অজান্তে আগমন,পর্বঃ- ০১
সাদিয়া সৃষ্টি
— এই মেয়ে, দাঁড়াও।
— দাঁড়াও বলছি।
— এক রাতের জন্য তোমার দাম কত? সেটা তো বলে যাও।
নিজের ডান কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগটা আরও শক্ত করে চেপে ধরল রেখা। ছেলে তিনটে মাতাল নয়। তবে বখাটে। আর রাতে এদের আনাগোনা শহরের গলিতে সাধারণ একটি ব্যাপার বটে। কিন্তু আজ রেখা প্রথম এমন পরিস্থিতির শিকার হলো। তাই কি করা উচিত- সে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। এদের থেকে কি করে নিজেকে বাঁচাতে হবে- এই প্রশ্ন মস্তিষ্ককে করতেই উত্তর আসলো, দৌড়াও। যত দ্রুত পারো দৌড়াও। নাহলে কোন একটা সর্বনাশ আজই হয়ে যাবে। কিন্তু এদের সাথে দৌড়িয়েও সে পেরে উঠবে না, এটা জানে। চিন্তায় মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছে। হাত পা কাঁপাও শুরু হয়ে গিয়েছে। চলার বেগ বাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। যতই দ্রুত চলছে, ততই মনে হচ্ছে তার পায়ের শক্তি কমতে কমতে অদৃশ্য হয়ে আসছে। পিছন থেকে ছেলেদের আওয়াজ স্পষ্ট ভাবে শোনা যাচ্ছে। বাজে বাজে শব্দের প্রয়োগ করছে তার উপর। রাস্তা ফাঁকা। আশেপাশে মানুষ একেবারেই নেই যে কারো কাছ থেকে সাহায্য চাইবে রেখা। মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়া ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে। বারবার প্রার্থনা করে চলেছে যেন তার কোন ক্ষতি না হয়।
হঠাৎ একটা ছেলে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলে উঠল,
— হাঁটতে থাকুন, থামবেন না।
রেখার কানে কতোটুকু পৌছাল সেটা জানা নেই, তবে রেখা তখন মনে মনে প্রার্থনা করতে করতে হেঁটে চলেছে। আশেপাশে তার খেয়াল নেই। হঠাৎ করে ছেলেটা রেখার ওড়নার কোণ ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাঁধা পেতেই রেখার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এই বুঝি ছেলেগুলো তাকে ধরে ফেলল! আজ আর তার নিস্তার নেই। আজই হয়তো তার সাথে অনেক খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। কাল হয়তো খবরের কাগজের এক পৃষ্ঠায় তারও জায়গা হবে। ছবি ছাপা হবে সেই ক্ষতবিক্ষত অবস্থার। যদি সে আজই মারা যায়! সৃষ্টিকর্তার নাম নিতে নিতে পিছনে ঘুরে তাকাল।
একটা ছেলেকেই তার ওড়না ধরে থাকতে দেখে তার কাপাকাপি বেড়ে গেল। সাথে সাথে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়া শুরু করল। কম্পনরত কণ্ঠে আকুতি করে উঠল,
— আমাকে প্লিজ ছেড়ে দিন। আমার সাথে কিছু করবে না।
ছেলেটি হয়তো বুঝতে পারল রেখার অবস্থা। তাই সে রেখার ওড়না ছেড়ে দুই হাত উপরে তুলে বলল,
— আমি ওদের দলের লোক না। আমি তো আপনাকে ওদের থেকে বাঁচালাম। ট্রাস্ট মি।
রেখা পুরো কথা শুনে বোকার মতো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। ছেলেটা তাকে বাঁচাল কখন আর কিভাবে? ছেলেটা রেখার মুখভঙ্গির পরিবর্তন দেখে হেসে বলল,
— আসলে ওই ছেলেগুলো যখন আপনাকে ফলো করছিল, তখন আমি আপনার কাঁধে হাত রেখে হাঁটা ধরলাম। ওরা আমাকে দেখে আর আপনার পিছু নেয়নি। এবার কি আমি হাত নামাতে পারি? আসলে হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।
রেখা সম্পূর্ণটা বুঝে কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেলল আর মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে তার সম্মতি প্রকাশ করল। ছেলেটা আবার এক গাল হেসে হাত নামিয়ে রাখল। তারপর সে নিজেই বলল,
— চলুন, যাওয়া যাক।
রেখা সাথে সাথে ভ্রূ কুঁচকে ফেলল। ছেলেটি অবাক হলো। ভেজা চোখ, কিছুক্ষণ আগেই হাসি হাসি মুখ ছিল। এখন মুহূর্তেই ভ্রূ কুঁচকে এলো। মেয়েটা কি সেকেন্ডে সেকেন্ডে এক্সপ্রেশন বদলায়? তবুও মুখে সেসব কথা বলল না।
ভ্রূ কুঁচকানো দেখেই ছেলেটির নিজের অজান্তেই দুই হাত আবার উঁচু হয়ে গিয়েছে। একেবারে সারেন্ডার পজিশনে। ছেলেটির হাত এভাবে উঠাতে দেখে নিজেকে বাংলা সিনেমার পুলিশ বলে মনে হলো রেখা। ফিক করে হাসতে গিয়েও হাসল না। নিজের অনুভূতি গোপন রাখল। ছেলেটা দেরি না করে বলে উঠল,
— আমি কিন্তু আপনার সাথে খারাপ কিছু করার কথা ভাবিনি। শুধু আপনার গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছে দেব। না, মানে, আমি যদি চলে যাই, আর ওরা যদি আবার পিছু নেয়। সেজন্য বলছিলাম। দেখুন না, এখনো কিভাবে তাকিয়ে আছে!
