সৃজা পর্বঃ২০,২১

সৃজা
পর্বঃ২০,২১
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
পর্বঃ২০

আজ একটা নতুন সকাল শুরু হলো সৃজার জন্য।সবকিছুই তার জন্য নতুন।এই বেলকনিটা থেকে সূর্য দেখা যায় না যেমনটা সাফওয়ানের রুম থেকে দেখা যায়।তবুও এই রুমটা সৃজার পছন্দ।বেলকনির গাছগুলোতে পানি দিয়ে নিচে নামলো সে।

রান্নাঘরে গিয়ে কফির বক্সটা নামাতেই সৃজার শাশুড়ীর আগমন ঘটলো।সকালের নাস্তা কি হবে তাই বলতে এসেছে হয়তো।সৃজাকে কিচেনে দেখে কিছুটা অবাক হলেন।তবে মুখটা গোমড়া করেই রইলেন।অন্যদিন হলে বলতেন তুমি করছো কেনো?সেফকে বললেই হতো।তবে সৃজাও বলতো সামান্য কাজের জন্য তাকে না বলাই ভালো।আর তাছাড়া সৃজার নিজের কাজগুলো নিজের করতেই ভালো লাগে।এ বাড়িতে আসার পর কোনো কাজই তাকে করতে হয় না।

কাপের টুংটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে কিচেন থেকে।সাফওয়ান এক্সারসাইজ করতে যাবে।ফ্রিজ থেকে ওয়াটার বোতলটা নিতে গিয়ে কিচেনে চোখ পরলো তার।সৃজাকে কিচেনে দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেলো।এ পাঁচ বছর ওকে ছাড়া থাকার অভ্যাস করতে হবে।তাই এখন থেকেই নিজেকো সামলে নিচ্ছে।যদিও তার ভুলের কারনেই সৃজা তাকে এক প্রকার শাস্তি দিচ্ছে।তবুও এটাই বা কম কিসে, সবশেষেতো সৃজার ঠিকানা সাফওয়ানই।

নাস্তার টেবিলে নীরবতা ঠেলে ইমরান চৌধুরীর পিএস মো.কাদির এসেছে।তিনি মূলত সৃজার জন্যই এসেছেন।কিছু কাগজপত্র আছে যেগুলোতে সৃজার সাইন দরকার।আইএলটিএস করার জন্য আজকেই ফরম পূরণ করে পাঠাতে হবে।কাল থেকে ক্লাস করতে হবে।কাগজগুলো সাইন করে সৃজা উপরে চলে গেলো।পুরোটা সময় সাফওয়ান খাবারের দিকে মনোযোগ দিয়ে রেখেছিলো।

বিকেলের দিকে সৃজার জন্য রাখা স্যার আসলো পড়াতে।সৃজার খারাপ লাগলেও তাকে বললো আর পড়বেনা।সে বিদেশ যাবে পড়তে।মনে মনে ঠিক করে রাখলো কোর্স কমপ্লিট না করলেও বাবাকে বলে পুরো টাকাটাই স্যারকে দেয়ার কথা বলবে।স্যারের প্রতি সৃজার অন্যরকম এক মায়া জন্মেছে।তবে সেটা প্রণয়ের নয় ভাই-বোনের।সৃজার হয়তো ভাই নেই কিন্তু এই লোকটাকে ভাই বলতে তো সমস্যা নেই।

আমাদের মনের অজান্তেই কতজনের সাথে কতরকম সম্পর্ক গড়ে উঠে।সবই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।কারণ জীব সৃষ্টি করেছেন যিনি, মায়াও সৃষ্টি করেছেন তিনি।একটা মানুষ ভালো হোক আর মন্দ হোক একসাথে থাকতে থাকতে তার প্রতিও মায়া জন্মে যায়।এটা মানুষের স্বভাবজাত,বিশেষ করে মেয়েদের।মেয়েদেরকে সৃষ্টিকর্তা মায়া দিয়েই সৃষ্টি করেছেন হয়তো।

