তুমি রবে নীরবে পর্ব২৪,২৫

তুমি রবে নীরবে
পর্ব২৪,২৫
অপরাজিতা টুয়া
পর্ব২৪

রোগীর ভিড় অনেকটাই কমে এসেছে এখন, বিকেল শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, টেবিলের ওপর মাথা রেখে বসে ছিলো বাবাই। মনটা খুব অশান্ত হয়েছিলো প্রথম দু একদিন, সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে প্রথমে স্নেহার সঙ্গে কথা বলবে ভেবেছিলো, কিন্তু ফিরেই দেখেছিল স্নেহা ঘুম চোখে ওর জন্য সোফায় বসে অপেক্ষা করছে, সেই সময় ওইসব কথা বলে ওর রাতের ঘুম টা নষ্ট করে দিতে আর ইচ্ছে হয়নি ওর।

সায়ন্তি যে ওকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে এই ভাবে অস্বস্তিতে ফেলবে একটুও ভাবতে পারেনি বাবাই। একদম হতবাক হয়ে গিয়েছিলো ও, সায়ন্তির বাবা যখন ওকে বিয়ের কথা বললেন, কি উত্তর দেবে ঠিক করে উঠতে পারলো না সেই মুহূর্তে। ভদ্রলোক সদ্য হসপিটাল থেকে ফিরেছেন, কোনো রকম চাপ ওনার জন্য খারাপ হতে পারে ভেবেই পিছিয়ে এলো ও। মুহূর্তে যেনো বাপির কথাও মনে হলো একবার, উনিও তো বাপিরই বয়সী প্রায়, কিছু হয়ে গেলে আর ক্ষমা করতে পারবেনা নিজেকে।

পরে রাত্রে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেক কিছু ভেবেছিলো সেদিন, স্নেহার সঙ্গে এই মুহূর্তে কোনো কথা ও বলবেনা, ও এমনিতেই খুব মন খারাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, আর কোনো টেনশন ওকে দেবেনা এবার, একেবারেই বলবে যা বলার, নিজেও এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে চাইছে ও, নতুন করে গুছিয়ে নেওয়া এই জীবনটায় আবার এরকম কিছুর সম্মুখীন হতে হবে, এক মুহূর্তের জন্যেও মনে হয়নি আগে। আজ পর্যন্ত যতবার ও নিজেকে গোছাতে চেয়েছে, প্রত্যেকবার ঠিক কোনো না কোনো ভাবে সায়ন্তি ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

কলেজের প্রথম দিন থেকে, যখন ও আটকাতে চেষ্টা করেছিলো ওকে, তখন রীতিমত সুইসাইডের ভয় দেখিয়ে ওকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছে একসময়। বাড়ির সবার সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক, বাপির অসুস্থতার শুরুও তো তাই থেকেই, যদি তখন ও শক্ত থাকতে পারতো, যদি সায়ন্তিকে বিয়ে করার জেদ না করতো, তাহলে হয়ত বাপি কে এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে হতো না!! বিয়ের পরেও তো ওকে কোনোদিনও শান্তিতে থাকতে দেয়নি, স্নেহার সঙ্গে যখন সম্পর্ক সহজ করার চেষ্টা করছিলো ও, তখনও নিজের সুবিধামত ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে ওকে। তবুও বাবাই তো প্রত্যেক মুহূর্তে ওর পাশে থাকার চেষ্টা করেছে, সব সময় চেয়েছে, বিয়ে না হলেও বন্ধুত্বটুকু অন্তত যেনো নষ্ট না হয় কোনো সময়। তাই তো ও পাঁচ মাস কথা না বলার পরেও ওর বাবাকে দেখতে যাওয়ার কথায় ও রাজি হয়েছিলো! ফ্ল্যাটের কথা জানতে পারা সত্বেও না জানার ভান করেছিলো, শুধু ওকে লজ্জায় ফেলতে চায়নি বলেই। কিন্তু আর না! ও যদি সব সময় ভেবে থাকে বন্ধুত্ব বজায় রাখার দায় শুধু বাবাই এরই, তাহলে ও ভুল ভেবেছে এবার। সেদিন ও একটুও বুঝতে দেয়নি সায়ন্তিকে, এর আগের বার রেস্টুরেন্টে মাথা গরম করে যা ভুল ও করেছিলো, এবার আর করবে না সেটা। প্রত্যেকবার অনেক সুযোগ হারিয়েছে, এবার আর কোনো সুযোগ হারাতে চায়না। সব কিছু একদম ঠান্ডা মাথায় করতে চায় ও, তাই এবার আর কোনো তাড়াহুড়ো করবে না ঠিক করেই নিয়েছে।

