । বেড রুমের থেকে শতগুণ সুন্দর তার এই ছোট বেলকেনিটা।গ্ৰিলহীনতা বেলকেনির সৌন্দর্য কয়েকশত গুন বাড়িয়ে তুলেছে । একপাশে তাকের উপর কৃত্রিম গাছ-পালা দিয়ে ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে তৈরি করা । কৃত্রিমের মাঝে কিছু কিছু সত্যিকারের গাছ রয়েছে । মাটি রাঙা মাঝখানে লম্বা হাতলযুক্ত ঝুড়ি। যেখানে ছোট ছোট তিনটে খরগোশ থাকে । উপরে গাঢ় সবুজ রঙের পাতলা কাপড় । তার পাশেই ওয়াটার ফলস রাখা । ফলসের মধ্যে ছোট ছোট লাল, হলুদ রঙের মাছ ও পাথর রয়েছে। উপরে অনেক শেওলা জমে আছে। বাংলায় যাকে বলে জলপ্রপাত কিংবা পানি চক্র। তাকের নিচে গাঢ় সবুজ নকশি পর্দা দিয়ে ঢাকা। বেলকেনির পুরোটা জুড়ে কৃত্রিম আর প্রাকৃতিক গাছ । মাঝে ফুঁলের গাছগুলো লক্ষ্য করে যাচ্ছে। যেখানে থোকায় থোকায় ফুল ফুটে আছে । অন্যপাশে একটা ঝুলন্ত দোলনা । দোলনার আশেপাশে অর্ধগলা ক্যান্ডলগুলো নিভে আছে । বেলকেনির দেয়ালে প্রাকৃতিক দৃশ্য আর্ট করা ।পায়ের নিচে মাটি রাঙা ফ্লোর। তৃষ্ণা একটু ঝুঁকে হাত দিয়ে মেঝে স্পর্শ করলো। কিন্তু না ,, এটা মাটি না ইট সিমেন্টের তৈরি ফ্লোর । চোখের দৃষ্টি বাইরে যেতেই আরো চমকে উঠল তৃষ্ণা । সামান্য কিছু দূরত্বে পাখিরা উড়ছে আর কিচিরমিচির ডাকছে । এই বেলকেনিটা তৃষ্ণার কাছে শুধু বেলকেনি নয় ,, একটা জঙ্গল।
ভাবনার মাঝেই একটা লেটুসপাতা তুলে তৃষ্ণার হাতের মুঠোয় বন্দী করে দিল । চোখের সামনে তুরি বাজিয়ে বললো..

— “এভাবে হাঁ না করে থেকে ওদের খাইয়ে দাও” ।

কাঁপা কাঁপা হাতে তৃষ্ণা গাজরটা খরগোশের দিকে এগিয়ে দিলো । খরগোশটা এগিয়ে দাঁত দিয়ে কুটকুট শব্দ করে গাজর খাচ্ছে । তৃষ্ণা আয়াতের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় বলল..

— “এগুলো সব কি আপনি পোষেন” ??

আয়াত তৃষ্ণার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দুহাত গ্ৰিলে রাখল । রেলিং এ সর্বশক্তি ভর করে তৃষ্ণার দিকে ফিরে বসলো। চোখজোড়া বন্ধ করে ধরা গলায় বলল..

— “জানো তৃষ্ণা ,, মানুষ মানুষকে ছেড়ে গেলেও অবুঝ পশুপাখি কখনো ছেড়ে যায় না। যখন আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে রিজেক্ট করেছিল ,, আমি পাগল গিয়েছিলাম। তবে সে আমাকে ঠকায় নি ।সে অন্য একজনকে ভালোবাসে , আমাকে ভালোভাবেই সেটা বুজিয়েছে । নিঃস্ব লাগছিল নিজেকে । তাকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়েছি ।যদি আমার ভাগ্যে সে থাকে তাহলে আমি ঠিক তাকে পাবো । তখন প্রকৃতিকে আপন করে নিয়েছি ।মন ভালো রাখতে এই প্রিয় বেলকেনিটাকে নিজের পছন্দমত সাজিয়েছে ।
এই খরগোশ দুটির মাঝে আমি,, আমাকে আর সেই প্রিয় মানুষটিকে খুঁজে পাই । আর পাখিরা রাতে এখানে থাকে । সারাদিন এদের দেখা পাওয়া যায় না ।
পূর্ণিমার রাতে এই বেলকেনিটাকে আমার কাছে রুপকথার গল্পের মতো মনে হয় “।

তৃষ্ণা গাজরটা খরগোশকে খাইয়ে, ছানাটাকে সাবধানে দুহাতে তুলে নিলো । আলতোভাবে খরগোশের কপালে অধর ছুঁইয়ে দিল । অঙ্গরুহ তে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল…

–” জানেন আমারও এক জোড়া খরগোশ ছিল । ভাইয়া এনে দিয়েছিল” ।

— “এখন নেই” । (বুকে হাত গুজে আয়াত)

মলিন হাসলো তৃষ্ণা । রিজভী খরগোশটাকে কি করছে জানা নেই তার। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল..

