দৃষ্টির অগোচরে দ্বিতীয় অধ্যায়,২য়_পর্ব,৩য়_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
২য়_পর্ব
“এভাবে লাশ দেখে তো বোঝা যায় না। কারণ তাকে কোনো ভাবে ইঞ্জুরি করা হয় নি। আসলে বাঙ্গালী সি.আই.ডি দেখতে দেখতে এতোটা মজে গেছে যে তারা ভাবে ডা. সালুকে এর মতো সবাই লাশ দেখলেই খুনের ধরণ বলে দিতে পারে।”
লোকটি হাসিমুখে কথাটা বলে। লোকটির কথা শুনে তীক্ষ্ণ কন্ঠে হাবীব বলে,
“কেনো লাশ দেখলে খুনের ধরণ বলা যায় না বলছেন?”
“বলা যায় না একেবারে তা নয়। তবে বলাটা কঠিন। যেমন এই লোকটিকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে খুব করা হয়েছে। কিন্তু বিষটা ঠিক কিভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। এটা কাটাছেড়া করেই বলা যাবে।”
“আপনি মশাই অকেজো। সেজন্যই এতো বাজে বকছেন”
“যদি সেটা ভেবে আপনি খুশি হন তবে তাই। আসলে শহীদুল স্যার ছুটিতে। তাই আমি এসেছি। শহীদুল স্যার আসলেও এই ভাবেই উত্তর দিতো।”
লোকটি আবারও গা জ্বালানো হাসি দিয়ে কথাটা বললো। হাবীব পারছে না তার মুখে ঘুষি মারতে। পারলে তাই করতো সে। এরপর লোকটা হাবীবের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনারা এই সেলটা পরিষ্কার করানোর ব্যাবস্থা করুন।”
“কেনো?”
“কারণ, আমার মনে হয় স্নিগ্ধের মৃত্যুর কারণটা এই সেলের বায়ুতে মিশে আছে।“
“কিভাবে বলছেন এই কথাটা?”
“ওয়াইল্ড গেস, বলতে পারেন। আর এমনিতেও এই সেলে খুন হয়েছে। তাই পরিষ্কার করানোটা জরুরি।“
“ চিন্তা করবেন না। যতক্ষণ খুনী ধরা না পড়ছে ততদিন এই রুমে প্রমাণ থাকবে এই রুমে কেও প্রবেশ করবে না, মিস্টার…“
“মেহরাব, মেহরাব মোর্শেদ”
“জ্বী মেহরাব মোর্শেদ, আপনি আপনার কাজটি ভালো করে করবেন আশা করি”
হাবীবের হুংকারের সাথে বলা কথাটা শুনে শুধু বাঁকা গালে হাসে মেহরাব। হাবীবের কোনো অজানা কারণে এই মেহরাব নামক ব্যাক্তিটিকে একেবারে পছন্দ হয় নি। কিছু কিছু মানুষের মুখটাই দেখলে বিরক্ত লাগে, মেহরাব সেই কাতারেই পড়ে। অসম্ভব সুদর্শন একটি পুরুষ। উচ্চতা, দৈহিক গড়ণ দেখে কেউ বলবে না ছেলেটি ফোরেন্সিক ডাক্তার। মডেল হিসেবে বেশ ভালোই নাম কামাতে পারতো সে। হাবীব গাঢ় নজরে মেহরাবকে দেখছে। মেহরাব একে একে স্যাম্পল কালেক্ট করতে লাগলো। স্নিগ্ধের ব্যাবহৃত জিনিসগুলো ও ল্যাবে পাঠালো সে। স্নিগ্ধের হাতের নখগুলোও নীল হয়ে গিয়েছে, হাতের তালুটা বেশ খসখসে লাগছে। যেনো কেউ দীর্ঘসময় যাবৎ তার উপর আর্সেনিকের প্রয়োগ করেছে। মেহরাব হাবীবের দিকে তাকিয়ে বললো,
“লাশটি ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন, আমার সবকিছু কালেক্ট করা হয়ে গিয়েছে”
হাবীব কোনো কথা বললো না। শুধু থমথমে মুখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মেহরাবের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মেহরাব বিনয়ের হাসি ঠোঁটের কোনে একে টিমের সাথে প্রস্থান করলো। হাবীবের দৃষ্টি এখনো মেহরাবের পানে। ছেলেটিকে কি কোথাও দেখেছিলো সে! না মনে পড়ছে না।
নুশরাতকে ডিজচার্জ করা হয়েছে। শরীরের দূর্বলতা এখনো কাটে নি। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। অতিরিক্ত ঘুমের ফলস্বরুপ দৃষ্টি ঝাপসা ঝাপসা লাগছে তার। তৌহিদ বিল ক্লিয়ার করে এসেছে। নুশরাতের ক্লান্ত মুখখানা দেখে ধীর কন্ঠে বলে,
“আমি উবার কল করেছি, চলে আসবে এখনি। হাটতে কষ্ট হচ্ছে কি?”
