সৃজা
পর্বঃ১৮,১৯
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
পর্বঃ১৮
গত দুদিন ধরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে।বর্ষার শুরু এখন।ইট-পাথরের এ দালানে বৃষ্টি ও যেনো কৃত্রিম।তা সৃজার মন ছুয়ে দিচ্ছে না।গ্রামে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দকে খুব মনে পরছে সৃজার।ছোট বেলায় মা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তাকে কত ছড়া শোনাতো।বাদলের মেঘলা আকাশ পরিষ্কার হওয়ার আগেই জীবিকার টানে মাঝিরা বেরিয়ে পরতো নৌকা চালাতে।গ্রামের অনতিদূরের নদীর স্রোতে নৌকা ভাসিয়ে মাঝি গেয়ে উঠতো’পাগল হইয়া বন্ধু পাগল বানাইলো……’…
বাড়ির সামনের কদম গাছটায় প্রতিবছর কত ফুল হতো।এখনো নিশ্চয় টিনের চালের সে শব্দটা আছে,কদম গাছেও নিশ্চয় ফুল ফুটেছে কিন্তু সৃজাই শুধু প্রতিবছরের ন্যায় দেখতে পেলো না।সব একই আছে শুধু ভিন্নতা এসেছে সৃজার মাঝে।সৃজার জীবনটা বদলে গেছে।বিয়ের পর সব মেয়ের জীবনই বদলে যায়,এটা অমোঘ সত্য।
যেখানে বেশিরভাগ মানুষের প্রিয় ঋতু বসন্ত সেখানে বর্ষা সৃজার প্রিয় ঋতু।প্রথমবার প্রিয় ঋতুর রচনায় সে এটাই লিখেছিলো। প্রায় সময় তার বান্ধুবীরা বলতো তুই তো রোমান্টিক না তাহলে বৃষ্টি এতো পছন্দ কেনো।তখন সৃজা বলতো কেনো বৃষ্টির সাথে রোমান্টিকতার কি সম্পর্ক।তখন তারাও আর কথা বলতো না।তর্ক করে সৃজাকে অসন্তুষ্ট করতে চাইতো না তারা।সৃজাকে সেসব কথা বললেও শুনতো না।
হায় সৃজার মনে পরে গেলো তার তো ইচ্ছে ছিলো তার স্বামীর সাথে বৃষ্টিতে ভিজবে, তাকে তার মনের কথা বলবে।মনে মনে আওড়ালো—
“এমন দিনে তারে বলা যায়,এমন ঘনঘোর বরষায়
এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরঝরে তপনহীন ঘন তমসায়।”
কই এমনতো হলো না সৃজার সাথে।কথা বলার আগেই তো সব ফুরিয়ে গেলো।সে সময়টা তো আর আসবেনা।বিয়ে হলো ঠিকই,বৃষ্টিও আসলো কিন্তু স্বামীর সাথে বৃষ্টিবিলাস করার সাধ তো পূর্ণ হলো না।
সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে।সকালের নাস্তাটা করেই সৃজার উদাস মন বৃষ্টি বিলাস করতে চাইলো।কিন্তু রুম থেকে বের হয়ে ছাদে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তার।ছাদে গেলেই হয়তো সাফওয়ানের সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।যদিও সাফওয়ান এখন অফিসে।তাই বেলকনিতে দাড়িয়েই ভিজছে।বৃষ্টিতে ভিজতে সৃজার যারপরনাই আনন্দ হতো।এই বৃষ্টিতে ভেজার জন্য কত বকাই না খেতে হয়েছে তাকে।তবুও সে গায়ে মাখতো না। নিজের ইচ্ছে মতো ভিজতো।
মনে পরে একবার স্কুল থেকে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরছিলো।স্কুল ছুটি হওয়ার পরপরই বৃষ্টি শুরু হয়।সৃজাও আর নিজেকে সামলাতে পারছিলো না তাই বাসার পথে ভিজতে ভিজতেই রওয়ানা দিলো।পরনের জামা কাপর সবই ভিজে গিয়েছিলো সেদিন।সৃজার সাথে সঙ্গী হয়েছিলো তার কতগুলো বান্ধুবী।যদিও তারা নামেই বান্ধুবী ছিলো।
