অনুভূতিরা শীর্ষে 💗দ্বিতীয়ধাপ,পর্ব-৬,৭

অনুভূতিরা শীর্ষে 💗দ্বিতীয়ধাপ,পর্ব-৬,৭
লেখনিতে_সুমাইয়া ইসলাম মিম
পর্ব-৬
.
.
.
সাদাদকে সবাই ঘিরে ধরে প্রশ্ন করছে যে সুবাহ এখন কি অবস্থায় আছে। কিন্তু সাদাদের মনমরা মুখটা দেখলেই সবাই আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। সাদাদ শুধু এক কথায় বললো,
–সুবাহ ভালো নেই। তার আমাকে প্রয়োজন। খুব বেশি ভয় পেয়েছে সে।

বলেই হাসপাতালে রাখা চেয়ারের সারিতে গিয়ে ধপ করে বসে পরে। সাদিয়া গিয়ে তার ভাইয়ের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রাখলো। সাদাদ সাদিয়াকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজলো। সাদিয়া সাদাদের মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বললো,
-সাদ! তোকেই তো শক্ত হতে হবে। আমার ভাই তো এতো ভেঙে পড়ার মানুষ না।

সাদাদ চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় কাঁপা কন্ঠে বললো,
–দি! আমার ভাবতেই গা শিউড়ে উঠছে, ওরা আমার সুবাহর সাথে ঠিক কি আচরণ করেছে। আমি ভাবতেই পারছি না। আমি একটাকেও ছাড়বো না। এখন শুধু সুবাহর বলার অপেক্ষা!

সাদিয়া “হুম” বলে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। তার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। হাসপাতালের ভোঁটকা গন্ধের দরুন তার প্রচন্ড বমি পাচ্ছে। তাকে এমন অস্থির আচরণ করতে দেখে সাদাদ সাদিয়াকে ছেড়ে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো। সাদিয়া আর থাকতে না পেরে মুখ চেপে ধরে ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দিলো। তাকে দৌড়াতে দেখে রুবায়েতও তৎক্ষণাৎ তার পিছু ছুটলো। সাদাদ রুবায়েতকে যেতে দেখে সে ধীর গতিতেই গেলো। যতই হোক বিয়ের পর সাদাদের আগে রুবায়েত এরই সবচেয়ে বেশি অধিকার রয়েছে সাদিয়ার প্রতি। সাদিয়ার নাড়ী উলটে বমি আসছে। রুবায়েত গিয়ে তার মাথা হালকা করে চেপে ধরলো। বেশ কিছুক্ষণ পর তার বমি থামলেও বমি ভাব টা এখনো রয়েছে। সে পিছনে রুবায়েত এর গায়ে হ্যালান দিয়ে হাঁপাচ্ছে। রুবায়েত পানি দিয়ে সাদিয়ার মুখটা ধুয়ে দিলো। তারপর আস্তে করে তাকে নিয়ে চেয়ারে বসালো। সাদাদ একজন ডাক্তারকে এনে সাদিয়ার চেকআপ করতে বললো। ডাক্তার তাকে দেখে সর্বপ্রথম জিজ্ঞাসা করলো তার পিরিয়ড মিস হয়েছে কিনা! সাদিয়ার ঠিকমতো বলতে পারলো না অস্বস্থির দরুন। তাই ডাক্তার তাকে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করতে বললেন।

.
সুবাহর ঘুম ভেঙে সে আবারও পাগলামি শুরু করেছিলো, কিন্তু সাদাদ গিয়ে তাকে সামলে নেয়। সুবাহ ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে,
–আমাহ..কে এ..খান থেকে নিয়ে.. হ চলো!

সাদাদ অবাক হয়ে গেছে। যেই মেয়েকে এতোদিন বলেও তুমি সম্বোধন করাতে পারে নি সে আজ নিজ থেকে তুমি বলছে। সাদাদ সুবাহর হাতটা শক্ত করে ধরলো।
–যাবো! একটু সুস্থ হয়ে নাও! যাবো!

সুবাহ সাদাদকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে। তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সুবাহ হিমশীতল কন্ঠে বললো,
–তুমি কি আমাকে ভুল বুঝেছো সাদাদ?