রেখা ছেলেটির পিছনের দিকে তাকাল। বখাটে ছেলে তিনটে পিছনেই আছে। তবে অনেকটা দূরে। রেখা কিছু বলল না। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকল। ছেলেটি রেখার দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের হাতের দিকে তাকাতেই ওর খেয়াল হলো যে নিজের অজান্তেই সে আবার দুই হাত তুলে ফেলেছে। হাত দুটো নামিয়ে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল সে। চোখের ইশারায় যাওয়ার কথা বলতেই রেখা আবার হাসি মুখে সম্মতি জানাল। তারপর দুজনে মিলে হাঁটা শুরু করল। ছেলেটা রেখার দিকে আড়চোখে একবার তাকাল। অল্প সময়েই যেন মেয়েটা অনেক কান্না করে ফেলেছে। পানি মুখে লেপ্টে আছে তখনও। সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটা ধরল সে। মাঝে মাঝে পিছনে তাকিয়ে দেখল ছেলেগুলো আছে কি না।
রেখার মন থেকে ভয় ততক্ষণে চলে গিয়েছে। সে বারবার কোণা চোখে ছেলেটিকে দেখছে। সাদা শার্ট পরিহিত ছেলেটি উচ্চতায় তার থেকে লম্বা। ৫ ফুট ৭-৮ হবে হয়তো। শার্ট এর উপরের দুটো বোতাম খোলা। হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। শার্ট এর বোতামের মাঝে একটা সানগ্লাস ঝোলানো। হয়তো রাত বলেই খুলে রেখেছে। কাঁধে ট্রাভেলিং ব্যাগ। কোথাও থেকে ঘুরে এসেছে না কি? অদ্ভুত সব প্রশ্নের উদয় হতে লাগল তার। চলার পুরো সময়টিতে সে ছেলেটাকে দেখেছিল। ছেলেটি তার ডান পাশে কিছু দুরুত্ব বজায় রেখে হাঁটছিল। ডান কানের নিচ বরাবর গলায় যে একটা তিল আছে, সেটাও নজর এড়ায়নি তার। ভালো লাগল তার। মোটামুটি গত কয়েক বছরে পুরোই অজানা এক অনুভূতি হানা দিল মনে। সে বারবার মনে মনে বলছে,
“প্লিজ, আমার দিকে আর তাকাবেন না। আগের বার তো তেমন খেয়াল করিনি, কিন্তু এবার তো আড়চোখে করেছি। সামনাসামনি দেখলে আমি কি করব নিজেও জানি না। মাদকদ্রব্য সাথে করে নিয়ে ঘুরেন নাকি? চেহারা দেখে আমি তো কেমন একটা ঘোরে চলে যাচ্ছি। প্লিজ এদিকে তাকাবেন না। আমার চোখে তো একদমই না।”
ভাবতে ভাবতে নিজের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল তারা। রেখা হাঁটা থামিয়ে দিয়ে দ্রুত পালাতে চাইল সেখান থেকে। তাই কোন মতে “এখানেই আমার গন্তব্য” বলেই বাড়ির মূল গেইট এর ভেতরে ঢুকতে গেল। গেটের দরজায় হাত দিতেই ছেলেটি বলে উঠল,
— ওহ! এখানে তাহলে?
ভদ্রতার খাতিরে রেখা জবাব দিল,
— জ্বি।
— ধন্যবাদ দিলেন না?
“আচ্ছা ঝামেলা তো! চেয়ে চেয়ে ধন্যবাদ নিতে আসে কে?”
মনের মধ্যে কথাটি আওড়ে নিলেও মুখে হাসি রেখেই বলল,
— ধন্যবাদ।
— বাই দ্য ওয়ে, আমি দ্রোহ আর আপনি?
