#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৪
বৈদ্যুতিক সংযোগ চলে গেছে। কতক্ষণে ফিরে আসবে জানা নেই। কাদিন হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে হয়রান হয়ে গেল। একটুর জন্য হাতপাখা হাতছাড়া হলেই ঘেমে যাচ্ছে। বাইরেও যেতে পারছে না। গ্রামের রাস্তাঘাট তার ভালো লাগে না। এখানে গর্ত, ওখানে কাঁদা! বিরক্তিকর! বেরুলেই প্যান্টে ধুলোবালি লাগার ভয়। বড় বিপাকে সে। টি -শার্ট ঘামে ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। এটাও তার সহ্য হচ্ছে না। ঘামে ভেজা পোশাক সে গায়ে রাখে না। টি- শার্ট একটানে খুলে ফেলতেই দীপা এসে ঘরে ঢুকল। কাদিন দীপার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিল, “গরমে মরে যাচ্ছি।”
দীপা বলল, “সব ছেলেরা বাইরে বসে আড্ডা দিচ্ছে। এমনকি বাবাও সেখানে। আপনি ঘরে বসে নিজেকে বউ পাগলা প্রমাণ করতে চান?”
কাদিনের চেহারা থমথম করে উঠল, “এখানে ত আর নতুন আসিনি। সবাই জানে আমি কেমন। ধুলোবালি, আবর্জনা এড়িয়ে চলি আমি।”
“ন্যাকা।” দীপা নাকে টেনে বলল।
কাদিন চোখ মুখ শক্ত করে আরো বলল, “কত বউ পাগলা তা নিশ্চয়ই তোমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।”
দীপা স্পষ্ট খোঁচার আভাস পেয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমিও ত আবর্জনাই। এড়িয়ে চলুন, আরো ভালো করে এড়িয়ে চলুন।”
কাদিন দীপার সাথে দূরত্ব ঘোচাতে চেয়েছিল। দীপাকে তার আবারো ভালো লাগতে শুরু করেছে। তাই বলল, “রাগ করে আছ নাকি?”
দীপা বলল, “তো আপনি আর কি আশা করেন? আপনার জন্যে কড়িকে আমি কথা শুনিয়েছি। এখন কড়ি যতই বলুক রাগ করেনি কিন্তু আমি জানি সে রাগ করে আছে।”
“কথা শুনিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ, আপনার জন্য। দোষ আপনার।”
“আমাদের মধ্যকার বিষয়াদি তুমি আমার বোনের সাথে আলোচনা করো?”
“তো করব না? ও কেন আপনাকে সব জানায়নি? এরপর দোষটা কার হলো? আমার না?”
কাদিন ফোঁস করে শ্বাস ফেলল, “ওর সাথে আর আলোচনা করবে না।”
“না, আরো করতে হবে। ওর রাগ ভাঙাতে হবে আমার। বুঝাতে হবে দোষটা আমার না, দোষটা ওর ভাইয়ের। রাগ হলে ও ওর ভাইয়ের উপর রাগ হবে।”
“কড়ি রেগে নেই। কড়ি রেগে থাকলে অন্যরকম হয়ে যায়। আমি বুঝি।”
“সত্যি?”
“মিথ্যে কেন বলব?”
দীপা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। আপনমনে কিসব ভাবল। পরে বলল, “ঠিকই ত। আমার মত নিষ্পাপ মানুষের প্রতি কেন রেগে থাকবে?”
অন্যসময় হলে কাদিন দীপার এ কথায় বিরক্ত হতো। এখনি বলছে এটা, আবার দু মিনিটে বদলে যাচ্ছে। কোনো স্থিরতা নেই। না আছে দু পয়সার কোনো বুদ্ধি। কিন্তু সে চেয়েও বিরক্ত হতে পারল না। বরং দীপার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, “হু তোমার মত নিষ্পাপ মানুষের উপর কেন রেগে থাকবে, কড়ি?”
“আপনার কি ধারণা? আমি নিষ্পাপ নই? আমি রুমডেট করা ফাজিল ক্যাটাগরির মেয়ে?” দীপার গলার স্বর আচমকা বদলে গেল।
কাদিন অবাক হয়ে বলল, “কি বলছ?”
দীপার ঠোঁট কাঁপছে, “আপনি যা চক্ষুলজ্জায় বলতে পারছেন না আমি সেটাই বলে দিলাম।”
কাদিন কঠোর গলায় বলল, “আমি এধরনের কিছুই ভাবিনি।”
“অবশ্যই ভেবেছেন।”
“বললাম না ভাবিনি।”
“ভয় পাচ্ছেন কেন?”
