আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_৬ #Esrat_Ety

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৬
#Esrat_Ety

সামিউলের কদিন থেকে মনে হচ্ছে কেউ একজন তাকে ফলো করছে। প্রথম প্রথম সে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এখন সে বেশ বুঝতে পারে কেউ একজন তার পিছু নেয়।
সামিউল একটা প্র’জে’ক্ট হাতে নিয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ। আজ দুদিন ধরে ঢাকার বিভিন্ন বস্তির আশেপাশে তার যাওয়া আসা। অন্তরাকে দিনে খুব একটা সময় দিতে পারে না।
সামিউল তার বাইকের সাথে ঝুলিয়ে রাখা টিফিন ব’ক্স’টার দিকে তাকায়। অন্তরা খুব ভোরে উঠে তার জন্য রান্না করে দেয়। সামিউল হাত দিয়ে টিফিন ব’ক্স’টা আলতো করে ছোঁ’য়। তার মুখে হাঁসি।

অন্তরার ফোন আসে। সামিউল ফোন রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে অন্তরা বলে,”আজ কোথায়?”

-এই আছি বাড্ডার কাছে একটা বস্তিতে।

-ওমা,এতদূর চলে গেলে!! খেয়েছো?

-এইতো এখনই খাবো। তুমি খেয়েছো?

-না,আমিও খাবো। আচ্ছা আমি আমার স্টোরিতে একটা ফটো দিয়েছি তুমি কোনো কমেন্ট করলে না যে!

-ভুল হয়ে গেছে আমার, মাফ করে দেন।

সামিউল অত্যন্ত নাটকীয় ভাবে বলে কথাটা।

অন্তরা খিলখিল করে হাসে। সামিউলের কাছে সে হাসি বড় মধুর লাগে শুনতে।
সামিউল বলে,”আজ হাতে কিছু টাকা পেয়েছি, শিহাব ভাই এ’ড’ভা’ন্স দিয়ে দিয়েছে। তোমার কি লাগবে অন্তরা?”

-আমি চাই আমার স্বামী যেনো সন্ধ্যে সন্ধ্যে বাড়ি ফিরে আসে। আমার একা একা মশার কা’ম’ড় খেতে ভালো লাগে না।

সামিউল হাসে। বলে,”যথা আজ্ঞা মহারাণী। আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরছি।”

***
শর্মীর মন আজ খুব খারাপ। সে একা একা বেলকোনিতে বসে আছে। তার হাতে একটা বই। একটু আগে তার পাপা তাকে রুমে ডেকেছিলো। তখন ওই মহিলাও পাপার রুমে ছিলো। পাপার বুকশেলফ থেকে বই নামিয়ে পড়ছিলো। কত বড় সাহস। পাপা তাকে রুমে ডেকেছিলো তার পরিক্ষার কথা জানতে। তার মি’ড টা’র্ম এ’ক্সাম চলছে। আজ ছিলো ম্যা’থ। শর্মি পাপাকে খুব ভ’য় পায়।তার পাপা লেখাপড়ার ব্যাপারে খুবই স্ট্রি’ক্ট। শর্মি ম্যা’থে বরাবরই কাঁচা। রাওনাফ শর্মির কো’য়েশ্চন পেপার থেকে শর্মিকে কিছু দুই মার্কের প্রশ্ন সলভ করতে বলে। শর্মী বলতে পারে না। রাওনাফ বুঝে যায় শর্মী কেমন পরিক্ষা দিয়েছে।

রাওনাফ বলে ওঠে,”এগুলো তো অত্যন্ত সহজ ছিলো। আমি গত পরশু রাতেও তোমাকে সলভ করা শিখিয়েছি! শেখাইনি?”

শর্মি মাথা না’ড়ে।

-তাহলে পারলে না কেনো?

-পাপা আমি সব গুলিয়ে…….