স্যার, আপনার একটা চিঠি আছে

মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো বেয়ারা সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, হাত বাড়িয়ে চিঠি টা নিলো বাবাই।

খুব উদগ্রীব হয়ে চিঠিটা খুললো, ও যে ট্রান্সফারের জন্য চেষ্টা করেছিলো, সেটা হয়ে গেছে, হাতে চিঠি পেয়ে শান্তি পেলো খুব, এত তাড়াতাড়ি যে হয়ে যাবে নিজেও আশা করেনি। আরও অন্তত দিন পনেরো লাগবে, এইরকমই আশা করেছিলো ও।

এইটার জন্যই তো অপেক্ষা করছিলো এতদিন, খুব আনন্দ হচ্ছে, অবশেষে বিরাট একটা সমস্যার সমাধান হতে চলেছে। আর মামনি আর টুয়াকে একা রাখতে হবেনা। মামনি শুনলে ভীষণ খুশি হবে, স্নেহাও চমকে যাবে একদম, খবরটা তাড়াতাড়ি দিতে হবে স্নেহা কে, চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো বাবাই।

রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই ঘিরে ধরলো বন্ধুরা, দু একজনের কাছে এর মধ্যেই ট্রান্সফারের খবর পৌঁছে গেছে,

কিরে? না খাইয়েই চলে যাবি নাকি? তোর বউয়ের সঙ্গেও তো আলাপ করাসনি কোনোদিনও,

কথাটা যে মিথ্যে নয় সেটা জানে ও ও, স্নেহার সঙ্গে এতদিনেও কোনো বন্ধুরই আলাপ করায়নি আজ পর্যন্ত, তাই ওদের সত্যিই যাবার আগে কাল একবার নিমন্ত্রন করার সিদ্ধান্ত নিলো বাবাই।

ঠিক আছে, কালই তাহলে বলেই তাড়াতাড়ি বাড়ির পথ ধরলো ও।

নমস্কার, আপনিই ডাক্তার অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জি তো?

প্রশ্ন শুনে পেছনে ঘুরে তাকালো বাবাই, প্রায় ওরই বয়সি একটি ছেলে হাত দুটো নমস্কারের ভঙ্গিতে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, ও ও হাত দুটো জড়ো করে ঘাড় টা হেলালো একটু।

আমি সঞ্জয়, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাইছিলাম, বেশ কিছুদিন ধরেই যোগাযোগ করতে চেষ্টা করছি, কিন্তু করে উঠতে পারছি না আর, বাবাই এর সামনে এগিয়ে এলো ছেলেটি।

নিশ্চয়ই কোনো রোগীর আত্মীয়, মনে মনে ভাবলেও মুখে কিছু প্রকাশ করলো না সেটা।

বলুন, কি বলতে চান?

অচেনা নম্বরের ফোন ধরেন না বোধহয়? একটু রূঢ় গলায় বললো ছেলেটি, বাবাই এবার স্পষ্টতই বিরক্ত হলো।

কে বলুন তো আপনি? এতো কথা কেনো বলছেন? কি বলতে চান সোজাসুজি বলুন, আমার তাড়া আছে।

কিছু মনে করবেন না, আমি খুব বিপদে আছি, তাই হয়ত একটু কড়া করে বলে ফেলেছি, গলাটা একটু নরম করে বললো এবার। আমি আসলে আপনার স্ত্রীর সঙ্গেও যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু উনি কোনো হেল্প করতে পারবেন না বলেছেন, তাই আপনার সঙ্গেই সামনা সামনি কথা বলতে এলাম।

স্নেহার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন ভদ্রলোক!! ওকে তো স্নেহা জানায়নি কিছু, মনে মনে চমকে উঠেও নিজেকে সামলে নিলো ও।

বলুন কি দরকার?

আপনার গার্লফ্রেন্ড সায়ন্তি আমার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করেছিলো এখন আর ফেরত দিচ্ছেনা….