“উহু, এখন ভালো লাগছে।“
নুশরাত মলিন হাসি একে কথাটা বলে। তৌহিদ তার পাশে বসে। তার নরম হাতটি নিজের হাতের মুঠোতে নেয় সে। গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“আমাকে ক্ষমা করে দিও, নুশরাত”
“ক্ষমার কথা আসছে কেনো?”
“সব জেনেশুনে আমি তোমাকে ওই মৃত্যুগুহায় পাঠিয়ে ছিলাম। সেজন্য”
“আপনি পাঠান নি, আমি নিজে গিয়েছিলাম। আর টিম ওয়ার্কে কারোর উপর ব্লেম গেমটা খেলা উচিত হয় না। কাজটা ঝুকিপূর্ণ ছিলো তা যেমন আপনি জানতেন আমিও কিন্তু জানতাম। আমার কাছে অপশন ছিলো রবিনের সম্পর্কে সব জেনে এই কেস থেকে সরে যাওয়া। কিন্তু পারি নি, কারণ এই কেসটা আমাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিলো। বরং আপনাকে আমি এই কেসের ভেতর টেনে এনেছি। তাই নিজেকে দোষ দিবেন না। আমার খারাপ লাগবে।“
নুশরাতের কথার উত্তরে শুধু মলিন হাসি হাসে তৌহিদ। তার হাসিতে গ্লানি, হীনমন্যতার ছাপ ছিলো। তৌহিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নুশরাতের হাতটা খানিকটা শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“এবার থেকে আমি তোমাকে কোনো বিপদে পড়তে দিবো না। বারো বছর আগে ঠিক যেভাবে আগলে রাখতাম ঠিক যেভাবে আগলে রাগবো।“
“সে সময়টা চলে গেছে তৌহিদ ভাই। এখন চাইলেও আমরা দুজন সেই অতীতে ফিরে যেতে পারবো না। আমাদের কিশোরজীবনটা আর ফিরে আসবে না। আমি বলছি না দোষটা আপনার ছিলো। দুজনেরই ছিলো, তখন আমি যেমন জেদ করেছিলাম, আপনিও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। সুতরাং যে গল্পটা আমরা ফেলে এসেছি, সেটাকে নতুন ভাবে শূরু করার কোনো মানে নেই। আপনার ফোন বাজছে। ধরুন।“
তৌহিদ স্তব্ধ হয়ে যায়। সত্যি তার ফোন বাজছে। উবার চলে এসেছে। এখন আলাদা হবার পালা তাদের দুজনের।
নুশরাতের বাসার গেটে এসে থামলো উবারটি। পুরোটা রাস্তা দুজন মানুষ নিঃশব্দে কাটিয়েছে। কেউ কোন কথা বলে নি। নুশরাতের দৃষ্টি সারাটা পথ বৃষ্টি ভেজা পিচের রাস্তার পানে ছিলো। আর তৌহিদের দৃষ্টি ছিলো তার মুখোপানে। গোলগাল মুখখানা শুকিয়ে গেছে এক দিনেই। চোখের নিচের কালচে অংশটুকু যেনো গাঢ় হয়ে উঠেছে তার। তৌহিদের ইচ্ছে হচ্ছিলো মেয়েটিকে আগলে ধরে বলতে,
“আমি আছি তো তোমার কাছে”_____ কিন্তু সেটা আর বলা হয় নি। উবারের ভাড়া দিয়ে পেছনের ফিরলে দেখা যায় নুশরাত বাড়ির পানে হাটছে। পা টা টেনে টেনে হাটতে হচ্ছে তার। পায়ে চোট পেয়েছিলো তখন। তৌহিদ অবাক হয়েছে এটা ভেবে এতোকিছু হবার পর ও কেনো রবিন নুশরাতকে মেরে ফেলেনি। তার কাছে সময় ছিলো। কিন্তু সে সেটা না করে নুশরাতকে তার পৈশাচিক কর্মকান্ডের চক্ষু সাক্ষী বানিয়েছে। তৌহিদের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। কিছু একটা ভেবে ছুটে গেলো নুশরাতের কাছে। হাতটা টেনে ধরে, নুশরাত তৌহিদের এমন কান্ডে বেশ অবাক হয়। হতবাক চাহনীতে তাকিয়ে থাকে সে। তৌহিদ তখন আবেগপ্রবণ কন্ঠে বলে,
