তুমি রবে নীরবে
পর্ব২৬ শেষ
অপরাজিতা টুয়া
স্নেহা একদম হতভম্ব হয়ে চুপ করে সোফায় বসে ছিলো, এতক্ষন ধরে যা যা ঘটলো এখনও ভালো করে বুঝে উঠতে পারছেনা ও। আজ প্রথম ও সায়ন্তিকে দেখলো, রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়েই দেখেছিলো, কিন্তু চিনতে পারেনি কোনোদিনও দেখেনি তাই, কিন্তু ও ভাবতেও পারেনি বাবাই এইরকম একটা কান্ড ঘটাতে পারে।
গত বেশ কয়েকদিন ধরেই বাবাই এর অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করেছে, কিন্তু ওর মনে হয়েছিলো সেটা বাপির জন্যে। আর কাল তো নিজেই ও এত খুশি ছিলো যে অন্য কোনদিকে খেয়াল করার মতো ইচ্ছেই ছিলো না। এখন খুব খারাপ লাগছিলো। ইসস! ও কতো চিন্তায় ছিলো, আর ও নিজের মনেই বক বক করে ওর মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে ওর কি করা উচিৎ, ঠিক করে উঠতে পারছে না, অনেকদিন পরে এত রেগে যেতে দেখেছে বাবাই কে আবার। এই মুহূর্তে ওর যা মনের অবস্থা, ও হয়ত স্নেহাকে দেখলেও রেগে যাবে।
এদিকে বাকি বন্ধুরাও তো এসে পড়বে, তাদের সামনে ও এই ভাবে বসে থাকলে দেখতে ভালো লাগবে না, কিছুটা দোলাচলে থেকেই উঠে দাঁড়ালো স্নেহা।
সায়ন্তি বেরিয়ে যাবার পর ঘরে ঢুকে এসেছিলো বাবাই, স্নেহা চুপ করে সোফায় বসে আছে, ও কি রেগে গেলো, সব কিছু ওকে না জানিয়ে করার জন্যে, বুঝতে পারছে না ও, আজকের দিনটা একদম অন্যরকম, আর কোনো বাধা নেই সামনে, এই সময় স্নেহার মন খারাপ হলে ওর ভালো লাগবে না। ওকে হয়ত আগে থেকে বললেই ভালো হতো, কিন্তু ও যে রকম, অতো টেনশন নিতে পারতো না একদম, সেই ভেবেই তো বলতে চায়নি বাবাই, বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই বুঝবে স্নেহা, দ্বিধা কাটিয়ে উঠে দাঁড়ালো ও।
বাবাই খাট থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিলো সবে মাত্র, স্নেহা ঘরে ঢুকে এলো।
যাও, স্নান করে এসো, বন্ধুরা এসে যাবে তো, মাথাটা তো বড্ড গরম হয়ে আছে মনে হয়,
গুমোট পরিবেশটা কাটানোর জন্যেই একদম সাধারন ভঙ্গিতে বললো স্নেহা, হেসে ফেললো বাবাই। যাক, তাহলে স্নেহা কিছু মনে করেনি ওকে না বলার জন্যে।
মাথাটা একটুও গরম ছিলো না আজ, একদম ঠান্ডাই ছিলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, দিনের পর দিন ক্রমশ বিরক্তিকর হয়ে উঠছিলো ব্যাপারগুলো, কোথাও গিয়ে তো শেষ করতেই হতো একসময়, তাই আজই করলাম। ছাড়ো, এসব আলোচনা ভালো লাগছে না আর, চলো বিকেলে কোথাও ঘুরে আসি, ফেরার সময় তোমার পছন্দের রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে ফিরবো একদম।
এতো টা বিরিয়ানি কি হবে তাহলে? তুমি তো আবার রাতের মতো একেবারে করে নিতে বলেছিলে। আর তোমার অন্য বন্ধুরা?
