সৃজা
পর্বঃ২২,২৩
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
পর্বঃ২২
ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর সৃজা বোঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে।বাইরে অন্ধকার ছেয়ে গেছে।কিছুক্সণ বিছানার সরাসরি জানালার দিকে তাকিয়ে রইল।রুমটাও আবছা অন্ধকার।সাফওয়ান ওর পাশেই আধশোয়া হয়ে ফোন টিপছে।ফোনের আলোটাও হালকা।সৃজা খেয়াল করলো ওর হাত এতক্ষণ সাফওয়ানকে জড়িয়ে ধরে ছিল।বোধগম্য হতেই হাতটা সরিয়ে ফেললো।
ফোনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই সাফওয়ান বললো
“ঘুম ভেঙেছে তাহলে।যাও ফ্রেশ হয়ে নাও খেতে হবে।আমারও কিছু খাওয়া হয়নি।”
সৃজা শাড়িটা ঠিক করে বিছানা থেকে নামল।সাফওয়ানের দিকে একবার তাকিয়ে ওয়াশরুমে গেলো।
সাফওয়ান আর সৃজা খেয়ে নিল।প্রচন্ড খিদে আর ঘুমের মধ্যে ঘুমকে প্রাধান্য দিয়েছিল।এখন বুঝতে পারছে শরীর কি পরিমান দূর্বল হয়ে পরেছিল।খাবার না খেলে যেনো এনার্জি কোথায় হারিয়ে যায়।খেয়ে হাত দুটো ধুতে গেলো।
ওয়াশরুম থেকে বের হতে সাফওয়ানকে আর দেখল না।বিছানায় একজন কিশোরী মেয়ে বসে আছে।বয়স ১৪ বা ১৫ র কাছাকাছি হবে।পরনে তার টপস আর স্কার্ট।আর দরজার পাশে ওর বয়সী আরেকটা মেয়ে তাকে ইশারা করছে কিছু।সৃজা তার পাশে বসলো।
“তোমার নাম কি?আর তুমি আমার কি হও আমি কিন্তু জানিনা।” মুচকি হেসে বললো সৃজা।
মেয়েটি যেনো সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারল।বললো
“আমি সাফওয়ান ভাইয়ার মেজো মামার মেয়ে নোভা আর ওইযে বাইরে সে হচ্ছে বড় চাচ্চুর মেয়ে নাতাশা।তুমি আমার বউমনি।তোমাদের বিয়েতে তো গিয়েছিলাম।কিন্তু তোমার সাথে কথা বলতে পারিনি।”
“কেনো?কথা বলতে পারোনি কেনো?” সৃজা অবাক হয়ে বললো।
“বাহ্ রে পরদিনই আমার পরীক্ষা ছিল না।তাই বিয়েটা দেখেই তোমাকে বাড়ি আনার সাথে সাথে চলে এসেছি।”
“ওহ আচ্ছা, আমার এতো সুন্দর সুন্দর কিউট কতগুলা ছোটবোন আছে জানতাম নাতো।নাতাশা ভেতরে আসো।”নাতাশা সংকোচ ঠেলে ভিতরে এসে নোভার গা ঘেসে দাড়ালো।
“আর বলো না বউমনি ও ভয় পাচ্ছিলো।ভেবেছিল তুমি রাগ করবে।”
“হায় আল্লাহ,আমি রাগ করবো কেনো?”
“কি জানি?সানিয়া আপু তো আমাদের সাথে কথা বলে না কিছু বললে রাগ করে।তাই ভাবলাম..
” তা কি ভাবলে আমিও রাগ করবো।আচ্ছা বাদ দাও আগামিকাল তোমরা দুজন আমাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাবে।পারবে তো?”
“আরে এটা কোনো ব্যাপার হলো।তোমাকে পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাবো।”
“আচ্ছা এখন নিচে যাই চলো।”নোভা আগে আগে চলে গেলো আর নাতাশা আমার পিছু পিছু আসছে।করিডর বেয়ে নিচে নামার আগেই একটা ছেলে বউমনি বলে ডাক দিলো।আমি নাতাশার দিকে তাকালাম
” উনি আমার বড় ভাই পাবেল,কলেজে পড়ে।তোমাকেই ডাকছে বউমনি।”সৃজা বললো
“হ্যা বলো”
“তোমাকে ডাকছে দাদু।সাফওয়ান ভাইয়া আর ফুপ্পিও সেখানে।”
নাতাশাকে নিয়ে পাবেলের পিছু পিছু গেলাম।বিশাল খাটটার একপাশে গিয়ে দাড়ালাম।নোভা চলে গেছে।নানুমনি এখন কথা বলছে স্বাভাবিকভাবে।আমাকে দেখে কাছে ডাকলেন।ধীর পায়ে তার পাশে গিয়ে বসলাম।আম্মাকে কিছু ইশারা করলেন।আম্মা বললেন
“এখনই কি প্রয়োজন এসব করার?তুমি সুস্থ হও তারপর নিজ হাতে দিও।”
নানুমনি অসুস্থ শরীরেই এক প্রকার রাগ করলেন।বললেন
“যা কইছি তাই করো।নাইলে আমি উঠমু এখন।”
আম্মা অগত্যা নানুমনির আলমিরাটা খুলে একটা বাক্স বের করলেন।বক্সটা অনেক কারুকার্য খচিত,খয়েরি কালার।বাক্সের ভাজে ভাজে চিকন কালো রেখা পরেছে।নানুমনির সামনে এনে বাক্সটা খুললেন।পুরো বক্সটা গয়না ভর্তি।সব পুরোনো ডিজাইনের।আম্মাকে একটা হার ইশারা করে বললেন পরিয়ে দিতে।সৃজার কন্ঠনালীর চিকন হারটার উপরই ওইটা পরিয়ে দিলো আম্মা।আমার অস্বস্তি হচ্ছে।কোনোরকমে লজ্জা পাওয়া মুখে বললাম