কথা শেষ করার আগেই ছেলেটি কে আটকালো বাবাই,

আমি কিছু কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই আপনাকে, সায়ন্তি আমার গার্লফ্রেন্ড নয়, শুধুই ক্লাসমেট, আর এরকম অনেক বন্ধু আমার আছে, তাদের সবার ধার শোধ করার দায়িত্ব আমি নিই নি, আপনার বোধহয় আর কিছু বলার নেই, বলেই পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলো ও।

বাড়ির গেটে পৌঁছে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলো স্নেহা দাঁড়িয়ে আছে, ও খবরটা শুনলেই দারুন খুশি হবে।

তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে, স্নেহা চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বললো বাবাই, অবাক হয়ে তাকালো স্নেহা।

তুমি মামনিকে একা রাখতে চাইছিলে না , আর আমিও ভেবে দেখলাম সেটাই ভালো হবে, মায়ের শরীরটাও তো ভালো নয়, তাই ট্রান্সফারের জন্য চেষ্টা করছিলাম, আজ অর্ডারটা হাতে পেলাম, ওখানেই কাছের হসপিটালে পেয়ে গেছি।

সত্যি!! তুমি বলোনি তো আগে!! সত্যিই খুব ভালো খবর এটা, এক্ষুনি ফোন করতে হবে সবাইকে, বলেই প্রায় দৌড়েই বেরিয়ে যাচ্ছিলো স্নেহা, বাবাই আটকালো।

আরে দাঁড়াও, আমার কথা শেষ হয়নি এখনও, সেইজন্য কাল আমার দু তিন জন বন্ধুকে নিমন্ত্রন করেছি, তোমার অসুবিধা হবে নাতো?

কিসের অসুবিধা? কোনো অসুবিধা নেই, বলেই ছুটে চলে গেলো স্নেহা,

ও এখন বেশ খানিকক্ষন ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে জানে বাবাই, এই অবসরে নিজের ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে সায়ন্তি কে ফোন করলো ও।

কাল তোর আমার বাড়িতে নিমন্ত্রন আছে, ঠিক সময়ে আসিস কিন্তু।

কেনো হটাৎ? ডিভোর্সের ব্যাপারে কি করলি? বউয়ের সঙ্গে কথা বলেছিস?

না, বলে নেবো, চিন্তা করিস না, হটাৎ কিছু নয় আরো কয়েকজন কেও বলেছি।

ভালোই হয়েছে তুই নিজে থেকে তোর বাড়িতে ডাকলি, আমিও ভেবেছিলাম তোর বউকে দেখবো একদিন, আজ পর্যন্ত কখনো দেখিনি তো, আর কোনোদিনও দেখতেও পাবোনা, এবার না দেখলে।

হ্যাঁ, চলে আয়, আলাপ করিয়ে দেবো তোকে, রাখছি এখন, বলে ফোনটা নামিয়ে রাখলো বাবাই।

ফোন রাখতে রাখতেই স্নেহা ফিরে এলো, দারুন খুশি লাগছিলো ওকে,

এতো সহজে যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে একটুও ভাবিনি জানো, মা আর মামনি দুজনেই খুব খুশি হয়েছে, কালকের দিনটা তোমার বন্ধুদের খাইয়ে দিয়েই সব জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করবো বুঝলে,

স্নেহাকে এত কথা বলতে ও দেখেনি কোনোদিনও, ও যে খুব খুশি হয়েছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা বুঝতেই পারছিল বাবাই। কাল নিশ্চয়ই বন্ধুদের মধ্যে সায়ন্তিকে আশা করবেনা ও, ওর কি রকম রিয়াকশন হবে ভাবছিলো বাবাই, কিন্তু এখন ও কিছু বলবেনা ওকে, মনে মনে ঠিক করে নিলো ও।

চলবে

তুমি রবে নীরবে
পর্ব২৫

জানলা দিয়ে রোদ এসে চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙলো বাবাই এর। কাল ঘুম আসতে অনেক দেরি হয়েছিলো, পাশে শুয়ে স্নেহা অনেক কথা বলে যাচ্ছিলো, কিন্তু ও শুধু হুঁ, হ্যাঁ র ওপরেই উত্তর দিচ্ছিলো, মনের মধ্যে যে অশান্তি টা চেপে রেখেছিলো, সেটা আরো বেশি করে জেঁকে বসছিলো ক্রমশ। স্নেহা যে এতো কথাও বলে, সেটা ভেবেই অবাক লাগছিলো, আসলে বাড়ি ফেরার আনন্দটা ও কিছুতেই চেপে রাখতে পারছে না। এখানে ও সারাদিন একা একা থাকে জানে বাবাই।