অন্য এখন আর কেউ নেই, ওটা এমনিই বলেছিলাম, শুধু ওকেই ডেকেছি বললে তুমি টেনশন করতে তাই। সবাইকে এখানে ডাকলে আর আলাদা ওর সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না, বাকিদের আসলে ওই রেস্টুরেন্টেই ডেকেছি ডিনারে, আর বলা হয়নি তোমাকে, রাজুদের দুপুরে খেতে আসতে বলেছিলাম, তোমার সব বিরিয়ানি শেষ হয়ে যাবে চিন্তা নেই।
ওদের কথার মধ্যেই হৈ হৈ করে ঢুকে পড়লো রাজু রা, ওরা খেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে ঘরে এসে শুয়ে পড়লো স্নেহা। সকাল থেকে রান্না বান্না করে বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে আজ। কাল থেকেই গোছানো শুরু করতে হবে, অবশ্য কিই বা আছে সেরকম নিয়ে যাবার মতো আর।
জীবন আসলে চাকার মত ঘোরে, আজ থেকে প্রায় বছর খানেক আগে যে বাবাই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল বিরিয়ানির থালা, তার সঙ্গে আজকের বাবাই এর আকাশ পাতাল তফাৎ। বিরিয়ানি সেদিনও স্নেহা খাইয়ে ছিলো রাজুদের, আজও খাইয়েছে, কিন্তু যেটা কষ্টের ছিলো সেদিন, সেটা আজ আনন্দের।
চোখ বন্ধ করে পুরনো সময় গুলোয় ফিরে যাচ্ছিলো স্নেহা, মনে পড়ছিলো মায়ের বলা কথাগুলো, সময় কে সময় দিতে হয়, সময় সত্যিই ঘুরিয়ে দেয় জীবনের মোড়। যখন প্রথম নতুন সংসার করতে এই বাড়িটায় পা দিয়েছিলো ও, তখন কোনোদিনও ভাবেনি, এমন দিন আসবে ওর জীবনে। তাও অনেক আশা নিয়ে এই ছোট্ট সংসার কে নিজের মত করে গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে ও, আজ তাই ফিরে যাবার আগে কেমন যেনো মন খারাপ লাগছে এই জায়গাটা ছেড়ে যেতে। বাড়ি ফিরে যাবার আনন্দ ছাপিয়েও কোথায় যেনো কষ্ট হচ্ছে ওর। ভালো মন্দ সব কিছু মিশিয়েই অনেক স্মৃতি ছড়িয়ে আছে বাড়িটার আনাচে কানাচে, জীবনের প্রথম সংসার শুরুর দিনগুলো, তা ভালো হোক বা খারাপ, একটা অন্যরকম ভালোবাসা, একটা অন্যরকম মাধুর্য্য জড়িয়ে থাকে তার সাথে, সারাজীবনই অমলিন তার স্মৃতি।
ঘুমাও নি তুমি? বাবাই এর প্রশ্নে চোখ খুলে তাকালো স্নেহা।
নাহ! ঘুম আসছে না, বাড়িটা ছেড়ে যেতে কেনো জানি না, মন খারাপ লাগছে জানো, ইঁট, কাঠ, পাথরেও মায়া জড়িয়ে থাকে বোধহয়।
এটা সাময়িক, কিছুদিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে, সঙ্গে থাকা মানুষগুলো যদি না পাল্টায়, তাহলে সব বাড়ি, সব শহরই নিজের, মন খারাপ কোরো না। আমার বরং অন্য রকম লাগছে, সেই স্কুল ছাড়ার পর, এতদিনে বাড়িতে গিয়ে থাকবো, বাপির কথা মনে পড়ছে খুব। বাপি খুব চেয়েছিলো আমি বাড়ির কাছাকাছি কোথাও থাকি, তখন যাইনি, আজ যখন যাচ্ছি তখন আর বাপি নেই, মনটা খারাপ হয়ে আছে খুব,
চুপ করে গেলো বাবাই, স্নেহার মনটাও খারাপ লাগছিলো।
সময় সব কিছু ঠিক করে দেয় জানোতো, মা বলে আমি বিশ্বাস করিনি এতদিন, এখন করি। কেউ কারও শূন্যস্থান পূরণ করতে তো পারেনা নিশ্চয়ই, কিন্তু সময় তাতে প্রলেপ দেয়, জীবন তো এগিয়ে চলে নিজের মতো, মামনি, টুয়া ওদের সবাই কে পেয়ে আস্তে আস্তে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে একদিন, বাবাই এর মাথায় হাত রাখলো স্নেহা।
ঠিকই বলেছো, আর ভাববো না এসব নিয়ে, চলো তৈরি হয়ে নাও, আমার বন্ধুরা দাঁড়িয়ে থাকবে ওখানে।
আজ খুব সুন্দর করে সাজছিলো স্নেহা, বাবাই খাটে শুয়ে লক্ষ্য করছিলো।
স্নেহা আয়নার মধ্যে দিয়ে দেখলো ওকে, মুড তো ঠিক হয়ে গেছে মনে হচ্ছে এখন, অনেকক্ষন ধরে মনের মধ্যে চেপে রাখা কথাটা বলেই ফেললো ও,
তোমাকে একটা কথা বলি? রাগ করবে না তো?
বলো, আয়নার মধ্যে দিয়েই তাকালো বাবাই।
অতো টা খারাপ ভাবে না বললেই পারতে, প্রথমবার আমাদের বাড়িতে এসেছিলো।
বলতে চাইনি তো!! এতদিন তো চুপ করেই ছিলাম, সম্পর্ক ভালো রেখেই তো সরে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ও নিজেই সেটা হতে দিলো কই!