সাদাদ ভ্রু কুঁচকে ফেললো।
–তোমাকে কেনো ভুল বুঝবো?

সুবাহ আগের ন্যায় বললো,
–ওরা যে আমাকে তুলে নিয়ে গেছে! তুমি নিশ্চয়ই ভাবছো ওরা আমার…

সুবাহ কিছু বলতে পারলো না। সাদাদ তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।
–তুমি আমার কাছে আগে যতটা পবিত্র ছিলে এখনো ঠিক ততোটাই পবিত্র আছো। ওরা তোমার সতীত্ব হনন করতে পারে নি। তুমি এইসব ভেবো না। তোমার সাদাদ কখনোই তোমার শরীরকে ভালোবাসে নি তাই ভুল বুঝার প্রশ্নই আসছে না। কিন্তু যারা যারা আমার স্ত্রীকে বিন্দুমাত্র অস্বস্থিতে ফেলেছে তাদের আমি কোনভাবেই বেঁচে থাকতে দিবো না। আল্লাহ ছাড়া ওদের কেউ বাঁচাতে পারবে না। আমি তোমাকে কথা দিলাম।

সুবাহ ভেজা লাল চোখে সাদাদের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো,
–সাদাদ আমি ওদের নিজ হাতে শাস্তি দিতে চাই! এটা আমার আবদার তোমার কাছে।

সাদাদ সুবাহর চোখের দিকে তাকালো। এই চোখে সে আপাতত প্রচন্ড ক্রোধ দেখতে পাচ্ছে।

.
এই দুঃখের সময়তেও একটা সুখবর সবাইকে একটু আনন্দ দিলো। সাদিয়া অন্তঃস্বত্ত্বা। দেড় মাস চলছে তার। হাসপাতালে তিনদিন থাকার পর সুবাহ চললো তার শ্বশুরবাড়ি। তার বাবা মা অনেক করে বললেও সে তাদের সাথে যেতে রাজি হয় না। সাদাদও চাইছে না সুবাহকে আপাতত তার থেকে দূরে রাখতে। এখনো তার বিপদ কাটে নি। সবাইই সুবাহকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু সুবাহ সারাদিনই মন মরা হয়ে থাকে, কি যেন ভাবে সারাদিন বসে।

রাতে সাদাদ এসে দেখে সুবাহ খাটে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। সাদাদকে রুমে আসতে দেখে সে পা গুটিয়ে উঠে বসলো। সাদাদ তার পাশে বসে সুবাহর গালে হাত রেখে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো। কিছু দেখতে না পেয়ে জানালা লাগিয়ে পর্দা দিয়ে দিলো।

রাতে ঘুমানোর সময় সাদাদ সুবাহকে তার বাহুডোরে আবদ্ধ করে শুয়ে পড়ে। সুবাহর মন খারাপ। সাদাদ একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
–কেন যে তুমি গাড়ি করে ভার্সিটি গেলে না, কেন জেদ ধরে রিকশা দিয়ে গেলে?!

সুবাহ অবাক চোখে সাদাদের দিকে তাকিয়ে রয়! সে কখন জেদ ধরলো?

(চলবে)..

অনুভূতিরা শীর্ষে 💗
দ্বিতীয়ধাপ
লেখনিতে_সুমাইয়া ইসলাম মিম
পর্ব-৭
.
.
.
সুবাহ অবাক হয়ে সাদাদের দিকে তাকায়!
–আমি জেদ কখন করলাম? ড্রাইভার কাকাই তো বললো গাড়িতে কিছু সমস্যার জন্য রিকশায় চলে যেতে! এমনকি উনি নিজেই আমাকে রিকশা ঠিক করে দিলেন সামনের রাস্তা থেকে!

সাদাদ চমকিত ভাবে উঠে বসলো। ভ্রু খানিক কুঞ্চিত করে সুবাহকে বললো,
–কি বলছো?

