সৃজা পর্বঃ৬,৭

সৃজা
পর্বঃ৬,৭
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
পর্বঃ৬

সাফওয়ানের এমন বাচ্চা বাচ্চা কথা শুনে হাসবে না কাদঁবে তা বুঝতে পারছেনা সৃজা।এর মাঝেই সাফওয়ান বিছানায় বসে সৃজার কোমর আকড়ে নিজের কোলে বসিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।

সৃজার কানের কাছে মুখটা রেখে শত ভালোবাসার বাণী শোনাচ্ছে ওকে

“বিলিভ মি আমি তোমাকেই প্রথম মন থেকে চেয়েছি।আমার প্রথম শয্যাসাথি থেকে শুরু এ পর্যন্ত যত মেয়ের সাথে আমি সেক্স করেছি সব তাদের ইচ্ছেতে ছিলো।আমি কখনো কাউকে জোড় করিনি।ওরা হয়তো টাকার লোভে আমার পেছনে ঘুরতো।আমিও তাদের সায় দিয়েছি এটা অবশ্য আমার দোষ।” কথাগুলো শুনে সৃজার মনের অবস্থা কি হচ্ছে এটা সে এবং তার সৃষ্টিকর্তা ভালো জানে।

অনেকক্ষণ এভাবেই রইলো দুজন।ঘরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে।মাঝে মাঝে নীরবতা মনকে প্রচন্ড শান্তি দেয়।

সৃজার অস্ফুট কান্নার জল হাতে লাগতেই হকচকিয়ে উঠলো সাফওয়ান।বারবার জিজ্ঞেস করলো কাদঁছে কেনো।সৃজা কান্নামাখা স্বরেই বললো

“আমি সহ্য করতে পারিনা এই ব্যাপার গুলো।আমার স্বামীর শরীরে কেনো অন্য মেয়ের ছোঁয়া থাকবে।আপনি কেনো বোঝেন না আপনার অবচেতন মনের কথাগুলো আমায় বড্ড পোড়ায়।ভিতর থেকে আমাকে দূর্বল করে দেয়।আমি একটা স্বাভাবিক জীবন চেয়েছিলাম।সেটা না দিতে পারলো আমার বাবা আর না দিতে পারলেন আপনি।আমি তো কোনো অন্যায় করিনি তবে শাস্তি কেনো পেতে হচ্ছে।ভেতরে ভেতরে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।”

সাফওয়ান আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সৃজার কাধে মুখটা রেখে বললো

“এই তুমি কাঁদছো কেনো??প্লিজ কাঁদে না হানি।আই প্রমিজ আর কোনো মেয়ের কাছে যাবোনা।কক্ষনো না।এই যে তোমাকে ছুঁয়ে বললাম।”কথাগুলো বিড়বিড় করে বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পরলো সে।সৃজার কাধে তার ঘুমন্ত ভারি নিঃশ্বাস আছড়ে পরছে।

সাফওয়ানের কোর্ট-টাই খুলে তাকে শুইয়ে দিলো সৃজা।তারপর নিজেও গুটিসুটি মেরে তার পাশে শুয়ে রইলো।সাফওয়ানের মুখটার দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো হয়তো এই সম্পর্কটা একটা সুযোগ ডিজার্ভ করে।আর যাই হোক নেশার ঘোরে মানুষ মিথ্যে বলে না এটা সে জানে।নিজের মনকে তার জন্যই প্রস্তুত করার ভাবনার মাঝেই ঘুমিয়ে পরলো সে।

অনেকদিন পর আজ শান্তির ঘুম দিচ্ছে সৃজা।সাতটা বাজার পরও সে স্বামীর বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমিয়ে আছে।এসির ঠান্ডা তাকে ঠেলে দিচ্ছে সাফওয়ানের উষ্ণতার মাঝে স্থান নিতে।