“মনের মানুষ আর মানুষের মন দুটো জিনিস পৃথিবীতে বড্ড বিরল। আমি এই দুটো জিনিস অনেক পুর্বেই পেয়েছি, কিন্তু অবহেলায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। এবার সেই ভুলটি আর করছি না। আসলেই সেই সময়টা বদলে গেছে। কিন্তু কি জানো তো! সময়ের প্রহরে আমরাও বদলে গেছি। এখন আমি আর আগের আমি নেই। তুমিও আর আগের তুমি নেই। বারোটা বছর নষ্ট করে বুঝেছি কত বড় ভুল করেছিলাম। কৈশোরটা আর ফিরবে না। কিন্তু এই মধ্যবয়সে তোমাকে হারাতে দিবো না।“
বলেই নুশরাতের কপালে আলতো ঠোঁটে চুমু দেয় তৌহিদ। নুশরাত হা হয়ে তাকিয়ে থাকে তৌহিদের দিকে। তার মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। পা টা যেনো জমে গিয়েছে। দেহের প্রতিটি লোমকূপ যেনো কেঁপে উঠেছে। হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেঁড়ে যাচ্ছে। তৌহিদ হাঁটা দিলো তার বাড়ির পানে। নুশরাত এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। সত্যি লোকটা পালটে গেছে। শ্যাম গাল দুটি রক্তিম হয়ে উঠলো। বেহায়া চোখ তাকিয়ে থাকলো লোকটির পানে।
সাত দির পর,
অবশেষে আবারো নিজের চেম্বারে বসলো নুশরাত। এই একই চেম্বারে সে এবং রবিন কাজ করতো। এখন পুরো চেম্বার জুড়ে শুধু সে রয়েছে। রবিনের ডেস্কটা ফাঁকা। রবিনের নেমপ্লেটটা এখন সেই জায়গায় ই রয়েছে। নুশরাত উদাস দৃষ্টিতে সব কিছু দেখতে লাগলো। রবিনের সকল কেস এখন তাকেই হ্যান্ড ওভার করা হচ্ছে। সব কেসের ফাইলগুলো রবিনের ডেস্কেই রয়েছে। সেদিন যদি রবিনের নামটি “আনন্দমহল বিশ্ববিদ্যালয়” থেকে চলে যাওয়া ছাত্রের লিস্টে না থাকতো তাহলে হয়তো কখনই এই মাকড়সার জালটি ভেদ করা সম্ভব হতো না নুশরাতের পক্ষে। সেই সূত্র ধরে রাজশাহীতে যায় নুশরাত, রবিনের বোন সামিরা থেকে রবিনের অতীতের ছঁড়াপাতা গুলো খুঁজে পায় সে। ভার্সিটি ছাড়ার পর রবিনের মানসিক বিপর্যয় ঘটে। সেই বিপর্যয়ের চিকিৎসাও করা হয় দেড় বছর। সবাই ভাবে রবিন তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। কিন্তু সে সাবাইকে ভুল প্রমাণ করে এই খুনের পর খুন করে। নুশরাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে রবিনের নেমপ্লেটটা নামিয়ে রাখে। অফিসের পিয়নটি তখন দরজায় নক করে। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো একটা ছোট কার্টুন হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে। নুশরাত অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“এটা কি সালাম ভাই?”
