দৃষ্টির অগোচরে দ্বিতীয় অধ্যায়,অন্তিম_পর্ব

দৃষ্টির অগোচরে দ্বিতীয় অধ্যায়,অন্তিম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

রবিনের উপর সন্দেহ তৌহিদের তখন হয় তখন আউট অফ নো হোয়ার রবিন স্নিগ্ধের কেস নুশরাতের কাছে নিয়ে যায়। সে চাইলেই নিজে স্নিগ্ধের উকিল হতে পারতো, কিন্তু সে তা করে নি। উপরন্তু রবিনের বাসা থেকে নুশরাত কিছু ছবি জোগাড় করে যা ছিলো প্রমাণ, রবিনের আনন্দমোহন ভার্সিটির ছাত্র হবার এবং মাহিরদের সাথে পরিচিতির। কিন্তু এবার কোনো ক্লু নেই। কোন পথে আগাবে সেটাও বুঝে পাচ্ছে না তৌহিদ। হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে হাবীব তার কাছে ছুটে এলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“স্যার, ব্যাপক ব্যাপার। ইশরার জ্ঞান ফিরেছে, ও হয়তো আমাদের মেইন কালপ্রিটের কাছে পৌছাতে সাহায্য করতে পারবে।“

তৌহিদ ব্যাস্ত হয়ে বললো,
“চলো হাবীব, সময় নষ্ট করার সময়টুকু আমাদের কাছে নেই।“
“দাঁড়ান স্যার”
“কি হলো আবার?”
“কিছু খেয়ে নিন স্যার, আপনি গতকাল দুপুর থেকে কিছু খান নি। এভাবে হলে অসুস্থ হয়ে যাবেন। এখন মনের শক্তির সাথে দেহের শক্তির ও প্রয়োজন। তাই সেটাকে কিছু দিন দয়া করে।“

তৌহিদ সত্যি ভুলে গিয়েছিলো তার শরীরে গত দুপুর থেকে অন্নের একটি দানা ও যায় নি। সে ভেবেছিলো গতকালের দিনটা নুশরাতের সাথে কাটাবে, তার বার্থ ডে বলে কথা। কিন্তু সব যেনো গুবলেটব হয়ে গেলো। রাতের রিসার্ভেশন ডিনার তো দূরে কথা, এখন সেই প্রইয় মানুষটিকেই খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো তৌহিদের। এখন ইমোশোনালী চিন্তা করলে হবে না তাকে র‍্যাশনালী চিন্তা করতে হবে। তৌহিদ হাবীবকে বললো,
“একটা পাউরুটি এনে দাও হাবীব।“
“জ্বী স্যার”

বলেই হাবীব দোকানের খোঁজে গেলো। তৌহিদ আকাশের দিকে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকালো। পরিষ্কার ঝলমলে নীল আকাশ, সাদা সাদা মেঘেরা দল মেঘে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শরতের সূচনা হচ্ছে, অথচ তার জীবনে কালো মেঘের ঘনঘটা ছেয়ে রয়েছে। আকাশের দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে ধীর স্বরে বলে,
“একটা ক্লু, একটা ক্লু; শুধু একটা ক্লু চাই। একটা ইশারা”