আসলে আমরা যখন কারোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি, তখন নিজের ভেতরেও একটা খারাপ লাগা তৈরি হয়, তাই নিজেকে ভালো রাখার জন্যেই এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত।
না, আমার একটুও খারাপ লাগছে না, এটা দরকার ছিলো, না হলে ভবিষ্যতে আরও অনেক বড় কোনো সমস্যা হয়ত তৈরি হতো, তখন এই কাজটা না করার জন্যই আফসোস হতো বরং।
ওর বাবা, মা র জন্যে খারাপ লাগছে, ওঁরা তো এত কিছু জানতেন না নিশ্চয়ই, তাই এগোচ্ছিলেন বিয়ে নিয়ে, ওঁরা যদি সত্যিটা জানতেন, তাহলে নিশ্চয়ই আটকাতে চেষ্টা করতেন মেয়েকে, তাঁরাও তাদের মেয়ের ভালোই চান সব সময়।
আজ পর্যন্ত কোনো সত্যি ও জানতে দিয়েছে কাউকে! ওঁরা সেরকম কিছুই জানেন না, ওর বাবা আমাকে বলেছিলেন এটা জেনে উনি খুশি হয়েছেন যে আমরা দেরিতে হলেও বিয়ের ডিসিশন নিয়েছি। তখনি বুঝেছিলাম, শুধু আমি নই ওঁরাও অন্ধকারেই আছেন। উনি যদি তখন জানতেন যে এটা সত্যি নয়, তাহলে এত ধাক্কা খেতেন, তার ফল যা হতে পারতো, তাতে আমার বিপদই বাড়তো হয়ত, সেই ভয়েই তো চুপ করে ছিলাম তখন। যাক গে, ওসব ছাড়ো এখন, আমাদের নিজেদের কথা বলি, তোমার জন্য আর একটা সারপ্রাইজ আছে।
আবারও সারপ্রাইজ? একদিনের জন্যে বেশি হয়ে যাচ্ছে এবার, ভয় পেয়ে যাচ্ছি, হেসে ফেললো স্নেহা।
নতুন জায়গায় জয়েন করার আগে কিছু দিন ছুটি নিয়েছি, হানিমুনে তো যাওয়া হয়নি তখন, তোমার কিসব দুঃখ ছিলনা, ফেসবুকে ফটো দেওয়া নিয়ে, এবার সুন্দর সুন্দর ফটো দিতে পারবে তুমি, মুচকি হেসে বললো বাবাই।
এটা তোমাকে কে বললো? টুয়া তাই না? ভীষণ লজ্জা লাগছিলো স্নেহার, কাল সকালেই টুয়াকে ফোন করে মজা দেখাবে ও।
ওকে বিশ্বাস করে বলেছিলাম, ও একদম কথা চাপতে পারেনা! রেগে গেলো স্নেহা।
তোমার মতো কথা আর কজনই বা চাপতে পারে, সঞ্জয় তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলো, তুমি বলেছিলে একবারও?
এটা আবার বলার মতো কোনো ব্যাপার নাকি, তোমার সঙ্গে সঞ্জয়ের কথা হয়েছিলো, সেটাও তো তুমি বলোনি আমাকে! আর উল্টে আমাকেই মিথ্যেবাদী বানালে, আমি তোমাকে কখন বললাম, টাকাটা দিয়ে দিতে? আমার নামে বানিয়ে বললে তুমি!
তুমিই তো সঞ্জয়কে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলে, তাই আমার যেনো তোমার মুখ দেখেই মনে হলো তুমি বললে, হেসে ফেললো বাবাই।
তুমি আমার মুখ দেখেই সব বুঝে নাও নাকি!!
নিই তো!! তুমি নিজে আর বলো কখন!! হাত ধরে স্নেহাকে কাছে টেনে নিয়ে এলো ও,
সায়ন্তির কথায় তুমি ভয় পেয়েছিলে স্নেহা? তুমি ওকে দেখে কি ভাববে, এটা ভেবেই কাল থেকে আমার খুব টেনশন হচ্ছিলো।
নাতো!! আমার বিশ্বাস ছিলো, আমি তো জানতাম, যদি তোমার সত্যি কিছু বলার থাকতো তুমি নিজেই বলতে আমাকে।
এই বিশ্বাসটুকুই ধরে রেখো সারাজীবন। কাল সকাল থেকেই হাতে হাতে গুছিয়ে নেবো দুজনে বুঝলে, রিলিজ অর্ডার নিয়ে এসেছি, আর যাবনা হসপিটালে, এবার একদম বাড়ি গিয়েই নতুন জায়গায় নতুন করে শুরু করবো সব কিছু, স্নেহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বাবাই।
চোখ বন্ধ করে বাবাই এর বুকে মুখ গুঁজে দিলো স্নেহা, সবাই কে নিয়ে এরকম একটা সুখী সংসারের স্বপ্নই তো ও দেখে এসেছে সারাজীবন!!
সমাপ্ত