সেদিন দুঃসাহস দেখিয়েছিলো একটা ছেলে।সৃজার হাতে মাঝ রাস্তায় কদম ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলো-ভালোবাসি সুন্দরী।প্রথমদিকে কিছুটা অবাক হলেও যখন বুঝতে পারলো তখন সৃজার সে কি রাগ।একটা চড় মেরে বসেছিলো।সাথে সাথে ছেলেটির এক কাজিন এসে বলেছিলো ও শহর থেকে এসেছে। এ গ্রামে নতুন তাই না বুঝে বলে ফেলেছে।সৃজাও তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলো।
বেলকনিতে দাড়িয়ে সেসব কথাই ভাবছিলো সে।দিনগুলো কতো সুন্দর ছিলো।কোনো চিন্তা ছিলো না, ভালোবাসা -বাসীর কোনো দায় ছিলো না।কারো মায়ায় জড়ানো উচিত না।সে মায়া ছাড়াতে কষ্ট হয়।নিজের দ্বারা তা উপলব্ধি করছে সৃজা।সে সবকিছুই পেয়েছে চাওয়ার থেকেও বেশি তাহলে স্বামীটা কেনো মন মতো হলো না।এ ভাবনায় তার দিন যায়।
সৃজার শাশুড়ী সবই জানে।তবে তিনি স্বামী স্ত্রীর ব্যাপারে কিছু বলবেন না।তার ভাবনা হয়তো ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।সৃজাকেও কিছু বলনি।এক্ষেত্রে সৃজা পূর্ণ স্বাধীন,শ্বশুরবাড়ি থাকলেও তাকে জোর করার স্বাধীনতা কারো নেই।তাছাড়া সাফওয়ানও বলেছে ও যা করতে চায় তাই করতে দাও।কিন্তু এ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে যেনো না পারে।
বৃষ্টির ছিটায় তার শরীর ভিজে যাচ্ছে।শাড়ির উপরের দিকটা ভিজে লেপ্টে রয়েছে তার গায়ে।কিছুটা ঠান্ডাও লাগছে তবুও সরছে না সে।ঠান্ডার থেকে বেশি ভাবনাগুলো ঝেকে ধরেছে তাকে।
আজ তিন দিন হলো সে সাফওয়ানের রুমে থাকে না।সেদিন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে এ রুমে চলে এসেছে।সাফওয়ান ঘুমিয়ে ছিলো বিধায় বুঝতে পারেনি।ঘুম থেকে উঠে সৃজাকে হন্নে হয়ে খুজেছে।পরে সৃজাই সার্ভেন্টকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে সে এ রুমে থাকবে।পরে সাফওয়ান কিছুটা শান্ত হয়েছে।
এর মধ্যে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার সব চেষ্টাই করেছে সৃজা।স্টাডি রুমের পাশের রুমটা নিজের করে নিয়েছে।সারাদিন শুধু বইয়ের মধ্যে মুখ গুজে থাকে।যদিও পড়াশোনা তেমন হয় না।সকালে সাফওয়ান চলে গেলে রুম থেকে বের হয়।রাতে সাফওয়ান ফেরার আগেই নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়।
সাফওয়ান সবটাই বুঝতে পারে।হয়তো সে যে শাস্তি দেয়ার কথা বলেছিলো সেটি নিচ্ছে সৃজা।এ শাস্তি তার প্রাপ্য এটা ভেবেই সৃজাকে জোর করেনি এ রুমে থাকতে।