নয়টার দিকে আধো চোখ মেলে সাফওয়ান বোঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে।মাথায় হাত চেপে কতক্ষণ বসে রইলো।পরক্ষণেই কোনো নারীদেহের স্পর্শ বুঝতেই সে ফিরে তাকালো সৃজার ঘুমন্ত মুখটার দিকে।কাপড় এলোমেলো তার।সৃজা তাকে এই প্রথম নিজে থেকে জড়িয়ে ধরে আছে ।বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো সাফওয়ানের।সূর্যের আলোটা চোখে পরতেই সেটা আড়াল করার জন্য উঠতে চাইলো।কিন্তু সৃজা উঠতে দিলো না তার হাতের বাধন আরো শক্ত হলো।অর্থাৎ সৃজা জেগে আছে।অনেকটাই অবাক হলো সাফওয়ান।

যখন বুঝতে পারলো সৃজা তাকে আপন করে নিয়েছে তখন সমস্ত সংকোচ ঠেলে তাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমের দিকে রওয়ানা দিলো সাফওয়ান।

“এবার থেকে যত রাগারাগী হোক না কেনো দিনশেষে আমি তোমাকে এই রুমেই চাই হানি।”সৃজা লজ্জার মাথা খেয়ে সাফওয়ানের বুকে মুখ লুকালো।

সদ্য প্রস্ফুটিত বেলি ফুলের ন্যায় লাগছে সৃজাকে।একটু আগেই সে স্নান সেড়ে বারান্দায় দাড়ালো।সাফওয়ান পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলো।এই মুহূর্তে ওদের দেখলে সবাই বলতে বাধ্য হবে রাজযোটক।

সৃজার মুখটা ঘুড়িয়ে নিজের অধর দিয়ে তার অধর জোরা আকড়ে ধরলো সাফওয়ান।সৃজা এই প্রথম তাকে নিজ থেকে সাড়া দিচ্ছে।সৃজার এক হাত রেলিংয়ের উপর আরেকহাত সাফওয়ানের গালে।

সাফওয়ান আজ দেরি করে অফিসে গেছে।ও যাওয়ার পরপরই টিউলিপ রুমে ঢুকলো হাতে একটা পুতুল নিয়ে।

“টিউলিপের নতুন পুতুলটাতো ভারি মিস্টি।কে দিলো এটা টিউলিপ ফুলটাকে।এখনতো টিউলিপ আমাকে ভুলেই যাবে।” বলেই দুষ্টুমি করে কান্না শুরু করলো সৃজা।

টিউলিপ এই কান্নাটাকে সত্যি মনে করেই সৃজার কোলে গিয়ে বসে ছোট ছোট হাতগুলো দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো

“নো, নো নো,আমার পুতুল মাম্মাকে কখনোই ভুলবোনা আমি।এটাতো কথা বলতে পারেনা কিন্তু তুমি তো কথা বলতে পারো।তাই টিউলিপের বেস্ট ডল হলো পুতুল মাম্মা।”

সৃজা বললো”ঠিক তো?”

“পিংকি প্রমিজ।”সৃজার কনিষ্ঠ আঙ্গুলটা টিউলিপের কনিষ্ঠ আঙ্গুল স্পর্শ করলো।

আজ সৃজার শিক্ষক আসবে তার অপেক্ষাই করছে সৃজা স্টাডি রুমে।যদিও তিনি চারটায় আসবে।সৃজা তিনটা থেকেই পরিপাটি হয়ে বসে আছে।মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে।আবার নতুন টীচারের কথা ভেবে নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে।যদি উনি আবুল স্যারের মতো হয়।আবুল স্যার তাদের ক্লাসে গণিত নিতো।প্রায় প্রতিদিন তিনি কাউকে না কাউকে বেধর আঘাত করতেন।এমনকি ক্লাসের একজন দোষ করলে উনি সবাইকে বেত্রাঘাত করতেন।জীবনে প্রথমবার সে আবুল স্যারের হাতে মার খেয়েছিল।সেটা এখনো ভুলেনি সে।তার ফোলা ফোলা হাত দুটো দেখে মা সেদিন কেঁদেই দিয়েছিলো।সৃজার বাবা এটা জানতে পেরে আবুল স্যারকে স্কুল ছাড়া করেছিলো।