পরদিন সকালে সৃজা গাড়িতে করে কোচিং সেন্টারে পৌঁছালো।ড্রাইভার বলে গেলো সময়মতো এসে যেখানে দিয়ে গেছে সেখান থেকেই নিয়ে যাবে।আজ সৃজা শাড়ি পরেনি হালকা গোলাপি কালারের থ্রি-পিছ পরেছে,তবে তার মাঝে বৈবাহিক চিহ্ন হিসেবে শুধু নাকফুলটা রয়েছে।যদিও আজকাল সবাই ফ্যাশন হিসেবে এটা ইউজ করে থাকে।

অনেক খোজাখোজির পর নিজের কাঙ্ক্ষিত ক্লাসে ঢুকলো সৃজা।ক্লাসে ঢোকা মাত্রই সব নতুন মানুষের ভিরে নিজেকে অপরিচিত লাগছিলো সৃজার।দ্বিতীয় সারির একটা চেয়ারে গিয়ে বসলো সে।ক্লাসের বেশিরভাগ মেয়েই শার্ট জিন্স অথবা টপস জিন্স পরা।দেখেই মনে হচ্ছে তথাকথিত আধুনিকমনা ধনী ঘরের সন্তান।কিছু ছেলে রয়েছে যারা সৃজার দিকে তাকিয়ে রইলো।সৃজার মনে হলো হয়তো তার অন্যরকম বেশ-ভূষাই এর কারণ।কিন্তু কারণটা ছিলো ভিন্ন সৃজা যদি জানতো ছেলেগুলো তার রূপের প্রেমে পরেছে তাহলে হয়তো কখনোই তাদের দিকে তাকাতো না।

ক্লাস শেষ হতেই একটা ছেলে সৃজার পিছু পিছু আসা শুরু করলো।সৃজা প্রথমবার পিছনে তাকিয়ে কাউকে দেখলো না।দ্বিতীয়বার পিছনে তাকাতেই তার খুব নিকটে একটা ছেলেকে দেখলো।এতো কাছে হওয়ায় সৃজা কিছুটা পিছিয়ে গেলো।ছেলেটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো

“হাই আ’ম তামিম জোবায়ের।হোয়াট অ্যাবাউট ইউ?”

একেতো অপরিচিত, তার উপর সৃজাকে এক প্রকার ইচ্ছে করে ভয় দেখালো।সৃজার মনোক্ষুণ্ণ হলো এতে।নিজেকে ধাতস্থ করে বললো

“আপনার নাম জেনে আমি কি করবো?আর আমি অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলিনা।”

বলেই সৃজা চলে যাচ্ছিলো।ছেলেটা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো

“পরিচিত হওয়ার জন্যইতো এসেছি।এখানে কোথায় থাকো?”

সৃজা কথাগুলো না শোনার ভান করে সকালে বলা ড্রাইভারের নির্দিষ্ট স্থানে দাড়ালো।ছেলেটা সেখানেও দাড়িয়ে কথা বলতে চাইলো।সৃজা এড়িয়ে গেলো।তার অস্বস্তি হচ্ছিলো।পরিচিত গাড়িটা দেখতেই তাড়াহুড়ো করে উঠে পরলো।ড্রাইভারকে বললো

“চলুন চাচা।” পরক্ষণেই নিজের পাশের সিটে তাকিয়ে আরো অবাক হলো সে।পাশে সাফওয়ান বসা সে এক ধ্যানে তাকিয়ে রয়েছে সৃজার দিকে।অফিসিয়াল গেটআপে কোলে ল্যাপটপ রাখা সাফওয়ানের।কিছুটা জানালার দিকে সেটে বসলো সৃজা।

গাড়িটা ছাড়তেই পিছনে তাকিয়ে ছেলেটাকে দেখলো সাফওয়ান।সে এতক্ষণ খেয়াল করেছে,একটা ছেলে সৃজার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে।আর সৃজাও এড়িয়ে গেছে।তবে তা বুঝতে না দিয়ে বললো

“ছেলেটা কে?আর তোমার সাথে কথা বলছিলো কেনো?”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই সৃজা তেতে উঠলো দাতে দাত চেপে বললো