তবুও প্রেয়সীর মুখটা একবার দেখার জন্য ছটফট করে সাফওয়ান।আগে প্রতিদিন সকালে সৃজা বাগানে হাটতো আর বেলকনিতে থেকে সাফওয়ান তা দেখতো।যখন সৃজা ফুল তুলতো ওর মনে হতো সৃজা নিজেই তো একটা লাল টকটকে শুভ্র ফুল তাহলে তার ফুলের কি দরকার।কিন্তু এখন তাকে বাড়িতে কোথাও দেখা যায় না।সে এ বাড়িতে থাকলেও না থাকার মতোই অনেকটা।
প্রথমদিন রাতে সৃজার রুমের সামনে গিয়ে ফিরে এসেছে সাফওয়ান।গতকাল রাতে মৃদু নক করেছিলো দরজায়।কিন্তু সৃজা দরজা খুলেনি।একা একা তার কিছুতেই ঘুম আসে না।সারারাত নিকোটিনের ধোঁয়ায় নিজের একাকিত্ব বিলিয়ে দেয়।মেয়েটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
যদি দরজার ওপাশে সে দেখতে পেতো তাহলে হয়তো বুঝতো তার অর্ধাঙ্গিনীও তাকে ভেবে ভেবেই রাত পার করে।দরজার ওপাশে তার ছায়া দেখলে মনে এক প্রকার শান্তি পায়।প্রথমদিন নক না করলেও সৃজা বুঝেছিলো সাফওয়ান এসেছে।দ্বিতীয়দিন দরজায় নক করার আওয়াজ সৃজার বুকে গিয়ে লাগছিলো।কিন্তু যখনই সেই বিদঘুটে ভাবনাগুলো সৃজার মনে পরে তখনই সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়।সে পারে না সাফওয়ানকে ক্ষমা করতে।কিভাবে ক্ষমা করবে সে এগুলো।সে তো ভুলতে পারেনা ওই দৃশ্যগুলো।
আজ সাফওয়ান ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে।কোনো জরুরী প্রয়োজন না থাকায় আজ সে বাড়িতেই থাকবে।হয়তো বাড়িতে থাকলে একসময় সৃজার দেখা পাবে।তার তৃষ্ণার্ত মনটা যে সৃজাকে দেখতে চায়।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।এক কাপ কফির জন্য সে সার্ভেন্টকে বলে যাওয়ার সময় সৃজার রুমেও উকি দিতে মন চাইলো।সৃজার রুমের দরজাটা আজ খোলা।দরজার সামনে এসে দেখলো সৃজা রুমে নেই।বিছানায় বই পত্রের ছড়াছড়ি।একটা খাতা মেঝেতে পরে আছে।রুমের আর সবকিছু পরিপাটি আছে।
রুমে ঢুকে বেলকনির দিকে চোখ চলে গেলো সাফওয়ানের, এতক্ষণে কাঙ্খিত মানুষটিকে দেখতে পেলো সে।তার দৃষ্টিতে কোনো অতিসুন্দরী কামিনী বৃষ্টি স্নান করছে।মৃদু পায়ে এগিয়ে গেলো তার পানে।
বেলকনির কাছে যেতেই দেখলো সৃজা একমনে বৃষ্টিতে ভিজছে।তার কোনো নরচর নেই।এক জায়গায় দাড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে।হয়তো গভীর ভাবনায় মত্ত।
কিছুক্ষণ বাদেই সাফওয়ানের তৃষ্ণার্ত মন সৃজাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলো।তাকিয়ে থাকতেই তার দম বন্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। সৃজার কোমরের কাছে শাড়িটা ভিজে লেপ্টে রয়েছে।ঘারে বৃষ্টির পানির ফোটা মুক্তোর দানার মতো চিকচিক করছে।সেগুলো গরিয়ে আবার সৃজার গলার গহীনে হারিয়ে যাচ্ছে।সৃজার উন্মুক্ত গলা,কোমর সব তাকে কাছে টানছে।কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে সে।নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না সাফওয়ান।