হাসপাতালের সাদা বিছানায় আঁধশোয়া অবস্থায় শুয়ে রয়েছে ইশরা। গতকালের স্মৃতিগুলো মাথায় ছাপ রেখে গিয়েছে। স্মৃতি বললে ভুল হয়ে দুঃস্বপ্ন। অজানাকে জানার কৌতুহল মাঝে মাঝে মানুষকে বিপদে গেলে, তার জীবন্ত প্রমাণ ইশরা। কেনো অচেনা এক ব্যাক্তির উপর ভরসা করতে গেলো সে! এই উত্তর তার নিজের ও অজানা। তাকে এখন ওয়ার্ডে শিফট করা হয়েছে, বাহাতে স্যালাইন লাগানো। তার দৃষ্টি শূন্য, মাথায় উপরের ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে সে। সে বেঁচে আছে এই ব্যাপারটা যেনো একটা বিষ্ময় তার কাছে। মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখেছে সে। পারভীন বেগমের মুখখানা শুকিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে আছে। তার এক মেয়ে হাসপাতালের বিছানায় আর আরেক মেয়ের খোঁজ গত রাত থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। একজন মায়ের কাছে এই বিষয়টা কতটা বেদনাদায়ক সেটা বোঝানোর জন্য ভাষাও কম পড়ে যাবে। বিগত আধঘন্টা মেয়ের পাশে বসে রয়েছেন তিনি, অথচ ইশরা এখনো কোনো কথা বলে নি। তখন ই দরজায় নক পড়ে। পারভীন ঘাড় ঘুরিয়ে দরজায় তাকান। তৌহিদ এসেছে। তিনি আকুল দৃষ্টিতে তৌহিদের দিকে তাকান। তৌহিদ মাথা নিচ করে ফেলে। দাঁত ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়িয়ে নিজের ব্যার্থতা বোঝায়। পারভীন বেগম কোনো প্রশ্ন করেন না। তার অসহায় মুখের দিকে তাকাতে পারছে না তৌহিদ। তিনি শাড়ির আঁচলে মুখ গুজে রুমের এক কোনায় চলে যান। তৌহিদ ইশরার দিকে এগিয়ে যায়। সে এখনো ফ্যানের দিকেই তাকিয়ে আছে। কথা কিভাবে শুরু করবে জানা নেই তৌহিদের। সে কিছুমূহুর্ত চুপ করে বসে থাকে। তারপর ধীর গলায় বলে,
“চেহারা দেখেছিলে ওই লোকটার?”
“নাহ”

বিলম্ব না করে জড়তাবিহীন কন্ঠে কথাটা বলে ইশরা। তৌহিদ বেশ অবাক হয়, সে ভেবেছিলো ইশরা ভয়ে কাতর থাকবে। তাকে স্বাভাবিক করতে সময় লাগবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। তৌহিদ আবার বলে,
“তুমি শিওর?”
“জ্বী”
“ইশরা, গতকাল ঠিক কি হয়েছিলো?”
“………”
“নুশরাতকে গতরাত থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। প্লিজ, কিছু লুকিও না। তুমি আমার শেষ ভরসা”

ইশরা এবার দৃষ্টি সরিয়ে তৌহিদের দিকে তাকালো। তার চোখের ভাষাটা ভিন্ন, তৌহিদের মনে হলো মেয়েটির মাঝে কোনো জীবনীশক্তি বাকি নেই। জীবনের নির্মম পরিহাসে সে হেরে গেছে। ইশরা দির্ঘশ্বাস ফেললো, তারপর ধীর কন্ঠে বললো,
“তার সাথে প্রথম পরিচয় গেমের মাধ্যমে। আমাদের ক্লানের নতুন প্লেয়ার ছিলো। বেশ ভালো খেলতো। ব্যাবহার ও মার্জিত। সেখান থেকে পরিচয় গভীর হলো। আমরা প্রায়ই কথা বলতাম। একসাথে খেলতাম। একটা সময় তার ফেসবুক আইডি জানতে চাইলে সে বিলম্ববিহীন দিয়ে দেয়। তারপর কথা হতো, অনেক কথা। কথা বলতে বলতে এক অজানা অনুভূতি জন্মালো। বেশ বিচিত্র এই অনুভূতি। সে আমার আসক্তিতে পরিণত হলো। তার সাথে কথা বলতে ভালো লাগতো। তাই বেশ কিছুদিন যাবৎ তার সাথে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে গিয়েছিলাম। অবশেষে সে গতকাল আমাকে দেখা করতে বলে। আমাকে বলেছিলো আমি যেনো কলেজ থেকে বের হয়েই মোবাইলটা বন্ধ করে দি। আবদারটা উটকো হলেও আমি তাই করি। আমাকে শ্যামলীতে যেতে বলে সে। শ্যামলী পার্কের পাশে একটি ছোট কফি শপ ছিলো। ওখানেই আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছিলো। আমি ওখানে যেয়ে বসি, একটা কফি অর্ডার করি। কফিটা খাবার পর থেকেই শরীর ছেড়ে দেয়। মাথা ঘুরিয়ে উঠে। আমার মনে হচ্ছিলো সব ঝাপসা হয়ে গেছে চোখের সামনে। আমি জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে একটা কাপড় টাইপ জিনিসে আটকা পাই। মনে হয় বস্তা। আমি চেষ্টা করি ওখান থেকে ছাড়া পেতে। কিন্তু আমার চিৎকার শোনার কেউ থাকে না। ধীরে ধীরে শ্বাস কষ্ট হতে থাকে। আতঙ্কে আমার শোরীর কাঁপতে থাকে। কত সময় চিৎকার করেছি মনে নেই। কিন্তু খুব ভয় হচ্ছিলো। মৃত্যু আমাকে শুষে নিচ্ছে, এই ব্যাপারটা বাস্তবে খুব নিষ্ঠুর। বাঁচার কোনো উপায় দেখতে পারছিলাম না। দেখছিলাম শুধু অন্ধকার। একটা অন্ধকার জায়গা, যেখানের মাপটা আমার উচ্চতা পর্যন্ত। আমি খুব কেঁদেছিলাম, আপু, আম্মুর মুখগুলো চোখের সামনে ভাসছিলো। আমার দৃষ্টি আবার ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো। দম আটকে যাচ্ছিলো, খুব পানি পিপাসা পাচ্ছিলো। গলা বন্ধ হয়ে আসছিলো। তারপর কিছু মনে নেই”