“আমার সাথে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করছিলো।কিন্তু ছেলেটা কে আপনি জেনে কি করবেন।নাকি সবাইকে নিজের মতো মনে করেন।” কথাটা কিছুটা আস্তেই বললো যাতে ড্রাইভারের কর্ণগোচর না হয়।

সাফওয়ান মাথার চুলে একবার হাত বুলিয়ে সৃজাকে বললো

“এক কথা বারবার বলো না।অযথা রাগিয়ে দিয়ো না।তবে এসব ছেলেপেলে থেকে একশো হাত দূরে থাকবে।”

সৃজা আর কথা বাড়ালো না।জানে কথা বললেই তার ডালপালা গজিয়ে এখানেই ঝগড়া শুরু হয়ে যাবে।তাই শান্ত থাকলো।তবে সাফওয়ান কিছুক্ষণ পর বললো

“তোমার হাতের চুড়ি কোথায়। দেখলে তো মনে হয় না বিবাহিত।এভাবে কি তুমি আমার থেকে দূরে যাওয়ার চিন্তা করছো?”কপাল কুচকে কতক্ষণ সৃজার দিকে তাকালো।

এই লোক বলে কি?মাথা খারাপ হয়ে গেছে।কোন কথা থেকে কোথায় যাচ্ছে।ওইদিন চুড়িগুলো খোলার পর আর পরা হয়নি।আর সে কিসব মনে করছে।মনে করলেই কি?এতে সৃজার কিছু আসে যায় না।সে নীরব থাকলো।

” কথা বলছো না কেনো?নাকি কাউকে পছন্দ হয়েছে আজ?ওই ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে তোমার?ওই ছেলেকে দেখলে মনে হয় একটা বখাটে,নিশ্চয় বাবা মায়ের থেকে টাকা নিয়ে নেশা ভান করে।এইসব ছেলে ভালো হয় না।”সাফওয়ান বোঝানোর চেষ্টা করছে সৃজাকে।

হায় আল্লাহ!!এই লোক কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে।তবে কথাগুলো শুনে সৃজার রাগ না হয়ে হাসি পাচ্ছে।কিন্তু এবার আর চুপ থাকতে পারলো না।

“আপনি চুপ করবেন?এসব কি বলছেন?আর আমি কি বুঝি না আমার জন্য কোনটা ভালো কোনটা খারাপ।”

সাফওয়ান বিরবিরিয়ে বললো

“তুমি সবই বুঝো শুধু আমাকে বুঝো না।”

সৃজা জিজ্ঞেস করলো

“কিছু বললেন।”

“বলার তো অনেক কিছুই ছিলো কিন্তু তুমিতো শুনবেনা।”
কথাটা বলেই আবার ল্যাপটপে টাইপিং করা শুরু করলো।বাসায় পৌছা মাত্র সৃজা তাড়াতাড়ি নেমে পরলো। সৃজার একটা কানের দুল সিটে পরে রইলো সৃজা জানতেও পারলো না।কিন্তু যে দ্বিতীয় ব্যক্তিটা দেখতে পেলো সে তা নিজের পকেটে পুরে রাখলো যত্ন সহকারে।

সৃজা বাসায় ঢুকতেই টিউলিপ তাকে জড়িয়ে ধরলো।

“কি হয়েছে আমার মাম্মাটার?”

টিউলিপ আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলো,সৃজা সেদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো।সে এখন আর খাবেনা।সার্ভেন্ট পাশে এসে বললো

“দেখুন না ম্যাম খেতে চাচ্ছেনা।”

“তুমি যাও।এখন আর খাওয়ানো লাগবেনা।টিউলিপ আজ আমার সাথে খাবে।”

টিউলিপকে সাথে নিয়েই উপরের দিকে পা বাড়ালো সে।সাফওয়ান দূরে দাড়িয়ে তা দেখলো।কত সহজেই সে এই বাচ্চাটার মায়ের জায়গা দখল করেছে।টিউলিপ তার মামানি বলতে পাগল।এই বাচ্চাটাকে রেখে সে অন্য কোথাও যাবে কিভাবে।ভাবনাদের ঠেলে সে নিজের রুমে গেলো।