-আর কোনো এক্সকিউজ না।

রাওনাফ ধ’মকে ওঠে। উর্বী বই বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে।

রাওনাফ বলে,”লেখাপড়ায় বড্ড ফাঁকিবাজ হয়েছো। তখন মাথা নেড়ে কেনো বলেছিলে তুমি সব বুঝেছো? আমি যাতে তাড়াতাড়ি তোমাকে ছেড়ে দিই এজন্য? I didn’t expect this from you. আমি ম্যা’থের টিচারকে ফোন করে দিচ্ছি আজ থেকে সে তোমাকে একবেলা নয়,দু বেলা পড়িয়ে যাবে। আশা করি ফাইনালে তুমি আমায় হতাশ করবে না। আর শোনো, কখনও ফাঁকি দেবে না, না বুঝলে বলবে, একশো বার বুঝিয়ে দেবো।”

শর্মী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এই অংক সাবজেক্ট টা থেকে সে পালিয়ে থাকতে চায়। কিন্তু সেটা সম্ভব না।
শর্মীর তার বাবার ধ’ম’কে একটুও খারাপ লাগছে না কিন্তু ওই মহিলা তাকে ধ’ম’ক খেতে দেখেছে বলে তার খুব রা’গ হচ্ছে। তার রাগে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে।

***
রওশান আরা চেয়ারে বসে ঝি’মুচ্ছে। আজকাল তার শরীর খুব একটা ঠিক যাচ্ছে না। আমিরুন তার পায়ের ন’খ কে’টে দিচ্ছে। উর্বী এসে তার পাশে বসে।
রওশান আরা উর্বীর দিকে তাকায়। কি সুন্দর একটা মুখশ্রী! রওশান আরার মন ভরে যায় দেখলেই। সে উর্বীকে বলে,”রাওনাফ একটু ফ্রি হলে তোমাকে আর রাওনাফকে ও বাড়িতে পাঠাবো।”

উর্বী মাথা নাড়ায়।
রওশান আরা তার দিকে তাকিয়ে বলে,
-রাওনাফ ফিরেছে?

-জি।

রাওনাফ ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। তাকে একটা রোগীর রি’পো’র্ট লন্ডনে তার বন্ধুর কাছে পাঠাতে হবে। তার অনেক কাজ। শর্মীর টিচার আসলে তার সাথে কথা বলতে হবে। সন্ধ্যায় হসপিটালে যেতে হবে। আজ তার নাইট ডিউটি।

রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়। আগে একটু কফি খেয়ে নিতে হবে। সে আমিরুনকে ডাকতে ডাকতে তাদের কাছে চলে আসে। তারপর আমিরুনের দিকে তাকিয়ে বলে,”ওহ তুই ব্যস্ত। আচ্ছা ঠিকাছে।তারপর আমায় একটু কফি খাওয়াতে পারবি? আমিই বানাতাম কিন্তু আমার একটু কাজ আছে।”
আমিরুন বলে,”জে আইচ্ছা ভাইজান। আমি আনতাছি।”

রাওনাফ চলে যায়। আমিরুন নখ কা’টা শেষ করে উঠতে যাবে তখন রওশান আরা বলেন,”আমিরুন! তুই গিয়ে ছাদ থেকে কাপড়গুলো আন। বৌমা রাওনাফের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে যাবে।”

উর্বী তার শাশুড়ির দিকে তাকায়। রওশান আরা চোখ বন্ধ করে গুনগুন করে গজল গাইতে শুরু করে।
আমিরুন উর্বীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে ছাদে চলে যায়।

***
রওশান মঞ্জিলে একটা দূ’র্ঘটনা ঘটে গেছে। কেউ বা কারা সামিউলকে ছু’ড়ি দিয়ে জ’খ’ম করেছে।

ফোনটা প্রথমে রাওনাফের কাছে আসে। সামিউলের একজন টিম মেম্বার ফোন দিয়ে রাওনাফকে জানায়। সামিউলকে রাওনাফের হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। অবস্থা গু’রু’ত’র। রাওনাফ বুঝতে পারছে না বাড়ির লোকদের কিভাবে খবর টা দেবে। অন্তরাকে জানানো দরকার। শাফিউল আর মোহনা এখনো বাড়িতে ফেরে নি। রাওনাফ বুঝতে পারছে না কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবে। সে আমিরুন কে ডাকে। আমিরুন দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায়,”ভাইজান কিছু কইবেন।”

-আমিরুন আমি যা বলবো মন দিয়ে শুনবি। সামিউলের একটা এ’ক্সি’ডেন্ট হয়েছে। অবস্থা গু’রু’তর। ওকে আমাদের হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। মাকে কিছু বলবি না। অন্তরাকে জানা। ওকে শান্ত রাখার চেষ্টা করবি। মনে থাকবে?

আমিরুন হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে রাওনাফের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। রাওনাফ বলে,”যা বললাম তা যেনো মাথায় থাকে। মা যদি জেনেও যায় তাকে সামলানোর দায়িত্ব তোর।”
রাওনাফ বেরিয়ে যায়। আমিরুনের হাত পা কাপছে। সে দৌড়ে অন্তরার রুমের দিকে যায়। উর্বী তাকে দেখে তার পিছু নেয়। আমিরুন উর্বীকে সবটা খুলে বলে।

অন্তরা অতি উৎসাহের সাথে সামিউলের জন্য ফুলকপির ব’ড়া বানাচ্ছিলো। দরজায় টোকার আওয়াজ পেয়ে অন্তরা গিয়ে দরজা খোলে। দরজার বাইরে আমিরুন আর উর্বী দাঁড়িয়ে। অন্তরা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমিরুন কাঁ’দছে। অন্তরা কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাত আমিরুন বলে,”ছুডো ভাইজানরে কারা যেনো ছু’ড়ি মা’রছে গো গানের আপা”।

অন্তরা তাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কি বলছে এরা!কিছুক্ষন আগেই তো কথা হলো। অন্তরার মনে হচ্ছে সে এখনি নিচে পরে যাবে। উর্বী এসে অন্তরার হাত ধরে। অন্তরা শুধু বলতে পারে,”আমাকে ওর কাছে নিয়ে যান।”
তারপরই অন্তরা অজ্ঞান হয়ে যায়।

সামিউল আইসিইউ তে। আশরাফ পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তার সাথে আরো দুজন ডাক্তার।
অন্তরা আইসিইউ রুমের দরজার কাচ দিয়ে সামিউলকে দেখছে।জ্ঞান ফেরার পরে সে পাগলের মতো করছিলো। শাফিউল তাই তাকে নিয়ে আসে হসপিটাল। হসপিটালে বাড়ির প্রায় সবাই এসেছে, শাফিউল, মোহনা, শায়মী, নাবিল, আমিরুন। বাড়িতে আছে শুধু উর্বী, রওশান আরা আর শর্মী।

রওশান আরা অ’স্থি’র হয়ে আছেন। সে সন্ধ্যা থেকে ছটফট করছেন। সবাই বলছে ছোটো খাটো একটা এ’ক্সি’ডেন্ট, হাত পায়ের ছা’ল উঠে গিয়েছে শুধু। কিন্তু তিনি বেশ বুঝতে পারছেন সবাই তার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে।
সে উর্বীকে বারবার জিজ্ঞেস করছে,”সত্যি করে বলো আমার ছেলেটার কি হয়েছে। একদম মিথ্যে বলবে না।”
উর্বী বারবার একই উত্তর দেয়,”আপনি উত্তেজিত হবেন না মা। তার সামান্য চো’ট লেগেছে।”

রওশান আরা শান্ত হতে পারে না। নামাজে দাঁড়ায়। নামাজ আদায় করে রওশান আরা হসপিটালে যাবে বলে তৈরি হয়। সে নিজের চোখে তার ছেলেকে দেখবে। উর্বী তাকে বারবার আটকানোর চেষ্টা করে। সে কোনো কথা শোনে না। শর্মী এসে রওশান আরাকে বলে,”আমিও যাবো দাদু। আমিও চাচ্চুকে দেখবো।”
তার চোখে পানি।

রওশান আরা বলে,”আয় তাহলে।”
বাধ্য হয়ে উর্বী তাদেরকে নিয়ে হসপিটাল যাবে বলে ঠিক করে।

উর্বী শর্মীকে বললো,”আমি তো তোমাদের হসপিটাল চিনি না। আব্দুল ভাইও তো নেই।”

শর্মী কপাল কুঁচকে রিমিকে বলে,”আমাদের হসপিটালের নাম বললে যে কোনো ড্রা’ইভার চিনবে। আপনি শুধু দাদুর হাত ধরে রাখুন।”

বাড়িতে কোনো গাড়ি নেই। বাড়ি থেকে বের হয়ে তারা তিনজন মেইন’রোডে এসে নামে।
সেখানে একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে।

***
রাওনাফ আইসিইউ রুম থেকে বের হয়। সবাইকে বলে,”চব্বিশ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। তোমরা সবাই শান্ত থাকো। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে আমার ভাইকে বাঁচাবো।”
তারপর অন্তরার দিকে তাকিয়ে বলে,”এই মূহুর্তে সবথেকে বেশি তোমাকে শ’ক্ত থাকতে হবে, আশা করি তুমি বুঝতে পারছো।”

অন্তরা বলে,”আমি কি এক মিনিটের জন্য ওর কাছে যেতে পারি।
শুধু এক মিনিট। ”
আকুল অনুরোধ অন্তরার।
রাওনাফ কি যেনো ভাবে, তারপর বলে,”যাও তবে কান্নাকাটি করো না,প্লিজ।”

রওশান আরা অস্থির হয়ে আছেন। শর্মীকে বারবার বলছেন,”আর কতদূর? আর কতসময় লাগবে? ”
_এই তো দাদু,আর একটু খানি।

রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। উর্বী রওশান আরার হাত ধরে আছে।
আশেপাশে শুধু গাড়ির হর্ন বাজানোর শব্দ ভাসছে। সবাই বিরক্ত হয়ে হর্ন বাজাচ্ছে। উর্বী সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের সিএনজির পেছনে ডানপাশে একটা লাল রঙের গাড়ি এসে থামে। রোড লাইটের আলোতে সে গাড়ির চালকের মুখ উর্বী তাদের সিএনজির আয়নায় দেখতে পায়। মুখে মাস্ক পরা। চোখ দেখা যায় শুধু। উর্বীর মনে হলো তাদের গাড়ির দিকেই তাকিয়ে আছে। উর্বী চ’ম’কে ওঠে।এই চোখ দুটো যে তার বড্ড চেনা। উর্বী চোখ সরিয়ে নেয়। তার হাত পা কাঁ’প’ছে।
রওশান আরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। উর্বী তাকে শক্ত করে ধরে রাখে। সে ভ’য়ে ভ’য়ে আবার মিররে তাকায়। এবার আর কাউকে সে দেখতে পায় না।

অন্তরা সামিউলের হাত ধরে আছে। সামিউলের মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। অন্তরা সামিউলের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,”আমার সাথে এভাবে বেঈমানি করলে তোমাকে আমি কখনোও ক্ষমা করবো না। কথা ছিলো না কিন্তু এমন কিছুর!”

***
রাওনাফ এসে শাফিউলকে বললো,”ওদের সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দেই। মা বাড়িতে নিশ্চই টেনশন করছে। তুই থাক শুধু। পুলিশ ত’দন্ত করছে। আমি এদিকটা দেখছি,তুই সেদিক টা দেখ।”

-পুলিশ তদন্ত করে কি জানতে পেরেছে?

-পুলিশ ধারনা করছে ছি’ন’তাইয়ের কে’ইস।
-শুধু ছি’ন’তা’ইয়ের কেইস হলে এতোটা জ’ঘন্য ভাবে কেউ কাউকে মা’রবে?
-বুঝতে পারছি না। আগে আমার ভাইটা সুস্থ হোক। আল্লাহ্‌ কে ডাক।

রওশান আরাকে আসতে দেখে রাওনাফ আর শাফিউল হতবাক হয়ে যায়। মা হসপিটালে কি করছে!
রওশান আরা পাগলের মতো ছুটে আসছে,তার পেছনে আসছে উর্বী আর শর্মী।
রাওনাফ রওশান আরাকে ধরে ফেলে। শর্মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”মাকে এখানে এনেছো কেনো।?”
তারপর উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী চুপ করে থাকে।

রওশান আরা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে,”ওরে রাওনাফ, আমার ছেলেটা কই। আমাকে আমার ছেলের কাছে নিয়ে যা বাপ,আমার দমটা যে বেরিয়ে গেলো।”
শাফিউল এসে মাকে ধরে। রওশান আরাকে নিয়ে রাওনাফের কেবিনে যাবে। এই মূহুর্তে মাকে কিছুতেই সামিউলের সামনে নেওয়া যাবে না।

উর্বী অন্তরার কাছে এসে দাঁড়ায়। তারা সবাই ওয়েটিংরুমে বসে আছে। অন্তরার চোখের পানি শুকিয়ে গালের সাথে লেপ্টে আছে।তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

উর্বীকে দেখেই নাবিল বলে,”এখানেও আপনি চলে এসেছেন।”

উর্বী নাবিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। মোহনা নাবিলকে ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”নাবিল, স্টপ!”

রওশান আরা রাওনাফকে বলে,”আমি শুধু একটা বার আমার ছেলেটার মুখ টা দেখবো। আমায় একটু নিয়ে যা বাবা।”

রাওনাফ বলে,”মা ভাই আগে সুস্থ হোক। তারপর তুমি দেখো। তুমি এরকম করলে অসুস্থ হয়ে পরবে। এখন আমি সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি ওদের সাথে যাবে।
রওশান আরা কাঁদতে থাকে। তার মন মানছে না। শাফিউল তাকে ধরে রেখেছে।

ওয়েটিং রুমের এক পাশে বসে মাস্ক পরা একজন মুখের সামনে খবরের কাগজ ধরে পড়ছিলো। তার দৃষ্টি ছিলো খবরের কাগজে, কিন্তু সে এসেছিলো অন্য কিছু দেখতে।

***
অন্তরা হাসপাতালে থেকে গেছে। অন্যরা সবাই বাড়ি ফিরে এসেছে।কেউ রাতে কিছু খায়নি। যে যার ঘরে শুয়ে আছে।
উর্বীও বাতি জালিয়ে রেখেই শুয়ে আছে। রাত বারোটার বেশি বেজে গিয়েছে। রাওনাফ আজ রাতে ফিরবে না। তার অনেক ভ’য় ভ’য় করছে, কোনো এক অজানা কারনে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।রওশান আরার ঘরে আমিরুনকে থাকতে বলেছে রাওনাফ নয়তো সে আমিরুনের সাথে থাকতো। উর্বী উঠে বসে।

দরজার বাইরে একটা আওয়াজ হয়। উর্বী চ’মকে ওঠে। তারপর মিউমিউ শব্দ আসে। এটা শর্মীর বেড়াল। উর্বী বুঝতে পারে তার ঘুম আসবে না। সে ধীরপায়ে হেটে রওশান আরার রুমের দিকে যায়, দরজা খোলাই ছিলো। সে ভিতরে ঢোকে। রওশান আরা ঘুমাচ্ছে,আমিরুন মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমিয়ে পরেছে।
সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে লিভিং রুমের দিকে চলে যায়। টিভি অন করে সোফাতে বসে পরে। কিছুক্ষন খবরের চ্যানেল ঘাটাঘাটি করে। পরে হাতে একটা ম্যাগাজিন তুলে নেয়। উর্বী বুঝতেই পারেনি সে এভাবেই সোফাতে ঘুমিয়ে যাবে। রাত তখন ৩টা তেইশ মিনিট।

***
সজীব রুমে ঢুকতেই সজীবের গালে সশব্দে উচ্ছাস একটা চ’ড় বসিয়ে দেয়। সজীব এই চ’ড়ের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। সে মাটিতে পরে যায়।
উচ্ছাস ওর শার্টের কলার ধরে ওপরে ওঠায়। চেঁচিয়ে বলে,”কি বললি,এখনো বেচে আছে? তোদের না বলেছিলাম পুরোপুরি খ’তম না করে যায়গা থেকে নড়বি না!”
_ভাই,বস্তির লোকজন চলে আসছিলো তাই আমরা….

উচ্ছাস হাত দিয়ে থামিয়ে দেয়। গলার স্বর হঠাৎ করে স্বাভাবিক হয়ে যায়। ঠান্ডা গলায় বলে,”কপাল ভালো।”

সজীবের কপাল থেকে ঘাম ঝরছে। সে নিশ্চিত উচ্ছাসকে সে এখন যে কথাটি বলতে যাবে তা শুনলে উচ্ছাস তাকে মেরেই ফেলবে।তবু সজীব বুকে সাহস জমা করে। অন্যদের কাছ থেকে জানার থেকে সজীব নিজেই বলবে। সে উচ্ছাসকে কে ডাকে,”ভাই।”
উচ্ছাস অগ্নি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়,”এখনো তুই দাঁড়িয়ে আছিস, যা আমার চোখের সামনে থেকে।”
-ভাই একটা বিরাট গণ্ডগোল হয়ে গেছে।
-আবার কি গণ্ডগোল হয়েছে।
উচ্ছাস ধমকে ওঠে।
-ভাই আজ যাকে আমরা মারলাম তার সাথে উর্বীর বিয়ে হয়নি। উর্বীর বিয়ে হয়েছে তার বড় ভাইয়ের সাথে। ডাক্তার রাওনাফ করিম খান, সিটি মেডিকেয়ার হসপিটালের একজন চেয়ারম্যান।

কথাগুলো একনাগারে বলে সজীব।
উচ্ছাস সজীবের দিকে তাকিয়ে থাকে। সজীব উচ্ছাসের চোখ দেখে মনের কথা পরতে পারছেনা। এতো বড় ভুলের জন্য উচ্ছাস তাকে কি করবে?

***
রাওনাফ ঘুমন্ত উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না উর্বী এভাবে সোফাতে কেনো ঘুমাচ্ছে। টিভি অন করাই আছে। রাওনাফ টিভি অফ করে দেয়। উর্বীকে দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রাওনাফ খানিকটা ইতস্তত ভঙ্গিতে উর্বীকে ডাকে। উর্বী ঘুমিয়েই আছে।
রাওনাফ আরেকটু জোরে ডাক দেয়,”উর্বী।”
উর্বী লাফিয়ে ওঠে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সে কিচ্ছু বুঝতে পারে না। রাওনাফের দিকে তাকায়।
রাওনাফ বলে,”দুঃখিত। তবে এভাবে সোফায় ঘুমাচ্ছিলে কেনো?”

_ টিভি দেখছিলাম ঘুমিয়ে যাবো বুঝতে পারিনি।
রাওনাফ বলে,”ঠিকাছে এখন রুমে যাও। ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছে।”
_কিন্তু আপনি ভিতরে আসলেন কিভাবে, দরজা খুলেছে কে?
_আমার কাছে চাবি ছিলো।
_আপনার ছোটোভাইয়ের এখন কি অবস্থা?
অনেক টা জড়তা নিয়ে প্রশ্ন করে উর্বী।
_আগে চব্বিশ ঘন্টা যাক।
রাওনাফ ক্লান্ত ভঙ্গিতে ওপরে ওঠে। তার ঘুমানোর প্রয়োজন। উর্বী তার পিছু পিছু ওপরে ওঠে।

***
সামিউলের অবস্থা এখন কিছুটা আশংকামুক্ত। তার জ্ঞান ফিরেছে তবে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
অন্তরা সামিউলের মাথার কাছে বসে আছে। সামিউলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সামিউল চোখ মেলে তার দিকে তাকায়।

তার শরীরে অসহ্য যন্ত্রনা। অন্তরা বলে,”তুমি ঘুমোও।”
সামিউল চোখ বন্ধ করে।

রাওনাফ পু’লিশের সাথে হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। পুলিশ ইন্স’পে’ক্টর বলছে,”আপনার ভাইয়ের যদি জ্ঞান ফিরে থাকে তবে আমরা তাকে কিছু সামান্য জিগ্যাসাবাদ করতে চাই আমাদের তদন্তের জন্য।”

_আমার ভাই এখনো কথা বলার মতো অবস্থায় নেই অফিসার।

_ঠিকাছে আমরা তবে আরো একদিন অপেক্ষা করি।

পুলিশ অফিসার চলে যাবার পরে রাওনাফ সামিউলের কেবিনের কাছে এসে দাঁড়ায়। সে একটা অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য দেখতে পায়। অন্তরা সামিউলের কপালে চু’মু দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রাওনাফ কেবিনে ঢোকে না। তার কাজ শেষ,এখন সব দায়িত্ব অন্তরার। রাওনাফ নিশ্চিত অন্তরা তার দায়িত্ব খুব ভালো ভাবে পালন করবে।

***
সম্ভবত শেষ রাতের পাখিটাও ঘুমিয়ে গিয়েছে। রাত এতোটাই গভীর। ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই উর্বীর ঘুম ভেঙে যায়। তার বুকটা কেমন ধরফরিয়ে ওঠে। সে ফোনটা হাতে নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে দেখতে পায় একটা অচেনা নাম্বার। নতুন সিমকার্ডে অচেনা নাম্বার টা দেখে তার খানিকটা খটকা লাগে। না চাইতেও ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশের ব্যক্তি নীরব। দীর্ঘক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না। উর্বী কয়েক মূহুর্ত পরে বলে ওঠে,”কে বলছেন!”

ওপাশের ব্যক্তি কোনো কথা বলে না। মাঝেমাঝে নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে শুধু। কান খাড়া করে উর্বী শুনতে থাকে। ওপাশের ব্যক্তিটি একটা গান শুনছে, পরিচিত একটা গান। গানের একটা লাইন শুনতে পেয়েই উর্বীর চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
সে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা কেটে দিয়ে পাথরের ন্যায় বসে থাকে।

রাওনাফের ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো উর্বীর ফোনের রিংটোন শুনেই। নীরবতা ভেঙে উর্বীর পাশ থেকে অদ্ভুত শব্দ তার কানে আসছে। দীর্ঘসময় পরে চাপা গোঙানির আওয়াজ রাওনাফের কানে পৌঁছায়। রাওনাফ উঠে বসে বেড সাইডের বাতি জ্বেলে দেয়। অনেকটা সংকোচ নিয়ে পর্দা সরিয়ে সে দেখে উর্বী হাপাচ্ছে। তার চোখে পানি। শাড়ির আঁচল দলা পাকিয়ে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে কাঁদছে যাতে আওয়াজ না বের হয়। রাওনাফ উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”আর ইউ ওকে! অসুস্থ বোধ করছো! ”

উর্বী স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করেও পারেনা। বিষাদের স্মৃতিগুলো তার গলা চে’পে ধরছে।

রাওনাফ এগিয়ে যায়,বলে,”Asthma আছে নাকি তোমার?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,”ওকে,যা বলছি সেটা করো। যাস্ট ব্রিদ ইন। ব্রিদ আউট।”

উর্বী করার চেষ্টা করে। রাওনাফ বলতে থাকে,”হ্যা এভাবেই, ব্রিদ ইন! ব্রিদ আউট!”

চলমান……

[ সম্পূর্ণ কাল্পনিক কাহিনী। এর সাথে বাস্তবের মিল খুঁজতে যাবেন না। যারা বাস্তবিক গল্প পছন্দ করেন তাদের জন্য এই গল্পটি নয়]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here