ইশরার গলা কাঁপছে। তার কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। হয়তো সেই সেই দুর্বিসহ মূহুর্তগুলো চোখের সামনে ভাসছে। মর্মান্তিক ঘটনাগুলো দ্বিগুন মর্মান্তিক হয়ে ওঠে যখন সেই ঘটনাগুলো বর্ণনা করতে হয়। তখন মানুষটি সেই ঘটনাগুলোকে দ্বিতীয় বার অনুভব করে। ইশরার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপারটাই ঘটছে। তৌহিদ ধীর কন্ঠে বলে,
“ইশরা, কালো আধারের পরেই সোনালী সূর্যের উদয় হয়। কালো মেঘের পরদ সরলেই নীলচে ঝলমলে আকাশ। এখন হয়তো জীবন অর্থহীন লাগছে। কারণ কালো মেঘের আড়ালে সূর্যটা লুকিয়ে আছে। কিন্তু দেখবে ঠিকই সেটা সরে যাবে। সরতে বাধ্য। আমাদের জীবনের সূর্যটা ঠিকই উদয় হবে, নতুন সকালের সূচনা হবেই।“

তৌহিদ দাঁড়ালো না, এখন তার অনেক কাজ। এক এক মূহুর্ত এখন গুরুত্বপূর্ন। প্রথমে থানায় যাবে, মোবাইলের মালিকের সাথে কথা বলতে। এরপর সেই লোকটির ফেসবুক আইডি বের করবে। অনেক কাজ। হাবীব এর মাঝে মোবাইলে ইমামের বানানো ছবি গুলো এগিয়ে দিলো। তৌহিদ চোখ মুখ খিঁচে বললো,
“এদের কোনো ডিটেইলস পাওয়া গেছে?”
“জ্বী না স্যার। আমাদের ক্রিমিনাল প্রোফাইলের বাহিরে।“
“ভালো কোনো হ্যাকার পরিচিত আছে?”
“কেনো স্যার? সার্চ করাতে হবে। বাংলাদেশের সকল নাগরিকের ডাটা যেখানে সঞ্চিত থাকে। এখন এমন কেউ নেই যার বাংলাদেশের এন.আই.ডি নেই। সুতরাং হ্যাকার লাগবে। এদের নাম, ঠিকানা, জন্মকুন্ডলী বেড়িয়ে পড়বে”
“স্যার আমাদের ডিপার্টমেন্টের কাউকে বললে হয় না? তারা দক্ষ।“
“না হাবীব, এটা আমার ব্যাক্তিগত কেস। এটা করার পারমিশন কোনো অধিদপ্তর আমাকে দিবে না। সুতরাং বিশ্বস্ত কাউকে প্রয়োজন।“
“স্যার সেটা ইল্লি্গাল হবে। আপনি জেলে যেতে পারেন, আপনাকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করলেও আপনার করার কিছু থাকবে না।“
“এতো চিন্তার সময় নেই আমার হাবীব। আমার জানটা যেখানে আটকা তাকে না বাঁচালে আমি কিভাবে বাঁচবো, বলতে পারো?”