“এটার কি দরকার ছিল নানু?আমারতো অনেক আছে।”
নানুমনি ফোকলা দাতেই হাসি দিলেন।বললেন
” না দিলেতো আমি শান্তি পাইতাম না বইন।তোরে তো কিছুই দেয়া হয় নাই।বিয়াতেও যাই নাই।তোর নানা মরার পর আর এই গায়ের বাইরে যাই নাই।ভাগ্যিস অসুখ করলো না হয় এই পুতলিটা তো দেখবার পাইতাম না।”
“এভাবে কেনো বলছেন নানুমনি।আপনার অসুখ না হলেও তো আমরা আসতে পারি।”
“হ কত আইছো তোমরা।আমার মাইয়াও তো আহে না দেখতে।” বলে আম্মার দিকে কঠোর দৃষ্টি দিলেন।আম্মা চুপ করে বসে রইলেন।
সাফওয়ান হয়তো আমার অস্বস্তি বুঝতে পারল।ও জানে আমি ভারি গহনা পছন্দ করি না।একবার গয়না পরে গলার জায়গায় জায়গায় লাল ছোপ পরে গেছিলো।সাফওয়ান দেখে প্রচন্ড রেগে গেছিলো। বললো
“নানীজান আমি এখন যাচ্ছি আবার পরে এসে দেখা করে যাবো।ঠিক আছে?তুমি রেস্ট নাও।” বলেই নানুর সামনেই আমার হাতটা ধরে বেরিয়ে আসলো।রুমে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড় করিয়ে গয়নায় হাত দিল।আমি বাধা দিয়ে বললাম
“আমি পারবো।ছাড়ুন!বেশি আদিক্ষেতা দেখাতে হবে না।” তবুও সরল না।গয়নাটা খুলে টেবিলের উপর রেখে বললো
“ডান।এবার যেতে পারো।”
কথাটা শোনার সাথে সাথে বেরিয়ে এলো সৃজা।সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে দেখলোএক পাশে রান্নাঘরের সামনের জায়গাটা জুড়ে সবজি,মাছ,মাংস কাটাকাটি হচ্ছে।বড় মামী সবটা খেয়াল করছে।আর তাড়া দিচ্ছে।ওনাকে খুবই ব্যস্ত দেখাচ্ছে।আমাকে দেখে বললেন
“ওমা!নতুন বউ তুমি এখানে কেনো?কিছু লাগলে তুলিকে বলবে।এই তুলি কোথায় গেলি?”মুহূর্তেই তুলি এসে হাজির হলো।
” এই তুই থাকতে নতুন বউকে নিচে নামতে হলো কেনো?”
সৃজা হতভম্ব হয়ে গেলো তার কথায়।এখানে তুলির দোষ কোথায়।
“আসলে মামী আমি এমনিতেই নিচে এসেছি।কোনো প্রয়োজন হলে তুলিকে বলে নিবো।আপনি চিন্তা করবেন না।”
“কি বলছো মা চিন্তা করবো না।তুমি হচ্ছো চৌধুরী বাড়ির রাণী। তোমার কোনো অসুবিধা হলে তোমার বড় মামা আমায় আস্ত রাখবেনা।এই তুলি যা নতুন বউয়ের আশে পাশেই থাকবে।” সৃজার অস্বস্তি এবার চরমে।তারা এমন কেনো?অগত্যা উপরে চলে আসতে হলো।নিজের রুমে যাওয়ার আগে দেখলো বামদিকের রুমটায় নোভা।সেদিকেই গেলো সে।দরজায় নক করলো।
“আরে বউমনি আসো, ভিতরে আসো।নক করছো কেনো?”
“তুমি এ রুমে থাকো।বাহ্ সুন্দর তো।”
” হ্যা এই রুমে আমি আর নাতাশা থাকি আর পাশের রুম তানভির ভাইয়ার।”
“তানভির কে?”
“বড় চাচ্চুর ছেলে।আজকে রাতেই আসার কথা।হয়তো রাস্তায় আছে।দাদু অসুস্থ তাই আসবে।”
“কেনো এমনিতে আসে না?”
নোভা কিছুটা মন খারাপ করে বললো
“ভাইয়া ভার্সিটির প্রফেসর তাই ব্যস্ত থাকে অনেক।বাড়িতে বেশি আসেনা।”
“ওহ আচ্ছা।” টিউলিপের কথা মনে পরে গেলো।বাড়িতে ঢোকার পর ওকে আর দেখিনি।তাই বললাম
“টিউলিপ কোন রুমে আমাকে একটু নিয়ে যাবে?”
“আরে বউমনি এভাবে বলছো কেনো।চলো এক্ষুনি নিয়ে যাচ্ছি।সানিয়া আপুর রুমেই আছে।এতক্ষণে হয়তো ঘুম থেকে উঠে গেছে।আমি কিন্তু ভিতরে ঢুকবো না।আপু রাগ করতে পারে।”
নোভার পিছু পিছু যাচ্ছি আর ভাবছি বুবু ভেতর থেকে যতটা নরম বাইরে থেকে ততটাই শক্ত আবরণে ঢাকা।এ বাড়ির প্রায় প্রত্যেকেই তাকে ভয় পায়।কিন্তু এটা তো জীবন নয়।এরকম করে কতদিন থাকবে উনি।
বুবু বিছানায় বসে কাজ করছে।পা গুলো বিছানায় ছড়িয়ে রাখা আর তার উপর ল্যাপটপ, চোখে চশমা।টিউলিপ পাশেই একটা পুতুল নিয়ে চুপচাপ বসে আছে।আমি নক করে ভিতরে ঢুকলাম।একবার দেখে নিয়ে ভিতরে আসতে বললো।আমাকে দেখা মাত্রই টিউলিপ দৌড়ে গলা জড়িয়ে ধরলো।বুবু কাজ করা অবস্থায়ই বললো
“সৃজা নোভাকে একটু ডাকো তো।” সৃজা অবাক হলো।তবে নোভা বাইরে থাকায় শুনতে পেয়ে ধীরে ধীরে রুমে ঢুকলো।
“আমায় ডাকলে আপু?”
