তুমি রবে নীরবে পর্ব ১

তুমি রবে নীরবে
পর্ব ১
অপরাজিতা টুয়া

টেবিলের ওপর রাখা বিরিয়ানির থালাটা ফ্লায়িং ডিশের মত উড়িয়ে দিলো বাবাই, সেটা সজোরে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়লো ঝন ঝন আওয়াজ করে, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো বিরিয়ানির ভাত আর মাংসের টুকরোগুলো। স্তব্ধ হয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো স্নেহা, চোখের সামনে অত কষ্ট করে সকাল থেকে রান্না করা খাবারের এই পরিণতি দেখে বুক টা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিলো ওর, কিন্তু চোখ ফেটে একটুও জল বাইরে আসতে দিলোনা সে।

গত প্রায় মাস খানেক ধরেই কম বেশি বাবাই এর এই ধরনের ব্যবহারে স্নেহা অভ্যস্ত হয়ে উঠছে ক্রমশ। অথচ ওর দিক থেকে তো ও চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখছে না, আজ বাবাই এর জন্মদিন ছিল। ও বিরিয়ানি ভালোবাসে বলে নিজে হাতে সকাল থেকে উঠে পড়ে হাত লাগিয়েছিল, কাল থেকেই জোগাড় করে রেখেছিলো সব মসলাপাতি। বাবাই সকালে হসপিটালে বেরিয়ে যাবার পর রান্না করেছিলো সবটাই। জন্মদিন বলে পায়েস ও বানিয়েছিল ওর জন্য। ভেবেছিলো বাবাই দুপুরে খেতে এলে সারপ্রাইজ দেবে, মনের মধ্যে একটু ভয় যে কাজ করছিলো না সেটা নয়, তবে জন্মদিনে এরকম কিছু একটা করবে এত টা খারাপ আশা করেনি ও।

এবার কি খেতে দেবো ওকে, ভাবতে ভাবতেই স্নেহার সামনেই গেঞ্জি টা ঘরের আলনা থেকে তুলে নিয়ে মাথায় গলাতে গলাতেই সজোরে দরজার ল্যাচটা বাইরে থেকে টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো বাবাই। আর সন্ধ্যের আগে যে ঘরে ফিরবেনা সেটা বুঝতেই পারছিলো স্নেহা। কোনো কিছুই ভালো লাগছিলো না আর, মেঝেতে নিচু হয়ে বসে খাবার গুলো মাটি থেকে তুলতে তুলতেই, এতক্ষণের চেপে রাখা কান্না টা গাল বেয়ে জলের ধারা হয়ে নেমে আসছিলো। সমস্ত খাবারগুলো তুলে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে মেঝেটা কে পরিষ্কার করে চুপ করে ঘরের সোফায় বসলো স্নেহা। এখনও হাঁড়িতে এক গাদা বিরিয়ানি পড়ে আছে, রাতের জন্যও করেছিলো এক সঙ্গেই, কি করবে বসে বসে ভাবছিলো স্নেহা। নিজেরও খাওয়া হয়নি এখনও কিন্তু আর খেতে ইচ্ছা করছে না একটুও।

বিরিয়ানি টা ফেলে দিতে খারাপ লাগছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা ক্ষোভ জন্মাচ্ছে আস্তে আস্তে। কার জন্য এত পরিশ্রম? যে ছেলেটা বিয়ের পর এক মাস পেরিয়ে গেলো, এত প্রচেষ্টা স্বত্বেও একটুও বদলালো না নিজেকে, তার জন্য আর নতুন করে কিছু করার ইচ্ছেটা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে স্নেহা। অথচ আজকের দিনটা তো ও অন্য ভাবেই কাটাবে ভেবেছিলো, যতই খারাপ ব্যবহার করুক না কেনো, জন্মদিনের দিন বউ কষ্ট করে নিজের হাতে ওর প্রিয় খাবার বানিয়েছে বলে ওর তো একটু হলেও খুশিই হবার কথা ছিলো, অন্তত স্নেহা সেরকম ভাবেই ভেবেছিলো সবটা। কিন্তু এই মুহূর্তে বুঝতে পারছিল ঠিক ডিসিশন নেয় নি ও। নিজের মতো ভেবে না নিয়ে গত মাস খানেকের ব্যবহার দেখেই শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল ওর।