স্যার আসলেন তবে ঠিক চারটা পাঁচ মিনিটে।সৃজা তাকে সালাম দিলো।স্যারকে দেখতে অনেকটা পুরোনো যুগের নায়কদের মতো।চুলগুলো একটু বড় বড়।একটা কমলা রঙের শার্ট পরে এসেছে।গায়ের রং শ্যামলা।চেহেরায় একটা গাম্ভীর্য রয়েছে।নামটা তার রাহীন হাসান।তিনি বুয়েটের ছাত্র।

স্যার আসার দশ মিনিট পরেই সাফওয়ান কল দিলো।স্যার রিসিভ করার অনুমতি দিলো।

“কি করছে আমার জানটা??”

“এখন স্যার এসেছে পড়ছি পরে কথা বলবো।”

“সেজন্যই তো ফোন দিলাম।স্যারকে ফোনটা দাও।”সৃজা ইতস্তত করে ফোনটা স্যারের হাতে দিলো।

কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা সৃজার কাছে ফেরত দিলো।কি কথা হলো যদিও সৃজা বুঝতে পারেনি।জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে করছে না।

প্রথমদিনেই অনেক পড়া দিয়ে গেলো রাহীন স্যার।স্যার যাওয়ার পরপরই সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে সে।সাফওয়ান এসে দেখলো সৃজা রুমে নেই।ফ্রেশ হয়ে স্টাডি রুমের সামনে যেয়ে সে দাড়ালো।দেখলো সৃজা মনোযোগ দিয়ে পড়ছে।সামনের চুলগুলো এই সুযোগে সৃজার চোখে মুখে ছড়িয়ে আছে।সাফওয়ান প্রায় আধা ঘন্টা দাড়িয়ে থেকেও তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হলো।

হঠাৎই শূন্যে ভাসায় সৃজা হকচকিয়ে গেলো।বুঝতে বাকি রইলো না সাফওয়ান তাকে কোলে তুলে নিয়েছে।সৃজা কোলে থেকেই বললো

“আরে আরে কি করছেন।আর আপনি কখন আসলেন।সার্ভেন্টকে বলে দিয়েছিলাম তো আপনি আসলে আমাকে ডেকে দিতে।”

“অনেক সময় হলো আমি এসেছি কিন্তু তোমার মনোযোগ বইয়ে ছিলো তাই আমাকে দেখতে পাওনি।আর পড়া সব আমি না থাকলে করবে।আমি যতক্ষণ বাসায় থাকবো ততক্ষণ আমার চোখের সামনে থাকবে।এখন চলো খাবে।আমার খিদে পেয়েছে।”

সকালে খুব ভোরে উঠে সৃজা পড়তে বসলো।সাফওয়ান এখনো ঘুমাচ্ছে।তাকে আটটায় ডেকে দেয়ার জন্য ঘড়িতে এলার্ম সেট করে রেখেছে সৃজা।কিন্তু তার আগেই নিজের পাশে সৃজাকে না পেয়ে ঘুম ভেঙে গেলো সাফওয়ানের।সার্ভেন্টকে কফি দিতে বলে স্টাডি রুমে গেলো সে।এই মেয়েটা এতো পড়ে কেনো।কই সে তো লন্ডন থেকেও এতো পড়তো না।যদিও তার সারাদিন ভার্সিটিতেই কাটতো।

“ব্রেকফাস্ট করেছো।”

“না।”কথাটা বলেই বুঝতে পারলো প্রশ্নকর্তা সাফওয়ান।

ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনো আটটা বাজেনি কিন্তু এর আগেই উনি উঠে গেছে।সাফওয়ান এসে সৃজার পাশে একটা চেয়ারে বসলো তারপর সৃজাকেও টেনে তার কোলে বসালো।সৃজার কানে ঠোঁট ছুইয়ে বললো

