দৃষ্টির অগোচরে দ্বিতীয় অধ্যায়,সূচনা_পর্ব

দৃষ্টির অগোচরে দ্বিতীয় অধ্যায়,সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

২০০৮সাল,
আনন্দমোহল বিশ্ববিদ্যালয়ের “অমর একুশে” হলের ৪০৩ নম্বর রুম। রুমটির দরজা ভেতর থেকে আটকানো। এই রুমটি ভার্সিটির চতুর্থ বর্ষের ছাত্র নাহিদ, মাহির, অনিক এবং দিহানের। রুমটির ভেতর থেকে একটি ছেলের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। চাঁপা আর্তনাদ। রাত দশটা বাজে। করিডোর থেকে আর্তনাদটি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু উপস্থিত ছাত্ররা এই আর্তনাদটি শুনেও না শোনার ভান করছে। তারা যে যার কাজে ব্যস্ত। কেউ মোবাইলে স্নেক গেম খেলছে তো কেউ তার প্রেয়সীর সাথে কথা বলছে। আশেপাশের রুমগুলোর ছাত্ররা পড়ার গুঞ্জন বাড়িয়ে দিচ্ছে যেনো এই আর্তনাদ শোনা না লাগে৷ কারণ তারা জানে এটাই তাদের জন্য উত্তম। আজ এই আর্তনাদ উপেক্ষা করলে আগামীকাল তাদের আর্তনাদ শোনা যাবে না। হলের ‘৪০৩’ নম্বর রুমটি অভিশপ্ত। এখানে ভুলে যদি কোনো প্রথম বর্ষের ছাত্র কোনো রাতে ঢুকে পড়ে তবে তার জীবনের কালরাত্রী হয় যায়। এই রুমের বাসিন্দাদের সবাই জমের মতো ভয় পায়। এই চারটি চতুর্থ বর্ষের ছেলে এবং তাদের আরোও ছয় জন সাঙ্গপাঙ্গ শুধু ‘অমর একুশে’ হল নয় বরং সম্পূর্ণ ‘আনন্দমোহন ইউনিভার্সিটি’ তে ত্রাশের সূত্রপাত করেছে। তাদের কাজ প্রতিরাতে কিছু প্রথম বর্ষের ছেলেপেলেকদ রুমে ডাকবে এবং নিজেদের মনোপূর্তির জন্য তাদের র‍্যাগ দিবে। এতে তারা পৈশাচিক আনন্দ পায়। আজ রাতে যে ছেলেটাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে ছেলেটা প্রথম বর্ষের আইন বিভাগের ছাত্র। তার নাম রবিন। ভার্সিটির ভর্তির আজ মাত্র উনিশ দিন হয়েছে। এই রুমে তার প্রবেশের কারণ সে অন্যায় করেছে। অন্যায়টা তার নগন্য৷ কিন্তু তবুও তাকে এখানে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তার অন্যায় সে মাহিরকে সম্মান করে নি। ক্লাসের তাড়ায় মাহিরের গায়ে ধাক্কা দিয়ে চলে গিয়েছে। সেই অন্যায়ের শাস্তি স্বরুপ তাকে এই ‘৪০৩’ নম্বর রুমটিতে আনা হয়েছে। এখন সে নগ্ন অবস্থায় অন্য ছাত্রদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অন্যদের কাজ তার ছবিটি ক্যামেরাবন্দি করা। ব্যাপারটা শুনতে যতটা কুৎসিত, কুরুচিপূর্ণ বাস্তবেও ততটাই কুৎসিত এবং কুরুচিপূর্ণ। ছেলেটা চোখে অশ্রু, এই অশ্রু ঘৃণার, এই অশ্রু লজ্জার, এই অশ্রু হীনমন্যতার। তাকে সকলের সামনে যেভাবে অপমান করা হচ্ছে তাতে তার বাঁচার ইচ্ছেটুকুই শেষ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা ফুপাচ্ছে, তার চোখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। কিন্তু সামনে বসে থাকা অমানুষগুলোর তাতে কিছুই যায় আসছে না। তারা তাদের আনন্দের খোড়াক পেয়েছে। গোল্ডলিফের জ্বলন্ত শিখায় সুখটান দিয়ে পিশাচের মতো হাসছে তারা। রবিন তার বন্ধুবর্গের দিকে অসহায় চাহনীতে তাকায়। তাদের চোখে চোখ রাখতেই লজ্জায় তারা চোখের দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। রবিন আশাহত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচার তাকে সহ্য করতে হচ্ছে। পরদিন থেকে ছেলেটাকে আর আনন্দমোহনের ক্যাম্পাসে দেখা যায় না। হলের ছেলেরা বলে,
“ভোর হতেই রবিন ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে গেছে”