“আপনার নামে আইছে, আমি রিসিভ করেছি।“
“আচ্ছা, রেখে যান।“
পিয়ন নুশরাতের টেবিলে বক্সটা রেখে দেয়। বক্স টি দেখতে বাদামী রঙের। সুন্দর করে প্যাকেটটি করা হয়েছে। উপরে একটি সাদা কার্ড ডাবল সাইড ট্যাপ দিয়ে আটকানো। কৌতুহল মানুষকে অস্থির করে তোলে। নুশরাতও অস্থিরতা অনুভব করতে লাগলো। সে চেয়ার ছেড়ে বক্সটি হাতে নিলো। সাদা কার্ডটি খুললো সে, সেখানে লেখা,
“ Get well soon
____ From your well wisher”
কে পাঠিয়েছে এই বক্স টি! তার ওয়েলউইশার কে রয়েছে! নুশরাত এন্টিকাটার দিয়ে বক্সটুকু খুলে। বক্সটি খুলতে আৎকে উঠে সে। বক্সটি ফেলে দূরে সরে যায় সে। বক্সের ভেতরে……
চলবে
দৃষ্টির অগোচরে
দ্বিতীয় অধ্যায়
৩য়_পর্ব
পিয়ন নুশরাতের টেবিলে বক্সটা রেখে দেয়। বক্স টি দেখতে বাদামী রঙের। সুন্দর করে প্যাকেটটি করা হয়েছে। উপরে একটি সাদা কার্ড ডাবল সাইড ট্যাপ দিয়ে আটকানো। কৌতুহল মানুষকে অস্থির করে তোলে। নুশরাতও অস্থিরতা অনুভব করতে লাগলো। সে চেয়ার ছেড়ে বক্সটি হাতে নিলো। সাদা কার্ডটি খুললো সে, সেখানে লেখা,
“ Get well soon
____ From your well wisher”
কে পাঠিয়েছে এই বক্স টি! তার ওয়েলউইশার কে রয়েছে! নুশরাত এন্টিকাটার দিয়ে বক্সটুকু খুলে। বক্সটি খুলতে আৎকে উঠে সে। বক্সটি ফেলে দূরে সরে যায় সে। বক্সের ভেতরে বেশ কয়েকটি কাটা আঙ্গুল রক্তাক্ত অবস্থায় রয়েছে। তাজা রক্তের তীক্ষ্ণ গন্ধ নুশরাতের নাকে আসছে। নুশরাতের কপালে সূক্ষ্ণ ঘামের রেখা জমছে, তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। হা পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। কাউকে যে ডাকবে সেটাও মাথায় আসছে না। গলার কাছে ভয়গুলো জড়ো হয়েছে। বক্সটির দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে নুশরাত। নুশরাত ছোটবেলা থেকেই বেশ সাহসী একটা মেয়ে, যেকোনো যুক্তিহীন ভয়ের কাছে সে পারাজিত হয় না। সর্বদা সব ঘটনার যুক্তি খুজতে চায় সে। কিন্তু আজকাল বড্ড ভীতু হয়ে গিয়েছে সে। মনের ভেতরে পরজীবির ন্যায় একরাশ ভয় বাসা বেঁধেছে, তারা অদৃশ্য। যখন এমন অযাচিত ঘটনা ঘটে তখন তাদের উপস্থিতির জানান দেয় তারা। মনের কুঠুরি থেকে বেড়িয়ে আসে তারা। গলাটা শুকিয়ে আসছে নুশরাতের, গা টা গুলাচ্ছে। বমি বমি পাচ্ছে। বাক্সটা ফ্লোরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ধীরে ধীরে রক্তের ছিটা সাদা টাইলসের ফ্লোরটাকে রঙ্গিন করে তুলেছে, ভয়ংকর সেই দৃশ্য__________
তৌহিদের সামনে বসে রয়েছে হাবীব। হাবীবের লম্বাটে মুখটা আরোও বেশী লম্বাটে লাগছে। চোখগুলো লালচে, চোখের নিচে কালচে গর্তটা দৃশ্যমান। শুকনো মুখে মলিন হাসি টেনে রয়েছে সে। তৌহিদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“আমাকে এতো জরুরি তলব দিলে যে?”