— “তাও এক বিশাল কাহিনী । অন্য একদিন বললো”।

— “ভাবী কোথায় তুমি? প্রতিবেশী আন্টিরা তোমাকে দেখতে এসেছে” ।(রুমে প্রবেশ করে দু’জনকে খুঁজে না পেয়ে আরোহী)

আরোহীর কথায় ধ্যান ভাঙলো তৃষ্ণা- আয়াতের । হাতের বাজে বন্দী রাখা খরগোশের ছানাটাকে আয়াতের হাতে দিয়ে আরোহীর ডাকে সাড়া দিল ।

— “আরোহী আমরা এখানে । দাঁড়াও আসছি”!

গোটানো শাড়ির কুচিগুলো ধরে আরোহীর সামনে এগিয়ে গেল । তৃষ্ণার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে খরগোশের মাথায় দিকে গভীর ভাবে তাকালো আয়াত। খরগোশটাকে হিংসে হচ্ছে প্রচুর । নিজের বিয়ে করা বউকে এখনো ছুঁতে পারলো না এদিকে তৃষ্ণা আয়াতকে ছেড়ে খরগোশকে চুমু খেয়েছে ।দুহাতে খরগোশটাকে উপরে তুলে নিলো । তৃষ্ণার ঠোঁট ছুঁয়ে দেওয়া জায়গাটায় গভীর ভাবে নিজের ঠোঁট ছুয়ালো । পারলে যেন স্থানগুলো খেয়ে ফেলতো ।
আড়চোখে বেলকেনিতের দিকে তাকিয়ে ভাইয়ের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নিল । দুজনে একসাথে বেলকেনিতে দেখে তৃপ্তিকর শ্বাস ছাড়লো । কিছু একটা ভেবে বলল…

— “ভাবী। নিচে আমাদের প্রতিবেশী আন্টিরা এসেছে তোমাকে দেখতে ।হুট করে বিয়েতে আসতে পারেনি তো তাই”।

তব্ধ নিঃশ্বাস ছাড়ল তৃষ্ণা । প্রতিবেশী আন্টিদের সাথে তেমন কোনো পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তাদের । কেমন স্বভাবের তাও তার অজানা । ঠোঁট কামড়ে ফোস ফাস করে মলিন কন্ঠে বলল…

— “তুমি যাও আরোহী। আমি আসছি”!!

রহস্যময়ী হাসি দিয়ে দ্রুত রুম প্রস্থান করলো সে । যেন বেরিয়ে গেলেই বেঁচে যাবে। পুরোটা সময় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল ।
বোধশক্তি হারিয়ে আরোহীর পেছনে পেছনে বেরুতে নিল তৃষ্ণা । বের হওয়ার আগেই থামিয়ে দিলো আয়াত । বাহুতে হাত রেখে টেনে বেডে বসিয়ে দিল । কাঁধে ঝুলন্ত তোয়ালে টা দিয়ে মাথার চুল গুলো স্বযত্নে মুছিয়ে দিল । কাবার্ডে গুছিয়ে রাখা হেয়ার ড্রায়ার বের করে নিল । তৃষ্ণার পাশে বসে প্রতিটা চুলগুলো সূক্ষ্মভাবে ড্রায়ার করে করে দিল ।
গা গুলিয়ে উঠলো তৃষ্ণার । কখনো কোনো ছেলের সংস্পর্শে যায়নি সে । ছাড়িয়ে নিতে চাইলে আরো দৃঢ় বান্ধনে আবদ্ধ করে নিল আয়াত । চুলের বাজে হাত রেখে তীক্ষ্ম কন্ঠে বলল..

— “খরগোশের ব্যবহার করা হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে সুন্দর ভাবে চুল গুলো শুকিয়ে দিচ্ছি । যদি আরেকবার মোছড়া – মুচড়ি করো, তাহলে খরগোশের মতো হাতে নিয়ে জানলার ফাঁক দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিবো ।মাইন্ড ইট” !