হঠাৎ কোমড়ের খোলা অংশটায় কারো উষ্ণ হাতের ছোঁয়া পেতেই কেপে উঠলো সৃজা।হাতটা ধীরে ধীরে তার নাভীর কাছে এসে শক্ত করে আকড়ে ধরলো।পেছনে ফেরার সাহস হচ্ছে না সৃজার। ক্রমাগত তার নিঃশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সে।
সৃজা বুঝতে পারছে এটা সাফওয়ান।সে আজ দরজা লাগায়নি নিচ থেকে আসার পর।আর এসময় সাফওয়ান স্বভাবত অফিসে থাকে।সাফওয়ান আজ বাসায় আছে সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।তাহলে ভুলেও দরজাটা খোলা রাখতো না।
সাফওয়ানের উষ্ণতা সৃজার মাঝে সঞ্চার হচ্ছে।ওর স্পর্শ গভীর থেকে গভীর হচ্ছে।সৃজা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না পেছন ফেরে সাফওয়ানকে জড়িয়ে ধরলো।সাফওয়ানের অনুভূতি যেনো আশকারা পেলো।সৃজার গলা, ঘারে নিজের অধরের ছোঁয়া দিচ্ছে।কখনো গভীর তো কখনো মৃদুভাবে।সৃজা কেপে কেপে উঠছে প্রতিটা স্পর্শে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সৃজা নিজের মধ্যে ফিরে এলো।যেসব ভাবনা তাকে সাফওয়ান থেকে দূরে রাখে সেগুলোই যেনো নতুন করে উদয় হলো।মনটা তেতো হয়ে উঠলো।সৃজা এক ধাক্কায় সাফওয়ানকে সরিয়ে দিলো।
সাফওয়ান ধাক্কা খেয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলো।সৃজা অগ্নি চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।সাফওয়ান অনেকটা অবাক হলো।এইতো সে মনে করেছিলো সৃজা বুঝি এবার সবটা মেনে নিয়ে আগের মতো হয়ে যাবে।সৃজার দিকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করতেই।সৃজা চেচিয়ে বললো
“মেয়ে শরীর থেকে বেশিদিন দূরে থাকতে পারেন না বুঝি?তাই শরীরের ক্ষুদা মেটাতে আমার কাছে এসেছেন।কেনো বাইরে,অফিসে যারা ছিলো তারা এখন সুখ দেয়না।” কথাগুলো বলছে আর থরথর করে কাপছে সৃজা।
সৃজার কথাগুলো সাফওয়ানের মনের যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিলো।সাথে রাগটাও ঝেকে ধরলো তাকে…..
চলবে…….
#সৃজা
পর্বঃ১৯
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে সৃজার সামনেই দেয়ালে পরপর কয়েকবার ঘুষি মারলো।এতে সৃজার কিছুটা ভয় লাগলো।থামাতে চাইলো তবে অদৃশ্য এক শক্তি তাকে আটকে রাখলো।বৃষ্টির শব্দের মধ্যেও ঘুষি দেয়ার শব্দগুলো শোনা যাচ্ছিলো।
কিছুক্ষণ পর সৃজার দিকে চাইলো সাফওয়ান।ঠান্ডা গলায় বললো
“তোমার এমন কেনো মনে হচ্ছে আমি শুধু তোমার শরীরটাকে চাই,আমি তো সম্পূর্ণ তুমিটাকে চাই।তুমি কেনো বুঝোনা।” করুণ দৃষ্টিতে সৃজার দিকে তাকালো।বা হাত থেকে টপটপ করে রক্ত পরছে।মেঝেতে পরে বৃষ্টির পানির সাথে মিশে যাচ্ছে সে রক্ত।বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়ে মাঝে মাঝে বজ্রপাত হচ্ছে।কিন্তু তা এই মানব মানবীর মাঝে বিস্ময় জাগাচ্ছে না।
সৃজা এগোলো না, বরং কিছুটা পিছিয়ে গেলো।আর দূর্বল হবে না সে।অনেক বোকামি করেছে এ কদিন।যদিও তার বুকের ভেতরটা রক্তাক্ত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষনে তবুও সে তা বাইরে প্রকাশ করবেনা।