— আমি কিছু না, ধন্যবাদ।
বলেই দ্রোহর সামনেই দ্রুত দরজা লাগিয়ে তার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল রেখা। অন্যদিকে দ্রোহ বোকাবনে গেল। নাম বলল না, তার উপর দরজাও এভাবে লাগিয়ে দিল। দরজা লাগানোর সময় তো মনে হলো অনেক শব্দ হবে। কিন্তু কোন শব্দ-ই হলো না। দরজা লাগানোতে অভিজ্ঞ মনে হয়। দ্রোহ নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করল।
অন্যদিকে নিজের ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে আরেক ঝামেলায় পড়তে হলো রেখাকে। দরজায় বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল এক অজানা ছেলে। তার বাড়িতে অজানা ছেলে কি করে ঢুকল সেটা বুঝতে পারল না সে। কিছু বলার আগেই ছেলেটা তার হাত ধরে টেনে ঘরের ভিতরে ঢোকানোর প্রয়াস চালাল। রেখা সেখানে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতরে দেখা চেষ্টা করল। তার ছাত্রী ভেতরেই আসে। নিজের জামা ঠিক করছে সে। মুহূর্তেই আবার চিন্তায় পড়ে গেল সে। এখন কি করা উচিত? সে যদি চিৎকার করে তার লাভের দিক থেকে কিছুই হবে না। উল্টো তাকেই দোষ দিবে সবাই। একে তো ২ মাসের ভাড়া দেওয়া হয়নি। যেকোনো মুহূর্তে বাড়ি ছাড়া লাগতে পারে। রেখা আবার ভয়ে জমে গেল। ভেতর থেকে তার ছাত্রী চাপাস্বরে বলল,
— ছেড়ে দেও প্লিজ ম্যামকে। চিৎকার করলে সমস্যায় পড়ে যাবো আমরা।
রেখা কিছু দলতে যাবে তার আগেই কেউ একজন এসে ছেলেটার মুখ বরাবর ঘুষি মেরে দিল। শক্ত হাতের ঘুষি পড়ায় এক ঘুষিতেই কাৎ হয়ে গেল সে। রেখা পাশে তাকিয়ে দ্রোহকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ছেলেটা ভয়ে সেখান থেকে চলে গেল। আবার কোন ঝামেলা তৈরি হয় কি না এই বিল্ডিং এ , সেই ভেবেই ছাত্রীও ছেলেটার পিছনেই দৌড় লাগাল। দ্রোহ রেখার দিকে তাকিয়ে বলল,
— এক গ্লাস পানি হবে?
— জ্বি।
বলেই রেখা চলে গেল পানি আনতে। ফিরে এসে দ্রোহকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে উঠল,
— ভেতরে আসুন। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো দেখায় না।
— তাহলে মাঝরাতে একটা ছেলেকে ঘরে ঢোকানো ভালো দেখায় বুঝি?
রেখা দ্রোহের হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলল,
— তাহলে বাইরেই থাকুন।
দ্রোহ এক লাফে ভিতরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে পড়ল।
— দাঁড়িয়ে পানি পান করা উচিত নয়।
রেখা দ্রোহের এমন কথায় মুচকি হাসল। দ্রোহ পানি পুরোটুকু শেষ করে বলল,
— বলুন তো কি হয়েছিল?
— আসলে যেই মেয়েটাকে দেখলেন সে আমার ছাত্রী। হঠাৎ আজ বলল আমার এখানে থেকে পুরো সিলেবাস রিভিশন দিবে। তাই আর মানা করলাম না। ওর মাকে ফোন করে জানালাম। হঠাৎ করে ওর জ্বর উঠল। হয়তো আগে থেকেই ছিল। আর বাসায় ওষুধ ছিল না। রাত করে অন্যদের ডেকেও লাভ হত না। তাই গলি পার হয়ে মেইন রোড পর্যন্ত যেতে হয়েছে ওষুধ কিনতে।
— রাত ১ টায়?
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রশ করল দ্রোহ।
— জ্বি। কিন্তু ফেরার পথে ঝামেলা হলো। আর বাড়ি এসে দেখি ও নিজের বয়ফ্রেন্ডকে এখানে এনেছে রাত করে। চিৎকার করলেও সব দায় আমার উপর আসতো। কারণ ছাত্রীকে আমি থাকতে দিয়েছি। তাই এসব হলো।
— আপনার নামটা বললেন না।
রেখাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল,
— আপনার নাম জানা কিন্তু কঠিন কিছু না। পাশের ফ্ল্যাটে ডাক দিলেই এসে বলে দিয়ে যাবে। তাই নিজেই বলুন না? এখন তো আমি আপনার বাসাও চিনি।
— রেখা, আমি রেখা। আর কিছু বলবেন?
— না, আমাকে মেইবি আমার মামা খুঁজছেন। আমাকে যেতে হবে। আজ আসি।
বলেই হাত নেড়ে চলে গেল দ্রোহ। রেখা সেদিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে দরজা বন্ধ করে দিল যাতে শব্দ না হয়।
চলবে।