একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ২৩

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৩
শিল্পী দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাসার ডাইনিং টেবিলের সামনে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি বেশ উদ্ধত, গলার স্বর ঠাণ্ডা, “মুবিন?”
মুবিন পিজা খেতে খেতে বিরক্তিতে বলল, “হু।”
শিল্পী বলল, “আমি তোকে খুব সহজ একটা শাস্তি দিয়েছিলাম। এক সপ্তাহ কোনোপ্রকার ফাস্টফুড খেতে পারবি না।”
মুবিন বলল, “তো?”
শিল্পী বলল, “পিজাটা রাখ। রুটি আছে রুটি খা।”
মুবিন বলল, “মা, ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থেকো না। যাও এখান থেকে।”
শিল্পী কখনো ছেলের গায়ে হাত তুলে না। ছেলে যখন বড় বড় অপরাধ করে, ছেলেকে ফাস্টফুড, আইসক্রিম না দেয়ার মত তুচ্ছ শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে সে। তবে আজ হাত তুলল। সপাটে মুবিনের গালে চড় বসাল। মুবিনের হাত থেকে পিজা খসে পড়ল প্লেটে। ঘাড় শক্ত হয়ে উঠল। শিল্পী বলল, “পঁচা রক্ত শরীর কেটে ধুয়ে ফেললেও শুধরানো যায় না। রক্তের দাগ রয়েই যায়। বাপ কোন দেশের ফেরেশতা যে ছেলে বস্তি হবে না। মারামারি, স্কুল পালানো, ফেইল এর উপর ফেইল করা আর কোনটা বাকি রেখেছে এই ছেলে! লজ্জা হয় এমন ছেলে পেটে ধরেছি।”
মুবিন চেয়ারে লাথি দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অবজ্ঞার স্বরে বলল, “তোমাদের ছেলে বলে আমারো লজ্জা হয়।”
এ কথা শুনে শিল্পী নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। তেড়ে এসে মারতে শুরু করল মুবিনকে। মুবিন সরল না। জমাট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মারুক যত পারুক। তার মা – বাবার সো কল্ড আদরের চাইতে তাদের মার খাওয়া ভালো। ফেরানোর মত কেউ নেই মুবিন জানে। মিলা মাকে ভয় পায়। দূরে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে একটু পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছে। বোধহয় কাঁদছে। মুবিন তার বাবার ঘরের দরজার দিকে তাকাল। দরজা দিয়ে তাকালে স্পষ্ট বাবার বিছানা দেখা যায়। বাবা এখন শুয়ে শুয়ে আয়েশ করে সিগারেট টানছেন। তাকিয়ে আছেন সিলিং এর দিকে ছুটে যাওয়া সিগারেটের ধোঁয়ার দিকে। তাঁর ঠোঁটে হাসি। মুবিন নিশ্চিত তার বাবা
এখন আসবেন না। তিনি অপেক্ষা করছেন মায়ের রাগ নামার এবং মুবিনের মার খাওয়া শেষ হওয়ার। তিনি এখন মনে মনে যুক্তি সাজাবেন। পরে তাঁর এই সম্পূর্ণ যুক্তির ঢল নামবে মায়ের বিপরীতে। একটু পরে এসে তাঁর প্রথম কথাটা অনেকটা এমন হতে পারে যে “আমি থাকতেই আমার ছেলের গায়ে তুমি হাত তুলো। ছেলে আমি কোনোভাবেই তোমাকে দিব না। ইন ইউর প্রেজেন্স মাই সান ইজ নট সেইফ।”

মুবিনের মার খাওয়া শেষ হয়েছে। ঠোঁট ফুলে গেছে। পিঠে স্কেলের দাগ পড়েছে। মঈন এতক্ষণে উঠে এল এবং একইসাথে করুণ এবং হিংস্র মুখ করে বলল, “মাই সান ইজ নট সেইফ উইথ ইউ এট অল। তুমি ত আমার ছেলেকে মেরেই ফেলবে। তুমি পুরোপুরিভাবে একজন সাইকো মহিলা। আমার ছেলে থাকবে তোমার কাছে? অসম্ভব।”
বলতে বলতে মঈন এসে আগলে ধরল মুবিনকে। মুবিন জোরে ধাক্কা দিয়ে বাবাকে দূরে সরিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। রাস্তা পেরিয়ে কাঠের সমিলের স্তূপকরা কাঠের গুঁড়ির উপর বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে ঢুকরে কেঁদে উঠল মুবিন। তার কান্নায় আকাশ থেকে জোছনা নেমে এল। পরম আদরে পিঠে আলো বুলিয়ে দিলো। মুবিন স্পষ্ট শুনতে পেল রাস্তার পাশে ঝিম ধরে শুয়ে থাকা কালো কুকুরটা জিহ্ব বের করে তাকে বলছে, “কেমন লাগে মুবিন? কেমন লাগে? মা – বাবার লড়াই শেষের ট্রফি হতে দারুণ লাগে?”
.