“হ্যা,টিউলিপকে একটু বাইরে নিয়ে যাও আমার সৃজার সাথে কথা আছে।” নোভা অনেক খুশি হলো।সে যেনো এর অপেক্ষাই করছিল।
“ওকে নিয়ে যাও।অনেকক্ষণ হলো চুপচাপ বসে আছে। তোমার কাছে রেখো।আর কোনো আন হেল্দি ফুড যাতে না খায় সেটা দেখো।”
“ওকে আপু”
নোভা বেরিয়ে যেতেই আমাকে বসতে বললো।কোলের ফাইলটা সরিয় চশমাটা খুলে রাখল।মৃদু কন্ঠে বললো
“সবাই যা বলবে তা ভালো না লাগলেও কেনো মেনে নিবে?তোমার এই ব্যাপারটা আমার পছন্দ না।তবে হ্যা শুনলাম তুমি নাকি মালয়েশিয়া যেতে চাও ফার্দার স্টাডির জন্য।”জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।
” জ্বী বুবু আমি পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাড়াতে চাই।আমার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।”
“শুনে খুশি হলাম।আমার সাপোর্ট সবসময় পাবে এক্ষেত্রে।তবে যা করবে ভেবে করবে।”
সৃজা মৃদু স্বরে বললো
“জ্বী”
“আমি আগামিকাল ঢাকায় চলে যাবো টিউলিপ তোমার সাথে এখানেই থাকবে কিছুদিন।আশা করি তোমার কোনো সমস্যা হবে না।”
“জ্বী না বুবু সমস্যা হবে না।তবে আপনিও কিছুদিন থাকতে পারতেন।”
“আমার এতো সময় নেই। অফিসের অনেক কাজ পরে আছে।”
সৃজার একবার বলতে ইচ্ছে করলো’এত কাজ করে কি করবেন।কিন্তু না বলে চুপ রইল।
“ঠিক আছে এখন যেতে পারো।আমার কিছু কাজ বাকি আছে।”
সৃজা মৃদু পায়ে বেরিয়ে গেলো।তার ভাবতেই অবাক লাগছে সানিয়া আজ নিজে থেকে তাকে উপদেশ দিয়েছে।
রাত ৯টা না বাজতেই নিচে খাওয়ার ধুম পরে গেছে।বাড়ির পুরুষদের আগে খাওয়ার নিয়ম।ছেলেরা আগে খাচ্ছে।পরে আমরা মেয়েরা বসলাম।বিকেলে খাওয়ার কারণে পেট ভরা ভরা লাগছে।খাচ্ছি না দেখে মেজো মামী বললেন
“কি হয়েছে সৃজা?খাবার ভালো হয়নি?”
“না না খাবার ভালো।আসলে দুপুরের খাবারটা বিকেলে খাওয়ায় আর খেতে ইচ্ছে করছে না।” কতগুলো উৎসুক মুখ যেনো চুপ হলো।সৃজা কোনোমতো খেয়ে উপরে গেলো।
_____________________
আজ ভোরের দিকেই সৃজার ঘুম ভেঙে গেলো।কাল রাতে সাফওয়ান আর ও একসাথে ঘুমালেও মাঝখানে কোলবালিস ছিল।সাফওয়ান অবসক হয়ে বলেছিল
“তুমি আমাকে এটুকু বিশ্বাসও করো না?আমার কিছু করার ইচ্ছে হলে কোলবালিস দিয়ে আটকাতে পারবে মনে করছো?”
সৃজা উত্তরে কিছু না বলে উল্টো পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরেছিল।সকালে উঠে দেখে মাঝখানের কোলবালিশ গায়েব।সাফওয়ানের বলিস্ঠ হাতে সে বন্দি।কোনো মতো নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসলো।ভাবনার মাঝেই করিডোর থেকে শব্দ শুনতে পেলো।কেউ তার চাপা রাগ ঝারছে কারো উপর।সৃজা শব্দ অনুসরণ করে সেখানে গেলো।সানিয়ার রুম থেকে শব্দ আসছে।একটা ছেলেও আছে রুমে।বুবুর কথাগুলো কানে আসছে
“আর কি চাও তুমি আমার কাছে?আরো ৫ বছর আগে আমাদের মধ্যে সব শেষ হয়েছে।সব তুমি নিজ হাতে শেষ করেছিলে।এখন আবার কেন আসতে চাইছো তুমি।প্লিজ যাও এখান থেকে।”
ছেলেটিও বলা শুরু করলো
“বাহ্ এবার সব আমার দোষ।তোমার কি কোন দায় ছিল না?আমাদের সম্পর্ক থাকতেও তুমি অন্য ছেলের সাথে সম্পর্কে ছিলে…
” ব্যস চুপ কর তুমি।তোমার এই মিথ্যা কথা আমি নিতে পারছিনা।তবে হ্যা পাঁচ বছর আগে আমি না বললেও আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি তুমি আসলে আমাকে ভালোই বাসোনি।ভালোবাসলে একবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে সত্যিই কি অন্য কোন ছেলের সাথে আমার সম্পর্ক আছে?কিন্তু তুমি তা করোনি।”
“আমি সেটাই বলছি সানিয়া আমি ভুল বুঝেছিলাম তোমাকে।পরে তো ভুল বুঝতে পেরেছি।তুমি কেনো ক্ষমা করে আবার আগের মতো হচ্ছো না।”
“কোনোকিছুই আগের মতো হবে না তানভির ভাই।তুমি এখান থেকে যাও।”
চলবে……
#সৃজা
পর্বঃ২৩
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
অন্যের কথা আড়াল থেকে শোনা বাজে অভ্যাস হলেও আজ সৃজার মন চাইছে সানিয়ার কথোপকথন শুনতে।তাই সানিয়ার দরজার কাছে যেয়ে আড়ালে দাড়ালো।এটাই তাহলে বড় মামার বড় ছেলে।যার কথা নোভা গতকাল বলেছিল।কিন্তু রাতে কখন এলো আমিতো টের পেলাম না।ভিতর থেকে সব স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সৃজা।
তানভীর কথা বলছে।চাপা অভিমান তার স্বরে।
“কেনো আগের মতো হবে না?আমি টিউলিপকে আমার পরিচয় দিবো।” তার চোখে মুখে সিরিয়াস ভাব।সানিয়া তার থেকে মুখটা ফিরিয়ে নিলো
“তুমি এখন বেশি করছো।ভুলে যেয়ো না আমি আর সেই আগের সানিয়া নেই যে তোমাকে ভালোবেসে হাজার রাত যন্ত্রণা ভোগ করতেও দ্বিধা করতোনা।আ’ম আ উইডো।আমি ভার্জিন নই আপনার মতো।”
হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো তানভীর।তার রাগ হচ্ছে সানিয়ার কথা শুনে।দাত চিবিয়ে বললো”আমার রাগ তুমি জানো সানিয়া।শত পঙ্কিলতা তোমাকে স্পর্শ করলেও আমার কাছে সেই শুদ্ধ, পবিত্র সানিয়াই থাকবে তুমি।”
“আপনার কথা শেষ হলে আসতে পারেন।”
তানভীর গো ধরে রইলো সে যাবেনা।সে কেনো যাবে।তার কথা এখনো শেষ হয়নি।রাগটা বজায় রেখেই বললো
“আমি এক পা ও যাবোনা।হয় তুমি এবার আমার হবে নাহয় সব শেষ করে দিবো।অনেক হয়েছে আর না।”
সানিয়াও রেগে গেলো।দ্রুততার সাথে বললো
“শেষ করে দাও!!আমাকেও শেষ করে দাও।তোমার রাগকে সবাই ভয় পেলেও আমি আর ভয় পাইনা।”
আচমকা শান্ত হয়ে গেল তানভীর, এই মেয়েটা কি দিয়ে তৈরি?আগেতো এমন ছিল না।তার মুখে একটু ভালোবাসার কথা শুনলেই আবেগে কেঁদে ফেলতো।তার রাগ হলে গুটিশুটি মেরে চুপচাপ এক কোণে দাড়িয়ে থাকত।কখনো তার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস পেতো না।তানভীর জোর করে সেই বন্ধ চোখেই ঠোঁট ছোঁয়াতো।কোথায় সে সানিয়া?শান্ত কোমল নিভে যাওয়া কন্ঠে সানিয়ার মাথায় হাত ছুইয়ে তানভীর বললো
“মানছি তো আমার ভুল।এবার ক্ষমা করে দে না।তুই দেখ তোর বিয়ের পরও আমি কোনো মেয়েকে আমার জীবনে প্রবেশ করতে দেইনি।কোনো গার্লফ্রেন্ড ও নেই।শুধু তুই ছাড়া কাউকে আজ পর্যন্ত ছুইনি।বিশ্বাস কর প্লিজ সোনা।আমি তো অন্য কাউকে ছুঁতেও পারবোনা তাই না? তোকে ছাড়াতো আমি ওভাবে কাউকে ছুঁতেও পারবোনা।বুঝতে পারছিস তো তুই,এই। ” সানিয়া চুপ রইলো।কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলো।
“তোকে যেভাবে ভালোবেসে,আদর করে,আলতো করে ছুই এভাবে তো কাউকে ছুতে পারবোনা। তুই জেনেও এমন করছিস কেনো?” কাতর কন্ঠে কথাগুলো বলে আলতো করে সানিয়ার গালে হাতটা রাখল।
সানিয়া হাতটা সরিয়ে দিলো।নিজের মুখটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো
“বিয়ে করুন সব ঠিক হয়ে যাব।রাতে একসাথে ঘুমালে এমনিতেই সে** হয়ে যাবে।তখন আমার কথা মনে পারবেনা।”
“এই তুই কি বলছিস?আমি তো তোর মন শরীর দুটোই চাই তাই না সোনা?প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর।আমি আর সিঙ্গল থাকতে পারবোনা।তুই রাজী হয়ে যা কেউ কিছু বলতে পারবেনা।”সানিয়ার মাথাটা আলতো করে বুকে ছোয়ালো।
সানিয়া এতক্ষণ কঠোর থাকলেও এবার কেঁদে দিলো।তানভীরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।সানিয়া নিজেকে এতক্ষণ শক্ত করে রাখলেও আর পারছে না।কিভাবে পারবে সে দৃঢ় হয়ে থাকতে।এই লোকটা তো ওকে সত্যি অনেক ভালোবাসে।ওর বিয়ের পর তো সুইসাইড অ্যাটেম্পড করেছিল।নিজের প্রতি নিজের রাগ থেকেই নানুবাড়িতে আসেনি সে।ইভেন ভাইয়ের বিয়েতে ও আসতে পারে ভেবে নানা অজুহাতে সে বিয়েতেও ছিলো না।কিন্তু এবার তো আসতেই হতো।ভালোবাসার নানুমনি যে মরণাপন্ন অবস্থায় ছিল।সেসময় তো এটা ভাবা হয়নি তার জন্য অসীম ভালোবাসার মানুষটাও এখানে আসবে।হ্যা মানছে সে ভুল তারও ছিল।হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ে করে ফেলা উচিত হয়নি।তাই বলেই তো লোকটা মরতে গেছিলো।
কথাগুলো ভেবে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তানভীরকে।সানিয়ার নখগুলো তানভীরের বেকে ক্ষতর সৃষ্টি করলেও সে ক্ষত এ আনন্দের কাছে হার মেনেছে।
কিছুক্ষণ বাদে সানিয়ার হাত আলগা হয়ে গেলো।কিন্তু তানভীর তবুও জড়িয়ে রেখেছে তাকে।ও বুঝতে পারছে সে আগের অভ্যাসটা এখনো রয়ে গেছে সানিয়ার।কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরতো আগেও।সানিয়াকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো তানভীর।তারপর নিজেও কতক্ষণ বিছানায় বসে সানিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
সৃজা পুরো দৃশ্যটাই দরজার আড়ালে থেকে শুনেছে এবং দেখেছে।সে বুঝতে পারছেনা এখানে কি হলো এতক্ষণ।একটা জিনিস তার কাছে পরিষ্কার সানিয়া আর তানভীর দুজন দুজনকে ভালোবাসতো ইভেন এখনো বাসে।তবে কোনো ভুল বোঝাবুঝি তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।তবে এটা মাথায় ঢুকছে না তার।সাফওয়ান তো বলেছিল বুবু ভালোবেসে বিয়ে করেছিল।তাহলে সেটা কি ছিল।সবটাই গোলমাল লাগছে।সাফওয়ানকে কি বলবো এসব কথা?নিজের মনে মনে প্রশ্ন করে উত্তর পেলো না সে।
হঠাৎ করে সামনে কেউ এসে পরায় চমকে উঠলো সৃজা।তানভীর পকেটে দুহাত গুজে দাড়িয়ে আছে তার সামনে।চোখের চশমাটা ঠিক করে সৃজার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো।মিষ্টি একটা স্বরে বললো
“তুমি সৃজা,সাফওয়ানের ওয়াইফ। এম আই রাইট?”