কাদিনের কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল, “তুমি বেশি বুঝো, দীপা।”
দীপা কাদিনকে এক সমুদ্র বিস্ময়ে ডুবিয়ে দিয়ে বলল, “তাহলে এখনি আমাকে চুমু খান।”
কাদিন অদ্ভুত দৃষ্টিতে দীপার দিকে তাকাল। দীপা চার্জার লাইটের আলোআঁধারিতে কাদিনের দিকে এগিয়ে এল, “কি হলো চুমু খান। আপনি নিশ্চয়ই সাধু সন্ন্যাসী না। কোনো মহাপুরুষও না যে বউয়ের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকবেন। তাহলে চুমু খাচ্ছেন না কেন?” দীপা কাদিনের উপর ঝুঁকে এল। কাদিন হতভম্ব। সে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “দীপা!”
দীপা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমি দেখেছি আপনি ঢেকে রাখা পানির গ্লাসেও মুখ দেয়ার আগে পানি পরিষ্কার কিনা দেখে নেন। প্লেট একজন ধুয়ে টেবিলে রাখলেও আপনি আবার সে প্লেট ধুয়ে তারপর তাতে খাবার নেন। বউটা শুধু শূচি হলো না। তাই রুচে না।”
কাদিন হাত দিয়ে ঠেলে দীপাকে সরিয়ে উঠে চলে গেল।
বাইরে আকাশ বুকে অগণিত তারা নিয়ে মাথার উপর ছাদ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার নীচে হারিকেন এর আলোয় দাবা খেলতে বসেছেন নিলয় এবং কাদের সাহেব। কায়েস, কাইয়ূম, রিমা, ইমাদ, মেহেদী ওরা তাঁদের ঘিরে বসে খেলা দেখছে। কাদিন গিয়ে চেয়ার টেনে ওদের পাশে বসল। খেলায় টান টান উত্তেজনা। কাদের সাহেব দাবা খেলায় ঝানু লোক। নিলয়ও কম যায় না। দুজনেই বুদ্ধির প্রতাপ দেখিয়ে লড়াই করছে। কড়ি বসে আছে একটু দূরে, সামনের পুকুরপাড়ে। একটু পর পর ঝুঁকে পানিতে হাত ছোঁয়াচ্ছে সে। কাদিন বসার কিছুক্ষণ পর কাদের সাহেব রহস্যময় গলায় বলে উঠলেন, “চ্যাকমেট।”
নিলয়কে শেষ পর্যন্ত অভিজ্ঞ কাদের সাহেবের কাছে হারতেই হলো। কায়েস বলল, “এবার আমি খেলব।”
কাদের সাহেব বললেন, “তো আয়।”
“উহুঁ, বাবা তোমার সাথে খেলব না। আমি হারতে চাইছি না।”
কাদের সাহেব হৈহৈ করে মহানন্দে হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। দাবা খেলায় জিতে যাওয়ার যে আনন্দ, সে আনন্দ রাজ্যাভিষেকের সম্রাটেরও নেই। কায়েস তার বাবার জায়গায় বসল। নিলয় হামি তুলতে তুলতে বলল, “নাহ আমার মনটাই ভেঙে গেছে। জিততে জিততেও হারলাম।”
কায়েস বলল, “আরে ধুর মিঞা বাবার কাছে সবাই হারে। আমরা দুজন খেলে দেখি হালচাল কি হয়।”
নিলয় আড়মোড়া ভেঙে উঠতে উঠতে বলল, “না ভাই আমি খেললে আবার আঙ্কেলের বিপরীতেই খেলব আর জিতবও।”
ইমাদ তার আগ্রহহীন চোখে কায়েসের দিকে তাকাল, “মে আই?”