দমে গেল তৃষ্ণা । চোখের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো শ্রাবণপথের পেছনে গুঁজে দিয়ে শান্তভাবে বসে রইল সে ।

পূর্ণরায় হেয়ার ড্রায়ার কাবার্ডে গুছিয়ে রাখল । প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় একপা দিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো । মোহনীয় চোখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে ঘোরলাগা কন্ঠে বলল…

— “বাইরে যাও আর যেখানে যাও। যাওয়ার আগে শাড়িটা পাল্টে যাও ।
তোমাকে এই অবস্থায় শুধু আমি দেখবো ।অন্যকেউ যাতে না দেখে”।

দরজা বন্ধ করার শব্দে হুঁশ ফিরল তৃষ্ণার । আয়াতের কথাগুলো মাথায় আসতেই নিজের দিকে তাকালো । লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলো সে। ইতিমধ্যে গালের খানিকটা অংশ রক্তিম আকার ধারণ করেছে । চুলের পানিতে পেছনের অংশ ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে ।

_________________________
— “মা ! ঘোমটা সরিয়ে একটু চুলগুলো দেখাও তো”?

বিরক্তির উপর চরম বিরক্তি হলো তৃষ্ণা । প্রতিবেশীদের এর জন্য তার ভালো লাগে না ।এই নিয়ে আঠারো না উনিশ বার বলেছে, ” মা একটু হেঁটে দেখাও? , হাতের রেখা দেখাও? , এতো চিকন কেন”? এটা ওটা বলতে বলতে তৃষ্ণার মধ্যে এমনিতেই বিরক্তিকর ভাব চলে এসেছে ।
মাথার ঘোমটা ফেলে খোঁপা করা শুষ্ক চুলগুলো ছেড়ে দিল । কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তৃষ্ণাকে দেখে থামলেন তারা । তৃষ্ণার এমন বিরক্তিকর ভাবটা প্রকট হলো আয়াতের মা মনিকার কাছে । চায়ের ট্রে টা টি টেবিলের উপর রেখে তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললেন..

— “তুমি এবার যাও! গিয়ে দেখ আয়াতকে কি প্রয়োজন হয়” ।

মনিকার মুখে রহস্যময়ী হাসি দেখে চাপা হাসলো তৃষ্ণা। সবাইকে সালাম দিয়ে রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো । দু-সিড়ি অতিক্রম করে থেমে গেল সে । নিচের দিকে তাকাতেই কপালের কোণে তিনটি উদ্বিগ্ন ভাজ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। উপর থেকে শাড়ির কুচিগুলো খুলে এসেছে । তট জলদি বাড়ির কুচিগুলো ঠিক করতে নিলে , কুঁচিগোছা ছুটে পায়ের কাছে পড়ে গেল । চোখ মুখে বিরক্তিকর ভাব নিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো সে । সবাই তার দিকে বিষন্ন চোখে তাকিয়ে আছে । কয়েকজনে ইতিমধ্যে বলেও ফেলেছে ..

— “মনি! এ-কেমন বউ এনেছিস ।শাড়িটাও ঠিকভাবে পড়তে পারে না”।

— “আমি হলে এমন মেয়েকে ছেলের বউ তো করতামই না । যদি হয়ে যেত পিটিসে সোজা করে দিতাম । বাবা মা আদরে আদরে বাঁদর তৈরি করেছে ।
যে মেয়ে নিজেকে সামলে উঠতে পারেনা। সে মেয়ে তোর ছেলেকে কি করে সামলাবে ।দেখিস হিতে বিপরীত হয়ে না যায় ।এখনো সময় আছে বউকে শাসনে জব্দ করে নে ..