কিন্তু ওর নিজের খুব টেনশন হচ্ছে, যে ঝড়ের মুখোমুখি ও হতে যাচ্ছে, সেটা ঠান্ডা মাথায় সামলাতে পারবে তো! স্নেহাকে কিছুটা আভাস দিয়ে কি রাখা উচিত ওর, ও সায়ন্তি কে দেখে আগেই অন্যরকম কিছু ভেবে বসবে না তো! নিজের ভেতরেই অশান্তি হচ্ছে ওর।

মাথাটা একটু ধরে আছে, আজ অনেকদিন পরে, স্নেহা চা নিয়ে আসেনি এখনও, নিশ্চয়ই আজ রবিবার বলে আর ডাকেনি ওকে। কিন্তু এখন বেশ কিছুদিনই তো ওর রবিবার, আর হসপিটালে যাওয়ার নেই, মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মন টা একটু ভালো হয়ে গেলো, আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো ও।

এমা! তুমি তো আবার শুয়ে পড়লে, আমি তোমাকে উঠতে দেখে চা নিয়ে এলাম তো।

না, জেগেই আছি, চা টা দাও, মাথা টা ধরে আছে, খাটে উঠে বসলো বাবাই।

তাই নাকি! আমি কাল রাতে অনেক কথা বলে ফেলেছি না? ইসস, খুব খারাপ লাগছে।

হ্যাঁ, তা একটু তো বলেছো, এখন প্রায়শ্চিত্ত করো, মাথা টা টিপে দাও একটু, বলেই হেসে স্নেহার কোলে মাথা রেখে আবার শুয়ে পড়লো ও।

সে না হয় করছি, কিন্তু তোমার বন্ধুরা,তাদের যে নিমন্ত্রন করেছো, বাজারে না গেলে তারা তো, না খেয়েই ফিরে যাবে। বলে না অতিথি নারায়ণ! অতিথি না খেয়ে ফিরে গেলে যে পাপ হবে তার প্রায়শ্চিত্ত কে করবে?

এই রে, সত্যি তো, একদম ভুলেই গেছি লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো বাবাই।

বেলের আওয়াজ শুনে রান্না ঘর থেকে উঁকি দিলো স্নেহা

আমি খুলছি, তুমি কাজ করো, দরজা খুলে দাঁড়ালো বাবাই।

আয়, ভেতরে আয়, হাসিমুখে সায়ন্তি ঢুকে এলো ভেতরে, বেশ সুন্দর করে সেজে এসেছে আজ, বাবাই লক্ষ করছিলো। স্নেহা রান্নাঘরে কাজ করছে, ওর সঙ্গে পরিচয় না করিয়েই ঘরে ঢুকে গেলো ও সায়ন্তিকে নিয়ে।

ভীষণ খুশি খুশি লাগছে ওকে, এতদিনে সব ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে বোধহয়।

সকালে গিয়েই বাবাই মাটন নিয়ে এসেছিলো, স্নেহা বিরিয়ানি করবে।

কিনে খাওয়াতেই পারি স্নেহা, কিন্তু প্রথম বার বাড়িতে ডাকছি তো বন্ধুদের, তাই তুমি নিজে হাতে করলে ভালো দেখাতো মনে হয়। একদম রাতের মত করে নিও, তাহলে আর ঝামেলা থাকবে না।

হ্যাঁ, ঠিক আছে, আমি তো রান্না করতে ভালোই বাসি, অবশ্যই বাড়িতেই করবো, তুমি নিয়ে এসো।

তাই আজ সকাল থেকেই রান্নার তোড়জোড়ে ব্যস্ত স্নেহা, বাবাই ওকে ডিস্টার্ব করতে চায় না।

আর সবাই কোথায়? ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো সায়ন্তি।

এই তো এসে যাবে এবার এক এক করে, তুই ঘরে আয়।

তোর বউ কে কিছু বলেছিস, ওর কি অবস্থা? ডিভোর্স দিতে রাজি হবে তো? জানতে চাইলো সায়ন্তি।