সাদাদ কিছু একটা ভেবে রুম থেকে দৌড়ে বের হলো। সাদাদদের বাড়ির নিচতলার বামদিকে ড্রাইভার ও দারোয়ানদের থাকার জন্য নির্ধারিত রুম রয়েছে। সাদাদ সেখানে যায়, কিন্তু ড্রাইভার রহমানের দেখা মিললো না। এতো ব্যস্ততার মাঝে সাদাদের মনে একবারও আসে নি যে তাদের বিশ্বস্ত ড্রাইভার রহমান এমন কিছু করতে পারে! সাদাদের কপালের রগ ফুলে উঠেছে। সে মনে মনে অনুশোচনায় মরে যাচ্ছে। আজ তার গাফলতির জন্যই সুবাহর এই অবস্থা! সাদাদ তার লোকেদের বললো যে করেই হোক ড্রাইভার রহমানের খোঁজ লাগাতে। সাদাদ রুমে এসে দেখে সুবাহ ঘুমিয়ে গেছে, ঔষধের ক্রিয়ায় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেছে। সাদাদ রুমের লাইট বন্ধ করে টেবিল ল্যাম্প জ্বালালো। এই নিস্তব্ধ রাতে সে জেগে আছে, মাথায় হাজারো চিন্তা, মনে হাজারো শঙ্কা, সে একবার তার বিছানায় তাকালো, আলগোছে শুয়ে থাকা তার স্ত্রীয়ের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কতক্ষণ। হঠাৎ করেই তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘশ্বাস। ডানহাতে কলম ধরে কি সব লিখে চলেছে আনমনে।

.
সকালে সুবাহকে নাস্তা খাইয়ে ঔষধ দিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো। এখন তার অনেক কাজ করতে হবে। যতবার সে তার হিংস্রতা শেষ করতে চায় ততবার পরিস্থিতি তাকে হিংস্র হতে বাধ্য করে। সাদাদকে এভাবে হিংস্র হতে দেখে তার নিজের লোকেরাই ভয় পেয়ে গেছে। সাদাদ গম্ভীরভাবে অফিসে এসে তার চেয়ারে বসে। হঠাৎ দরজায় শব্দ হওয়ায় সেদিকে ফিরে তাকায়। সাব্বিরকে আসতে দেখে চেয়ারে ইজি হয়ে বসে তাকে রুমে আসতে অনুমতি দিলো। অনুমতি পেয়ে সাব্বির এসে সামনে একটা চেয়ারে বসে একটা ফাইল সাদাদের দিকে এগিয়ে দেয়। সাদাদ ফাইলের দিকে তাকাতেই সাব্বির বলে,
-হাসপাতালে সঠিক সময়েই নেওয়া হয়েছিলো হিমেলকে। তার বয়ান অনুযায়ী সকল তথ্য এই ফাইলে দিয়েছি, একটু দেখে নিয়েন ভাই! সে বিপরীত পক্ষের লোক ছিলো না। তারা যার হয়ে কাজ করে তাকে কখনোই দেখে নি। কেননা যতবার তারা তাদের সেই ক্রাইমগুরুর কাছে যেত, কাজ শেষ হতেই তাদের এক ধরনের ড্রাগস দেওয়া হতো যার দরুন সেই সময়টায় তারা কোথায় ছিলো, কার সাথে কথা বলছিলো সবটাই ভুলে যেত। এই ড্রাগস দেওয়ার কথা হিমেল এর মেডিকেল রিপোর্ট দেখে তাকে জেরা করে জানতে পারি! আর কিছু জানলে আপনাকে জানিয়ে দিবো।

সাদাদ অন্যদিকে তাকিয়েই বলে,
–হুম।

সাব্বির রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠতেই সাদাদ বলে,
–ড্রাইভার রহমানের কি খবর? খোঁজ পেয়েছিস তার?

সাব্বির হতাশ গলায় বললো,
-তাকে খোঁজার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে কিন্তু কিছুতেই পাচ্ছি না। কিন্তু আমরা থেমে নেই ভাই!