“এবার পড়ো।আমি দেখবো।তোমাকে পড়তে দেখতে আমার ভালো লাগে।”হুট করেই লজ্জা গ্রাস করলো সৃজাকে।গালে খানিকটা লাল আভা ছড়িয়ে পরলো।সাফওয়ানের ঘুম ঘুম কন্ঠ তার মারাত্মক ভালো লাগে।সাফওয়ান তা বুঝতে পারলো।সৃজার এই লাল আভার কপোল তাকে সবসময় মুগ্ধ করে।

” চলুন অফিসের জন্য রেডি হবেন।এখন পড়া থাক।আপনি অফিসে গেলে আবার পড়তে বসবো।”

সাফওয়ানের অফিসে যাওয়ার আগে প্রায় সবকিছুই সৃজা গুছিয়ে দেয়।সাফওয়ান এখন তার সামনে দাড়িয়ে আছে আর সৃজা ড্রেসিং টেবিলের উপর বসে তার টাই বেঁধে দিচ্ছে।সৃজাকে নানাভাবে জালানোর পাশাপাশি তাকে বারবার বলছে সময় মতো খেয়ে নিতে।পড়ার জন্য যেনো খাওয়ায় অবহেলা না হয়।সৃজা তার কথায় মুগ্ধ হচ্ছে এটা কি সে জানে?শেষে কপালে গভীরভাবে অধর ছুঁইয়ে সে প্রস্থান করার পূর্বে বলে গেলো

“বুবুর ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়ো না।কোনো প্রশ্ন থাকলে আমি আসলে করবে।মাকে বা বুবুকে জিজ্ঞেস করবেনা এ ব্যাপারে।”

সৃজা হ্যা বোধক মাথা নাড়ালো।

আজ টিউলিপের মাম্মা অফিস যায়নি।যে মেয়ে নিজের ভাইয়ের বিয়েতেও থাকে না এতো ব্যস্ত বলে।সে নাকি আজ অফিস যায়নি।এটা সৃজাকে ভাবাচ্ছে।যদিও সাফওয়ান বলে গেছে এর উত্তর সে পরে পাবে।তবে মানব মনতো অস্থির হবেই।সকাল থেকে বুবু নিজের রুমে বন্ধ করে রেখেছে।নাস্তা করার সময়ও টেবিলে দেখা যায়নি।এ নিয়ে বাসার কেউ কিছু বলেও নি।

চলবে…..

#সৃজা
পর্বঃ৭
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী

দুপুর ১২টার দিকে শাশুড়ী মা টিউলিপকে নিয়ে আমার রুমে আসলেন।বললেন ওকে আমার কাছে রাখতে আর উনি না বললে যেনো টিউলিপকে বাইরে যেতে না দেই।কথাগুলো বলার সময় ওনাকে কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিলো।কিছু সময় পর খুব জোরে কিছু ভাঙচুর করার শব্দ পেলাম।বুবুর রুম থেকেই এ আওয়াজ আসছিলো।

একটু পর কারো গগনবিদারী চিৎকার শুনে টিউলিপ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।এটা আর কারো না সানিয়া চৌধুরীর আওয়াজ টিউলিপ প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে।আচ্ছা ও কি বুঝতে পারছে এটা ওর মায়ের আওয়াজ।

আমার নিজেরও খারাপ লাগছে।একটু পর সব শান্ত হয়ে গেলো।হঠাৎ ঝড় আসার পর চারদিক যেমন শান্ত হয়ে যায় তেমন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।টিউলিপ আমার বুকে মুখ লুকানো অবস্থায়ই ঘুমিয়ে গেছে।ওকে বিছানায় শুইয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো সৃজা।