ঠাস ঠাস শব্দে করে নিচে এলো আয়াত । প্রতিবেশী আর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে। মেয়েটার চোখজোড়া ছলছল করছে । এই বুঝি আটকে রাখা অশ্রু গুলো কান্না রুপে বাইরে বেরিয়ে এলো। হাঁটু কাছের ট্রাউজার টা সামান্য গুটিয়ে নিল । হাঁটু ভাঁজ করে তৃষ্ণার কাছে বসে পড়লো। পায়ের কাছ থেকে অগোছালো কুচিগুলো গুছিয়ে পূর্ণরায় তৃষ্ণার হাতে ধরিয়ে দিলো।

(চলবে)

#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::০৪

অজানা মানুষের স্পর্শে শরীরের শিরায় শিরা গভীর ঝাঁকুনি অনুভব করলো তৃষ্ণা। ইতিমধ্যে প্রতিবেশীদের কথায়, কষ্ট অনুভব করে শরীরটা অনেকটাই কেঁপে উঠেছে । সেই অস্বাভাবিক কম্পনের সাথে আয়াতের দেওয়া স্পর্শে কম্পিত হলো সে । কাঁপা কাঁপা হাতে আয়াতের এগিয়ে দেওয়া কুঁচি গুলো নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে নিল । কোনো দিকে না তাকিয়ে কোনো উপায়ে কোমরে গুঁজে পূর্ণরায় উপরে আসার জন্য পা বাড়ালো।
হাত ধরে থামিয়ে দিল আয়াত । কিছুক্ষণ সময় নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল..

— “আজকের পর থেকে সাবধানে এবং সামলে শাড়ি পড়বে । যদি সমস্যা হয়, বেল্ট ইউস করবে । আর যদি অতিরিক্ত সমস্যা হয়, তাহলে শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু পড়বে । ভুলেও যাতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে ।এবার যাও..

মাথা নিচু করে আয়াতের কথায় সায় দিলো তৃষ্ণা। ধরে রাখা হাত ছাড়িয়ে নিল। নত ভঙ্গিতে বড় বড় পা ফেলে উপরে চলে গেল। তৃষ্ণাকে রুমের ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে তৃক্ষ্ম চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বলল…

— “কি জানো বলেছিলেন একটু আগে !! ও হে মনে পড়েছে .
কোন মেয়ে বিয়ের আগে শাড়ি পড়ে বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি করে, একটু বলবেন ? আচ্ছা আপনি কি বিয়ের আগে শাড়ি পড়তেন? আচ্ছা বাদ দিন । তৃষ্ণার মতো মেয়েকে আপনার ছেলের সাথে বিয়ে দিতেন না । সত্যি টা কি জানেন আন্টি, আপনার মতো শাশুড়িরা তৃষ্ণার মতো মেয়েকে ডিজার্ভ করে না । বাবা মায়ের আদরে কোনো সন্তান বাঁদর হয়না ।
যে মেয়ে নিজেকে সামলাতে পারে না , সে কিভাবে আমাকে সামলাবে ।আমার মা যাতে আমার ওয়াইফকে মেরে জব্দ করে ফেলে । আন্টি আমার ওয়াইফ কোনো অলংকার নয় যে তাকে জব্দ করে নিতে হবে ।তাকে মারবো নাকি আদর করবো সেটা ব্যক্তিগত আমার এবং একান্ত ” আয়াত রিদুয়ান” এর ব্যাপার ।বাইরের কারো ইন্টা-ফেয়ার আমি এলাও করবো না ।মাইন্ড ইট”।

একদমে কথাগুলো বলে থামলো আয়াত। রাগে ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে নিজেকে সংযত করছে ।

— “তৃষ্ণার খাবারটা রুমে দিয়ে যাস”।

কথাটা বলে লেবু নামক কাজের মেয়েটাকে ইশারা করলো আয়াত। লেবুর সম্মতি পেলে মিনিট খানেক সময় নিল না আয়াত। হনহন করে নিজের রুমে চলে গেল ।আয়াত যেতেই উঠে দাঁড়ালো তারা । প্রচ্ছন্ন কন্ঠে বললেন..

— “সাদর আমন্ত্রণে বাড়িতে ডেকে এভাবে অপমান না করলেও পারতি মনু “।

হাতের উল্টো পিঠ দেখিয়ে থামিয়ে দিল মনিকা। স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন..

— “আমি তোদের অপমান করতে ডাকি নি, আমার পুত্রবধূকে দোয়া করতে ডেকেছিলাম । কিন্তু তোরা কি করলি, উল্টো আমাদের আনন্দময় পরিবেশটাকে নষ্ট করে দিলি।
আমাকে শাসনের জ্ঞান দিয়েছিলি না। তাহলে তোর বউমা তোর ছেলে ,কেন তোর সাথে থাকে না ? তাকে অন্তত একটু শাসন করার দরকার ছিলো । এবার আসতে পারিস” ।