সৃজা বিস্ময়ের পর বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
“অবাক হওয়ার কিছু নেই আমি শুনেছি তোমার কথা।বাড়িতে পা রাখতেই আমার বোনেরা তোমাকে নিয়ে গল্প করা শুরু করেছিল।তাই চিনতে অসুবিধা হলো না।তাছাড়া ছবিও দেকেছিলাম।ইউ আর মাচ বিউটিফুল দেন পিকচার।”
লজ্জা পেলো সৃজা।তবে নিজের মনে মনেই নিচু হয়ে গেলো এতক্ষণ কি করছিলো ভেবে।ছিঃ কি ভাবলো লোকটা।নিজেকে ধাতস্থ করে বললো
“জ্বী আমি সৃজা।আমি আসলে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম..
” এক্সপ্লেইন করার প্রয়োজন নেই।আমি জানি সবটা শুনেছো।আরো কিছু জানা দরকার তোমার।চলো একটু লনে হেটে আসি।কাম্।”বলেই সামনের দিকে হাটা দিলো।সৃজাও পিছু পিছু গেলো।
সকালের নরম ঘাসে পা রেখেই সৃজার পুরনো অনুভূতি জাগ্রত হলো।গতকাল রাতে তুমুল বৃষ্টি হয়েছে।প্রকৃতি এক নতুন রূপ ধারণ করেছে।পাতাগুলো একদম পরিষ্কার লাগছে।সকালের সূর্যের মৃদু রশ্মিতে পাতায় থাকাইশঃ কি সুখটাই হচ্ছে এখন।ইচ্ছে করছে উড়তে।পাখির মতো ডানা মেলে এ পাশ ওপাশ ঘুরে বেড়াতে।কিন্তু সম্ভব না।ধ্যান ভাঙলো তানভীরের কথায়
“সানিয়ার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা আমি।”সৃজা চমকে তার মুখের দিকে তাকালো।সে কথা বলছে।
” এখন হয়তো জিজ্ঞেস করবে তাহলে টিউলিপের বাবার সাথে কি ছিল।টিউলিপের বাবাকে বিয়েটা সে আমার উপর জেদ করেই করেছিল।সবাই জানত ভালোবেসে বিয়ে করেছে।আসলে সে আমার থেকে দূরে যেতে চেয়েছিল।তাই বিয়েও করলো এমন কাউকে।”বুঝতে পারলাম কথাগুলো বলতে তার ক্ষীণ কষ্ট হচ্ছে।কিছুক্ষণ থেমে দূরে পুকুরটার দিকে তাকিয়ে আবার বললো
“দোষটা যদিও আমার ছিল।কিন্তু পরে যখন বুঝতে পারলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেলো।সানিয়া তখন বেবি এক্সপেক্ট করছে।যেই মেয়েটাকে সীমাহীন ভালোবেসেছি তাকে ছাড়া হাজার রাত পাড় করার কষ্ট সামলাতে না পেরে একসময় সুইসাইড করলাম।একটা বিরাট ভুল করে বসলাম।” দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক থেকে।কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।আমি চুপচাপ শুনছিলাম।
“কিন্তু বেঁচে গেলাম।বেঁচে থেকেও নিজেকে পরিবার থেকে আলাদা করে ফেলেছিলাম।কোনো অনুষ্ঠানেই আসা হয় না আমার।বাড়িতে আসলেই সবাই বিয়ের জন্য তাড়া দেয়।তারা তো আর জানে না তাদের ছেলেটা যাকে ভালোবাসে তাকে পাওয়া অসম্ভব ছিল।মা এখনো কানের কাছে এসে মিনমিন করে বোঝায় আমাকে। তারও তো একটা সখ আছে।কিন্তু আমারতো সানিয়াকে ছাড়া চলবেনা।”
“বিয়েতো করতেই হতো।হয়তো তাতে ভালোবাসা থাকত না।গতকাল এসেই সানিয়ার কথা জানতে পারলাম ও এসেছে।বুকের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার হলো।সমস্ত সংকোচ ঠেলে ওর সাথে দেখা করলাম।তারপর হয়তো তুমি সবটা শুনেছো।”
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সৃজা। তারপর ক্ষীণ গলায় বললো
“আপনার সাথে বুবুর বিয়ে হলে তার জীবনটা আবার আগের মতো হবে আশা করি।আমি আসলে কিছু বলার মতো খুজে পাচ্ছিনা।সবকিছু এত দ্রুত আর সব একসাথে আমার সামনে এলো।তবে এটুকু বলবো আমার সাপোর্ট আপনাদের সাথে আছে।আপনাদের জীবনটা সুখের হোক।”
মৃদু হাসির রেখা দেখা গেলো তানভীরের ট্রীম করা দাঁড়ির গালটায়।
“চলো যাওয়া যাক।কেউ তোমাকে আমার সাথে দেখে রেগে যাচ্ছে।”
“কে রেগে যাচ্ছে?” তানভীরের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো সৃজা।স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দোতলার জানালা দিয়ে সাফওয়ান গম্ভীর দৃষ্টিতে এদিকেই তাকিয়ে আছে।
ধুপধাপ পা ফেলে ঘরে ঢুকলো সৃজা।বড় ভাইয়ের সামনে এ কেমন ব্যবহার।কি ভাবল লোকটা?সাফওয়ান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সৃজার লাল হওয়া মুখটার দিকে একবার তাকাল।সৃজা চুপচাপ একটা বই খুলে বসলো।সাফওয়ানকে স্পষ্ট ইগনোর করছে।বুঝতে পেরে তোয়ালেটা রেখে সৃজার সামনে এসে বসলো।হাত থেকে বইটা সরিয়ে সৃজার কোলে মাথা রাখলো।দুহাতে কোমর পেচিয়ে ধরল সাফওয়ান।
সৃজা কেঁপে উঠলো ঠান্ডা পানির স্পর্শে।এই লোকটা ঠিক করে মুখ মুছে না কেনো।চুল তো পুরো ভেজা।সৃজা চিমটি কেটে সাফওয়ানকে সরাতে চাইল কিন্তু পারলো না।পেটে মুখ গুজেই বললো
“এটা নতুন টেকনিক নাকি?আগেতো চিমটি কাটতে দেখিনি।”
“আগে দেখেননি কারণ আগে এমন বেহায়াপনা করেননি।”
মুখ তুলে সৃজার দিকে চাইল।বুঝতে পারল কোন কথা বলছে।নিজেকে ঠিক করে উঠে দাড়ালো সাফওয়ান।
“এখানে বেহায়াপনার কি আছে। তোমার দেবর হোক আর যাই হোক তার সাথে একা কথা বলতে যাবে কেনো তুমি?”
