মায়াজালে আবদ্ধ,পর্ব:১
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
>তোমার লজ্জা করে না কিছুদিন পর আমাদের বিয়ে আর তুমি অন্য একটা মেয়ের সাথে হাফ নগ্ন হয়ে ছবি উঠে সেটা আবার ফেসবুকে আপলোড দিয়েছো? ছি জুনায়েদ, আমি তোমার থেকে এটা কখনই আশা করিনি। আমি তোমাকে বিশ্বাস করতাম আর সেই তুমি আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলা করলে? ভেবেছিলাম জুনায়েদ সাঈদ আর যায় হোক খারাপ চরিত্রের না কিন্তু আমার ধারণা একদম মিথ্যা। একটা চরিত্রহীন লম্পটকে বিশ্বাস করে ভালোবেসে ভুল করেছি আমি। রেগে
>আমার কলার ছাড়ো দেখছে সবাই । আর কি সব আজে বাজে কথা বলছো বলবে? কিসের ছবি আর কোন মেয়ে? ওর হাত ধরে
> চিনতে পারছো না তাই না? একদম ভালো মানুষ সাজার নাটক করবা না। আমি গতকাল রাতে সব দেখেছি।
কথাটা বলে জুনায়েদের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে কান্নাই ভেঙে পড়লো রীমলি। জুনায়েদের সাথে ওর দীর্ঘ পাঁচ বছরের সম্পর্ক আর আগামীমাসে তার পূর্ণতা পেতে চলেছে কিন্তু হঠাৎ করে গতকাল রাতে ফেসবুক ঘাটাঘাটি করার সময় ও একটা অপরিচিত মেয়ের আইডিতে জুনায়েদ আর ওই মেয়েটার কিছু ছবি দেখতে পাই। ছবিতে মেয়েটার চেহারা বোঝা না গেলেও জুনায়েদের চেহারা বেশ ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে। এটা দেখে রীমলির মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল। আর কেই বা চাই তার প্রেমিককে অন্য একটা মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখতে। সারারাত ওর ঘুম আসেনি টেনশনে। জুনায়েদের ফোনটাও বন্ধ ছিল সন্ধ্যা থেকে। তাই রাতটা কোনো রকমে পার হতে না হতেই ও সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছে ওর খোঁজ করতে। রীমলি প্রথমে ওর বাড়িতে গিয়েছিল ওখানে না পেয়ে বাধ্য হয়ে ভার্সিটিতে এসেছে। ওর আসার আগে জুনায়েদ বন্ধুদের সাথে কথা বলছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট নিয়ে আর তার মধ্যেই রীমলি এসে ওর কলার ধরে টানতে টানতে সবার সামনে এনে এমন শুরু করেছে। জুনায়েদের প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছে আর রাগ ওর বাড়ছে তবুও ও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। রীমলিকে ও প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসে। এই মেয়েটার জন্য ও কি না করেছে তার ঠিক নেই।। কিন্তু ওর তো অন্য কোনো মেয়ের সাথে কোনো চেনা জানা নেই,যার সাথে ও এমন কিছু করতে পারে। রীমলিকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে তাহলে অন্যমেয়ের দিকে ও তাকাতেই বা যাবে কেনো? জুনায়েদ অবাক হচ্ছে রীমলির ব্যবহার দেখে, মেয়েটা এতো বছরে ও ওকে চিনতে পারলো না। কোথায় কি দেখেছে তার ঠিক নেই সেই জন্য এখনে এসে এমন করছে। আর সব থেকে বড় কথা জুনায়েদের সম্মান নিয়ে টানাটানি করছে। বন্ধুদের মধ্যে ওর যথেষ্ট সুনাম আছে ভালো ছেলে হিসেবে আর পড়াশোনাতে ও কখনও ক্লাসের সেকেন্ড হয়নি বারবার প্রথম হয়েছে। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি সবখানেই স্যাররা ওকে খুবই পছন্দ করে আর ভালোবাসে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বাবার অফিস তারপর আবার রীমলিকে সময় দেওয়া সব কিছুই ও রুটিন মাফিক করে। রুটিনের বাইরে ও কিছুই করে না। যদি কখনও বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছে তবে তা খাতায় নোট করে আর সে করবে অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক, ভাবা যায়? এটা আবার যেমন তেমন সম্পর্ক না, সুইমিং পুলে পানির মধ্যে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে অভার রোমান্টিক হয়ে মধ্য রাতের পিকচার। ছবিটা দেখেই জুনায়েদের চোখ কপালে। এটা ওর ছবি কিন্তু কেমন করে সম্ভব? ওর তো আর কোনো জমজ ভাই ও নেই যে সে হবে। ও একা আর ছোট্ট পিচ্চি একটা বোন আছে,নবম শ্রেনীতে পড়ে। তাহলে ওর মতো দেখতে ছবির ছেলেটা কে? ওকে এমন করে তাঁকাতে দেখে রিমলী ওর হাত থেকে ফোনটা কেঁড়ে নিয়ে বলল,