সাফওয়ান আবারো বললো
“তুমি আমার সাথে এক রুমে থাকতে চাওনি,মেনে নিয়েছি সেটা।কিন্তু লুকিয়ে থাকছো কেনো।তোমাকে না দেখলে তো ভালো লাগে না।বুকের দিকে হাত দিয়ে বললো” It hurts,it realy hurts।”
সৃজা মুখ ফিরিয়ে নিজের অশ্রু লুকালো।এই লোকটা আবার নাটক করছে।আর ভুলবেনা সে এসব কথায়।
“ঠিক আছে তোমার অনুমতি ছাড়া আর কখনো তোমাকে ছুবো না।এবার রুমে চলো।এখানে কেনো পরে আছো?” বলেই এগিয়ে গিয়ে সৃজার হাতটা ধরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলো।
সৃজা ঠায় দাড়িয়ে রইলো।হাতটা দুহাতে ছাড়িয়ে নিলো।কন্ঠে জোর এনেই বললো
“আপনি বলেছিলেন ডিভোর্স ছাড়া যেকোনো শাস্তি মঞ্জুর আপনার।”
সাফওয়ান অবাক হয়ে তাকালো সৃজার দিকে।তার চোখে,মুখে আড়ষ্টভাব নেই,পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে।বৃষ্টির পানিতে অনেকক্ষণ ভেজার কারণে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।আর কি শাস্তি দিবে তাকে!!এটাই কি বেশি নয়।দুদিন ধরে সে অন্য রুমে আছে।না দেখা দিচ্ছে, না কথা বলছে।মুখটা স্বাভাবিক করে বললো
“কি বলতে চাও তুমি?”
“আজ বাবা বাসায় এলেই শুনবেন।এ বাড়ির প্রধান যিনি তার সামনেই বলবো।অপেক্ষা করুন।” কথাটা বলে সাফওয়ানকে মারিয়ে রুমে ঢুকলো।রুমেই এসেই কি যেনো খুজতে লাগলো।
সাফওয়ান চলেই যাচ্ছিলো।সৃজা হাতটা ধরে আটকে দিলো।বিছানায় বসিয়ে হাতে ড্রেসিং করে দিলো।সৃজা আপনমনে সাফওয়ানকে কতক্ষণ বকে গেলো।নিজে ভিজা কাপরে আছে সেদিকে তার খেয়াল নেই।মেঝেটাও ভিজে গেছে।সাফওয়ান পুরোটা সময় সৃজার দিকে তাকিয়ে রইলো।
সরতে গিয়ে ভিজা মেজেতে পরতে চলেছিলো সৃজা।কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিলো।সাফওয়ান কাছে আসার আগেই বললো
“আমি ঠিক আছি।এবার নিজের রুমে যান।”কথাটা বলেই গটগট পায়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।সাফওয়ান কতক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলো।
অগত্যা সাফওয়ানকে উঠতে হলো।কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে এ রুমে বেধে রাখছে কিন্তু তাকে যেতে হবে।নাহলে সৃজাই হয়তো এ রুম ছেড়ে দিবে।ফোস করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে রুম ত্যাগ করলো সাফওয়ান।
যাওয়ার সময় সার্ভেন্টকে বলে গেলো সৃজার রুম পরিষ্কার করে দিয়ে আসতে।রুমে বৃষ্টির পানি ছড়িয়ে রয়েছে।
ড্রয়িং রুমে পিন পতন নীরবতা বিরাজ করছে।সৃজার শাশুড়ী আর শ্বশুর সোফায় বসে আছে।সাফওয়ানও আরেক পাশের সোফায় বসে আছে।সানিয়াকে থাকতে বললেও কাজের অজুহাতে সে আসেনি এখনো।নীরবতা ভেঙে ইমরান চৌধুরী বললেন
“কি বলতে চাও বলো বউমা?”