বুবুর অস্বাভাবিক আচরণ তাকে ভাবাচ্ছে।আসার পর থেকে সে একবারো টিউলিপের বাবার কথা শুনেনি।সে আছে কি নেই তাও জানা হয়নি।আর বুবুও বেশি কথা বলে না কারো সাথে।নিজের সবকিছু নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলো যে এসব ভাবার সময় হয়নি সৃজার।কাউকে জিজ্ঞেস ও করেনি সে এ ব্যাপারে৷বরাবরই সাংসারিক ঘটনাগুলোতে উদাসীন সৃজা।

কিন্তু এখন তার নিজের সংসার আছে।একটা নতুন পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সে পরিবারের সকল বিষয় জানা দরকার তার।তার সকল প্রশ্নের উত্তর একমাত্র সাফওয়ানের কাছে পাবে।

সৃজাকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এলো সার্ভেন্ট।ইশারায় তাকে আস্তে কথা বলতে বললো।টিউলিপ এখনো ঘুমাচ্ছে।সেও খায়নি কিছু।তাই সৃজা বললো টিউলিপ উঠলে খাবে।

এর মধ্যে সাফওয়ান একবার ফোন দিয়েছে।বাড়ির পরিস্থিতি দেখে ভয় পেতে মানা করেছে।সৃজা ভেবে পাচ্ছে না সে কেনো ভয় পাবে।সাফওয়ান কি তাকে টিউলিপের মতো মনে করে নাকি।স্বামীর তুলনায় স্ত্রী খুব বেশি ছোট হলে যা হয় আর কি।

রাত এগারোটার দিকে সাফওয়ান বাড়ি এলো।রুমে এসে দেখলো সৃজা বইয়ের উপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।চুলগুলো খোলা থাকায় তা সৃজার মুখশ্রী দেখতে দিচ্ছে না।কাছে এসে হাঁটু গেরে বসে চুলগুলো কানে গুজে দিলো সাফওয়ান।তারপর ফ্রেশ হতে গেলো সে।

প্রায় আধা ঘন্টা হলো সৃজার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সাফওয়ান।সকালে এ সুযোগটা হয় না কারণ সৃজা তার আগে ওঠে সবসময়।এখনো ওর ঘুম ভাঙেনি।ও মাঝে মাঝে ভেবে পায়না।এই মেয়েটা এতো ঘুম কাতুরে কেনো।

ঘুম ভাঙানোর কৌশল হিসেবে সৃজার দৃশ্যমান গালটায় ছোট ছোট চুমু দেয়া শুরু করলো।ওর গালগুলো একদম তুলোর মতো নরম।সাফওয়ানের মনে হয় সারাক্ষণ আদর করি।সৃজা নড়েচড়ে উঠলো।ঘুম ঘুম চোখেই বললো

“কখন আসলেন?আমায় ডাকেননি কেনো?ভালো করেছেন ডাকেননি।আমি ঘুমাবো।প্লিজ আপনি খেয়ে শুয়ে পরুন।আর আমাকে একটু বিছানায় দিয়ে যান।”বলেই হাতগুলো দিয়ে সাফওয়ানের গলা জড়িয়ে ধরলো। এখনো সে ঘুমে।

সাফওয়ান সৃজাকে কোলে করে বিছানায় না গিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাড় করলো।আর বললো

“পাঁচ মিনিট সময় ফ্রেশ হয়ে আসো।আমার খিদে পেয়েছে।একসাথে খাবো দ্রুত আসবে।”

অগত্যা সৃজাকে খেতে হলো।এখন তার একটুও ঘুম পাচ্ছে না।বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করছে।সাফওয়ান এখনো কাজ করছে।এতো কি কাজ তার যে অফিসেও সারাদিন ব্যস্ত থাকে আবার বাসায় আসার পরেও ব্যস্ত থাকে।

সৃজার রাগ হলো এবার।উঠে গিয়ে সাফওয়ানের ল্যাপটপটা কেড়ে নিয়ে কোলে বসে পরলো।সাফওয়ান হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিলো।সৃজা সাফওয়ানের ঠোঁটের উপর এক আঙ্গুল দিয়ে চুপ করার নির্দেশ দিলো।এবার নিজে বলা শুরু করলো

“বাসায় এসেও আপনার এতো কাজ কিসের।আর আপনি না বলেছিলেন আমাকে বুবুর ব্যাপারটা বিস্তারিত বলবেন।কখন বলবেন?”