> এবার তো বিশ্বাস হয়েছে? তোমার স্পেশাল বাংলো বাড়িতে এই মেয়েটা আসলো কেমন করে, যদি তুমি ওকে নিয়ে না যাও? তলে তলে এই সব করে বেড়াও আর সাধু পুরুষ সেজে ভন্ডামি করো তাইনা? আমি আজকের মধ্যেই তোমার এই ভন্ডামি ছুটিয়ে দিবো। রীমলীকে চিনো না তুমি।
হুমকি ধামকী দিয়ে ও যেমন এসেছিল তেমনিভাবে গটগট করে চলে গেলো। জুনায়েদ ওকে অনেক ভাবে বোঝানো চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। ও চলে যেতেই বন্ধুরা ওর দিকে তাঁকিয়ে হাসতে শুরু করলো। পাশ থেকে সব বলাবলি করছে,
> কি রে ভাই তাহলে এই তোর গুরুত্বপূর্ণ কাম? তলে তলে এইসব করো আর আমাদেরকে উপদেশ দিতে আসো? হেসে
> ওর কি দোষ বল?সবটা হলো বয়সের দোষ। এই বয়সে কেউ সাধু পুরুষ হয়না।
এসব কথা শুনে জুনায়েদের প্রচণ্ড রাগ উঠে গেলো ও হাত মুঠো করে তেঁড়ে যেতে গিয়ে ও পারলো না ওর বন্ধু আমির ওকে আটকে দিয়ে ওর হাত ধরে টানতে টানতে ভার্সিটির বাইরে নিয়ে এসে বলল,
> এখন এডিটিং করে এমন পিকচার হামেশায় তৈরী করা যায়। রাগান্বিত না হয়ে আসল সত্যি টা খুঁজে বের কর।
> কিন্তু কে আছে যে আমাদের সম্পর্ক ভাঙার জন্য এই জঘন্য নোংরা কাজটা করেছে?
> আশেপাশে খুঁজে দেখ কেউ তো আছে। আর যেই আইডি থেকে পিকচার গুলো আপলোড হয়েছে সেই আইডির মালিকের কাছে শুনলেই তো হয়ে যায়। চিন্তা করতে হবে না এখন বাড়িতে যা।
> রীমলীকে তো চিনিস? বাড়িতে এতোক্ষন মনে হয় তান্ডব সৃষ্টি করেছে। জানিনা আমাকে বিশ্বাস করবে কি না তবে চেষ্টা করবো বোঝাতে।
> আমি তোর পাশে আছি কিছুই হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
> জানি তুই আমাকে বুঝবি। আচ্ছা তুই এদিকটা সামলে নে আমি আসছি।
কথাটা বলেই জুনায়েদ আর অপেক্ষা করলো না বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। আজ ও প্রচণ্ড অপমানিত হয়েছে কিন্তু রীমলি তো ওর জন্য কষ্ট পাচ্ছে এটা ভেবেই ওর কেমন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কে এমন করতে পারে? বাংলো বাড়িতে কতদিন যাওয়া হয়নি তাহলে ওই ছবিটা কবে তোলা হলো। জুনাইদের মনে হাজার রকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই ও বাড়িতে প্রবেশ করলো। সোফায় জুনায়েদের বাবা জয়নাল হক গম্ভীর হয়ে বসে আছেন।উনি প্রচণ্ড রাগী আর একগুঁয়ে টাইপের মানুষ।। ও ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই উনি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,
> তোমাকে মানুষ করতে পারলাম না আমি। ভেবেছিলাম আমার ছেলেটা আর যায় হোক আমার ভাইয়ের ছেলের মতো অকর্মণ্য নয় কিন্তু আমার ধারনা একদম ভুল।
> বাবা কি হয়েছে বলবে? এগিয়ে এসে
> জুনায়েদ মা কোথায় তুমি ওকে আমার সামনে থেকে সরতে বলো নয়তো কিন্তু আমি ওকে গুলি করবো বলে দিলাম। এতো কিছু করে এখন বলছে কি হয়েছে। ওর জন্য ওই উগ্র মেজাজি মেয়েটাকে আমি বাড়ির বউ করতে মেনে নিয়েছিলাম আর ও তলে তলে অন্য মেয়েদের সাথে রাতের বেলা সুইমিং পুলে গোসল করে বেড়ায়। এটা দেখারও বাকি ছিল। আমাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীতে কারও বদনাম নেই সেখানে আমার ছেলের এই পরিণতি। বাপ দাদার ছবির সামনে যেতেও আমার লজ্জা লাগছে। রেগে
একটু দূরে জুনায়েদ মা আমেনা বেগম স্বামীর মুখের দিকে তাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এই মূহুর্তে কিছু বলা মানে নিজেই নিজের বিপদ ঘাড়ে নেওয়া তার থেকে চুপ থাকাই ভালো। এদিকে জুনায়েদ রাগে ফুলছে সামান্য কিছু ছবি দেখেই এই অবস্থা। নিজের ছেলের উপরে এদের কোনো বিশ্বাস নেই। ও আর কথা বাড়ালো না বিড়বিড় করতে করতে রুমে এসে ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। রুমের সব জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ওকে রুমে আসতে দেখে ওর পেছন পেছন অলি (ওর ছোট বোন) এসে দাড়ালো। জুনায়েদ ওর দিকে তাকাতেই মেয়েটা করুন মুখ করে বলল,
> তোমার রুমে আরও প্রমাণ খোঁজা হয়েছে।
> মানে কি? এইসব কে করেছে?