সৃজা স্বাভাবিকভাবেই বললো
“আমি গ্রাজুয়েশন করতে বিদেশ যেতে চাই।এ বাড়ির সব ছেলে-মেয়েই বিদেশে পড়েছে।তাই আমারও ইচ্ছা চৌধুরী বাড়ির বউ হিসেবে আমিও বিদেশে পড়বো।”
সাফওয়ান অবাক হয়ে সৃজার দিকে তাকিয়ে রইলো।কিছুটা জোরেই বললো
“কোথাও যাবে না তুমি।বাংলাদেশে পড়তে হলে পড়বে আর না হয় পড়ার দরকার নেই।”
সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে ইমরান চৌধুরী বললেন
“তুমি চুপ থাকলেই ভালো হবে।আমাকে কথা বলতে দাও।আর আমার মনে হয় না বউমা ভুল কিছু দাবী করেছে।”
বাবার কথায় কিছুটা দমে গেলো সাফওয়ান।
সৃজার শাশুড়ীও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।ইমরান চৌধুরী ট্রে থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে একটা চুমুক দিলেন তারপর বললেন
“তোমার শাশুড়ী চেয়েছিলো তুমি বাংলাদেশের কোনো রেপুটেড ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নাও।কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিলো তুমিও অ্যাব্রোডে পড়ো।”
সৃজার শাশুড়ী মাঝখান থেকে বললেন
“সৃজা এ বাড়ির বউ তাই আমার মনে হয় ওর এখানে থেকেই পড়া উচিৎ। দূরে যাওয়ার কি প্রয়োজন,আমি বুঝতে পারছিনা।”
ইমরান চৌধুরী বললেন
“তুমি খুব ভালো করেই জানো এ বাড়ির ছেলে-মেয়ে আর বউদের মধ্যে কোনো পার্থক্য কখনোই করা হয়নি।তাই সে হিসেবে সৃজার ইচ্ছে পূরণ হবে।”
কথাটা শোনামাত্র এক প্রকার রাগ করেই সাফওয়ান ড্রয়িং রুম ত্যাগ করলো।তাহলে এই শাস্তিই দিতে চেয়েছিলো সৃজা তাকে।
আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিলেন তিনি।বললেন
“কয়েকদিন পর সাফওয়ান আর তোমাকেই সব সামলাতে হবে তাই সে অনুযায়ী তোমার যোগ্যতাও অর্জন করা দরকার।”
“তুমি নিজে থেকে কথাটা বলায় আমি খুশি হয়েছি।”
সৃজার কথাটা পছন্দ হয়নি সে তো আর ওনাদের কোম্পানি সামলানোর জন্য পড়তে চায়না।নিজের পায়ে দাড়াতে চায় সে।নিজের দেশের জন্য কিছু করতে চায়।সৃজা ইতি উতি না করে বললো
“আমি মালয়েশিয়া যেতে চাই পড়ার জন্য।”
“সে তো ভালো কথা,তুমি যেখানে চাও সেখানেই পড়তে পারো।তাহলে আমি কিছুদিনের মধ্যেই সবকিছুর ব্যবস্থা করছি।”
“আপনাকে কোনো ব্যবস্থা করতে হবে না বাবা।মালয়েশিয়া আমার বড় বোন থাকে আমি সেখানেই পড়বো।আর দুলাভাই সব ব্যবস্থা করতে পারবে।আমি চাই না আপনি এ ব্যাপারে কষ্ট করুন।”
“কষ্ট কেনো বলছো।আর মান্থলি একটা খরচ আছে সেটার ব্যবস্থাও আমি করে দিবো।চৌধুরী বাড়ির বউ হয়ে অন্যের উপর নির্ভর হয়ে তোমায় চলতে হবেনা।”
অগত্যা সৃজাকে তাই মেনে নিতে হলো।মাথা নিচু করে নিজের রুমের দিকে হাটা দিলো।