সাফওয়ান সৃজার আঙ্গুলে চুমু দিতেই সে সড়িয়ে নিলো।সাফওয়ান এবার সৃজার কোমর আকরে লাইটটা অফ করে বিছানায় গিয়ে শুলো।সৃজা এখনো তার সাথে লেপ্টে আছে।এবার বললো সে

“তুমি এখন বুবুকে যেমন দেখছো ও কখনোই এমন ছিলো না।ওর হাসিতে পুরো চৌধুরী বাড়ি হাসতো।ওকে কখনো মন খারাপ করতে দেখা যায় নি।ড্যাড ওকে প্রচন্ড ভালোবাসতো।যে কোনো অনুষ্ঠানে বা পার্টির জন্য ও সবার আগে শপিং করতো।আমাদের বাড়ির সব অনুষ্ঠান ওকে ছাড়া অপূর্ণ ছিলো।

বুবু আমার সাথে সবকিছু শেয়ার করতো।তার মতে ছোট ভাই নাকি পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন বন্ধু।আমার সাথে কথা বলার জন্য ও পাগল হয়ে যেতো।সারাদিন ভার্সিটিতে কি হতো না হতো সব বলতো আমাকে।আমি শুনতে না চাইলেও জোর করে শুনাতো।”

আমি চরম অবাক হলাম ভাবা যায় এমন গম্ভীর সানিয়া চৌধুরী নাকি এতো চঞ্চল ছিলো।সাফওয়ান আবার বলা শুরু করলো

“বুবু আর দুলাভাইয়ের লাভ ম্যারেজ ছিলো।বিয়ের পর ওরা লন্ডনে সেটেল হয়েছিলো।ওরা হ্যাপি ফ্যামিলি ছিলো।বিয়ের দুই বছর পর টিউলিপ জন্মগ্রহণ করে।

আমাদের পুরো পরিবারে সুখের কমতি ছিলো না।টিউলিপের যখন এগারো মাস বয়স তখন ওরা বাংলাদেশে আসে দেখা করতে।এর কিছুদিন পরেই ওদের তৃতীয় অ্যানিভার্সিরি ছিল।টিউলিপকে বাড়িতে মমের কাছে রেখে ওরা সেদিন ঘুরতে গিয়েছিলো।
দুর্ভাগ্যবসত ওদের গাড়িটা ওইদিন দূর্ঘটনার শিকার হয়।হাসপাতালে নেয়ার পর বুবু বেঁচে ফিরলেও দুলাভাইকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।তারপর থেকে বুবু নিজেকে অপরাধী মনে করে কারণ গাড়িটা ও চালাচ্ছিলো।” অজান্তেই আমার মনটা হুহু করে উঠলো বুবুর জন্য। তার কষ্টটা পাহাড়সম।অনুভব করলাম সাফওয়ানের কন্ঠও জড়িয়ে যাচ্ছে

“প্রায় ছয় মাস ও কারো সাথে কথা বলেনি।শুধু নিজের রুমে থাকতো আর মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাদঁতো। টিউলিপ যেদিন প্রথম ওকে মা বলে ডাকলো সেদিন থেকে ও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে।যদিও প্রতি বছর এই দিনে ওর পাগলামি আবার শুরু হয়।বুবুকে দেশের সেরা সাইকেআর্টিস্ট দেখানো হয়ছে।কিন্তু ও এক দুইটা কাউন্সলিং এর পর আর যায় না।তাই এখনো পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেনি।সবার সামনে স্বাভাবিক থাকলেও ও আসলে মন থেকে ভালো নেই।”