রবিন নামক ছেলেটির ভার্সিটি জীবন উনিশদিনেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়৷ র‍্যাগ নামক বিষাক্ত কাটা তার কিশোর জীবনের স্বপ্নগুলোর বীজ অংকুরেই গলা টিপে হত্যা করে। তার কিশোর জীবনের অভিশাপ ছিলো সেই রাত্রী। সেই কালরাত্রী।

বর্তমান,
নুশরাত ঘুমাচ্ছে, বেচারি অনেক ভয় পেয়েছে। হাসপাতালের বেডে স্যালাইন লাগিয়ে রাখা হয়েছে তার। খুব শকড এ ছিলো বলে ডাক্তার হাই পাওয়ারের ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছেন। তৌহিদ তার পাশে বসে রয়েছে। এক মনে সে নুশরাতকে দেখে যাচ্ছে। রবিনের পৈশাচিক তান্ডব নিজ চোখে দেখেছিলো নুশরাত। ভয় পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। অবশেষে এই সাপের লেজের মতো কেসটার সমাধান করা গেলো। তৌহিদ আলতো হাতে নুশরাতের হাতটি নিজের মুঠোতে নিলো। এইবার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে মোটেই ক্ষমা করতে পারতো না তৌহিদ। সব জেনে শুনে একটা সিংহের গুহায় নুশরাতকে সে পাঠিয়েছিলো। হাতটি নিজের মাথায় ঠেকিয়ে চুপ করে বসে থাকে তৌহিদ। তখন ফোনটা বেজে উঠে তার৷ ফোনটা রিসিভ করতেই শুনে,
– স্যার, স্নিগ্ধকে কাস্টেডির ভেতরেই কেউ মেরে ফেলেছে।

কথাটা শুনতেই ফোনটা পড়ে যায় তৌহিদের হাত থেকে। রবিন তো এসাইলামে, তবে কে এই খুনী! কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে তৌহিদের। রবিনের মানসিক অবস্থা বিকৃত। সেকারণে তাকে কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তার একার পক্ষে এই নজরদারি পার করা সম্ভব নয়। তৌহিদ এসাইলামের পরিচিত অফিসার শাহাদাতকে ফোন করে। শাহাদাত ফোনটি রিসিভ করতেই তৌহিদ তাকে জিজ্ঞেস করে,
“রবিন কি করছে?”
“ঘুমোচ্ছে, কড়া ঘুমের ঔষধ পড়ছে।”

শাহাদাত তৌহিদের প্রশ্নের উত্তরস্বরুপ কথাটা বলে। তৌহিদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাকে বলে,
“কড়া নজরে রাখবেন। ড্যাঞ্জারাস খুনি কিন্তু। দৃষ্টির আড়াল করলেই নিজের আসল রুপ ধারণ করবে। স্নিগ্ধকে জেলে খুন করা হয়েছে। তাই রবিনকে নজরবন্দি রাখাটা দরকার….
” কে খুন হয়েছে?”