সাব্বির চলে যেতেই সাদাদের পিয়ন তুষার এসে বলে,
-স্যার! আপনার আজকে মিটিং আছে নামাজের পর। বড় স্যার আপনাকে ডাকে।

সাদাদ তার কথার উত্তর দিয়ে চললো তার বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।

.
প্রায় মাসখানিক পেরিয়ে গেলো। সাদিয়ার প্রেগন্যান্সির তিনমাস চলে। সাদিয়া প্রেগন্যান্ট জানার পর থেকেই তার যত্নআত্তি যেন আগের তুলনায় দ্বিগুণ। দুই পরিবারের মাঝেই এই প্রথম বাচ্চা আসতে চলেছে। রুবায়েত চেষ্টা করে সাদিয়াকে সময় দিতে। তবুও কাজের জন্য তাকে যেতেই হয় বাইরে। সাদিয়া সারাক্ষণই ভয় থাকে তার ভাই এবং স্বামীকে নিয়ে। দুজনের কাজেই রয়েছে অনেক ঝুঁকি। সময় করে শাশুড়িকে নিয়ে চলে যায় তার বাপের বাড়ি। সুবাহকে সময় দেয়, তার মন ভালো করার চেষ্টা করে। কিন্তু সুবাহর মনমরা মুখটা দেখলেই সাদিয়ার বুকটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। একটা বিষয় সকলে লক্ষ্য করেছে যে সুবাহ সাদিয়ার বিষয় খুবই যত্নশীল। বাচ্চাটার জন্য সে নিজেও অনেক আগ্রহভরে অপেক্ষা করছে। সাদিয়া সুবাহর আগ্রহ দেখে মুচকি হাসে।

.
সাদাদ কাজ শেষ করে সাদিয়ার সাথে দেখা করতে যায়। এটা তার প্রতিদিনের কাজ বলা চলে। সাদিয়া তার ভাইকে দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়ে রয়! ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার যত্নআত্তিতে। সাদিয়া সাদাদকে বেশ সচেতকভাবে বলে,
-সাদ! আমার মনে হয় সুবাহর একটা বাচ্চা প্রয়োজন।

সাদাদ চমকে বলে,
–কি বলো এগুলো দি?

সাদিয়া আগের ন্যায় বলে,
-হ্যাঁ! তুই বুঝতে চেষ্টা কর! একটা বেবী আসলে সুবাহর মন আরো ভালো হয়ে যাবে। সারাদিন তার একা থাকা লাগে। একটা বেবী থাকলে আর ওই একাকিত্বটা অনুভব হবে না।

সাদাদ নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
–দি! সুবাহ এখনো বাচ্চা একটা মেয়ে। আর ও কি বাচ্চা সামলাবে। ওর তো পড়াশোনাও শেষ হয় নি! আর ওর জন্য কিটকেট তো আছে, আবার এখন বাচ্চার কি প্রয়োজন? সময় হলে তখন বাচ্চা নেওয়া যাবে।

সাদিয়া অনেক চেয়েও তার ভাইকে বুঝাতে পারলেন না।

.
সাদাদ রাতে বাসায় ফিরে দেখে সুবাহ গুনগুন করে গাইছে আর ঘর গোছাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য সাদাদের মনে হলো তাদের জীবনে কোন সমস্যা নেই। সেই আগে যেমন সুবাহর গুনগুনানি সারা ঘরময় বাজতো আজও তেমনই এক দিন। সাদাদ মুচকি হাসে। সুবাহ তাকে দেখে এগিয়ে আসে। সুবাহকে এতোদিন ক্ষুণ্ণমনে থাকতে দেখে কিটকেটও চুপচাপ থাকতো। কিন্তু আজ সেও তার মায়ের পিছু পিছু রয়েছে। সুবাহ সাদাদের হাত ধরে তাকে খাটে বসায়। তারপর নিজে মেঝেতে বসে সাদাদের কোলে মাথা রাখলো। সুবাহর দেখাদেখি কিটকেট খাটের উপর উঠে সাদাদের গা ঘেঁষে মাথা এলিয়ে দিলো। এদের কান্ড দেখে সাদাদ হালকা হাসলো। দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
–কি ব্যাপার? আজ মা বাচ্চা দুজনেই আদর খেতে চলে এসেছে! হুম?

সুবাহ একটা শ্বাস ফেললো। সাদাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
–এমনিই। মন চাইলো তাই! তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। আজ তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে।

সাদাদ অবাক হয়ে সুবাহর দিকে চেয়ে রয়।

(চলবে)..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here