“স্যার আপনার সাহায্যের প্রয়োজন।“
আমতা আমতা করে কথাটা বলে হাবীব। সে সত্যি ই সাহায্য চায়। তার অসহায় চাহনী জানান দিচ্ছে কথাটার সত্যতার। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৌহিদ। তারপর বলে,
“হঠাৎ আমি কেনো?”
“আমি কোনো দিক পাচ্ছি না স্যার, স্নিগ্ধ আমার কাস্টেডিতে ছিলো। সেখানে ওকে খুন করা হয়েছে। সিসি টিভিতে কোনো ফুটেজ নেই খুনীর। শুধু দেখা যাচ্ছে স্নিগ্ধ ছটফট করতে করতে মারা গেছে। আমার উপর প্রেসার বাড়ছে। চাকরিটা চলে ও যেতে পারে। আমাকে আপনি ছাড়া কেউ সাহায্য করতে পারবে না। তাই স্যার, আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না দয়া করে।“
হাবীবের কথায় চিন্তায় পড়ে যায় তৌহিদ। যতই হোক এক থানার কর্মরত হয়ে অন্য থানার ব্যাপারে সে নাক গলাতে পাড়ে না। কিন্তু হাবীবের গো বেচারামুখখানা তাকে ভাবাচ্ছে। যদিও তার অধঃপতনে হাবীবের হাতটা অনেক বেশি ছিলো, তবুও আজ সে কঠোর হতে পারছে না। কিছুক্ষন চুপ থেকে ধীর কন্ঠে বলল,
“ফোরেন্সিক রিপোর্ট এসেছে?”
“ওই শালা ডাক্তার একটা চালবাজ”
“হাবীব”
“স্যার, এক সপ্তাহ ধরে ঘুরাচ্ছে”
“তাই বলে তুমি ওকে গালি দিতে পারো না।“
“মেজাজ ই ঠিক রাখতে পারছি না স্যার, সবার উপর মেজাজ খারাপ হয় আজকাল। আর ওই ডাক্তার, এতো বিরক্ত করছে।“
হাবীবের মেজাজ সত্যি খারাপ। টানা এক সপ্তাহ ধরে মেহরাব নামক ব্যাক্তিটি তাকে ঘুরাচ্ছে। রিপোর্ট মেইল করা তো দূরে থাক, সে তার ফোন পর্যন্ত ধরছে না। ল্যাবে গিয়ে খোঁজ নিয়েও হতাশ হচ্ছে হাবীব। লোকটা কি চাচ্ছে বুঝে উঠছে না হাবীব। তৌহিদ হাবীবের কথা শুনে চিন্তিত কন্ঠে বলে,
“এমন নয় তো, এই নতুন ডাক্তার বুঝতেই পারছে না মৃত্যুর কারণ?
“হতে পারে, যখন স্নিগ্ধ মারা যায় ডাক্তার বলেছিলেন হার্ট ফেইল্যুর হয়েছে। কিন্তু এই হার্ট ফেইল্যুর এর কারণটা তারা বলতে পারেন নি। স্নিগ্ধের হার্টে কোনো সমস্যাও ছিলো না, সে ফিজিক্যালি যথেষ্ট ফিট একটা ছেলে। ওর এমন হার্ট ফেইল্যুর ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না।“
তৌহিদ তার সামনে থাকা ছবিগুলোতে চোখ বুলাতে বুলাতে বললো,
“শহীদুল স্যার কি ছুটি থেকে ফেরেন নি?”