ফোনের কথার মাঝেই পেছন থেকে কন্ঠটি কানে আসে তৌহিদের। সে ফোনটি কেঁটে দিয়ে পেছনে ফিরে। নুশরাত ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে রয়েছে। ভয়ে তার চেহাসা ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে। তৌহিদ এগিয়ে এসে পাশে বসে। হাতটি আলতো করে চেপে ধরে তার। তারপর ধীর কন্ঠে বলে,
“কেউ খুন হয় নি। তুমি ভূল শুনেছো।”
“আপনি মাত্র বললেন”
“ঘুমের ঘোরে ভুল শুনেছো।”

বেশ জোর দিয়ে কথাটা বলে তৌহিদ। তৌহিদের কথা শুনে নুশরাত চুপ করে যায়। তবে মনের আশংকার জালটি ক্রমশ বিস্তারিত হচ্ছে। রবিন নামক মানুষটা তার খুব ভালো বন্ধু ছিলো। সেই বন্ধুকে এতোটা পৈশাচিক তান্ডবে লিপ্ত থাকতে দেখে নিজেকে কিছুতেই স্বাভাবিক রাখতে পারছে না সে। নুশরাতের অস্থির চাহনী দেখে তৌহিদ নম্র কন্ঠে বলে,
“আন্টি দুবার ফোন দিয়েছেন। তোমার স্যালাইনটা শেষ হলেই আমরা বাসায় ফিরবো। কেমন?”

উত্তরে শুধু ছোট্ট করে “হু” বলে আবারো চুপ হয়ে যায় নুশরাত। তৌহিদ ও কথা বলে না। হাসপাতালের কেবিনে নিস্তব্ধতা বিরাজমান হয় তখন। শুধু ভীত দুটো মন নিজেদের আকড়ে থাকে যেনো ভয়ের মাত্রাটা কিছুটা হলেও কমে।

হাবীব ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধের লাশের দিকে। লাশটি হা করে আছে। ফর্সা মুখটা নীলচে হয়ে গেছে। তার বেশ কিছুদিন যাবৎ শরীরটা খুব একটা ভালো ছিলো না। প্রচুর মাথা ব্যাথা করছিলো তার। শরীরটা খারাপ হচ্ছিলো। তাকে যে সেলে রাখা হয়েছিলো সেই সেলটা একটি বদ্ধ সেল। একটি জানালা ব্যাতীত হাওয়া আসা যাবার কোনো ব্যাবস্থা ছিলো না। এমন একটা পরিবেশে আসামীদের শরীর খারাপ হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক বিষয়। ফরেন্সিক ডাক্তার শহীদুল সাহেবকে ডাকা হয়েছে। কিন্তু তিনি কয়েকদিনের জন্য রংপুর গিয়েছেন। তার বদলে নতুন একজন ডাক্তার এসেছেন। তিনি ই স্নিগ্ধের লাশের ময়নাতদন্ত করবেন। হাবীব তার কাছে গিয়ে হিনহিনে কন্ঠে বলে,
“কখন ধরে তো দেখেই যাচ্ছেন! কিছু বুঝতে পারলেন কি?”
“এভাবে লাশ দেখে তো বোঝা যায় না। কারণ তাকে কোনো ভাবে ইঞ্জুরি করা হয় নি। আসলে বাঙ্গালী সি.আই.ডি দেখতে দেখতে এতোটা মজে গেছে যে তারা ভাবে ডা. সালুকে এর মতো সবাই লাশ দেখলেই খুনের ধরণ বলে দিতে পারে।”

লোকটি হাসিমুখে কথাটা বলে। লোকটির কথা শুনে তীক্ষ্ণ কন্ঠে হাবীব বলে,
“কেনো লাশ দেখলে খুনের ধরণ বলা যায় না বলছেন?”
“বলা যায় না একেবারে তা নয়। তবে বলাটা কঠিন। যেমন এই লোকটিকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে খুব করা হয়েছে। কিন্তু বিষটা ঠিক কিভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। এটা কাটাছেড়া করেই বলা যাবে।”
“আপনি মশাই অকেজো। সেজন্যই এতো বাজে বকছেন”
“যদি সেটা ভেবে আপনি খুশি হন তবে তাই। আসলে শহীদুল স্যার ছুটিতে। তাই আমি এসেছি। শহীদুল স্যার আসলেও এই ভাবেই উত্তর দিতো।”

লোকটি আবারও গা জ্বালানো হাসি দিয়ে কথাটা বললো। হাবীব পারছে না তার মুখে ঘুষি মারতে। পারলে তাই করতো সে। এরপর লোকটা হাবীবের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনারা এই সেলটা পরিষ্কার করানোর ব্যাবস্থা করুন।”
“কেনো?”
“কারণ……

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here