ছেলেকে এসময় বাসায় দেখে সাফওয়ানের মা খুবই অবাক হলেন।তবে সেই সাথে খুশিও হলেন।আজ নিশ্চয়ই বাসায় খাবে তার ছেলে।তাড়াতাড়ি সবকিছু রেডি করতে গেলেন তিনি।

দেখতে দেখতে প্রায় এক মাস কেটে গেলো।এভাবেই সাফওয়ানের সাথে লুকোচুরি করে তার দিন কাটছে।তবে তার শাশুড়ী এখন পুরো স্বাভাবিক ব্যবহার করে।সাফওয়ান প্রায় দিনই ওকে আনতে যায়।আর ওই ছেলেটাও সৃজার সাথে কিছুদিন কথা বলার চেষ্টা করে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।

সৃজা এখন কোচিংএ যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে।সে সবসময়ই থ্রি পিছ পরে যায়।তবে সাফওয়ানের রাগের বশবর্তী হয়ে এখন হাতে চুড়িও পরতে হয়। এমন সময় দরজায় নক হলো।সৃজা অনুমতি দিলো আসার।একজন সার্ভেন্ট এসেছে।তড়িঘড়ি করে বললো

“ম্যাম বড় ম্যাম অসুস্থ হয়ে পরেছে আপনাকে ডাকছে।”

সৃজা কথাটা শোনামাত্র তার রুমে গেলো।দেখলো একজন সার্ভেন্ট ওনার লাগেজ গোছাচ্ছে আরেকজন তার মাথায় মালিশ করছে।বিধ্বস্ত অবস্থা তার।সৃজা যেয়ে তাকে ধরলো।বললো

“কি হয়েছে আম্মার?” সৃজার কথা শোনামাত্র তিনি হাতগুলো ধরে নিজের কাছে বসালেন।সৃজা,

“মা রেডি হয়ে নাও,গ্রামের বাড়ি যেতে হবে।আমার মায়ের অবস্থা বেশি ভালো না।বড় ভাই ফোন করে বললো,মা নাকি মৃত্যশয্যায়।”বলেই কাদঁতে লাগলেন।

কিছুক্ষণ পর আবার বললো

“মা বোধহয় এবার আমাদের ছেড়ে চলেই যাবে।সাফওয়ান আর ওর বউকে শেষবার দেখতে চায়।আমার সাফীটা তার চোখের মণি ছিলো।সাফওয়ানও তার নানীজানকে কম ভালোবাসেনা।”

সৃজা এই প্রথম ওনাকে কাদঁতে দেখলো।অবাক হলেও বুঝতে পারলো মায়ের জন্য সব সন্তানেরই আলাদা টান থাকে।সে টানেই উনি অসুস্থ হয়ে পরেছেন।মায়ের মৃত্যু সংবাদ সব সন্তানের জন্যই যেনো একটা অভিশাপ।

কথা না বাড়িয়ে রেডি হয়ে নিলাম।বাড়ির বউ হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করতেই হবে।টিউলিপও যাবে।ওর জামাকাপড় গুলোও গুছিয়ে নিলাম।টিউলিপ আনন্দে আছে সে ঘুরতে যাবে।বাচ্চারা আসলেই সিরিয়াস বিষয় বোঝে না,যার জন্য তারা সবচেয়ে আনন্দে সময় পাড় করতে পারে।

রেডি হয়ে নিচে নামার আগে সাফওয়ান ফোন দিলো।ওর কিছু ড্রেস গুছিয়ে নিতে বললো।সময়টা এমন যে না ও করা যায় না।সৃজা শাশুড়ীর কাছে এসে তাকে নিজে থেকে ধরে গাড়িতে উঠালো।টিউলিপ একপাশে আর শাশুড়ী একপাশে মাঝখানে সৃজা বসে আছে।সামনের সিটে সৃজার শ্বশুরমশায়।সানিয়া আর সাফওয়ান অফিস থেকেই একসাথে যাবে।অফিসের জরুরি কিছু নিয়ম আছে যেগুলো পালন করতেই হবে।মানুষ মরে যাচ্ছে তারপরও তাদের নিয়ম শেষ হয় না।কি হবে এসব নিয়ম মেনে।

চলবে…..