নাহ! বলা হয়ে ওঠেনি এখনও, ফিরতে অনেক রাত হয়েছিলো তো তাই।

তুই সব ব্যাপারেই এতো ভয় পাস কেনো বলতো? এতদিনেও বলে উঠতে পারলি না, এদিকে বাড়িতে আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করছে।সেই যে সেদিন এলি, তারপর থেকে তো ফোনও করিসনি একবারও, মা জানতে চাইছিলো তুই তোর মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিস কিনা।

জানিসই তো, আমি কোনো কিছুই বলে উঠতে পারিনা সহজে, নিজের এই বেশি ভদ্র স্বভাবের জন্যই না সব সময় সবাই, নিজের সুবিধা মত ব্যবহার করে আমাকে।

সে তো জানিই, আমার চেয়ে আর কেই বা বেশি চেনে তোকে! তারমানে তুই তোর বউ বা মা, কাউকেই বলে উঠতে পারিস নি এখনো তাই তো!! এদিকে আমার বাড়িতে তো বাবা দিন ঠিক করার জন্য চাপ দিচ্ছে আমাকে। এখন তাহলে কি হবে? আমি কি অনন্তকাল বসে থাকবো, কবে তুই লজ্জা কাটিয়ে বউ কে ডিভোর্সের জন্য বলবি বলে? ছেড়ে দে, তোর দ্বারা কিছু হবে না, বুঝে গেছি আমি। এবার যা করার আমিই করবো।

হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে, তোর সঙ্গে আলাপ করাবো তো, তুই নিজেই বলে দিস বরং, আমার পক্ষে বলা সম্ভব হবে না মনে হচ্ছে। চা খাবি?

তুই না আমাকে লাঞ্চের নিমন্ত্রন করেছিস, শেষে চা খাওয়াবি?

আরে না না, সেটা তো হবেই, তার তো অনেক দেরি আছে এখন, একটু চা খা ততক্ষন।

স্নেহা, চা করো একটু, ঘর থেকেই চেঁচিয়ে বললো বাবাই।

চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকলো স্নেহা, সায়ন্তি তাকিয়ে দেখলো ওকে। ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলো বাবাই, অনেক কিছু বলার জন্য তৈরি হচ্ছে ও।

এসো, ও সায়ন্তি, তুমি তো এতদিন নামে চিনেছ ওকে,আজ পরিচয় করিয়ে দি। সায়ন্তির তোমাকে কিছু বলার আছে, ও তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়, বসো এখানে, হাত বাড়িয়ে স্নেহাকে খাটে বসতে বললো বাবাই।

স্নেহা হাত জড়ো করে নমস্কার করলো ওকে, সায়ন্তিও একটু হাত টা তুললো শুধু।

দ্যাখো, আমি বেশি রেখে ঢেকে কথা বলতে পারিনা অনির মতো, যা বলি সোজাসুজি বলতেই পছন্দ করি সব সময়, আমার কিছু বলার আছে তোমাকে, অনি বলতে পারেনি, তাই আমিই বলছি, স্নেহার দিকে তাকালো সায়ন্তি।

স্নেহা মুখে মৃদু হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে, ওর মনে কি চলছে বুঝতে চেষ্টা করছিলো বাবাই।

আসলে আমরা বিয়ে করবো ঠিক করেছি..

এক মিনিট, আমরা নই তুই, তুই বিয়ে করবি বলে ঠিক করেছিস, সায়ন্তিকে থামিয়ে দিয়ে বললো বাবাই।

মানে? সায়ন্তি অবাক হয়ে তাকালো।

মানে আমি তো অলরেডী বিবাহিত। যাকগে, স্নেহা, আমি বলি তোমাকে, ও আসলে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে আমাকে এতদিনে, কারণ ও এতদিন পরে বুঝতে পেরেছে যে ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। যদিও ওর আগে যা সমস্যা ছিলো এখনও সেগুলোই আছে, ওর ভাইয়ের পড়াশুনা, বাবার অসুস্থতা সবগুলোই আগের মতই আছে, তাও যেহেতু বাপি মারা যাওয়ায় আমার আর ত্যাজ্যপুত্র হয়ে সম্পত্তি হারানোর ভয় নেই, সেহেতু ওই সমস্যাগুলো এখন আর ততটা বড় কিছু সমস্যা নয়।

রাগে, অপমানে থরথর করে কাঁপছে সায়ন্তি। তুই কি আমাকে অপমান করার জন্য ডেকে এনেছিস এখানে?