হাবীব কথা বাঁড়ালো না। তৌহিদ ঝড়ের বেগে সিড়ি দিয়ে নেমে গেলো। তার হাতে সময় কম। নুশরাত বেঁচে আছে এটুকু বিশ্বাস তার মনে অটল। এখন শুধু তাকে খোঁজার দেরি।

তৌহিদের সামনে হ্যাকার বসে রয়েছে, হাবীব বহু কষ্টে একে জগার করেছে। ছেলেটির বয়স বাইশ তেইশ হবে। সে এখনো ভার্সিটির গেট পার হয় নি। তাদের সামনে ইশরার ল্যাপটপ। ইশরার সোস্যাল মিডিইয়ার একাউন্ট খোলা। তৌহিদের তাজ্জব হয়ে গেলো যখন ইশরাকে কবর থেকে তোলার ছবি গুলো দেখতে পেলো। সেখানে নুশরাতের জন্য পাঠানো হুমকি ম্যাসেজ গুলোও রয়েছে। এতো ব্যাস্ত হয়ে নুশরাত গতকাল কেনো বেরিয়েছিলো সেটা এখন বুঝতে পারছে সে। মোবাইল নাম্বারের মালিকের সাথে কিছুক্ষণ পূর্বে কথা বলেছিলো তৌহিদ। তার ভাষ্য, তার এই নাম্বার এবং ফোনটি মাস খানেক পূর্বে হারিয়ে যায়। তিনি সামান্য দোকানী, হারানো নাম্বার যে পুনরায় তোলা কিংবা বন্ধ করা যায় সেই ধারণা তার নেই। তার সেটা নিয়ে মাথা ব্যাথাও নেই। মোবাইলের দাম হাজার তিনেক আর সিমের দাম দেড়শ। এটা নতুন কিনে নিলেই হয়। তার পেছনে এতো ঝামেলা পোহাবার কি মানে? তৌহিদ এক পর্যায়ে বেশ চটে উঠে। তার সিম দিয়ে ক্রাইম হচ্ছে অথিচ তার কি না মাথা ব্যাথা নেই। লোকটির সাথে কথা বলার পর থেকেই মাথার যন্ত্রণা দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে। হাবীবের উদ্দেশ্যে সে বলে,
“এক কাপ কড়া চা দিতে বলতো আলিফকে।“
“জ্বী স্যার।“

এরপর সে হ্যাকারের উদ্দেশ্যে বলে,
“ওহে ছোকরা, আর কতক্ষণ? দুই ঘন্টা হতে চললো।“
“এই তো স্যার, হয়ে যাবে।“
“দু ঘন্টা ধরে তো শুনছি। পেলে কিছু?”
“স্যার আইপি এড্রেসটা খুজে বের করতে সময় তো লাগবে।“
“সেটারই তো অভাব, তাড়াতাড়ি”

হঠাৎ টুং করে শব্দ আসে ল্যাপটপ থেকে। আগুন্তক নামক আইডি থেকে একটি ম্যাসেজ এসেছে। তৌহিদ সেটা ওপেন করতেই দেখে তাতে লেখা,
“Bravo, bravo.. I am impressed… হ্যাকার খুজে আমাকে খোঁজার চেষ্টা? ভালো, ভালো। এতো কষ্ট করছেন দেখে আমার ভালো লাগলো। বেশ আমি নিজেই ধরা দেই, কষ্টটা কমিয়ে দেই। ওই ছোকরা হ্যাকার আমাকে খুঁজতে পারবে না। আমি ধরা না দিলে ওর পক্ষে আমাকে খোঁজা অসম্ভব। এরচেয়ে বরং আমি আমাকে খোঁজার পথ বলে দেই,
‘জমিন তলা আসমান উপর,
নাকি আসমান জমিন সব বরাবর?
বল খোদা বল খোদা বল।
হিঁদুর পোড়া শ্মশান আর মিয়ার গোরস্তান।
কার থেকে কে ছো্ট-কহ,কার কি অবস্থান?
জলের উপর পানি না পানির উপর জল?
বল খোদা বল খোদা বল’

গানটি দারুন। গানের মাঝেই আমি রয়েছি।“

তৌহিদের চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো। লোকটার ধূর্ততা দেখে সে অবাক। এতো ধূর্ত কোনো মানুষ হতে পারে। এর মধ্যেই হ্যাকার বলে উঠলো,
“স্যার, লোকেশন চেঞ্জ হচ্ছে। এই লোকেশনটা এক এক সময় এক এক জায়গায় দেখাচ্ছে। লোকটা অতি ধূর্ত।“

