#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১৬
কাদিন তাহমিদের কথা শুনল না। সে মেহেদীকে চুপচাপ সালামী দিয়ে দিলো। মেহেদী সেই সালামী নিয়ে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইল তাহমিদের দিকে। ভয়ে তার বুক কাঁপছে। আপুর এখন কি হবে? আর কত কাঁটা বিছানো পথে হাঁটতে হবে তার আপুকে? কখনো কি কৃষ্ণচূড়ার লাল গালিচা ভাগ্যে জুটবে না আপুর?
ইমাদ আর নিলয়ের মনেও একই অনুভূতি ভিন্ন ভিন্ন শব্দে ডানা মেলছিল। দীপার মা’ই শুধু সেই মুহূর্তে কমিউনিটি সেন্টারের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আনন্দাশ্রু মুছছিলেন। তাঁর মেয়ে আবারো যে এক নতুন বেড়াজালে আটকা পড়ছে সে সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই নেই।
লালচে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে দীপার বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এল। দীপার মা মেয়েকে জড়িয়ে হুহু করে কাঁদছিলেন। আর দীপা? কান্নারচোটে ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার দশা! মায়ের বুক ছাড়ছিল না ও। রিমা টেনে ছাড়িয়ে নিলো। দীপা আবার মেহেদীকে জড়িয়ে ধরল। মেহেদীও দু’হাতে বোনকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। ভাই – বোনের কান্নাকাটি চলতেই লাগল। কাইয়ূম মেহেদীকে বুঝিয় বলল, “ভাইয়া, তুমি এমন করে কাঁদলে তোমার আপুর কান্নাও বন্ধ হবে না।”
মেহেদী একহাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে চোখ মুছল। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, “তুমি একটা ঝামেলা, আপু। তাড়াতাড়ি বিদায় হও।”
দীপাকে হাসাতে চেয়েছিল সে। দীপা না হেসে আরো বেশি কাঁদতে লাগল। নিলয় চেষ্টা করে ধমক দিলো, “কী করছিস, দীপু? যাবি না নাকি? মত পাল্টে গেছে? আমরা কিন্তু আর রাখব না তোকে।”
দীপা এবার মেহেদীকে ছেড়ে নিলয়ের হাত দুটো ধরে নিজের কপালে ঠেকাল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। নিলয় দীপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কড়ি পাশে দাঁড়িয়ে সবটা দেখতে দেখতে আশেপাশে তাকিয়ে ইমাদকে খুঁজল। কোথাও নেই কেন উনি? দীপা ভাবি এখনি তো নিলয়কে ছেড়ে উনাকে খুঁজবেন। কড়ি ভিড় ছেড়ে বেরিয়ে এল। এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে ইমাদকে খুঁজে পেল কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে। শূণ্য চেয়ারগুলোর একটা দখল করে বসে আছে সে। দীপুর ওখানে এখন যাবে না। বড় আপুর বিদায়ের সময়ও গাড়ির আশেপাশে এক মাইলেও ছিল না সে। বড় আপুকে নিয়ে যে ভয় ছিল তাই হয়েছিল। বড় আপু সংসার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আগের মত সবকিছু এখন আর অত সহজ নয়। আপুর সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হলেও কত দিনক্ষণ দেখে দেখা করতে যেতে হয়। খালি হাতে আপুর শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া যায় না বলে হুটহাট দেখা করা যায় না। পকেটে টাকা থাকতে হয়, নিজেরও সময় থাকতে হয়, আপুরও সময় করতে হয়। তারপর এই একটু দেখা। এরপর আবার আপু যখন বাড়িতে বেড়াতে আসে তার আবার ছুটি থাকে না। দেখা যায় নিজের পরীক্ষা নাহয় স্টুডেন্টের পরীক্ষা। এক সঙ্গে ঈদ করা হয় না ক বছর হলো?
“শুনছেন?”
ইমাদ মোটেও শুনেনি বুঝতে পেরে কড়ি আবার ডাকল, “শুনছেন?”