না, কিছু কথা বলার জন্য ডেকেছিলাম, আজ পর্যন্ত তোকে যত টাকা দিয়েছি, সেগুলো বন্ধু হিসাবেই দিয়েছি, ওগুলো আর ফেরত চাইবো না। তুই ওই সঞ্জয়ের কাছ থেকে যেটুকু নিয়েছিস সেটুকু তুই নিজেই ফেরত দিতে পারবি আশাকরি। স্নেহা যদিও বলেছিলো যে এতদিনের বন্ধু হিসাবে তোর বিয়েতে তো ভালো কিছু দেওয়া উচিত আমাদের, তাই ওই টাকাটা আমার আর স্নেহার তরফ থেকে তোর বিয়ের আগাম উপহার হিসেবেই দিয়ে দিতে, কিন্তু আমি পরে ভেবে দেখলাম যে আমি আসলে তোকে একটা ফ্ল্যাট গিফট করেই দিয়েছি অলরেডী, তাই আর নতুন করে কিছু দিলাম না।

সেদিন যখন তুই তোর ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে বিয়ের কথা বললি, তখনই এই কথাগুলো বলবো বলে ভেবেছিলাম, কিন্তু একটাই কারণে বলিনি। তুই হয়ত আমার মৌনতা কে আমার সম্মতির লক্ষণ বলেই ধরে নিয়েছিলি, কিন্তু এগুলো আমি আসলে স্নেহার সামনেই তোকে বলতে চেয়েছিলাম, যদি ওখানে কিছু বলে ফেলতাম, তাহলে আজ তোকে এখানে আর নিয়ে আসতে পারতাম না। তাই তোর মায়ের দেওয়া মিষ্টিটা ইচ্ছে না হলেও হাসি মুখেই খেয়ে নিয়েছিলাম, আর তোর বাবার কথার কোনো প্রতিবাদও করিনি।

তুই আমার বাবা চলে যাওয়ার দুঃখে অত কিছু দুঃখিত হোসনি আমি জানি সেটা, তোর হয়ত মনে নেই কিন্তু আমি ভুলিনি, কয়েক মাস আগে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে তুই আমার বাবা সম্বন্ধে কি বলেছিলি। তুই বলেছিলি না, আমার বিয়ের পর বাবা সুস্থ হয়ে গিয়েছেন কিনা, নাহ! উনি একটুও সুস্থ হননি আর, সেটা এখন বুঝেছিস নিশ্চয়ই।

এতদিন পরে বাড়িতে ডেকে এই কথাগুলো কেনো বললি? এতদিন বলিস নি কেনো? আমি তো তোকে বেশ কয়েকদিন আগেই বলেছিলাম, আমার বাড়িতে কতদূর এগিয়ে গেছে তুই জানিস?

ও হ্যাঁ, এটা তুই ভালো প্রশ্ন করেছিস। আসলে আমি আগেই তোকে বলতাম, কিন্তু আমার ট্রান্সফার অর্ডারটা হাতে পাইনি, তাই বলিনি এতদিন, এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আসলে আর কোনোদিনও তোর মুখ দেখতে চাইনা, কাল থেকে আর যেতে হবেনা হসপিটালে তাই আজ তোকে বললাম। তোর বাড়িতে কতদূর এগিয়ে গেছে সেটা জানার আমার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ যা করেছিস তুই সবটাই নিজের দায়িত্বে করেছিস আমাকে না জানিয়েই, তাই কি করে বাকিটা এবার সামলাবি সেটা তোকেই ঠিক করতে হবে।

আর তুই নতুন করে শুরু করতে বলেছিলি না, হ্যাঁ আমি নতুন করেই আবার শুরু করেছি সব কিছু স্নেহার সঙ্গে, এখানে তোর আর কোনো প্রয়োজন নেই। শোন, স্নেহা বিরিয়ানি টা সত্যিই খুব ভালো বানায়, তবু তোকে খেয়ে যেতে বললাম না আর, বাইরে বেরিয়ে যাবার দরজাটা খুলে ধরলো বাবাই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here