রাগে তৌহিদের গা কাঁপছে, লোকটি তাদের পুতুলের ন্যায় নাঁচাচ্ছে। আর সে তার সাথে সাথে নাচছে। সে ধাধার জালে জড়িয়ে গোলকধাধায় ফেলে দিয়েছে। লালন ফকিরের এই ফোক গানের মাঝে ক্লু খোঁজা কি চারতে খানেক ব্যাপার! রাগে সজোরে টেবিলে থাবা বসিয়ে দেয় তৌহিদ। এর মাঝেই হাবীব কফি নিয়ে আসে। কফিটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“স্যার ম্যাডামের অফিসটা একবার চেক করে আসলে কেমন হয়? তার শত্রুর লিস্ট ওখানেই পাওয়া যাবে”
“তুমি বলছো, এই ব্যাক্তি নুশরাতের শত্রু?”
“স্যার দিক খুঁজলেই দিক পাবো। তাই বলছিলাম”
“বেশ চলো”

দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে রয়েছে নুশরাত। তার সামনে খাবারের এটো প্লেট।। গত রাত থেকে কিছুই খাওয়া হয় নি তার। একটু আগে কেউ একজন এসেছিলো দরজার নিচ থেকে প্লেট ঢুকিয়ে চলে গেছে। সেখানে দুটো মোটা রুটি এবং বাসি ডাল ছিলো। ক্ষুধা মানুষকে দিয়ে সব করায়, তার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ক্ষুধার জন্য সে ডাল টা বাসি না ফ্রেস সেটাও বিবেচনা করে নি সে। ঘরটিতে কিছুই নেই যা তাকে এই রুম থেকে বের হতে সাহায্য করবে। মাথায় কোনো বুদ্ধিও আসছে না। তাই দেয়ালে আলতো করে মাথাটা আঘাত করছে সে। হঠাৎ তীব্র ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো সে। মাথার ববি পিনটা ক্ষত স্থানে গুতো দিয়েছে। বা হাত দিয়ে পিনটাকে খুলে আনে নুশরাত। হুট করেই মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়, এবার হয়তো এই বন্দি ঘর থেকে মুক্তি পাবে সে।

স্বর্ণ নামক লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তোহিদ। সে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আসে স্বর্ণের দিকে। স্বর্ণের বিশ্বাস হচ্ছে না নুশরাত কিডন্যাপ হয়েছে। গতকাল ও তো বেশ সুন্দর কথা বলেছিলো। সে অবাক কন্ঠে বলে উঠলো,
“আপনারা সার্চ করেন নি?”
“আপনার মনে হচ্ছে আমি এখানে ফাও ঘুরতে এসেছি?”
“ না সেটা বোঝাই নি। আসলে”
“ থাক, বেশি কথা বইলেন না। অল্প কথায় উত্তর দেন। নুশরাতের মাঝে কি কোনো ক্লাইন্টের সাথে ঝগড়া বা কোনো মনোমালিন্য হয়েছিলো?”
“নাহ, উনার ক্লাইন্ট তো জেলে। উনি ঐ একটা কেস নিয়েই পড়ে ছিলেন। তেমন কিছু হয় নি।“
“ওহ”
“আচ্ছা একটা প্রশ্ন, ওরা কি কোনো র‍্যানসাম মানি চেয়েছে?”
“উহু, একটা ধাধা দিয়েছে, উত্তর দিলে নাকি তাকে খুজে পাওয়া যাবে।“
“কি ধাধা?”
“জেনে আপনি কি করবেন?”