________________________
বালিশে মুখ গুজে কুপিয়ে কুপিয়ে কেঁদে চলেছে তৃষ্ণা। এতো গুলো বাজে কথা শুনিয়েছে তাকে , সবটা মুখ বুঁজে সহ্য করে নিত সে । কেন তার মৃত বাবা মাকে নিয়ে সামান্য একটা ব্যাপারে কটু কথা শুনি দিল । যা সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই।
দরজায় হেলান দিয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে আছে আয়াত । যে মেয়েটার থেকে বিন্দু পরিমাণ দূরে অবস্থান করলে নিজেকে পাগলের নিম্ন মানুষ হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করে ।সেই প্রিয় মানুষটিকে এভাবে কাঁদতে দেখে ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে যাচ্ছে সে। ভেতরে প্রবেশ করে রুমের এক কোণ থেকে অন্য কোণে পায়চারী করে কাঠ কাঠ গলায় বলল..

— “আয়াত রিদুয়ানের ওয়াইফ হবে কঠিন মনের। সামান্য একটু কথায় বাচ্চাদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদা, ডোন্ট লাইট মি “।

মাথা তুলে তাকালো তৃষ্ণা। দুটো রক্তবর্ণ চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন চোখের আগুনে ঝলসে ফেলবে তাকে। ক্ষনে ক্ষনে কপালের রগ দুটো তীব্র ভাবে আতঙ্কতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আয়াতের অবস্থা যাচাই- বাছাই করে পূর্বের ন্যায় বালিশে মুখ গুজে নিল। টান টান হয়ে নিজের সকল শক্তিটুকু বেডের উপর ছেড়ে দিল।
তৃষ্ণার পায়ের দিকে অবলোকন করে এগিয়ে গেল সে। পায়ের ব্যান্ডজটা রক্তে লাল হয়ে গেছে। নিজের উপর উষ্মা হলো সে। মেয়েটা পায়ের ব্যাথায় ব্যাথিত হচ্ছে আর সে হাজারটা রুদ্র বচন শুনিয়ে দিল ।
মোটা ব্যান্ডেজ করা পায়ে কিছুক্ষণ মশৃণভাবে হাত ছুঁয়ে দিল । অতঃপর ধীরে ধীরে রঞ্জিত ব্যান্ডজগুলো সময় নিয়ে অতি সাবধানে খুলে ফেলল ।
ব্যান্ডেজের শেষ প্রান্তটা ধরে টান দিতেই ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো তৃষ্ণা । দৃঢ় বান্ধনে আবদ্ধ করে নিল বেডশিট। মনে হলো কেউ পায়ের ব্যাথার্থ স্থানটা ছিঁড়ে নিয়ে গেল। চিৎকার দিতে গিয়েও দিল না। কথায় কথায় গায়ে হাত দেওয়া পছন্দ নয় তার।
আয়াত শোণিত ব্যান্ডেজ দিয়ে ধীরে ধীরে তৃষ্ণার পায়ে জমাট বাঁধা রক্ত গুলো মুছে দিল। পূর্বের মতো ব্যান্ডেজ করল না। তৃষ্ণার দুইবাহুতে হাত রাখল , অতঃপর তৃষ্ণার হাত নিজের কাঁধে রেখে ধীরগতি ভাবে শোয়া থেকে উঠে বসালো। অপরাধী কন্ঠে বলল..

— “আই এম সরি তৃষ্ণা। আমি বুঝতে পারিনি ।বুঝলে কখনো ওভাবে বলতাম না। তোমার যত সমস্যা হবে আমাকে বলবে। আমি কি বাইরের লোক না-কি, তোমার হাসবেন্ড তো “!

আয়াতের শান্ত কন্ঠে ভেতরে ভেতরে এক প্রকার ঝড় বয়ে গেল তৃষ্ণার। একটু আগে যে ছেলে চোখ গরম করে তাকে শাসিয়ে ছিল এখন সেই ছেলে অপরাধী কন্ঠে ক্ষমা চাইছে। আয়াতের এমন ভঙ্গিমা রিজভীর সাথে অনেকটা মিল আছে। নিজেকে নতুনভাবে কারো মায়ায় ঝরাতে ভয় হচ্ছে তার। কিন্তু অবুঝ মন তার কথায় সায় দিচ্ছে না। আচ্ছা সে আদোও কি আয়াতের স্ত্রী হওয়ার যোগ্য।নিজের হাতটা কাঁধ থেকে নামিয়ে অস্ফুট কন্ঠে বলল..