#সৃজা
পর্বঃ২১
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী

গ্রামের কাঁচা রাস্তায় যখন গাড়িটা ঢুকলো তখনই এক অন্যরকম অনুভূতি মনে হানা দিলো।একপাশে সৃজার শাশুড়ী ঘুমিয়ে আছে আরেক দিকে টিউলিপ তার গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।সৃজাই শুধু জেগে আছে।গ্রামের গাছগুলো যেনো সৃজার কত পরিচিত।দূরের ক্ষেতে কৃষক গরু দিয়ে হাল চাষ করছে,কিছু ক্ষেতে আবার ট্রাক্টর দিয়ে জমি চষা হচ্ছে।একই জায়গা অথচ বিস্তর পার্থক্য।

যেমন তার আর সাফওয়ানের মধ্যে কত পার্থক্য।অনেক দিক দিয়ে বিপরীতে তারা।কিন্তু মনটা কাছাকাছি।মনের কথা পাত্তা দিতে ইচ্ছে করে না আর।নিজেকে শক্ত হতে হবে তো।সামনে তো আরো খারাপ কিছু হতে পারে।কিংবা আরো ভালো কিছু।

মাটির নরম গন্ধ সৃজার ঈন্দ্রীয় সজাগ করলো।টিউলিপকে আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে ধরে জানালার পাশে বসলো।গ্রামের আকাশটা মেঘলা হয়ে গেলো হুট করে।হয়তো বৃষ্টি হবে।এই তো একটু আগের রোদে কৃষক ঘেমে একাকার হচ্ছিল এখনি আবার বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা হয়ে যাবে।

বৃষ্টি নামার আগেই বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামল।সৃজা লক্ষ্য করল গ্রামের সকল বাড়ি থেকে ভিন্ন এটা।পুরোনো প্রাসাদের মতো অনেকটা।দেখে মনে হচ্ছে কয়েকদিন আগে রং করা হয়েছে।বাড়ির লনের পাশের রাস্তায় গাড়িটা থামল।গেটের সামনে কিছু মহিলা বেড়িয়ে এসেছে।সামনে যে তিনজন মহিলা দাড়িয়ে তারা সকলেই প্রায় গয়নার দোকান।সৃজা বুঝতে পারছেনা এতো শোকাবহ পরিবেশেও তারা সেজেগুজে দাড়িয়ে আছে কেনো।

ধ্যান ভাঙলো ইমরান চৌধুরীর কথায়।

“সাফিয়া উঠো আমরা চলে এসেছি।”

ড্রাইভার এসে সৃজার পাশের দরজাটা খুলে দিল।অন্য পাশ থেকে সৃজার শাশুড়ী নামলো।টিউলিপকে কোলে নিয়েই বেরোলো।

গেটের সামনে আসতেই সৃজার শাশুড়ীকে ভিতরে ঢুকতে দিলেও সৃজাকে ঢুকতে দিলো না।তাকে বরন করা হবে এখন।এটা এ বাড়ির নিয়ম।নতুন বউ প্রথম বাড়িতে এলে এগুলো মানতেই হবে।সৃজা বুঝতে পারছেনা এরকম শোকাবহ একটা পরিবেশে তারা বধূবরণ নিয়ে পরে আছে কেনো?আর সে তো নতুন বউ না।বিয়ের তো অনেকদিনই হলো।ইমরান চৌধুরী বললেন

“এসব কি হচ্ছে?আমার বৌমাকে এখানে দাড় করিয়ে রেখেছো কেন?আর একন এসব করার প্রয়োজন কি?”