এবার একটু চটে গিয়ে স্বর্ণ বলে,
“আরে মশাই, উনি তো আমার কলিগ নাকি। যদি আমি হেল্প করতে পারি সমস্যা কি?”
“তাহলে বলুন
‘জমিন তলা আসমান উপর,
নাকি আসমান জমিন সব বরাবর?
বল খোদা বল খোদা বল।
হিঁদুর পোড়া শ্মশান আর মিয়ার গোরস্তান।
কার থেকে কে ছো্ট-কহ,কার কি অবস্থান?
জলের উপর পানি না পানির উপর জল?
বল খোদা বল খোদা বল’

মিনিট দশেক চুপ থেকে স্বর্ণ বললো,
“মাওয়া ২য় ঘাট”
“কিভাবে বুঝলেন?”
“জমিন তলা আসমান উপর মানে পানির নিচে মাটি আর উপরে আসমান। নাকি আসমান জমিন সব বরাবর অর্থাৎ যেখানে সব মিলে যায়, নদীর পারের জমি। হিঁদুর পোড়া শ্মশান আর মিয়ার গোরস্তান টা মানে যেখানে শ্মশান এবং গোরস্থান উভয় থাকবে। ঘাটের এদিকে একটা শ্মশান আছে। তার পাশেই আবার ছোট করে গ্রামের গোরস্থান। আমি একবার ভেতর দিয়ে যেতে দেখেছি। আর জলের উপর পানি নাকি পানির উপর জল মানে পদ্মা নদী। সেটা হিন্দুর জন্য জল, মুসলমানের পানি।“
“ধন্যবাদ”

তৌহিদ আর দেরি করলো না, ধন্যবাদ বলেই অফিস থেকে বেড়িয়ে গেলো। মাওয়া ঘাট পৌছাতে কম করে হলেও দু ঘন্টা। এখন না বের হলে হয়তো দেরি হয়ে যাবে।

খুব কষ্টে দরজাটা খুললো নুশরাত। পা টিপে টিপে বের হলো রুমটি থেকে। বেশ অন্ধকার একটি জায়গা। রুম থেকে বের হতেই নিচে যাবার সিড়ি। মরীচা ধরা সেই সিড়ি, নুশরাত ধীর পায়ে নেমে আসে সিড়ি দিয়ে। সিড়ি দিয়ে নেমেই একটি বড় জায়গা। নুশরাতের বুঝতে বেশ কষ্ট হচ্ছে সে কোথায় আছে? লঞ্চের ডেক? হতে পারে। নুশরাত গোল গোল জানালার কাছে যায়। নীল পদ্মার ঢেউ দেখা যাচ্ছে। সে হয়তো কোনো পুরোনো লঞ্চ কিংবা জাহাজের মাঝে আছে। কিন্তু লোকটি তাকে এখানে কেউ এনেছে। বাহিরের ঝলমলে রোদ হওয়া সত্ত্বেও ভেতরে আলো নেই। তাই নুশরাত মাকড়সার জালে মোড়া সুইচটা অন করে। অন করতেই পুরো জায়গাটা আলোকিত হয়ে যায়। এটা একটা লঞ্চের নিচ তালা। জায়গাটাতে সাধারণত বসার জন্য সিট বানানো হয়। কিন্তু এখানে কিছুই নেই, পুরো ফাঁকা। বরং ফ্লোর জুড়ে শুধু নুশরাতের ছবি। ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে নুশরাত, তখন ই পেছন থেকে শুনতে পায়,
“উঠে গেলো মামনী?”

বারো বছর পূর্বে এই কথাটা কানা বসিরের মুখ থেকে শুনেছিলো সে। ভয়ার্ত চোখে পেছনে ফেরে সে। লোকটি কানা বসির নয়, লোকটিকে সে চিনেও না। কিন্তু লোকটির চাহনী ভয়াবহ। লোকটি এগুতে লাগলে নুশরাত দু কদম পিছিয়ে যায়। লোকটি বলে উঠে,
“মামনি, ভয় পাচ্ছো। ভয় পেয়ো না। আমি তো তোমাকে আদর করবো”

সেই চাহনী সেই কন্ঠ। শুধু চেহারা আলাদা, অত্যন্ত জোয়ান একটি ছেলে সে। কিন্তু ছেলেটির চেহারাতে কানা বসিরের ছাপ রয়েছে। নুশরাত কাঁপা স্বরে বলে,
“কে আপনি?”
“কেনো চিনছো না? আমি সে, যাকে তোমার ওই পুলিশ মরদ ঠিক এই জায়গায় গুলি করেছিলো! চিনতে পারছো না?”