“অ্যাহ্ আসছে।নিজেতো ধোয়া তুলসি পাতা।সৃজা প্রায়ই এরকম ইঙ্গিত করে কথা বলে।সাফওয়ান বুঝতে পেরেও কিছু বলে না।তবে তার খারাপ লাগে না।বরং ভালো লাগে,অন্তত কথা তো বলে।
চুলগুলো ঠিক করে সাফওয়ান বেরিয়ে গেলো জগিং করতে।সৃজা বইয়ে মুখ গুজে পরে রইলো।কিছুক্ষণ বাদে দরজায় নক হলো।সৃজা অনুমতি দিলো আসার।তুলি এসেছে কফি নিয়ে।সৃজা উঠে বসলো
” তুমি কি করে জানলে আমার কফি লাগবে।”
“না না,আমি জানতাম না।সাফওয়ান স্যার বলে গেছে।” সৃজা কফিটা নিলো।মনে মনে ভাবলো তার স্বামীর অনেক উন্নতি হয়েছে।
“আচ্ছা টিউলিপ কোথায়।”
“টিউলিপ মামুনি তো নোভা আপাদের সাথে ঘুমাইছে কাইলকা।”
“ওহ আচ্ছা।ও ঘুম থেকে উঠলে আমার কাছে নিয়ে এসো।এখন যাও।”
“জ্বী আইচ্ছা।”
সৃজার ভাবতেই ভালো লাগছে টিউলিপ কাউকে বাবা বলে ডাকতে পারবে।তার পূর্ণতা যেনো এখানেই অপূর্ণ ছিল।এখন সেটাও পূরন হবে।
বেলা এগারোটার দিকে নিচ থেকে সৃজার ডাক এলো।কি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে সেখানে সৃজাকেও লাগবে।
#সৃজা
পর্বঃ২৪
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
বাড়ির নিচতলায় হলরুমের মতো জায়গাটায় সবাই বসে আছে।বিশেষ করে নানু ও বসে আছে।তিনি এখন মোটামুটি সুস্থ।সোফায় জায়গা না হওয়ায় কিছু লোক এক্সট্রা চেয়ার নিয়েও বসেছে।তবে বাচ্চারা নেই এখানে।আশ্চর্যের ব্যাপার সাফওয়ান ও নেই।তানভীর ভাইয়া একপাশে দাড়িয়ে আছে।বড় মামা আমাকে দেখে বললেন
“ওই তো এসেছে বউমা।হ্যা এখন বলো কি বলতে চাও।” ষাটোর্ধ লোকটির চোখ চিকচিক করছে।হয়তো তানভীর ভাইয়ার থেকে আশানুরূপ কিছু শুনতে চাচ্ছে।নীরবতা ভেঙে তানভীর ভাইয়া বললেন
“সব ভেবে দেখলাম আমার বিয়ে করা উচিৎ।…
সবার মুখেই হাসি ফুটলো।বড় মামী কথা কেড়ে নিয়ে বললো
“জানতাম,আমার ছেলে আমার কথা ফেলতেই পারে না।আমি মেয়ে দেখেছি বাবা।তোর যাকে পছন্দ তাকেই বিয়ে করবি।”
তুলিকে হাক দিয়ে বললেন
“এই তুলি যা আমার ড্রয়ার থেকে ছবিগুলো নিয়ে আয়।”
তানভীর ভাইয়া থমথমে মুখে বললেন
“আমার মেয়ে পছন্দ করা আছে।আর ওকে ছাড়া আমি কাউকে জীবনসঙ্গী করতে পারবোনা।”বড় মামী অবাক হলেন।তার ছেলের মুখে তো কখনো কোনো মেয়ের কথা শুনেননি।তাহলে কার কথা বলছে সে।তারপরও খুশি হলেন,ছেলে বিয়ে করবে এটাই অনেক।
বড় মামা খুশি হয়েছে কিনা বোঝা গেলো না।তবে তিনি জানেন ছেলের জেদ সম্পর্কে যাকে বলবে তার সাথেই বিয়ে হবে।মুখটা গম্ভীর করে বললেন
” মেয়ের নাম বলো আমরা প্রস্তাব নিয়ে যাই।তোমার বিয়ের জন্য তোমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে আটকে আছে।যত তারাতাড়ি সম্ভব বিয়েটা সেড়ে ফেলতে চাই।”
তানভীর ভাইয়া অকপটে বললেন “ইটস সানিয়া।”
হলরুমে ছোট খাটো একটা ভূমিকম্প হলো।সবাই চমকে তার দিকে তাকালো।শুধু নিশ্চুপ ছিলাম আমি আর আমার শ্বশুরমশায়।ইমরান চৌধুরীকে দেখে মনে হলো তিনি জানতেন এমনটাই হবে।
আম্মা চমকালেও তিনি যে খুশি হয়েছেন তা বোঝা যাচ্ছে।তার চোখ চকচক করছে।এতোদিন মেয়েটা মায়ের কাছে থাকলেও তার মা তাকে প্রতিটা মুহূর্তে শুধু কঠোর হতে দেখেছে।টিউলিপের বাবার মৃত্যুর পর মেয়েটার মুখ দেখলেই সাফিয়া বেগমের বুকটা ধ্বক করে উঠতো।বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হতো তার।তানভীরের কথায় তিনি যারপরনাই খুশি হয়েছেন এমন ভদ্র,নম্র ছেলেই তো চেয়েছিলেন তিনি।যে সানিয়ার জীবনটা গুছিয়ে দিবে।সাফিয়া বেগম স্বামীকে মৃদু স্বরে বললেন
“একি আমি ঠিক শুনলাম।” ইমরান চৌধুরী স্বাভাবিক মুখেই বললেন