সেজেগুজে আসা বউদের মধ্যে একজন বললো

“ভাইজান আপনি এই মেয়েলি ব্যাপারে কিছু বইলেন না।মায়ের আদেশেই এসব হচ্ছে।মৃত্যু শয্যায় থেকেও নিয়মের হেলা করবেন না।এটা তো আপনি জানেনই।যদি সুস্থ হয়ে জানতে পারেন আপনার কথায় নিয়মের হেরফের হয়েছে তাহলে তুলকালাম হয়ে যাবে।”

ইমরান চৌধুরী অসন্তোষ মুখে বললেন

“ঠিক আছে যা করার করো তারাতারি।আর টিউলিপকে কেউ শুইয়ে দিয়ে আসো।বৌমা ওকে নিয়ে কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকবে।”

কথাটা বলতেই কিছু মানুষ দ্রুত টিউলিপকে নিয়ে ভেতরের দিকে হাটা দিলো।সৃজা দাড়িয়ে রইলো।ইমরান চৌধুরী ও ভিতরে গেলেন।সৃজা এখনও দাড়িয়ে আছে।সাফওয়ান আসলে একসাথে বরণ করবে ততক্ষণ তাকে এখানেই থাকতে হবে।এমনিতেই জার্নি করে ক্লান্ত লাগছে তারউপর এসব আর নিতে পারছে না সৃজা।মানুষগুলোর মধ্যে গুঞ্জন হচ্ছে সৃজাকে নিয়ে।একজন মহিলা বললেন

“বাহ!আমাদের সাফীর বউ তো পরীর মতো সুন্দর।”

আরেকজন বললো

“না বুবু, পরীর থেকেও বেশি সুন্দর।কিন্তু এতো শুকনো কেনো।”

তার কথায় বাগড়া দিয়ে একজন বললো
“তো কি তোর মতো মুটি হবে।” উপস্থিত মানুষের মধ্যে হাসির রোল পরে গেলো।

তাদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম এই তিনজন সাফওয়ানের মামানি।আর পাশে একজন কাজের লোকের হাতে মিষ্টি ও পানি আরেকজনের হাতে ধান,দূর্বা।সাফওয়ানের কয়েকজন কাজিনের সাথে বাইরের মানুষও আছে।

ভিরের মধ্যে কে একজন বললো”এই নতুন বউকে একটা চেয়ার এনে দে।”

সাথে সাথে একজন একটা চেয়ার এনে দিল বসার জন্য।সৃজা আর অপেক্ষা করল না।বসে রইল।কিছুক্ষণ পরই সাফওয়ানের গাড়িটা এলো।সাফওয়ানের কাজিনদের একজন বললো সানিয়া আপুও এসেছে। বুবু আগে বেরিয়ে আসলো।সাফওয়ান গাড়ি পার্ক করতে গেছে।বুবু আমাকে বাইরে বসা দেখে কিছুটা অবাক হলো।রেগে গিয়ে বললেন

“হোয়াট দ্য হেল,এখানে কি হচ্ছে? বড় মামানি,মেজো মামানি,ছোট মামানি তোমাদের কি কান্ডজ্ঞান নেই?”

“কেনো কি হয়েছে মা?সানিয়া মা তুমি বোধহয় সফর করে ক্লান্ত হয়ে গেছো যাও উপরে যেয়ে জিরিয়ে নাও।”

“আপনারা আমার কথা ভাবছেন অথচ আমার একমাত্র ভাইয়ের বউ আধা ঘন্টা আগে এখানে এসে ভিতরে ঢুকতে পারেনি।সেটা খেয়াল করেন নি?”

সবার মুখটা দেখার মতো হলো।বড় মামানি বুবুকে আবারও একি কথা বলে উপরে পাঠালেন।বললেন

“এখনি সব নিয়ম শেষ করে নতুন বউকে উপরে পাঠাবো।মা তুমি রাগ করো না।সাফী বাবা তো এসে পরেছে।”

অগত্যা সানিয়া রাগে লাল হয়েই উপরে চলে গেলো।সাফওয়ান গাড়ি পার্ক করে এলো।তার মুখটা থমথমে।এখানে কি হচ্ছে তা নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই।তাদের বরণ করার নিয়ম শুরু হলো।আমাদের দুজনকে একটা পাথরের সমতল শীলে দাড় করালো।তারপর তেল দূর্বা মাথায় দিয়ে কি যেনো পরল।এরপর মিষ্টিমুখ করে বললো

“এবার বউকে নিয়ে ভিতরে যাও বাবা।” সাফওয়ান সবার সামনেই আমার হাতটা ধরে নিয়ে আসলেন।পেছন থেকে কেউ একজন বললো বউ পাগলা।সত্যিই কি তাই???