বুবুর জন্য আসলেই কষ্ট লাগছে।এমনটা না হলেও পারতো।যদি দুলাভাই বেঁচে থাকতো তাহলে টিউলিপকে আর বাবাকে মিস করে মন খারাপ করতে হতো না।ওতো এতিম হয়ে গেলো।

যতই ঐশ্বর্যের মধ্যে বড় হোক না কেনো বাবাকে না পাওয়ার ব্যথাতো ভুলতে পারবেনা।ধন-সম্পদ কখনো একজন মানুষের অভাব পূরণ করতে পারেনা।যে কখনো বাবার আদর পায়নি সেই ভালো জানে তার জীবনে বাবার অস্তিত্ব কতটুকু।সৃজা ঠিক করলো বুবুর সাথে কথা বলবে সে।তাকে আবারো আগের মতো হতে হবে।কারণ পুরো পরিবার তাকে মিস করে।যেকোনো অনুষ্ঠানে তিনি অনুপস্থিত থাকে।এমনকি নিজের ভাইয়ের বিয়েতেও ছিলো না।

সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও চোখ বন্ধ করে আছে।আমিও আর কিছু বললাম না। হয়তো তারও ওই ঘটনাগুলো মনে পরছে।সুখের মুহূর্ত গুলো পরবর্তীতে বেদনা দেয় এটাই স্রষ্টার নিয়ম।কিছুক্ষণ পর সাফওয়ান আরকটু নিবিড় করে জড়িয়ে ধরলো আমায় বুঝলাম ঘুমাবে।আমিও তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।এই মুহূর্তে তাকে শান্তনা দেয়ার কোনো ভাষা আমার কাছে নেই।আমিও একসময় তাকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পরলাম।

আজ সকালেও একই অবস্থা আমার শাড়ির আচল সাফওয়ানের নিচে।নিজেরই এখন লজ্জা লাগছে।আমি শাড়ি ঠিক রাখতে পারি না।এ বাড়ির বউরা যত আধুনিকই হোক না কেনো তাদের শাড়ি পরার নিয়ম।তাই না চাইতেও শাড়ি পরতে হয়।শাড়ির আঁচলটা ধীরে ধীরে টানতে লাগলাম কিন্তু শেষমুহূর্তে সাফওয়ান সেটা খপ করে মুঠোয় নিয়ে বললো

“লজ্জা পাচ্ছো কেনো?তুমি এতো লজ্জা কোথায় পাও।যখন তখন যেখানে সেখানে তুমি লজ্জায় লাল হয়ে যাও।এভাবে সবসময় লাল হতে থাকলেতো নিজেকে আটকে রাখা দায়।আমাকে পাগল করার ধান্দা তোমার সবসময়।”

ওনার এসব কথায় আমি লজ্জা পেলেও শাড়িটা ওনার হাতের মুঠো থেকে নিয়ে ওয়াশরুমে দৌড়ে চলে গেলাম।হয়তো উনি এখন হাসছেন।আর কখনো শাড়ি পরে ঘুমাবো না শিক্ষে হয়ে গেছে আমার।

সাফওয়ান চলে যাওয়ার পর মনে হলো আমার নতুন শিক্ষককে উনি কি বলেছেন সেটাইতো জানা হচ্ছে না।শুধু মনে হচ্ছে ওনার কথাগুলোর জন্য স্যার আমাকে সাবলীল ভাবে পড়াতে পারছেনা।প্রতিদিন রোবটের মতো কতগুলো পড়া দেয় আর পড়া নিয়ে চলে যায়।এভাবে আমার মোটেও ভালো লাগেনা।আমার কত কিছু জানার আছে শহর সম্পর্কে, পড়াশোনার বিষয়ে আমিতো ওনার গম্ভীর মুখের দিকে তাকালে কোনো কিছুই বলতে পারিনা।শিক্ষক মানুষ সবসময় ছাত্রদের উদ্ভুদ্ধ করবে নতুন কিছু জানার জন্য ওনারা কেনো শুধু রোবটের মতো পড়াবে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here