“হ্যা ঠিক শুনেছো।তানভীর আমাকে আগেই এ ব্যাপারে জানিয়েছে।তবে আমার মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই হবে না।”
সাফিয়া বেগম যেন উত্তরটা শুনে নিভে গেলেন।মনের মধ্যে যে ক্ষীণ আশার দ্বীপ জলেছিল সেটা নিভু নিভু প্রায়।যদি সানিয়া রাজী না হয়?এরকম হীরের টুকরো ছেলে তো আর পাবেনা।
বড় মামী সহসা কিছু বলতে পারলেন না তবে মিনমিন করে আওড়ালো
“ও তো বিবাহিত বাবা,তার উপর ওর মেয়েও আছে।”
“আমি সব জানি মা।বিয়ের পর টিউলিপ আমার পরিচয় পাবে।”
বড় মামীর মুখটা দেখার মতো।তবে তিনি খুবই ক্ষুব্ধ। ছেলের জেদের কারণে চুপ করে রয়েছে।বড় মামা বললেন
“তুমি যা বলছো ভেবে বলছো?এ ব্যাপারে সানিয়ার মত নেয়াও জরুরী।”বড় মামী মামাকে দিকে তাকিয়ে রেগেই বললেন
” একটা বিবাহিত মেয়েকে আমার ছেলের বউ করবে তুমি।”মামা থামিয়ে দিলেন তাকে।বললেন
“তুমি চুপ করো।বিবাহিত বলে কি মেয়েটা মানুষ না?বড় মামী বিরবির করে বললেন বোনের মেয়ের প্রতি বেশিই দরদ।তবে কথাগুলো কেউ শুনতে পেলো না।সকলকে থামিয়ে বড় মামা নানুর দিকে তাকালেন
” আম্মা আপনি বলেন কি করব?আপনার কথাই এখনো এ বাড়ির শেষ কথা।”
নানু কিছুটা ঠিক হয়ে বসলেন।তারপর গলাটা পরিষ্কার করে বললেন
“আমার বড় নাতীকে আমি চিনি সে যা বলে তাই করবে।তবে যা সে সম্মান ক্ষুইয়ে করবে আমি চাই সেটা সম্মানের সাথেই করা হোক।তবে তার আগে আমার নাতনীরও মতামত নেয়া দরকার।কোথায় সে?”
তানভীর ভাইয়া আমাকে ইশারা করলেন বুবুকে নিয়ে আসতে।উত্তেজনায় আমার পা চলছেই না।তাড়াতাড়ি করে বুবুর রুমে গেলাম।হঠাৎ করে রুমে ঢোকায় বুবু কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।আজ একটা থ্রি-পিস পরেছে সানিয়া।দেখে মনেই হচ্ছে না সে এক বাচ্চার মা।সৃজা খুশিখুশি মুখে বললো
“নিচে চলো বুবু।তোমাকে ডাকছে।আর একটা অনুরোধ প্লিজ রাজী হয়ে যেও।”সানিয়া বিনিময়ে একটা মুচকি হাসি দিলো।
সিঁড়ির মাথায় এসে দাড়াতেই সকলের দৃষ্টি সানিয়ার উপর পরলো।নানু বললেন
” দিদিভাই আমার পাশে এসে বসো।”সানিয়া তার পাশে গিয়ে বসলো।
“আমি যা বলবো ঠিক করে শুনবে তারপর নিজের মত দিবে।তানভীর দাদুভাই তোমাকে বিয়ে করতে চায়।ছেলে হিসেবে সে লাখে একটা।কিন্তু সে শুধু তোমাকেই বিয়ে করবে বলছে।গত চার বছর কম মেয়ে দেখা হয়নি তার জন্য।সে শুধু এড়িয়ে গেছে।” কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন তিনি।তারপর আবারো বললেন
“বিয়ের আগে তোমাদের সম্পর্কটার ব্যাপারে আর কেউ না জানলেও আমি জানতাম।তানবীর দাদুভাই আমার কাছে আগেই তোমাকে চেয়েছিল।কিন্তু তুমি হুট করে ওর ওপর রাগ করে বিয়েটা করে ফেললে।তাই কিছু করারও ছিল না আমাদের।”
এই কথাগুলো শুনে যেনো মানুষগুলো আরো একবার অবাক হলো।তাইতো সানিয়াকে চায় তানভীর।এবার সবটা পানির মতো পরিষ্কার ঝকঝকে মনে হলো সবার কাছে।
“এবার বলো তোমার কি মত?তুমি চাইলে সময়ও নিতে পারো।”
তানভীর ভাইয়া নানুকে থামিয়ে দিয়ে বললো
“ও কি বলবে।আমি যা বলবো ও তাই করবে।কি রে বল তুই রাজী।শুধু মাথা নাড়ালেই হবে।তাহলেই সবাই বুঝে যাবে।”
তানভীরের সাথে যে সানিয়ার সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল তা তার চোখের আকুলতাই প্রকাশ করছে।সে সানিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।আর মনে প্রাণে চাইছে রাজী বলে দে।
সানিয়ার মন তখন দোটানায় ভুগছে।এই মানুষটাকে তো সে সত্যিই ভালোবাসে।অভিমান করেই তো কতকিছু হয়ে গেলো।এখন নাহয় তার কথাই সই।তানভীরের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে সানিয়া বললো
