#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪২
মুবিন,
তুমি কি বড় হয়ে গুন্ডা হতে চাও? স্যরি, স্যরি তুমি অলরেডি
সন্ত্রাস। সমস্যা কি তোমার? গতকাল হৃদয়ের সাথে তুমি আবার মারামারি করেছ। ওর আঙুল থেতলে দিয়েছ, তুমি। আগামী সপ্তাহে যে আমাদের প্র্যাক্টিকেল খাতা সাইন করানোর লাস্ট ডেইট, তুমি জানো না? এখন ও কি করবে? ওর খাতা কে লিখে দিবে, তুমি? অ্যাই, তুমি না মাত্র গত সপ্তাহে হাসপাতাল থেকে ফিরলে? হাসপাতাল থেকে ফিরে বড় বড় জালেমরাও ভয়ে ভালো মানুষ হয়ে যায়। আর তুমি? তোমাকে দেখে বুঝলাম কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না। আচ্ছা তোমার কিসের এত অহঙ্কার, মুবিন? আমাকে বলো। বলতেই হবে। প্রিটেস্টে উচ্চতর গণিতে একই সাথে দুই দুইটা রসগোল্লা পাওয়া লাড্ডু তুমি। ডাবল জিরো! রসায়নে পেয়েছ ১৫, পদার্থে ৮, জীববিজ্ঞানে ৩৬, সাধারণ গণিতে ২। এই ধরনের নাম্বার পাওয়া ছেলের এত অহঙ্কার আসে কোথা থেকে? তোমার মা-বাবাই তোমাকে লাই দিয়ে দিয়ে নষ্ট করেছে। উনারা আরেক চিজ। তাঁদেরকে আমি একদিন মিনা কার্টুনের সিডি কিনে না পাঠালে না আমার নামও সুহা না। মিলার প্রতি তাঁদের আচরণ দেখে আমি শকড। আর তুমিও কমকিছু নও। আস্ত একটা স্বার্থপর তুমি। লজ্জা করে না তোমার মিলার জন্য কিনে আনা নতুন পাখা নিজের ঘরে নিয়ে যেতে? লজ্জা করে না প্রতিবছর শুধু নিজের জন্মদিন সেলিব্রেট করতে? লজ্জা করে না মা-বাবার ঝগড়ার সময় এতগুলো মেহমানের সামনে নিজের ছোট বোনকে একা রেখে দরজা আটকে বসে থাকতে? লজ্জা করেনি এভাবে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে? লজ্জা করে না তোমার টু টু করে ঘুরে এক ক্লাসে দুইবার পড়তে? ছিহ কি নির্লজ্জ তুমি! সমানতালে কাপুরুষও। কাপুরুষ না হলে কেউ আত্মহত্যা করতে যায়? তুমি যেসব সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ মিলাও ত সেই একই সমস্যাগুলোই ফেস করছে। তুমি সমস্যা দেখলে পালিয়ে যাও, আর ও পারুক না পারুক সমস্যার সমাধান করবার চেষ্টা করে। একই পরিস্থিতে থেকে মিলা যদি ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল হতে পারে তাহলে তুমি কেন ফেইল করে ছোটবোনের সাথে এক ক্লাসে পড়ো? সমস্যা তোমার পারিবারিক সমস্যায় না। সমস্যা তোমার মাঝে। তুমি কোথায় তোমার এই অস্বাভাবিক পরিবারের জীবনটাকে স্বাভাবিক করে তুলবার চেষ্টা করবে, তা না করে আরো কঠিন করে ফেলছ। ওহো কিচ্ছু বুঝো না তুমি, আর নাহয় বেশি বেশি বুঝো। তুমি ভালো হবে না মরবে এগুলো তোমার বিষয়, কিন্তু আমার বান্ধবীর সাথে কোনোপ্রকার অন্যায় করার আগে দশবার ভাববে। আমি তোমাকে ছাড়ব না। অনেক সহ্য করেছি, আর না। ফেইল মারো আর পাশ করো তা তুমি জানো। গুন্ডার মত রাস্তাঘাটে মারামারি করলেও করো। মা-বাবার সাথেও তোমার ব্যাপার তুমিই মেটাও, কিন্তু ভাইয়ের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন তোমাকে করতেই হবে। না করলে তোমার খবর আছে। তুমি কি জানো মিলা কত কষ্টে থাকে? কত কাঁদে? তুমি ত একা একাই মা – বাবার সব আদর নিয়ে নাও। ওকে কে আদর করবে? তুমি একটু আদর করতে পারো না? ও শক্ত বলে, নিজেকে সামলাতে পারে মানে কি এমন যে ওকে এই কষ্টগুলো পেতেই হবে? এখন থেকে ওর জন্মদিন তুমি পালন করবে, ওর খেয়াল তুমি রাখবে। আর শুনলাম হোস্টেলে উঠেছ। ভালো ভাই হও, ভালো থাকো।”
ইতি,
“সুহা।”
পুনশ্চঃ এই চিঠির জন্য যদি মিলাকে মারো কিংবা কিছু বলো তারপর হবে… মিলা কিচ্ছু জানে না। মাইন্ড ইট।
মুবিন চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে রাখল। তারপর যে ছেলেটা চিঠিটা নিয়ে এসেছে তার নাক বরাবর ঘুষি মারল। ছেলেটা থুবড়ে পড়ল মাটিতে। মুবিন এগিয়ে গিয়ে কলার ধরল তার। নাক ফুলে গেছে ছেলেটার। ব্যথায় মুখ কুঁকড়ে যাচ্ছে বারবার। বিস্ময় আর ভয় মিশ্রিত চাহনি নিয়ে সে বলল, “সুহা বলেছিল চিঠিটা দিতে।”
মুবিন চুইঙ্গাম চিবুতে চিবুতে বলল, “কোথায় সে?”