কড়ি তার মরহুম দাদীর ঘরের পালঙ্কে বসে পান খাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। একসময় সে জানালা দিয়ে মুখের পান ছুঁড়ে ফেলল। দীপা এসে পাশে দাঁড়াল, “অ্যাই কি করছ?”
কড়ি বিস্বাদ মুখে বলল, “পান খাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। খুবই বাজে স্বাদ।”
“পাতা ছাগলদের খাদ্য। তুমি কেন পাতা খাবে? দাও পান আমাকে দাও। আমি খাই। কারণ আমি ছাগল।”
কড়ি অবাক হয়ে দীপার দিকে তাকাল। দীপা পানের বাটা থেকে পান তুলে নিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, “তুমি কেন আমাদের কেবিনে বসোনি? আ’ম স্যরি, কড়ি। আমি তো ছাগল। মাথা আউলে গিয়েছিল তাই তোমাকে উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়েছিলাম। তুমি আমার সাথে এভাবে রেগে থাকলে আমি কেঁদে ফেলব।”
কড়ি যে রাগ করেনি সে কথাটুকু বলার সুযোগ কড়ি পেল না। তার আগেই মুখ ভর্তি পান নিয়ে দীপা কেঁদে ফেলল। কড়ি দু’হাঁটু একসাথে জড়ো করে বসেছিল। এখন হাঁটুর উপর কনুই রেখে গালে হাত রেখে তাকিয়ে তাকিয়ে দীপার কান্না দেখতে দেখতে হেসে ফেলল। অপরাধবোধ মুহূর্তেই দীপার রাগ হয়ে গেল। রেগেমেগে সে বলল, “আমি কাঁদছি আর তুমি হাসছ? একটু নাহয় এটাসেটা বলেছি তাই বলে তুমি আমার কান্না দেখে হাসবে? ভাইটা যেমন শয়তান, বোনটাও খারাপ।”
কড়ি হা হা করে হেসে উঠল। ঝুনঝুনির শব্দের মত সে হাসি সারা ঘরে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। কড়ি আছে দারুণ ফূর্তিতে। ফূর্তির পেছনের সম্পূর্ণ অবদান ইমাদের। ট্রেনের ঘটনার পর ইমাদের প্রতি খুব বিরক্ত ছিল সে । দীপার জন্য নয়, ইমাদ ঐ কেবিনে ছিল বলেই সে সেখানে যায়নি। পরে খুব মজা পেয়ে গেল। মজা পাওয়ার কারণ হলো একটু আগে দখিনের বড় ঘরটায় সে তার মোবাইল চার্জ দিতে গিয়েছিল। সেখানে চার্জ দিতে সুবিধা বেশ। প্লাগ ইন করে মোবাইলটা মিটসেফ এর উপর রেখে দেয়া যায়। অন্য ঘরগুলোতে মোবাইল রাখতে হয় নীচে। কখন কে পা দিয়ে ভেঙে ফেলে এই ভয়ে সবাই দখিনের ঘরেই চার্জ দিতে যায়। কড়ি চার্জ দিতে গিয়ে দেখল সেখানে আরেকজন চার্জ দিয়ে রেখেছে। চার্জ ফুল হয়েছে কিনা দেখার জন্যে কড়ি মোবাইল খুলে দেখল। মোবাইল লক করা, চার্জ ৮৮%, স্ক্রিনে ইমাদের ছবি। সাথে একটা মেয়ে বাবু। বাবুটা ইমাদের গালে চুমু দিচ্ছে। ইমাদের ভাবভঙ্গি ভাবলেশনহীন, চোখের দৃষ্টি ঠাণ্ডা, ঠোঁটে হাসির চিহ্ন মাত্র নেই। অথচ, বাবুটা পরীর মত হাসছে। কথা সেটা না। কথা হলো সেখানে অনামিকা নামে কারো মেসেজ ভাসছিল। মেসেজে লেখা “খেয়ে নাও।”
কড়ি মুচকি হেসে আপনমনে বিড়বিড় করল, “হায়রে হায়নার দল! তোরা সবগুলোই এক গোয়ালের গরু।”
সে মোবাইল জায়গামত রেখে চলে এল। হয় হায়না নাহয় গরুর তালিকায় রামিম এবং তাহমিদের পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হলো ইমাদের নাম। এতক্ষণ ইমাদের কথাগুলো মনে পড়লেই মেজাজ খিটখিট করত আর এখন আরো বিনোদন পাচ্ছে। সামনে ইমাদ যা যা বলবে তাতেও মজা পাবে। কড়ি সেজন্যই প্রফুল্ল। তার প্রফুল্লচিত্তের এই হাসির শব্দটুকু ছুটে গেল পাশের ঘরেও। ইমাদ ভার্সিটি অথরিটির কাছে মোবাইলে একটা মেইল লিখছিল। সে ভুল করে সেই মেইল পাঠিয়ে দিলো তার এক কাজিনকে। এই এক সমস্যা। কড়ি আশেপাশে থাকলে সবকিছুতে সে ভুল করে ফেলে। ইমেইল আবার নতুন করে ফরোয়ার্ড করল, কাজিনকেও স্যরি লিখে মেইল করতে হলো।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here