“আমি রাজী।আপনারা বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন।তবে কোনো আয়োজন হবে না।”তানভীরের মুখে হাসি ফুটলো।তানভীর ভাই সবার দিকে তাকিয়ে বললেন
” আমি চাই আগামিকালই বিয়েটা হোক।সানিয়ার কথামতো কোনো আয়োজন হবেনা।ও আমার জীবনসঙ্গী হবে এতেই আমি খুশি।”
মেয়ের মুখে ইতিবাচক উত্তর শুনে যেনো সানিয়ার মা এবং বাবা চাঁদ হাতে পেলো।ইমরান চৌধুরী বুকে জড়িয়ে ধরলেন তানভীর ভাইকে।চোখের কোনটা নিঃশব্দে মুছে উপরে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।সাফিয়া চৌধুরী ব্যস্ত হয়ে গেলেন তার হাতে সময় কম।মেয়ের গয়নাগুলো অন্তত কাউকে দিয়ে আনতে হবে।তিনিও ব্যস্তসমস্ত হয়ে মেয়ের মাথায় একটা চুমু খেয়ে উপরে চলে গেলেন।
এই আনন্দের মুহূর্তে সৃজা মিষ্টি নিয়ে এলো।বড় মামীর মুখটা শুধু মলিন।আর সবার মুখেই হাসি।সৃজা সেটা খেয়াল করলেও তার মাঝে ক্ষীন আশা আছে সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তীর বিষয় টিউলিপ বাবা ডাকতে পারবে কাউকে।সবাইকে থামিয়ে তানভীর ভাইয়া বললো
“আমি টিউলিপকে এডপ্ট নিবো।এবং কালই সব লিগ্যালি সাইন করবো।আশা করি কারো আপত্তি নেই।আর আপত্তি থাকলেও আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল।”
সানিয়া হয়তো এটা জানত।সে এ ব্যাপারে কিছুই বললো না।সানিয়া জানে সে তার বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে পাচ্ছে।তার সব সিদ্ধান্তই চিরকাল বেদবাক্য সানিয়ার জন্য।এই মুহূর্তে সানিয়া খুব করে ভাইটাকে মিস করছে।কোথায় সে?
সৃজার দিকে এগিয়ে গেলো সানিয়া।সৃজা খুশিতে তাকে জড়িয়ে ধরলো।আত্মহারা হয়ে সে বলেই ফেললো
“আমি খুব খুশি বুবু।” সানিয়াও মুচকি হাসি ফেরত দিলো।হয়তো এতোদিনের মেকি খোলস থেকে সে বেরিয়ে আসার রাস্তা পেয়েছে।
“সাফী কোথায়?ওকে দেখছি না কেনো?” সৃজা থতমত হয়ে গেলো।সেটাই তো এই খুশির দিনে তিনি কোথায়।সকালে যে বের হলো আর তো আসেনি।সৃজা আশ্বাস দিয়ে বললো
“তুমি ভেবো না বুবু।তোমার ভাই হয়তো ব্যস্ত আছে।আমার বিশ্বাস উনিই সবচেয়ে বেশি খুশি হবে।”
সাফওয়ান এলো একেবারে রাতে।বাড়িতে আজ অন্যরকম পরিবেশ বিরাজ করছে।কেমন আনন্দের আমেজ। দেরি না করে নিজের রুমে গেলো সাফওয়ান।সৃজা রুমে নেই।সেদিকে না তাকিয়ে আগে ফ্রেশ হতে গেলো।ফিরে এসেও সৃজাকে দেখল না।রুম থেকে বেরিয়ে এলো।এ রুম ও রুম করে খোজ লাগাল।নোভাদের রুমের সামনে এসেই থমকে গেল।
সৃজা তখন নোভাদের রুমে।দুবোন তাকে ধরেছে কাল কি পরবে তা ঠিক করে দিতে।গত দু ঘন্টা যাবত এটাই হচ্ছে।কাবার্ডের সব জামা কাপর বিছানায় নামানো তারপরও ঠিক করতে পারছেনা কোনটা পরবে।সৃজা অধৈর্য হয়ে মুখে হাত দিয়ে বসে আছে।এর মধ্যে দরজার দিকে চোখ গেলো।একি সাফওয়ান দাড়িয়ে আছে।কখন এলো উনি।সৃজা উঠে দাড়ালো
“আমি আসছি।তোমরা রাত ভরে ঠিক করো কোনটা পরবে।”
নোভা জাপটে ধরলো সৃজার হাত
“না বউমনি যেয়ো না।আগে জামা চয়েজ করে দাও।নাহলে কাল দেখবে একটা ফকিন্নি মার্কা জামা পরে আছি।”
সৃজা দরজার দিকে ইশারা করল।সেদিকে তাকিয়ে এমনি হাত ছেড়ে দিল নোভা।নাতাশা বললো
“তুমি যাও বউমনি। কালকেও ঠিক করে দিতে পারবে।”
হায় আল্লাহ এই মেয়ে বলে কি।সৃজা বেরিয়ে আসার আগেই সাফওয়ান ওদের ইশারা করে বললো
“নিজেদের জিনিস নিজেরা চয়েজ করবে এরপর থেকে।” সৃজার দিকে তাকিয়ে বললো
“তুমি রুমে চলো।”
নোভা আর নাতাশার মুখটা চুপসে গেলো।তার মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো।
সৃজাও অনুগত স্ত্রীর মতো সাফওয়ানের পিছু পিছু এলো।
চলবে…..