“না স্যার এখনো ফেরেন নি। এইজন্য এই চালবাজ বেহতারের সাথে আমার কাজ করতে হচ্ছে। শহীদুল স্যার থাকলে তো কোনো কথাই ছিলো না।“
স্নিগ্ধের ছবিগুলো একের পর এক দেখে যাচ্ছে তৌহিদ। লাশের মুখটা নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে, বলা যেতেই পারে তাকে বিষ দেওয়া হয়েছে। বিষের কারণে তার হার্ট ফেইল্যুর হয়েছে। কিন্তু বিষটা ঠিক কেমন? কিভাবে দেওয়া হলো এই বিষ? এর মাঝেই ফোনটি বেঁজে উঠে তৌহিদের। স্ক্রিনে চোখে বুলাতে ভ্রুযুগল কুঞ্ছিত হয়ে আসে তৌহিদের।
নুশরাতের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে তৌহিদ। এখনো ভয়ের কুকড়ে আছে মেয়েটা। বমি করে মুখটা শুকিয়ে গেছে, ঠোঁট জোড়া ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। বক্সটি উলটে পালটে দেখতে লাগলো হাবীব। সাদা কার্ডটি এই নিয়ে পাঁচবার দেখেছে। বক্সের ভেতরের আংগুল গুলো মোমের, কিন্তু রক্তটা আসল। কেউ নুশরাতকে ভয় দেখানোর জন্য এমনটা করেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্নটি হলো কেনো? এবং কে এই ‘Well-wisher’? হাবীব থমথমে কন্ঠে বললো,
“স্যার, বক্সটা ল্যাবে পাঠালে ফিংগারপ্রিন্ট পাওয়া যাবে। সাথে ব্লাডের স্যাম্পল ও নেওয়া যাবে। পাঠাবো কি?
“হু, পাঠিয়ে দাও। আর পিওনকে জিজ্ঞেস করো কুরিয়ার বয় সম্পর্কে।“
“জ্বী স্যার।“
হাবীব বেড়িয়ে গেলে তৌহিদ নুশরাতের নত মুখখানা আলতো হাতে তুলে ধরে। গলার স্বরে কমিয়ে বলে,
“কিছু হয় নি, আমি আছি তো! এতো ভয় পাবার মতো কিচ্ছু হয় নি। এটা কারোর বিশ্রি শয়তানি ছাড়া আর কিছুই নয়।“
“কিন্তু রক্তটা তো আসল। কেউ আমাকে হুমকি দিতেই এই বক্সটা পাঠিয়েছে।“
“কে সে? মানছি তোমার শত্রু অনেক, তবে এতো সাইকো টাইপ কোনো শত্রু তোমার নেই। কে করবে এটা, রবিন এস্যাইলামে। আর স্নিগ্ধ মারা গেছে।?”
“স্নিগ্ধ মারা গেছে মানে?”
নুশরাতের প্রশ্নে থমকে যায় তৌহিদ। সে এই কথাটা লুকিয়ে রেখেছিলো নুশরাত থেকে, কিন্তু এখন মখটা ফসকে ঠিক ই বেরিয়ে গেলো। তৌহিদের দৃষ্টি সরিয়ে ফেলায় নুশরাত তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,
“স্নিগ্ধ মারা গেছে। কবে? কিভাবে? আমাকে জানান নি কেনো?”
“তুমি অসুস্থ ছিলে, তাই”
“তাই লুকিয়ে গিয়েছেন?”
নুশরাতের কন্ঠের তীক্কনতা বেড়ে যায়, সে রীতিমতো জেরা করা শুরু করে তৌহিদকে। তৌহিদ তাকে শান্ত করার জন্য আকুলকন্ঠে বলে উঠে,
“তখন তুমি এই নিউজটা নিতে পারতে না নুশরাত। ডাক্তার তোমাকে রেস্ট নিতে বলেছিলো। আর স্নিগ্ধ কিভাবে মারা গেছে এখনো জানা যায় নি। ডাক্তার প্রাইমারি রিপোর্টে বলেছে হার্ট ফেইল্যুর। ইনভেস্টিগেশোন চলছে। কিছু জানতে পারলে তোমাকে জানাবো।“
নুশরাত কোনো কথা বলে না, শুধু চুপ করে শুনে। যদি এই কাজ তাদের মধ্যে কারোর না হয় তবে এই কাজটা কার। এমন কাজে কেউ অতীতের কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে না তো? অতীতের কোন ছেড়াপাতা! যা জীবন্ত হতে চায়!