ঠিক ওদের ফ্ল্যাট টার উল্টোদিকে স্টেশনের ধার বরাবর একটা বস্তি আছে, ওখানকার বাচ্চা গুলো প্রায়দিনই খেলার সময় ঢুকে পড়ে ওদের বিল্ডিংয়ের ক্যাম্পাসে। স্নেহাদের দোতলার ফ্ল্যাটে উড়ে এসে পড়ে ওদের বল, সেই বল নিতে ওপরে এসে ওরা একটু টি ভি দেখতে দাঁড়িয়ে পড়ে দরজা খুললেই। সারাদিন মোটামুটি একাই থাকে বলে একটু কেও এলেই কথা বলতে ইচ্ছে করে ওর। এই করেই বাচ্চা গুলোর সঙ্গে একটা মিষ্টি সম্পর্ক তৈরি হয়েছে স্নেহার, আগে একটু ভয় পেলেও এখন মাঝে মাঝেই কার্টুন দেখার আবদার নিয়ে এসে পড়ে ওরা। আসলে এই কলকাতা শহরে কোনো ফ্ল্যাট বাড়িতে ঢোকার সাহস আগে না পেলেও এখন স্নেহার ব্যাবহারে ভয় কেটেছে ওদের। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো স্নেহা। রাজু একটু এদিকে আয়, নীচে রাজু কে দেখে ডাক দিল ও। রাজু এই বস্তিতেই থাকে স্নেহার টি ভি দেখার পার্টনার, রাজু ওপরে উঠে আসতেই বিরিয়ানির টা একটা বড় গামলায় ঢেলে ওর হাতে দিয়ে বললো আজ দাদার জন্মদিন, সবাই মিলে ভাগ করে খাস, আর হ্যাঁ গামলা টা মনে করে ফেরত দিয়ে যাস বিকেলে।

রাজু খুশি মনে চলে যেতেই খাটে এসে শুয়ে পড়লো স্নেহা। কেনো যে এই বিয়েতে রাজি হলো ও, নিজের বাবা, মায়ের ওপর প্রবল রাগ হচ্ছিলো ওর। কিন্তু ও নিজেও তো খুব বেশি কিছু আপত্তি জানায়নি, বরং ভেবেছিলো আস্তে আস্তে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে এক সময়। আসলে ও যে ছোটো থেকেই বাবাই কে নিজের স্বামী হিসাবেই জেনে এসেছে, আর অন্য কাউকে এই জায়গাটা দেবার কথা ভাবতেও পারেনি কোনো দিনও, চোখ বন্ধ করলেই শুধু এই একটা মুখই তো চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওর, কি করবে ভাবতে ভাবতেই চোখ টা ঘুমে জুড়িয়ে এলো স্নেহার।

ঘুম থেকে উঠে দেখলো সন্ধ্যে হয়ে গেছে, রাস্তার আলো গুলো জ্বলে উঠছে একটা একটা করে, বাবাই ফেরেনি এখনও। এই টেকনিক টা গত এক মাসে বেশ বুঝতে পারছে স্নেহা, ইচ্ছা করেই ঘরে আসেনা ও যাতে স্নেহার মুখোমুখি হতে না হয় সহজে, একদম রাত করে ফিরেই খেয়ে শুয়ে পড়বে। প্রথম প্রথম খুব চিন্তা হতো, ঘর বার করতো, বার বার ব্যালকনি তে গিয়ে দাঁড়াতো স্নেহা। এখন কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে ও, তাই চিন্তার পরিমাণ টা কমে গেছে অনেক টাই। সন্ধ্যে প্রদীপ জ্বালা হয়নি এখনও, ঘরের আলো গুলো জ্বালতে লাগলো স্নেহা। এবেলা কি রান্না করবে বুঝতে পারছেনা, জন্মদিনের পায়েস টাও বানিয়ে রেখেছিলো সকালে, বিরিয়ানির সঙ্গে দেবেনা বলে ফ্রিজে তুলে রেখেছিলো, রাতে খাওয়ার সময় দেবে ভেবেছিলো, সেটা এখন আর ঠিক হবে কিনা মনস্থির করতে পারছিলো না এই মুহূর্তে।

যাইহোক কিছু করতে হবে ভেবেই রান্না ঘরে ঢুকলো স্নেহা। সবজি গুলো ট্রে থেকে নিয়ে কি রান্না করবে ভাবছিলো, তখনই ফোন টা বেজে উঠলো, ধরতে গিয়ে দেখলো মামনি ফোন করেছে। বাবাই কোথায়, সকাল থেকে একবারও কথা বলতে পারলাম না, ফোন টা বন্ধ কেনো, উদ্বিগ্ন গলা ভেসে এলো। তোমার ছেলে তো বাড়িতে নেই মামনি, বলে যায়নি কোথায় বেরিয়েছে, এলে করতে বলবো বলেই শাশুড়ির ফোন টা রেখে দিলো স্নেহা। ফোন টা রাখার পর মনে হলো, ফোন বন্ধ তো থাকেনা সাধারণত তাহলে কি কিছু হলো বাবাই এর? রাগ আর কষ্ট টা ছাপিয়ে কোথাও টেনশন হতে লাগলো স্নেহার।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here