— “আমার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন, নিজেকে আপনার জন্য প্রস্তুত করতে চাইছি। যোগ্য হতে চাইছি আমি’।

কাতর মুখটা হাসৌজ্জ্বল মুখে রুপান্তরিত হতে সময় লাগলো না আয়াতের। বাহু থেকে হাতটা না সরিয়ে সামান্য ঝুঁকে দুহাতের গভীর বন্ধনে আবদ্ধ করে নিল তৃষ্ণাকে।
বিব্রত বোধ করলো তৃষ্ণা। হুটহাট জড়িয়ে ধরা , পায়ে হাত দেওয়াতে ক্ষনে ক্ষনে তাকে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। সেই ব্যাপারটা কি আয়াত নামক মানুষটা বুঝতে পারে না। আয়াতের চুলের বাজে হাত রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল..

— “কি করছেন? ছাড়ুন। যখন তখন যে কেউ এসে পড়তে পারে”।

ছাড়লো না আয়াত। বরংচ শক্তিশালী শরীরের সমস্ত ভড় তৃষ্ণার উপর ছেড়ে দিল ।পড়ে যেতে নিলে বেডের উপর হাতের করতলে ভড় করে নিজেকে সামলে নিল সে।

— “ছোট ভাইজান আপনার খাবা..! বিশ্বাস করেন ভাইজান আমি কিচ্ছু দেহি নাই “। (উল্টো ঘুরে লেবু)

দুজনকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে উল্টো ঘুরে গেল লেবু। আয়াতের কথায় খাবার দিতে এসে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে ভাবতে পারে নি।
তৃষ্ণাকে ছেড়ে এক লাফে সরে গেল আয়াত। আয়াত সরে যেতেই শাড়ি ঠিক করলো তৃষ্ণা।
দেয়ালের হেলান দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল..

— “আমাদের প্রাইভেট সময় নষ্ট করে এসেছে, কিছু দেখিনি।
এসেই যখন গেছিস , তাহলে বাইরে দাঁড়িয়ে ডং না করে ভেতরে আয়। তাছাড়া এখানে তেমন কিছুই হয়নি। হলে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকবে”।

চপল পা ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো লেবু। শব্দময়ে খাবারের প্লেটটা টেবিলের উপর রাখল। আড় চোখে আয়াতের দিকে তাকিয়ে সময় নিয়ে ভেংচি কাটলো।মাথার দুপাশে ঝুঁলে থাকা লম্বা বেণুনী দুটো দুহাতে ঘুড়িয়ে ভাব নিয়ে বলল..

— “আমার বয়ে গেছে। তোমাদের প্রাইভেট সময়ে আসতে । খাবার দিতে বলেছিলে তাই এলাম”।

বেণুনী দুটো নাচাতে নাচাতে প্রস্থান করলো লেবু নামক কাজের মেয়েটি। লেবু যেতেই চোখ বড় করে আয়াতের দিকে তাকালো তৃষ্ণা। তৃষ্ণার মুখের রাগী আভা দেখে চুপসে গেল আয়াত। ঠোঁট প্রশস্ত করে মলিন হয়ে বলল…

— “চিন্তা করছো কেন? পিয়াসু পাখি। আরো আদর হবে ,আগে খেয়ে নাও”।

আগ্নেয়গিরির মতো ফুটতে লাগল তৃষ্ণা। টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাসটা খপ করে হাতের মাঝে বন্দী করলো। পানিটুকু আয়াতের দিকে ছুঁয়ে মারলো। তারপরেও শান্ত হলো না সে, পূর্ণরায় গ্লাসে পানিতে পূর্ন করে নিল।
দুহাতে মুখ আড়াল করতে গিয়েও পারল না আয়াত। তার আগেই তৃষ্ণার ছোড়া পানিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল। এখানে থাকলে ভূমিকম্পন থেকে শুরু করে সাইক্লোন পর্যন্ত হতে পারে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আয়াতের।চোখ বন্ধ করে এক দৌড়ে রুমের বাইরে চলে গেল সে।
আয়াত বেরিয়ে যেতেই ভর্তি গ্লাসটা এক ঢোকে খালি করে নিল তৃষ্ণা। একটু আগের দৃশ্য গুলো ক্রমাগত চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আদোও এমন অদ্ভুত অনুভুতির কোনো নাম আছে কি-না জানা নেই তার। বুঝতে পারছে, আয়াত নামক মানুষটার সাথে ক্রমশ দৃঢ় প্রত্যয় জরিয়ে পড়ছে সে।।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here