লোকটি এগিয়ে আসছে। সে তার কপালে মাঝখানটা বারবার দেখাচ্ছে। আর বলছে,
“চিনতে পারছো না?”
“আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাসী নই। যে মারা গেছে সে ফিরতে পারে না। তুমি আর যেই হও কানা বসির নও। নও তুমি কানা বসির।“
“বেশ তবে আজকে প্রমাণ করে দেয়?”

বলেই লোকটি দ্রুত গতিতে এগিয়ে এলো নুশরাতের দিকে। ক্ষীপ্র গতিতে সে ঝাপিয়ে পড়লো তার উপর। নুশরাত মাটিতে আছড়ে পড়লো। সে হিংস্র জানোয়ারের মতো নুশরাতের জামা টানছে, গায়ে কাঁমড়াচ্ছে। ব্যাথায় নুশরাত কুঁকিয়ে উঠছে। কিন্তু সেই পিশাচ রুপী মানুষ থেকে নিজেকে ছাঁড়াতে পারছে না। লোকটি চিৎকার করছে,
“তোকে সেদিন ছেঁড়ে দিয়েছিলাম। আজ আর ছাঁড়বো না। তোকে আমি ছিরে খাবো। সেদিন ভুল করেছিলাম।“

নুশরাত চিৎকার করছে। নিজের আত্নরক্ষার চেষ্টা করছে কিন্তু এই পশুর সাথে পেরে উঠছে না। হঠাৎ একটি গুলির শব্দ কানে এলো তার। এক দলা রক্ত ছিটকে পড়লো তার মুখে। ধীরে ধীরে লোকটি নিস্তেজ হয়ে পড়লো। লুটিয়ে পড়লো তার উপর। নুশরাত এখনো বোঝার চেষ্টা করছে কি হয়েছে। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। হঠাৎ কেউ লোকটাকে সরিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। এই আলিঙ্গন তার খুব পরিচিত। এটা যে তৌহিদ। নুশরাত হু হু করে উঠলো। তৌহিদ আরোও শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরলো। তার ধীর কন্ঠে বললো,
“আমি আছি, আমি আছি। ভয় নেই, আমি আছি”

এক মাস পর,
আজ তৌহিদ এবং নুশরাতের গায়ে হলুদ। তাদের সকল শুভাকাঙীরা এখানে এসছে। শুধু একজন বাদে, সে হলো মেহরাব। সেদিনের সেই লোকটি মেহরাব ছিলো। মাওয়া ঘাট ২ এ যাওয়ার সময় ডাক্তার শহীদুলের ফোন আসে। তিনি জানান তার ছাত্র অসুস্থ থাকায় সে আসতে পারে নি। তাই ছুটি শেষ করে সেই জয়েন করবে। কথাটা শুনেই তৌহিদের মাথায় বাজ পড়ে। তাহলে মেহরাব নামক ছেলেটি কে ছিলো। অনেক খোঁজ করে জানা যায়, সে এসাইল্যাম থেকে এক পলাতক পাগল ছিলো। সে নিজেকে কানা বসির দাবী করতো। প্রফেশনে ডাক্তার হলেও কোনো একটা ঘটনার পর থেকে সে নিজেকে মেহরাব নয় বরং কানা বসির দাবি করতো। সেই ঘটনাটি কি সেটা তৌহিদ জানতে পারে নি। সব রহস্যের সমাধান হয় না। কিছু রহস্য অজানা থাকে। মেহরাবের রহস্য মেহরাবের সাথেই চলে গেছে। ঠিক মাথার মাঝে গুলি করায় তার ওখানেই মৃত্যু হয়। মেহরাবের এই রোগকে স্প্লিট পারসোনালিটিও বলা হয়। তবে তার ডাক্তারদের মতে তার মাঝে ক্রিমিনালদের প্রতি একটা অবিচ্ছেদ্য আকর্ষণ ছিলো। যখন মেডিক্যাল কলেজে পড়তো তখন প্রচুর রিয়েল লাইফ কিলারদের তথ্য জোগাড়ে ব্যস্ত থাকতো। অনেকের মতে ‘কানা বসির’ এর প্রতি প্রথম আকর্ষন জন্মায় যখন কানা বসিরকে ময়না তদন্তের জন্য তার মেডিক্যাল কলেজে আনা হয়। তখন মেহরাব প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলো। লঞ্চ থেকে তার বিরুদ্ধে নানা প্রমাণ পাওয়া যায়। সেই আগুন্তক আবার সেই স্নিগ্ধের খুনী। স্নিগ্ধকে সে কেনো খুন করেছে ব্যাপারটা একটা ধাধা! তবে সেই স্নিগ্ধের ছেলের পাইপ দিয়ে বিষাক্ত গ্যাস ইনপুট করেছিলো। নুশরাতকে যখন এগুলো জানানো হয় তখন সে সেই ট্রমাগুলো থেকে বের হতে পারে। এখন সে ওকালতি আবার শুরু করেছে। ঘটনার এক সপ্তাহ পর নুশরাতের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে তৌহিদ। তবে নুশরাতের একটা প্রশ্ন এখনো রয়েই গেছে, ‘তৌহিদ তাকে খুজে পেলো কিভাবে’। ছাঁদের কোনায় দাঁড়িয়ে এটাই ভাবছিলো সে। হঠাৎ অনুভব করলো কেউ একজন তার কোমর আকড়ে ধরেছে। স্মিত হেসে নুশরাত বলে,
“আর তো দু দিন, তারপর তো আমি পুরো পুরি আপনার। এগুলো না হয় তোলা থাক।“
“রোমান্সের দিনকাল নেই। যখন ইচ্ছে হয় তখন ই করা উচিত। নয়তো বাসি হয়ে যায়। আর তোমার যা স্বভাব। কখন কোন বিপদে পড়ো। তখন আমি পাবো কোথায় তোমাকে?”
“না অবশ্য ঠিক। আচ্ছা, সেদিন আপনি আপাকে খুজলে কিভাবে?”
“মনের চোখ দিয়ে”
“ঠাট্টা হচ্ছে? আমি উকিল। আমার সাথে ঠাট্টা?”
“স্বর্ণ হেল্প করেছিলো। মেহরাব আমাকে ধাধা দেয়। সেখানেই উত্তর। আমি পারছিলাম না, বুঝছিলাম না। তখন স্বর্ণ হেল্প করে। ওই উত্তর বলে মাওয়া ঘাট ২”
“কিন্তু ওখানে তো অনেক লঞ্চ, এই লঞ্চটা পেলেন কিভাবে?”
“বলবো?”
“হু”
“এক মিনিট”