ছেলেটা নিজের কলার থেকে মুবিনের হাত সরিয়ে বলল, “আমি জানি না। দু’তলার সিঁড়িতে দেখা হয়েছিল।”
মুবিন ঠাশ করে আরেকটা চড় মারল ছেলেটাকে। তারপর ঘুরে দু’তলার দিকে গেল।
.
মুবিন এসময়ে স্কুলে থাকায় মেসের যে ঘরটায় সে থাকে, ইমাদ সে ঘরটায় গেল। এখনি সুযোগ। গিয়ে মুবিনের সবকিছুতে একবার চোখ বুলাল। বিছানা উল্টে দেখল সেখানে ছারপোকা আছে কিনা। মেসে সাধারণত ছারপোকাদের রাজত্ব। মুবিন আয়েশি ছেলে। ছারপোকার কামড় খেতে খেতে ঘুমানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। যা ভেবেছিল তাই। ছারপোকাদের ডিম তোশকের কোণায় এঁটে আছে। এগুলো ফুটলে সর্বনাশ। তোশক রোদ দেয়ার মত জায়গা এখানে নেই। ইমাদ তাই নিজের ঘর থেকে ইস্ত্রী নিয়ে এল। চাদর উঠিয়ে বিছানায় উঠে বসল। তোশক টেনে ধরে ছারপোকার ডিম পাকিয়ে আছে এমন জায়গাগুলোতে ইস্ত্রী চেপে ধরল। গরম তাপে মরবে সব। ছেলেটাকে নিয়ে কি করবে সেটাই ভাবছে ও। কত যে মায়া লাগে। ওরকম বয়সের একটা ছেলে কি করে মরবার কথা চিন্তা করে? ওর তো এখন উড়ে বেরানোর কথা। আর মিলা? মিলা কেমন আছে? মিলার সাথে একবার দেখা করতে পারলে ভালো হতো। আচ্ছা, কড়ির সাথে কি মুবিনকে নিয়ে কথা বলা যায়? সবচেয়ে ভালো হতো কড়ি যদি একটু মুবিনের সাথে কথা বলতো। মুবিন এখানে আসবার পর থেকে যদিও একদিনও ইমাদ আর ওর কথা হয়নি তবুও ইমাদ দূর থেকে চেয়ে দেখেছে। পড়াশুনা তো দূরের কথা সে ঠিকমত খাওয়া-দাওয়াটা পর্যন্ত করে না। সবই খেয়াল করে। তবে সমস্যা হলো মুবিন যথেষ্ট বেয়াদব। ওর সাথে কথা বলতে যাওয়া মানে যেচে পড়ে চরম অপমানিত হতে যাওয়া। কড়ি কিছু বলতে গেলেই দেখা যাবে মুবিন কড়ির সাথেও বেয়াদবি করে বসবে। ইমাদের সেটা সহ্য হবে না। থাক কড়িকে এ বিষয়ে টেনে আনবার কোনো প্রয়োজন নেই। ওর কাজ শেষ। ইস্ত্রী গুছিয়ে ও উঠে চাদর বিছিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আজকে অনেকদিন পর দীপুর সাথে ওর আর নিলয়ের বেরুনোর কথা। দীপুকে আজকাল সাথে পাওয়া মুশকিল। পড়াশুনা, সংসার, শ্বশুরবাড়ি সব সামলাতে সামলাতে নাভিশ্বাস ওর। আজ বহুদিন পর আবার ওরা তিনজন একটু একসাথে ঘুরবে, আড্ডা দিবে। যদিও বিশেষ একটা কাজেই ওরা বেরুচ্ছে তবুও শুধু তিন বন্ধুর সময় এটা। নতুন কোনো স্মৃতি তৈরী হবে আজ। প্রিয়জনদের সাথের ছোট থেকে ছোট, প্রতিটা মুহূর্ত খুব দামি।
ইমাদ আর নিলয় কথা মতো দীপুকে ছাতিপট্টি পেয়ে গেল। ছাতিপট্টির রাস্তার দু’পাশ জুড়ে শুধু জুয়েলারির দোকান। কুমিল্লা শহরের বেশিরভাগ জুয়েলারি দোকান এই এলাকায়। দীপু আকাশী রঙের সেলোয়ার কামিজ পরে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে ওর সাদা ওড়না আর চুলগুলো উড়ছে। ও বারবার বিরক্ত হয়ে কানের পেছনে চুল গুঁজছে। বিয়ের পর দীপু আরো সুন্দর হয়েছে। তারমানে ভালো আছে ও। ইমাদ মনে মনে আশ্বস্ত হলো। যাক তার মানে ও শুধু শুধু ভয় পেয়েছিল। অবশ্য ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণও ছিল। দীপুর সব জেনেশুনে কোন মেয়ে তার ভাইয়ের জন্য শুধু শুধু কোনো স্বার্থ ছাড়া তো আর বিয়ের কথা বলতে পারে না। ইমাদের ধারণা ভুল ছিল না। কড়িরও স্বার্থ ছিল তাই এ বিয়েকে স্বাগত জানিয়েছে, তবে ইমাদ যেরকম স্বার্থ ভেবেছিল সেরকম স্বার্থ নয়, অন্য কারণ।
চলবে…