অন্ধকার রুমের একটি রকিং চেয়ারে বসে রয়েছে একজন মানব। হাতে একটি ছবি। চেয়ারের সাথে সাথে সে দুলছে। কালচে আধারকে গিলে জ্বলে উঠে হলুদ লাইটার। ছবিটা সেই ললহমান অগ্নির উপর রাখে মানব। শ্লেষ্মাজড়ানো কণ্ঠে গেয়ে উঠে,
“আমার সবটুকু বিশ্বাস যে দিয়েছে ভেঙ্গে
তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই সে দিয়েছে আমার অন্ধ চোখ এ আলো
যার বিশালতার মাঝে আমি একটুকু পাই নি ঠাই
তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই সে যে দিয়েছে আমায় মহাশুন্যে আশ্রয়।“_______
ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ফাঁকা আধারে। জ্বলে ছাই হচ্ছে ছবিটি। সম্পূর্ণ ছবি ছাই হতে তীক্ষ্ণ হাসিতে কেঁপে উঠলো ঘরটি। এ হাসি এ জগতের নয়, এ হাসি কোন স্বাভাবিক মানবের নয়।_______
পরদিন
সকাল ৯টা,
শরীরটা ভালো লাগছে না নুশরাতের। গতকাল তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গিয়েছিলো সে। সারারাত ঘুম হয় নি তার। কিন্তু তবুও আজ চেম্বারে এসেছে সে। কিছুদিন পর কেসের হেয়ারিং। অনেক স্টাডি বাকি, এই কয়দিন পুরোনো কেসে ডুবে থাকায় ভালোভাবে কাজ করতে পারে নি সে। এবার আর ফাঁকি দিবে না। শতভাগ কন্সেনট্রেশন দিবে এই কেসে। অবশ্য তৌহিদ শুনলে বেশ রাগারাগি করবে। সে তাকে বলেছিলো রেস্ট নিতে। কিন্তু তৌহিদের উপর অভিমান করেছে নুশোরাত। গতরাতে কথা বলে নি। একটা জিনিস নুশরাত বুঝে পাচ্ছে না, প্রতিরাতে কেনো ঐ লোকটার সাথে তাকে কথা বলতে হবে! এমন তো মোটেই নয় যে তার প্রেম করছে। তবুও রাত এগারোটার দিকে লোকটা প্রতিদিন ফোন দিবে, খেয়েছো? ঘুমাবা কখন? কি করো? এসব অহেতুক প্রশ্ন করবে। ব্যাপারগুলো নুশরাতের জন্য খুব নতুন। এর আগেও তার বিয়ে হয়েছে, একজন হাসবেন্ড ছিলো। কই মাহির তো কোনো কালে তাকে এভাবে ফোন দিয়ে খোঁজ নেয় নি। তবে এই লোকটা কেনো নিচ্ছে? প্রশ্নের উত্তরটা জানা তবুও খুঁজিতে ইচ্ছে করে তার বেহায়া মনের। শুনেছে রবিনের বদলে নতুন কেউ রুম শেয়ার করবে তার। লোকটা হাই কোর্টের উকিল। বিগত আটবছর যাবৎ ক্রিমিনাল লয়ার হিসেবে কাজ করছে সে। নামটা মনে পড়ছে না নুশরাতের। কারণ নামটা পরিচিত নয়, বরং একটু অন্যরকম। লিফট নেমেছে অবশেষে। বিগত দশ মিনিট পূর্বে সে কল দিয়েছিলো। এখন সে অবশেষে গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসেছে। বড় বিল্ডিং হবার কারণে ভিড় ও প্রচুর। কোনোমতে সব ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো নুশরাত। যেই না গেটটা আটকাবে তখনই………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি