আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_৭ #Esrat_Ety

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৭
#Esrat_Ety

রাওনাফ উর্বীর প্রেশার চেক করে উর্বীর দিকে তাকায়। বয়সের তুলনায় ছোটো দেখতে লাগার পাশাপাশি মেয়েটাকে দেখলে খুবই নাজুক প্রকৃতির মনে হয়। যেন অসুস্থতা রয়েছে।

উর্বী নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে। রাওনাফ উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে উর্বীকে দেয়। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিয়ে পানি খায়। রাওনাফ খুবই স্বাভাবিক গলায় বলে,”প্যানিক অ্যাটাক। এরকম সবসময় হয়? ধরো মাসে দু তিনবার।”

উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ বলে,”ঠিকাছে ঘুমিয়ে পরো। মানে চেষ্টা করো।”

কথাটি বলে রাওনাফ পর্দা টেনে দিতে যাবে তখনই উর্বী বলে ওঠে,”ওটার প্রয়োজন নেই।”

রাওনাফ মাথা ঘুরিয়ে তাকায় উর্বীর দিকে। উর্বী বলতে থাকে,”এখন হঠাৎ কেনো যেনো হাস্যকর লাগে।‌ এমনিতেই অদৃশ্যমান পর্দা রয়েছে। ওটাতে তেমন কোন পার্থক্য হয়না।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পর্দা সরিয়ে আলমারিতে তুলে রাখে। উর্বী চুপচাপ বসে থাকে । রাওনাফ এসে নিজের পাশটায় শুয়ে পরে।
অনেকটা সময় নিয়ে উর্বী ধাতস্থ হয়। রাওনাফ চুপচাপ শুয়ে আছে।

উর্বী ঘাড় ঘুরিয়ে রাওনাফকে দেখে বলে ওঠে,”আপনি মায়ের অনেক বাধ্য ছেলে!”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলে,”হ্যা। সেই তকমা দিতে পারো।”

উর্বী কিছু বলে না। রাওনাফ হুট করে বলে ওঠে,”তুমিও ভাইয়ের অনেক বাধ্য বোন।”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে প্রসঙ্গ পালটে বলে ওঠে,”আপনার সাবেক স্ত্রীর সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি যদি কিছু মনে না করেন তো। মানে ওনার সাথে আপনার বিয়েটাও কি পারিবারিক ভাবে হয়েছে? হুট করে!”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী প্রশ্নটি করে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছিলো। রাওনাফ স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”লাভ ম্যারেজ ছিলো। হুট করে কিছুই ছিলো না। ওর বাবা আমার মায়ের দূরসম্পর্কের ভাই ছিলো, ওরা বড়লোক ছিলো। শহরে থাকতো, পড়াশোনার জন্য আমি ওদের বাড়িতে থাকতাম,ওর ছোটো ভাই-বোনদের পড়া দেখিয়ে দিতাম। সেখান থেকে মন দেওয়া নেওয়া হয়। পরে ওর পরিবার সবটা জেনে গেলে আমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে। আমি মেস ভারা করে থাকতে শুরু করি। হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে একদিন আমার মেসে চলে এসে বলে,”আমাকে বিয়ে করো।”
তখন আমি মেডিকেল স্টুডেন্ট। তৃতীয় বর্ষ।”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। এই লোকের জীবনেও প্রেম ছিলো!

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”আরো কিছু জানতে চাও?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ বলে,”জানতে চাইলে জিজ্ঞেস করো। তোমার তো অধিকার আছে!”

উর্বী রাওনাফের দিকে একপলক তাকিয়ে বলে ওঠে,”আপনারও তো অধিকার আছে। আপনি জানতে চাইবেন না?”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,”তোমার তো প্রাক্তন হাজবেন্ড নেই। থাকলে ভদ্রলোকের সম্পর্কে টুকটাক জানতে চাইতাম। বাকি রইলো তোমার পাস্ট লাইফ। সেটা আদৌও আমাদের বোঝাপড়ায় দরকার হবে কিনা আমি জানি না। বোঝাপড়া বর্তমান নিয়ে হয়। অতীত নিয়ে নয়। আর যদি বলো ওসব জানাটা আমার অধিকারের মধ্যে পরে তাহলে বলবো কাউকে অস্বস্তি দিয়ে আমি অধিকার খাটানো অপছন্দ করি। এমন অধিকার না খাটালেই আমার স্বস্তি।”

কাছের মসজিদে ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছে। রাওনাফ উঠে ফ্রেশ হয়ে টুপি হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায়। উর্বী ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কিছু সময় পরেই সে ঘুমিয়ে পরে।

রাওনাফ মসজিদ থেকে ফিরে এসে দেখে উর্বী গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে । বাইরে আলো ফুটে গিয়েছে। অক্টোবর শেষ হতে না হতেই একটা হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করেছে ভোরের দিকে, কেমন শীত শীত ভাব।
রাওনাফ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এসি অফ করে উর্বীর পায়ের কাছে রাখা চাদরটা তার গায়ে টেনে দিয়ে চলে যায়।

***
ঘুম ভাঙার পর উর্বী ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না তখন ক’টা বাজে। দেখে মনে হচ্ছে বেলা গড়িয়ে গিয়েছে বেশ। কেউ তাকে ডাকতে আসেনি। রাওনাফ নেই। দরজা চাপিয়ে রাখা।

উর্বী ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানার ওপর একটা ওষুধের পাতা দেখতে পায়। সাথে একটা টুকরো কাগজ। হাত বাড়িয়ে কাগজটা তুলে নিয়ে দেখে তাতে লেখা,”খাওয়ার পরে একটা খেয়ে নিও।”

ডাক্তার তার ডাক্তারি করে গিয়েছে। উর্বী ওষুধের পাতার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে। দুঃখের কোনো ওষুধ আছে? আছে কোনো ডাক্তার? যারা রোগীর দুঃখ শুনে বলবে,”এই নাও! এই ট্যাবলেট টা দিনে তিনবার খাওয়ার পরে খাবে। তাহলে তোমার দুঃখ তুমি ভুলে যাবে। কখনও মনেই পরবে না,পরবেই না!”

***
শর্মীকে আজ খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। স্কুল থেকে ফিরে সে সেই যে ঘরে ঢুকেছে আর বের হয়নি। তার গায়ে জ্ব’র এসেছে। সে বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
শায়মী আর নাবিল বাড়িতে নেই, কোচিং এ গিয়েছে। শর্মী তার ফোন থেকে তার পাপাকে কল করে,ওপাশ থেকে রাওনাফ ফোন রিসিভ করে বলে,”হ্যা মামনি। কিছু বলবে?”
-পাপা আমার মনে হচ্ছে আমার গায়ে জ্ব’র এসেছে।
-সে কি! আচ্ছা আমি মোহনাকে বলছি তোমাকে মেডিসিন দিয়ে দিতে।
-চাচী আমাকে মেডিসিন দিয়ে দিয়েছে পাপা।

-গুড। তুমি রেস্ট নাও। আমি তাড়াতাড়ি ফিরবো।

-পাপা!

-হ্যা মামনী বলো।

-এবারও যদি আমি অংকে ফেইল করি তুমি কি আমার উপরে রাগ করবে।

রাওনাফ বুঝে যায়, শর্মীর রেজাল্ট ভালো হয়নি আর সেটার স্ট্রে’স থেকেই জ্ব’র বাধিয়েছে।
সে বলে,”এইসব রেজাল্ট আমার কাছে একদমই মূল্যহীন মামনি, তুমি সুস্থ থাকো আমি এটাই চাই।”
শর্মী চুপ করে থাকে। তার ভিষন কান্না পাচ্ছে। সে তার পাপাকে বারবার হতাশ করে।
রাওনাফ বলে,”আচ্ছা মামনী তুমি রাখো,আমি একটু তোমার চাচ্চুকে দেখতে যাবো, আমি শিঘ্রই ফিরবো। আজ তোমার চাচ্চুকে নিয়ে ফিরবো, তুমি রেস্ট নাও।”
রাওনাফ ফোন কেটে দেয়। শর্মী দেয়ালের দিকে তাকায়। দেয়ালে তার মায়ের একটা ছবি টাঙানো। তার মায়ের কথা তার অল্প অল্প মনে আছে। তার যখন পাঁচ বছর তখন তার মা একটা এ’ক্সি’ডেন্টে মা’রা যায়।

শর্মীর জ্বর বাড়তে থাকে। সে দেয়ালের ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে,”মাম্মা।”
তার চোখ দিয়ে পানি বের হয়।

****
“এবার আস্তে আস্তে বলুন তো সেদিন আপনার সাথে কি হয়েছিলো।”
পুলিশ অফিসার সামিউলের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সামিউল রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ চোখ দিয়ে ইশারা করে সব বলতে।
অন্তরা পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
সামিউল ধীরেধীরে মুখ খোলে,”সেদিন আমি ওই বস্তিতে আমার একটা প্র’জে’ক্টের কাজে গিয়েছিলাম। আমার সাথে আমার কিছু টিম মেম্বার ছিলো। তারা একটু ওয়াশরুমে যাবে বলে বস্তির ভিতরে ঢুকেছিলো। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নির্জন ছিলো জায়গাটা।হঠাত একটা লোক আসে আমার কাছে। মুখে মা’স্ক পরা। আমাকে এসে বলে আমি অনেক বড় ভুল করেছি,আমার সেটা করা উচিৎ হয়নি। তার নাকি আমাকে মে’রে অনেক খারাপ লাগবে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হঠাত কোত্থেকে সেখানে আরো দুজন লোক আসলো,তারাও মুখে মা’স্ক পরে ছিলো। তারা এসেই আমাকে ধরে ফেলে। আর আগের লোকটি পকেট থেকে একটা ছু’ড়ি বের করে প্রথমে আমার পেটের ডাক দিকে একটা……
অন্তরা সামিউলকে থামিয়ে দেয়,বলে,”প্লিজ আর বলতে হবে না।”
সামিউল বলে,”তারপর আমার কিছু মনে নেই অফিসার।”

-তারমানে লোকগুলোর চেহারা আপনি দেখেননি?

-না অফিসার।

-আপনার কাউকে সন্দেহ হচ্ছে? আপনার কোনো শ’ত্রু?

-না অফিসার। এমন কোনো শত্রু আমার নেই।

পুলিশের অফিসারের কপাল কুঁচকে যায়। কোনো তথ্য পাওয়া গেলো না যেটা তাকে আসামী ধরতে সাহায্য করবে।

সে বলে,”যাই হোক,কি আর করা। বস্তির কয়েকজনের থেকে জানতে পারি আ’সা’মীরা তিনজন তাদের দেখে একটা মোটরসাইকেলে উঠে পালিয়ে যায়। তারা মোটরসাইকেলের নাম্বার প্লেট থেকে নাম্বারটা লিখে রেখেছিলো। খোজ নিয়ে জানা গেলো সেটা ভু’য়া নাম্বার প্লেট ছিলো। আজকাল যা শুরু হয়েছে দেশে।

যাইহোক,সাবধানে থাকবেন। কাউকে সন্দেহ হলে জানাবেন। আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।”

পু’লি’শ অফিসার চলে যায়। রাওনাফ অন্তরাকে বলে,”সবকিছু গুছিয়ে নাও। এখন বাড়ি যাবো।”

***
সামিউলকে দেখেই রওশান আরা ডুকরে কেঁদে ওঠে। সে পরম মমতায় তার ছেলেকে বু’কে টেনে নিতে চায়। রাওনাফ বাধা দেয়,”মা শান্ত হও। ওর ক্ষত পুরোপুরিভাবে সারে নি। ইন*ফেকশন হয়ে যেতে পারে।”
রওশান আরা দাঁড়িয়ে যায়। সামিউল বলে,”আমি ঠিক আছি মা,তুমি চিন্তা কোরো না। সেরে উঠবো আমি।”
রওশান আরা অন্তরার দিকে শীতল চোখে তাকায়। তারপর সামিউলকে বলে,”না তুই ঠিক থাকতে পারবি না। এই মেয়েটা যতদিন তোর জীবনে আছে তুই ঠিক থাকতে পারবি না। আমি নিশ্চিত ওর জন্যই আজকে তোর এই অবস্থা হয়েছে!”

রাওনাফ বলে,”মা কি বলছো তুমি। এতে অন্তরার দোষ কোথায়?”

-কে বলতে পারে ওর কোনো পুরনো প্রেমিক কিংবা স্বামী সামিউলকে মা’রতে চেয়েছে কি না। নয়তো আমার সাদাসিধে ছেলেটার তো কখনো শ’ত্রু ছিলো না।

অন্তরা রওশান আরার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ বেয়ে পানি পরছে। উর্বী দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে। তার এই মেয়েটার জন্য ভিষন খারাপ লাগছে।

রাওনাফ মাকে জোর করে রুম থেকে বের করে নিয়ে যায়। রওশান আরা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পরেছে। উর্বী তাদের পিছু পিছু বেরিয়ে যায়।

***
মোহনার কোলে মাথা দিয়ে শর্মী শুয়ে আছে। তার জ্ব’র কিছুটা কমেছে। রাওনাফ রুমে ঢোকে। মোহনা বলে,”আপনার কথা মতো মাথায় পানি ঢেলেছি ভাইয়া,তাই একটু কমেছে জ্বর।”
রাওনাফ বিছানায় বসে। তার মেয়ের মাথায় হাত রাখে। শায়মী স্টাডি টেবিলে বসে পড়ছিলো।
রাওনাফ মোহনার দিকে তাকিয়ে বলে,”দোষ আমার মোহনা, বাচ্চা গুলোকে আমি একদম সময় দিতে পারি না। আমি ভুলেই যাই ওদের মা নেই।”
শায়মী পড়া রেখে তার পাপার দিকে তাকায়। মোহনা বলে,”এমন কথা বলছেন কেনো ভাইয়া, ওরা আমার ছেলেমেয়ের থেকে কি কম! সবসময় চেষ্টা করি ওদের মায়ের অভাবটা বুঝতে না দিতে।আমি ভাবি ওরা তিনজন আমারই ছেলেমেয়ে।”

-আমি জানি মোহনা। তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

শর্মী তার পাপাকে ডাকে,”পাপা!”
-হ্যা মামনি বলো!
-নেক্সট টাইম আমি অনেক ভালো করবো প্রমিজ। অনেক বেশি মার্কস এনে দেবো।
রাওনাফ তার ছোট্ট মেয়েটাকে নিজের কোলের কাছে টেনে নেয়।তার মায়াভরা মুখটার দিকে তাকালে রাওনাফের বুকটা হুহু করে ওঠে।

উর্বী পর্দার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে থাকে তাদের। জীবনের মানে গিয়ে তার কাছে দাড়িয়েছে শুধুই অনুশোচনা। সময়,পরিস্থিতির চাপে একটা কাজ করে ফেলে অনুশোচনা করার নামই জীবন। এই অনুশোচনা অনুশোচনা খেলা সেদিন ফুরায় যেদিন জীবন ফুরিয়ে যায়।

***
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দীর্ঘ আটবছর পরে আবারও কিছু মেয়েলী প্রসাধনী এসে স্থান নিয়েছে। রাওনাফ গায়ে ব্লেজার চাপিয়ে নিতে নিতে সেদিকে একপলক তাকিয়ে আয়নায় উর্বীর প্রতিবিম্বের দিকে তাকায়। উর্বী একটা বই হাতে চুপচাপ বসে আছে। কয়েকপলক উর্বীকে দেখে রাওনাফ বলে ওঠে,”তুমি কি আগামীকাল যেতে পারবে? না মানে, চোখে এ’লা’র্জি আছে বললে। আমাদের হসপিটালে ডক্টর ফিলিপ হফম্যান বলে একজন আই স্পেশালিস্ট আসেন সিঙ্গাপুর থেকে দুমাস পর পর। তুমি চাইলে তাকে দেখাতে পারতে।”

উর্বী কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। এলার্জি যে তার গোটা জীবনে, চোখে নয়। সে কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,”বেশি অসুবিধা হলে আপনাকে জানাবো। আপাতত থাক।”

তারপর রাওনাফের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে ওঠে,”একটু ব্যাংকে যেতে চাচ্ছিলাম আমি।”

রাওনাফ ঘুরে তাকায়। তারপর বলে,”একা যেতে পারবে? আমি যাবো?”

উর্বী মাথা নিচু করে নিচু স্বরে বলে ওঠে,”ভালো হতো।”

_ঠিকাছে তুমি রেডি হও। আমি অপেক্ষা করছি।

উর্বী আলমারি থেকে শাড়ি বের করে ওয়াশ রুমে ঢোকে। রাওনাফ টেবিলের ওপর থেকে গাড়ির চাবিটা তুলে নিতে গিয়ে ছোটো ফটোফ্রেমটাতে চোখ যায় তার। হাত বাড়িয়ে ফ্রেমটা তুলে নিয়ে শিমালার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে।

উর্বী ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। একবার রাওনাফের দিকে, একবার তার হাতের দিকে তাকায়। কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”চাইলে এরিয়ে যেতেই পারতেন। মায়ের এতোটাও বাধ্য ছেলে হবার প্রয়োজন ছিলো না। নিজের বাধ্যতা দেখাতে গিয়ে এখন রিগ্রেট ফিল করছেন।”

রাওনাফ ছবিটা রেখে উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর বলে ওঠে,”রিগ্রেট কেনো?”

_এই যে, ভালোবাসার মানুষটি যে ছবিতে বন্দী হয়ে আছে। তার দিকে অপরাধীর মতো তাকিয়ে আছেন। আট বছর নিজের বিশ্বস্ততা দেখিয়ে শেষরক্ষা আর করতে পারলেন না।

রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”তা ঠিক বলেছো। শেষ রক্ষা হলো না। তবে বাকি কথা গুলো ভুল, অনুশোচনা হতো যদি কোনো অন্যায় করতাম। আমি কোনো অন্যায় করিনি। না শিমালাকে ঠকিয়েছি,না ওর যায়গা কাউকে দিয়েছি। পৃথিবীতে কারো স্থান কেউ নিতে পারেনা উর্বী। একটা মনে একাধিক মানুষ যার যার নির্দিষ্ট স্থান নিয়ে থাকে,একে অন্যের স্থান নিয়ে নয়। না দেওয়া যায়। তাই অনুশোচনা হচ্ছে না।”

উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ বলে,”তবে হ্যা। একটা বিষয়ে খুব রিগ্রেট হয়। তুমি কখনোই তিনটা বাচ্চা ওয়ালা সঙ্গি ডিজার্ভ করোনা। মা অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন, আমাকে বলা হয়েছিলো মেয়ের পূর্ণ সম্মতি রয়েছে। বয়স ত্রিশ শুনে ভাবলাম আর যাই হোক, সে নিজের ভালোমন্দ বুঝেই হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তোমাকে দেখার পর থেকে আমার মনে হয় তুমি এসব কিছু ডিজার্ভ করো না। আরো ভালো কিছু ডিজার্ভ করো। আ বেটার লাইফ!”

উর্বী ম্লান হাসে। রাওনাফ বলতে থাকে,” আর কি যেনো বললে? এরিয়ে যেতে পারতাম। বাধ্য ছেলে হবার প্রয়োজন ছিলো না। অবশ্যই , আমারও এটা এখন মনে হচ্ছে, কিন্তু তখন পরিস্থিতির উল্টো চলার মতো মনের জোর পাইনি। একটা মানুষ সবসময় একই রকমের মানসিক ক্ষমতা নিয়ে বসে থাকে না, কখনো কখনো এলোমেলো হয়ে যায় তার ছকে বাঁধা আচরণ। মানব চরিত্রের খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। জীবনের সব পরিস্থিতিতে ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত শুধু মাত্র তারাই নিতে পারে যারা আশীর্বাদ প্রাপ্ত। দূর্ভাগ্যবশত রাওনাফ করিম খান আশীর্বাদ প্রাপ্ত নয়। ভুল ভাল কাজ সেও করে বসে।”

উর্বী রাওনাফের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। রাওনাফ গাড়ির চাবি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়।

***
গাড়ি গুলো সব বাম দিকে টার্ন নিচ্ছে! রাওনাফ এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে ওঠে,”ভুল করে ফেললাম। সিটি ব্যাংকের পেছনের রাস্তা দিয়ে আসা উচিত ছিলো। সামনে সম্ভবত রাস্তা ব্লক এখন ইউটার্ন নেওয়া সম্ভব না। গাড়িটাকে বামে কোথাও পার্ক করে রাখি। তুমি নামো। অপজিটে গিয়ে দাঁড়াও।

উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ গাড়িটা বাম পাশের রাস্তা সংলগ্ন একটি পার্কের পার্কিং লটে রাখে।
উর্বী না দাঁড়িয়ে সামনের দিকে পা বাড়াতেই রাওনাফ এসে উর্বীর হাত টেনে নেয়। হুশ করে একটা একটা বাইক চলে যায়।

মূহুর্ত কেটে যায়। উর্বী পুরো ব্যাপারটা যতক্ষনে বুঝতে পারে দেখতে পায় ততক্ষণে রাওনাফকে শক্ত করে ধরে রেখেছে নিজের হাত দিয়ে। আঁকড়ে ধরা যাকে বলে। রাওনাফ বিব্রত ভঙ্গিতে আশেপাশে তাকাচ্ছে। উর্বী বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। বাইকের চালক বাইক থামিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,”কানা নাকি!!”

রাওনাফ হাত উঠিয়ে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলে,”সরি!”

উর্বী তখনও হাপাচ্ছে। রাওনাফকে ছেড়ে একপাশে দাঁড়িয়ে। রাওনাফ ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,”আমি বুঝতেই পারিনি একজন ত্রিশ বছরের ভদ্রমহিলা ফাঁকা রাস্তা পার হতে জানে না।”

উর্বী কিছু বলেনা। হাঁপাতে থাকে। রাওনাফ বলে,”কাম ডাউন। কিছুই হয়নি।”

_আমি ভয় পাই। আমি ম’রতে ভিষন ভয় পাই।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উর্বী।

_সবাই পায়। আমিও পাই।

উর্বী চোখ তুলে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ বলে,”চলো। তোমাকে রাস্তা পার হওয়া শিখিয়ে দিচ্ছি। এটা তোমাদের মফস্বল নয়। এখানের লাইফস্টাইল অন্যরকম। মেয়েরা শাড়ি বোরখা পরে কিভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাসে ওঠে, জার্নি করে, রাস্তা পার হয় দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। রাস্তা পার হওয়া খুবই চ্যালেঞ্জিং একটা ব্যাপার। রাজধানীর রাস্তা আর মফস্বলের রাস্তা এক নয়। এসো শিখিয়ে দিচ্ছি। ”

কথাগুলো উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলতে বলতে রাওনাফ সামনে পা বাড়াতেই উর্বী রাওনাফের হাত টেনে ধরে। হুশ করে একটা লেগুনা গাড়ি চলে যায়। রাওনাফ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।

উর্বী ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,”আগে নিজে রাস্তা পার হতে শিখেন।”

রাওনাফ লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। উর্বী মাথা নিচু করে ডানদিক,বামদিকে দেখে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। রাওনাফ তাকে অনুসরণ করে।
এভাবে নিজেকে পণ্ডিত জাহির করতে গিয়ে লজ্জা পাবে সে বুঝে উঠতে পারেনি।

***
বেলকোনিতে চেয়ার পেতে চুপচাপ বসে আছে উচ্ছাস। তার হাতে তার গিটার। ধূসর রঙের টি শার্টের উপরে একটা ব্ল্যাক শার্ট পরে আছে,হাতা ফোল্ড করে রাখা।
সজীব এসে দরজার কাছাকাছি দাঁড়ায়। উচ্ছাস তার দিকে না তাকিয়ে বলে ওঠে,”উর্বীর কোনো খবর থাকলে বলবি।”

_স্বামীর সাথে বেরিয়েছে।

_কি করছিলো? হাসছিলো? খুব আহ্লাদ করছিলো বেয়াদব টা?

_অতটা দেখিনি। এ ঝলক দেখতে পেয়েছি। গাড়িতে শুধু ও আর ওর স্বামীই ছিলো।

উচ্ছাস চুপ হয়ে যায়। সজীবকে ঠান্ডা গলায় বলে,”যা।”

সজীব চলে যায়। উচ্ছাস বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”লোভী মেয়ে মানুষ যত্তসব!”

চলমান…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here