বলেই তৌহিদ হাটুগেড়ে বসে। তার দেওয়া নুপুরের একটি জোড়া খুলে সে। তারপর সেটা দেখিয়ে বলে,
“এটাকে বলে জিপিএস”
“আপনি আমার পেছনে ট্রাকার বসিয়েছেন? আমি কি চোর?”

বেশ রেগে কথাটা বলে নুশরাত। তৌহিদ তখন হেসে বলে,
“বলেছিলাম না, এবার তোমাকে ছাড়ছি না। তোমাকে নিয়ে ভয় হয় যে। আর এটা না থাকলে আজ হয়তো তোমাকে হারিয়ে ফেলতে হতো। এই ট্রাকারটা খুব শক্তিশালী নয়, তবে তোমার কাছে ২০০ মিটারের ভেতর এটা নোটিফিকেশন দেয়। যখন অথৈ পদ্মায় আমি দিশেহারা হয়ে স্পিড বোটে তোমাকে খুজছিলাম তখন এটাই আমাকে তোমার কাছে নিয়ে গেছে। ভাগ্যিস এটা তুমি গ্রহণ করেছিলে।“

তৌহিদের কন্ঠটি কাঁপছে। নুশরাত আলতো হাতে তার মুখখনি তোলে। আলতো ঠোঁটে চুমু আকে। নাকে নাক ঘষে বলে,
“ভালোবাসি, অনেক ভালোবাসি”

তৌহিদ জড়িয়ে ধরে তাকে। আজ তার ভালোবাসার পুনরায় প্রাপ্তি হয়েছে। অবশেষে নুশরাতের মুখে ‘ভালোবাসি’ শব্দটি শুনেছে সে। শব্দটা শোনার জন্য আকুল হয়ে ছিলো সে। আজ সত্যি সব কালো মেঘ ঘুছে গেছে, নতুন সূর্যের উদয় রয়েছে। তাদের জীবনের নতুন শুভ সূচনা। বিকেলের সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। দুটো মানব-মানবী নিজেদের মাঝে বিলীন হয়ে আছে। আহা কি চমৎকার গোধলী____

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here