সাফওয়ান আমাকে নিয়ে সরাসরি নানুর রুমে এলো।নানুর চারপাশে কতজন মুরুব্বি বসে আছে।রুমে ঢুকে সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিলাম।সকলেই সালামের উত্তর দিলেন।

আম্মা নানুর একহাত ধরে বসে চোখের জল ফেলছেন।সাফওয়ান আমাকে নিয়ে তার কাছাকাছি বসলো।আম্মা আমাদের দেখলেন তারপর বললেন

“মা দেখ তোমার সাফী এসেছে ওর বউকে নিয়ে।”

নানু পিটপিট করে তার চোখ খুললেন।এত ফর্সা শরীরে চোখগুলো খরগোশের চোখের মতো মনে হচ্ছে।পাপড়িগুলো সাদা,ভিতরটা হালকা লাল।আমার কিছুটা ভয় লাগল।কেনো জানিনা সাফওয়ানের হাতটা দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ধরলাম।তিনি আমাকে ইশারায় কাছে ডাকছেন।আমি গিয়ে পাশে বসলাম।আস্তে আস্তে কিছু বলছেন কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারছিনা।দেখে মনে হচ্ছে চোয়ালের অধিকাংশ দাতই পরে গেছে।ডাক্তার পাশেই ছিলেন।উনি পালস চেক করলেন।বললেন

“চিন্তা করার কিছু নেই।এ যাত্রায় রক্ষা।তবে সাবধানে থাকতে হবে।মাথার চোটটা গুরুতর।তবে ঠিক হয়ে যাবে, শুধু সময় লাগবে।”

সবাই যেনো হাফ ছেড়ে বাচল।নানুমনি বাথরুমে পরে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছিল।তখন নাকি অবস্থা অনেক খারাপ ছিল।ডাক্তার বললো

“এখন ওনার ঘরে শুধু প্রয়োজনীয় একজনকে রেখে সবাই বাইরে যান।ওনার রেষ্টের প্রয়োজন।”

সাফওয়ান নানুমনির হাতটা ধরে চুমু দিলো।তারপর বললো

“তুমি সুস্থ হয়ে যাও নানীজান।তোমার সাফী তোমার কাছে এসেছে।দেখ তোমার নাতবউ সৃজাও এসেছে।তুমি আনন্দ করবেনা?তোমাকে বিছানায় ভালো লাগে না নানীজান।”

কতক্ষণ নীরব থাকার পর সাফওয়ান উঠল।সবাই একে একে চলে গেছে।বুবু দূরে দাড়িয়ে ছিল তার চোখেও জল দেখতে পেলাম।আমাকে নিয়ে সাফওয়ান বেরিয়ে এল।

দোতলার নানুমনির রুমের বিপরীত দিকের কর্ণারের একটা রুমে সাফওয়ান আর আমাকে থাকতে দিয়েছে।এখানে এক রুমেি থাকতে হবে আমাদের।তাদের তো আর বলা যায় না “আমার স্বামীকে আমি শাস্তি দিয়েছি তাই এখন আমি অন্য রুমে থাকবো।আমাকে আরেকটা রুম দিন।”

এ রুমে বেলকনি নেই।সাফওয়ান ওয়াশরুমে।আমার লাগেজটা এ রুমে নেই।কাকে বলবো দিয়ে যাওয়ার কথা।কাউকে তো চিনিও না।একটু বাইরে গিয়ে আবার চলে আসলাম।একটু পর একজন মেয়ে আসলো হাতের ট্রেতে শরবতের দুটি গ্লাস।পড়নে লাল টকটকে থ্রি পিছ।মাথায় দুই পাশে দুইটা বিনুনি।পাশের টেবিলের উপর ট্রেটা রেখে আঙ্গুলে ওরনার প্রান্ত পেচাতে পেচাতে সৃজাকে বললো