বিদেশ যাওয়ার আগে আইএলটিএস পরীক্ষা দিতে হবে।এটাও ভাবলো সে।বিদেশ যাওয়ার আগে প্রায় তিন মাস সময় আছে তার হাতে।
রুমের লাইটটা অন করেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো সৃজা।সাফওয়ান বিছানায় শুয়ে আছে।হাতে তার সিগারেট,তবে ধরায়নি সেটা।আঙ্গুলের মাঝে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।সৃজাকে দেখে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো
“ওহ তুমি এসে গেছো।যাও লাইটারটা নিয়ে এসো।বোধ হয় ওই রুমেই ফেলে এসেছি।সিগারেটটা ধরাতে পারছিনা একটা লাইটারের জন্য।” বলে আবারও সৃজার রুমে রাখা দ্য কিস পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
সৃজাও সেদিকে দৃষ্টি দিলো।নাহ্ এই লোকটা কখনোই ভালো হবেনা।বেশরম কোথাকার!!কত কিছুই তো আছে এরুমে, তোর ওই দিকে তাকানোর দরকার কি?কতবার ভেবেছে পেইন্টিংটা এ ঘর থেকে সরানোর কথা বলবে কিন্তু মনেই ছিলো না।
“দাড়িয়ে আছো কেনো?নাকি ভাবছো আমাদেরও ওরকম পোজে একটা ছবি তোলা দরকার।”বলেই একটা দুষ্টু হাসি দিলো।সৃজার গা জ্বলে গেলো মনে হচ্ছে।
” এই অনেক বলেছেন।এখনি এ রুম থেকে যাবেন।আমার আপনাকে সহ্য হচ্ছে না।প্লিজ যান এখান থেকে।”বলেই এক আঙ্গুলে দরজাটা নির্দেশ করলো।
সাফওয়ান সাথে সাথে বেড থেকে উঠে সৃজার চোয়াল আকরে ধরলো এক হাতে।হাতের সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে এক পা দিয়ে পিষতে শুরু করলো।দাঁতে দাঁত চেপে বললো
“আমি তোকে বলেছিলাম ডিভোর্স ছাড়া যেকোনো শাস্তি দিতে,তুই দিয়েছিস শাস্তি।এই রুমে থাকিস তা মেনে নিয়েছি।কিন্তু তুই অ্যাব্রোড কেনো যাবি?”
সৃজা সাফওয়ানের হাতটা ছাড়িয়ে গলায় ক্ষানিকটা জোর এনে বললো
“আপনি বলেছিলেন আমি যে শাস্তি দিবো সেটাই মেনে নিবেন।তাহলে জেনে রাখুন এটাই আপনার শাস্তি।”
সাফওয়ান কিছুটা থমকালো।বললো
“না তুমি যেতে পারবেনা।এখানে থেকেই পড়বে।ড্যাডকে না করে দিবে তুমি।”
“কেনো না করবো আমি?যেনো পরবর্তীতে আপনার রক্ষীতাদের বলতে সুবিধা হয় আমি মূর্খ।যাতে আপনি বলতে পারেন আমি আপনার স্টান্ডার্ডের না। ” সৃজার কথায় অভিমান স্পষ্ট।কিছুটা থেমে আবারো বললো
“নাকি আমার শরীরের মায়া ছাড়তে সমস্যা হবে আপনার?”
“সৃজা!!!এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে।”
“কোনোটাই বেশি হচ্ছে না মি.সাফওয়ান চৌধুরী।আমি বিদেশ যাবোই।”
সাফওয়ান হার মেনে নিলো।শান্ত ভঙ্গিতে বললো
“বিদেশ থাকবে তো মাত্র পাঁচ বছর তারপর তো আমার কাছেই ফিরতে হবে তোমাকে।তাই যেতে দিচ্ছি।তাই বলে ভেবো না তুমি সাফওয়ানের নাগালের বাইরে।তোমার যেকোনো বিষয় তোমার আগে আমার জানা হয়ে যাবে।তাই সাবধান।”
চলবে…..