ইমাদ সম্বিৎ ফিরে পেল। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল, “জি বলুন।”
“দীপা ভাবি আপনাকে খুঁজছেন।”
ইমাদ কিছু একটা বলতে ঠোঁট নাড়ছিল। কড়ি বলল, “আচ্ছা বলতে হবে না। চলুন।”
ইমাদ বলল, “আমি আসছি আপনি যান।”
“এখনি চলুন।”
“আমার এদিকে একটু কাজ আছে। সেড়ে আসছি।”
“এদিকে আপনার এখন কোনো কাজ নেই।” কড়ির দৃষ্টি এবং কণ্ঠ উভয়ই স্থির। ইমাদও কড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টি স্থির। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে নিজের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করল। ইদানিং সে বড্ড অনুমেয় এবং সহজবোধ্য হয়ে যাচ্ছে। বড্ড বাজে বিষয় এটা। সে কঠিন করে বলল, “আপনি কি করে জানেন আমার এখানে কোনো কাজ নেই?”
“আমি জানি।”
ইমাদ সাধারণত খুব একটা রাগে না। তবে এই মুহূর্তে সে ক্রুদ্ধ। নিজের উপরেও, সামনে দাঁড়িয় থাকা এই মেয়েটির উপরও। স্বভাবসুলভ সে তার রাগ চেপে শান্ত থেকে বলল, “কাজ আছে তো।”
কড়ি এবার হেসেই ফেলল, “বিদায় মুহূর্ত মেয়েদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সব মেয়েরা ঐ সময়টায় প্রিয়জনদের সান্নিধ্য চায়। আবেগজনিত কারণে এখানে একলা বসে থাকবেন না।”
ইমাদ এবার উঠে দাঁড়াল। এই মেয়ে বাজেভাবে তাকে ধরে ফেলছে। এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না। সে এখন দীপুর কাছে যাবে এবং একটুও আবেগপ্রবণ হবে না। ইমাদ কড়িকে বুঝাতে একজন ওয়েটারকে ডেকে ইনিবিনিয়ে একটু কথা বলে বুঝাল সে সত্যিই ব্যস্ত ছিল এখানে। তারপর কড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “চলুন।”
ইমাদ গাড়ির কাছের জটলাটায় গিয়ে দাঁড়াল। ইমাদকে দেখে মেহেদী বলল, “ইমাদ ভাইয়া, কোথায় ছিলেন আপনি? আপু বারবার খুঁজছিল আপনাকে। আপনাকে না দেখে গাড়িতে উঠছেই না।”
ইমাদ বলল, “ভেতরের দিকটা দেখছিলাম।”
এতক্ষণে সে এসেছে বলে দীপা কেমন অভিমানী চোখে তাকাল। অবিরত কাঁদছে সে। ইমাদ দীপার তাকানো দেখে মুচকি হাসল। দীপার কান্না থামার কোনো নাম নেই। চক্রবৃদ্ধি হারে ক্রমে ক্রমে তা বেড়েই চলেছে। একেওকে ধরে কাঁদছে ও। কেউ ওকে গাড়িতে টেনে আনতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত ইমাদ সফল হলো। সে দীপাকে টেনে আনতে সক্ষম হলো। কাদিন গাড়িতে উঠে বসতেই ইমাদ বলল, “দীপু, এবার উঠ।”
দীপা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “এখানে আর কেউ উঠবে?”
রিমা অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি বা কড়ি উঠব।”
কড়ি বলল, “আপু তুমি’ই উঠো।”
দীপা এতগুলো মানুষকে একইসাথে অবাক করে দিয়ে কান্নাভাঙা গলায় বলল, “আমি মাঝে বসব না। আমি জানালার পাশে বসব।”
দীপার মা কান্না বন্ধ করে মেয়ের দিকে কটমট করে তাকালেন। কেউ কেউ সশব্দে হেসে উঠল। রিমা হাসতে হাসতে বলল, “কাদিন, নাম তুই। ওকে ঐ পাশে বসতে দে। তুই মাঝে বস।”
চলবে…