“বড় আপা কইছে আপনার কোনো প্রয়োজন লাগলে আমারে কইতে।” বলেই আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড় দিল।আবার মিনিটের মধ্যেই দৌড়ে ভিতরে ঢুকলো বললো

“আপনারে তো আমার নামি কই নাই।তাইলে ডাক দিবেন কি কইয়া।আমার নাম তুলি।তু কইলেই আমি হাজির।”

সৃজা ভেবেচিন্তে বললো

“তো তুলি আপাতত আমার লাগেজটা এ রুমে দিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”

“এইডা কইতে আমি এখনি নিয়া আসতাছি।”বলেই আবার দৌড় দিল।

মাথার চুলগুলো খুলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চিরুনি করছি এমন সময় সাফওয়ান বের হলো।এই লোক এখানে এসেও শুধু তোয়ালে পরে বেরিয়েছে।কোনো লজ্জা নেই।এটা কি শহর যে সবাই নক করে ভিতরে ঢুকবে।অসহ্য!!

সৃজার পেছনে এসে দাড়ালো সাফওয়ান।চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেলছে।সৃজা আড়চোখে আয়নাতে তাকালো।এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে দরজাটা লাগিয়ে দিল সৃজা।সাফওয়ান অবাক হলো না কারণ সে জানে সৃজা কেন এমন করল।দরজার সামনে দাড়িয়েই বললো

” যান চেঞ্জ করে আসুন।এটা কি শহর নাকি যে যখন তখন এভাবে বেরোবেন।যান বলছি।”সাফওয়ান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সৃজার দিকে।সৃজার দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরছে।সাফওয়ান এক পা এক পা করে বাইরে থেকে আওয়াজ এলো”ম্যাডাম আপনার লাকেজ নিয়া আইছি।দরজা খোলেন।”

সাফওয়ান অগত্যা উল্টো ঘুরে জামা কাপর নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।সৃজা দরজা খুলে দিলো।লাগেজটা নিয়ে তুলিকে বিদায় দিল।মেয়েটা বেশি কথা বলে।সাফওয়ান একটা ব্লুু কালার পোলো শার্ট আর জিন্স পরে বের হলো।আমাকে বললো

“যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।নিশ্চয়ই ক্লান্ত।শাওয়ার নিয়ে ঘুম দিবে।আমি একটু বাইরে যাবো।”

…………….

“আর হ্যা তার আগে খেয়ে নিবে।আমি বলে যাচ্ছি খাবার পাঠাতে।” বলে দ্রুত পায়ে চলে গেল।

সৃজার ইচ্ছে করল একবার জানতে কোথায় যাচ্ছে কিন্তু পরক্ষণে থমতমে মুখে একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।এখানে থাকাকালীন শাড়ি পরতে হবে।

গোসল করে এসে ভেজা তোয়ালেটা মাথায় রেখেই সৃজা ঘুমিয়ে পরলো।তার প্রচন্ড ঘুম পেয়েছে।টেবিলের উপর খাবার রাখা তাও খেয়াল করেনি।

“আমার দেখার রেখা তোমাতে সীমাবদ্ধ
আমার জানার জ্ঞান তোমাতেই সমাপ্ত”
সৃজার ঘুমন্ত মুখের উপর ঝুকে কেউ এই কথাগুলো বলছে।সৃজা অবচেতন মনে বুঝতে পারলেও লোকটিকে অচেতন মনেই জড়িয়ে ধরে আরো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।

সাফওয়ান রুমে ঢুকে খাবারের প্লেটটা দেখে রেগে গিয়ে সৃজাকে কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারেনি।সৃজার দিকে তাকিয়েই মনটা নরম হয়ে গেলো।চুলের তোয়ালেটা ধীরে ধীরে খুলে দিল।সৃজার পাশে শুয়ে কতক্ষণ ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো।সাফওয়ানের মনে হচ্ছে প্রেয়সীর ঘুমন্ত মুখটা দেখে তার মনটা কবিত্বময় হয়ে যাচ্ছে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here