কায়েস বলল, “অফকোর্স, অফকোর্স।”
ইমাদকে কায়েসের সাথে খেলতে বসতে দেখে কড়ির ঠোঁটের কোণায় রহস্যময় হাসি দেখা গেল। কয়েক মুহূর্ত মুচকি হেসে কি যেন ভাবল সে। তারপর আস্তেধীরে উঠে দাঁড়িয়ে দাবা খেলার আসরটার দিকে এগিয়ে গেল। ইমাদ এবং কায়েস যখন পুরোপুরি খেলায় ডুবে যাচ্ছিল তখন কড়ি দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি খেলতে চাই।”
ইমাদ মুখ তুলে তাকাল না। চুপচাপ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কড়ি বলল, “আপনি মেহমান মানুষ, আপনি কেন উঠছেন? ছোট ভাইয়া উঠবে।”
ইমাদ নির্বিকার গলায় বলল, “না আপনারা খেলুন, আমি আসছি।”
ইমাদ চলে যাওয়ায় কায়েস কড়িকে ধমক দিলো, “এটা কোনো কাজ করলি, কড়ি? বেচারা খেলতে বসেছিল। তুই মাঝে এসে খেলবি বলে উঠিয়ে দিলি। মেহমান না আমাদের? একদম বাচ্চাদের মত করলি।”
“আমার খেলতে ইচ্ছে করছে। তুমি তোমার চেয়ার ছাড়ো। উনাকে ডেকে নিয়ে আসি।”
কড়ি ইমাদের পেছন পেছন গেল।
ইমাদ বাড়ির পেছনের সুপারিবাগানে এসে পড়েছে। এক হাতের ভেতর অন্যহাত গুটিয়ে সুপারি গাছে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়াল। কড়ি এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল “চলে এলেন কেন? আপনার সাথেই খেলতে গিয়েছিলাম।”
ইমাদ বলল, “আচ্ছা।”
“আমি জানি আপনি আমার সম্মতিতে আমার সাথে দাবা খেলতে চান এবং আজীবন খেলে যেতে চান। এরপরও আপনার সাথে খেলতে চাইছি।”
কড়ির কণ্ঠের স্পষ্ট টিটকারি টের পেয়ে ইমাদ চোখ ঘুরিয়ে কড়ির দিকে তাকাল। চোখ রাখল কড়ির চোখের দিকে। এই অন্ধকারেও মেয়েটার চোখ জ্বলজ্বল করছে। বিড়ালের মত চোখ বলেই কি? নাকি মেয়েটার প্রতি তার প্রবল অনুভূতিই আলো হয়ে জ্বলজ্বল করছে? ইমাদ বুঝে উঠতে পারল না। ধীর গলায় বলল, “আপনার সাথে দাবা খেলার প্রশ্নই উঠে না।”
“তাই?”
ইমাদ কিছু বলল না, চুপ করে রইল। কড়ি কপালে ভ্র উঁচিয়ে একগালে হেসে বলল, “ভয় কিসের?”
ইমাদ আবার আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল। তার চাহনী এবং মুখের অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন নেই। সে নির্বিকার কণ্ঠে বলল, “আপনি কেমন খেলেন জানা নেই। ভালো খেলেন, খারাপ অথবা, মোটামুটি যাইহোক জিতলে মনে করবেন আপনার কাছে নিজেকে জাহির করে আপনাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছি আর হারলে বলবেন হেরে গিয়ে ইমপ্রেস করছি।”
“ওহ আচ্ছা এই ভয়।”
ইমাদ নিশ্চুপ। কড়ি সংশয় কাটাতে বলল “চলুন কিছুই মনে করব না।”
“আচ্ছা।” ইমাদ চট করে হাঁটতে শুরু করল। কড়ি আর ইমাদ মুখোমুখি বসতেই কারেন্ট চলে এল। উঠোনের লাইট দুটো ওদের দুজনের মুখে আলোর জোয়ার ভাসিয়ে জ্বলে উঠল। চোখাচোখি হলো দুুজনের। কড়ি ইমাদের চোখের দিকে তাকিয়েই তার কালো সৈন্যকে এগিয়ে দিলো। ইমাদ চালল তার চাল। তার গুটি সাদা রঙের।
কাদিন গরম অনেক সহ্য করেছে। আর পারছে না। কারেন্ট আসায় পাখার বাতাসের লোভে ঘরের দিকে এগুলো সে। থমকে গেল ঘরের ভেতর গিয়ে। দীপা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে পা দুলাচ্ছে। এতক্ষণে বাল্বের আলোয় দীপার পান খাওয়া লাল ঠোঁট চোখে পড়ল কাদিনের। কাদিন দ্রুত পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল। দীপাকে থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়ে চুমু খেতে গেল। দীপা নিজের মুখ সরিয়ে ধাক্কা দিয়ে ওকে দূরে সরিয়ে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল, “লুচ্চা কোথাকার!”
দীপার মাথা গিয়ে লাগল খাটের স্ট্যান্ডে। মুহূর্তেই কপাল ফুলে গেল। কাদিন হতবাক! এইনা বলল চুমু খেতে! এখন আবার সে লুচ্চা হয়ে গেল!
চলবে…