> রীমলি আপু এসেছিল ওই তো এইসব করেছে। আর তোমার রুমে মেয়েদের পোশাক কসমেটিক ও পেয়েছে। সবটা আব্বুকে দেখিয়েছে। আপু ছবিটা কম্পিউটারে চেক করেছে এটা রিয়েল ছবি কোনো ভুল নেই। তোমার কপাল পুড়েছে ভাইয়া।
> এই এখান থেকে যা তুই। কপাল পুড়েছে মানে কি যতসব বাজে কথা।
> যাচ্ছি। তুমি সত্যিই এইসব করো ভাইয়া?
অলি সন্দেহের দৃষ্টিতে জুনায়েদের দিকে তাঁকিয়ে আছে। কথাটা শুনে জুনায়েদ রেগে গিয়ে ওর দিকে চোখ বড়বড় করে তাকাতেই অলি দৌড়ে চলে গেলো। জুনায়েদ চারদিকে তাঁকিয়ে ধুপ করে সোফায় জড় করে রাখা কাপড়ের উপরে বসে পড়লো। প্রচণ্ড টেনশন হচ্ছে। ছবিটা সামান্য কিন্তু ব্যাপার টা সামান্য হবে না। রীমলি ছেড়ে দেওয়ার মতো মেয়ে একদম নয়। এটা নিয়ে যখন ওর মনে একবার সন্দেহ হয়েছে এর শেষ দেখে তবেই ও ছাড়বে। কথাটা ভেবেই এর মাথার মধ্যে কেমন দপদপ করে জ্বলে উঠল।ওদের ভালোবাসা কি এতোটা ঠুনকো নাকি হঠাৎ একটা ছবি দেখেই এতো দিনের সম্পর্ক ও ভেঙে দিবে? কখনো না। এটা ভেবে ও নিজেকে শান্ত করলো আর ভাবলো ঠিক হয়ে যাবে সব। কিছুক্ষণ পরে ও রুমের সব জিনিসপত্র আগের মতো সুন্দর করে গুছিয়ে গোসল করে নিলো। প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে কিছু খেতে হবে এটা ভেবে ও নিচে গিয়ে খাবার টেবিলে এসে বসলো। টেবিলে কোনো খাবার নেই দেখে জুনায়েদ চিৎকার করে ওর মাকে ডাকলো,
> আম্মু খাবার দাও প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে আমার।
ওর চিৎকার শুনেও আমেনা বেগম বাইরে আসলেন না। কিন্তু অলি আসলো আর মন খারাপ করে বলল,
> রীমলি আপুর আবা ফোন করেছিলেন তোমাদের বিয়েটা আর হচ্ছে না। আব্বুকে উনি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে তাই আব্বু
তোমার খাবার বন্ধ করেছেন। আগামীকাল থেকে তোমার অফিস যাওয়াও বন্ধ। তুমি নিজের মতো চলবে। এখন থেকে স্বাধীন।
> বিয়ে হবে না মানে কি? আচ্ছা আমি আসছি।
জুনায়েদ আর অপেক্ষা করতে পারলো না। বিয়ে হবে না শুনে মাথা ঘুরছে ওর। ভাবলো মেয়েটা হয়তো পাগল হয়ে গেছে। জুনায়েদ দ্রুত বাইক নিয়ে রীমলিদের বাড়ির উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লো। সামান্য দূরে ওদের বাড়িটা কিন্তু আজ মনে হচ্ছে শেষ হতেই চাইছে না। ও কোনো করমে ওদের বাড়িতে পৌঁছে ভেতরে গিয়ে কলিংবেল বাজালো। দুবার বাজার পরেই দরজা খুলে গেলো। ওপাশে রীমলি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জুনায়েদ ওকে জড়িয়ে ধরতে গেলো কিন্তু ও বাধা দিয়ে বলল,
> কেনো এসেছো আব্বু ফোন দিয়ে কিছু বলেনি?
> কি হচ্ছে রীমলি? আমি সত্যি বলছি এমন কিছুই করিনি আমি। বিশ্বাস করো ওই মেয়েটার সাথে আমার কখনও দেখা হয়নি।
> ওও।
রিমলী ওর দিকে নিজের ফোনটা এগিয়ে দিলো একটা ভিডিও অপেন করে। ভিডিও টা দেখে ওর গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।
(চলবে )