#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৮
ভয়ে মিলা পরপর কয়েকটা ঢোক গিলল। মুবিন ঐ বইটাই খুঁজছে না তো? পড়ার টেবিল থেকে আড়চোখে ওর দিকে তাকাল মিলা। মুবিন পুরো বুকশেলফ চষে ফেলছে। ওর বইয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ দারুণ। মিলা জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। বুকটা দুরুদুরু করছে। মুবিন এবার অধৈর্য্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “প্রডিজি বইটা পাই না কেন, মিলা?”
মিলা কেঁপে উঠল। জামা টেনে বুকে থুথু দিয়ে বলল, “কী যেন জানি না তো।”
মুবিন মেঝেতে বসে নীচের তাক হাতাতে লাগল। একদম কোণায় বইটি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে, “পেয়েছি।”
আতঙ্কে জমে গেল মিলা। মুবিনের চোখে যেন না পড়ে তাই একদম শেষের তাকে রেখেছিল সে। মুবিন বইটা খুলে দেখবে না তো? আশঙ্কায় মিলা আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগল।
যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয় প্রবাদটিকে শতভাগ সত্য করে দিয়ে মুবিন বইটি খুলে দেখল। বইয়ের মাঝ থেকে দুটো পাতা খসে পড়ল মেঝেতে। বইয়ের পাতা ছেঁড়া! পরমুহূর্তেই ছোটখাটো একটা বিস্ফোরন ঘটে গেল। মুবিন উঠে এসে মিলাকে মারল। মিলাও হাতাহাতি লেগে গেল, কিন্তু মুবিনের সাথে পারা কঠিন। শেষটায় ব্যাথায় কুঁকড়ে গিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠল। ধাক্কা দিয়ে ভাইকে সরিয়ে বলল, “ছাড়।”
“ভালো করেই ছাড়ছি তোকে।” মুবিন রোষানলে জ্বলে উঠে আবার তেড়ে গেল।
“এত গুন্ডা কেন তুই?”
“সত্যি সত্যি বল কেন ছিঁড়লি? আমাকে শায়েস্তা করতে? হ্যাঁ? তোর স্যার বিদায় হয়ে যাওয়ার আমার বই ছিঁড়ে ক্ষোভ দেখিয়েছিস?”
“আরে না। সুহাকে দিয়েছিলাম।”
“আমার বই তুই আমার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া ছাড়াই নিজের বান্ধবীকে দিয়ে দিলি? আর তোর বান্ধবী বই পড়তে নিয়ে একদম ছিঁড়েই ফেলল!”
“ও করেনি। ওদের বাসায় মেহমান এসেছিল। মেহমানের ছোট বাচ্চা ছিল। বাচ্চাটা ছিঁড়ে ফেলেছে।”
“আমার বই কাউকে দেওয়া নিষেধ না? বল নিষেধ না? আমি আমার জানের জিগার বন্ধুদেরও বই দেই না। তুই তা খুব ভালো করেই জানিস।” মুবিন চেঁচাচ্ছে। মিলা কী বলবে? চুপ করে রইল। মুবিন বলল, “একদম চুপ করে থাকবি না। বল নিষেধ কিনা?”
“নিষেধ।” মিলা চোখ মুছল।
“তো কেন দিলি?”
“ও চেয়েছিল।”
“ও চেয়েছিল! ও চাইলেই কী দিতে হবে? ও কী তোর নিজের জানের চেয়েও প্রিয়?”
মিলা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “হ্যাঁ, নিজের জানের চেয়েও প্রিয়। কী করবি মেরে ফেলবি এখন?”
মুবিন ব্যঙ্গ করে উঠল, “বাবা!!! সিনেমা! বান্ধবী নাকি জানের চেয়েও প্রিয়! সর সামনে থেকে। আর কোনোদিন আমার শেলফে হাত দিবি না। সোজা হাত ভেঙে দিব।”
মিলা হিসহিসিয়ে বলল, “একশবার দিব। সুহা আবার বই চাইলেই বই দিব। ও যেটা চাইবে আমি সেটাই দিব।”
“দিতে হলে নিজের বই দে গিয়ে। অামারগুলায় ভুলেও আর হাত দিবি না।” মুবিন ধমকে উঠল।
“আমি এতসব বোরিং জিনিসপত্র পড়ি না। আমার থাকলে আমারটাই দিতাম। তোর মতন এত ছোট আত্মাওয়ালার বইয়ের দিকে ফিরেও তাকাতাম না। মনটা একটু বড় কর।”
“তোর সুহা কী আমার হবু বউ লাগে যে ওর জন্য আমার আত্মা, মন বড় করে ওকে আমার বই দিতেই হবে?”
“তোর মতন গুন্ডার কোনোদিন সেই সৌভাগ্য হবেও না।”
মুবিন মুখ খিঁচিয়ে আঙুল তাক করে বলল, “শোন আমার বই আর কখনো দিবি না কাউকে।”
“আর কাউকে ত দিইও না। সুহাকে শুধু দিই, আর দিবোও।”
“ওর জন্য এত পিরিতি কেন আপনার?”
“এত পিরিতি কারণ একমাত্র ও আমার কেয়ার করে। আর কারো কাছে আমার কোনো গুরুত্ব নেই। তোর মা – বাবার কাছেও আমি নোবডি। তোরা যখন আমায় কষ্ট দিস তখন ওর কাছে গিয়েই কাঁদি।”
“এক প্যাঁচাল পেয়েছে। সবসময় টেনেহিঁচড়ে সেটাই নিয়ে আসে।”
“তোর কাছেও আমার গুরুত্ব নেই। সামান্য একটা বইয়ের জন্য আমাকে মেরেছিস তুই। মনে রাখলাম।”
“যা, যা মনে রেখে যা করবার করিস। যাহ্।” হাত নাড়াতে নাড়াতে বলতে বলতে চলে গেল মুবিন। তারপর সারা দুপুর নিজের ঘরে পড়ে ঘুমাল। দুপুরের খাবার ছেড়ে দিলো মিলা। খাবে না সে! মুবিন বিকেলে ঘুম থেকে উঠে খেতে বসে গলা উঁচিয়ে ডাকল, “এই মিলা খাবি না?”
“তোকে খাব।” মিলার রাগের জবাব।
“সাহস থাকলে আয় না, আয়।”
“মাথা ব্যাথা আমার। বিরক্ত করিস না।”
“সারাদিন ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদলে মাথা ধরবেই। পান থেকে চুন খসতেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ! আমার কী! না খেলে না খাবে।”
বিড়বিড় করতে করতে একলাই খেয়ে নিলো সে। তারপর মাঠে খেলতে চলে গেল। খেলায় মন বসল না তার। মা-বাবার ডিভোর্স আর কার কাছে মিলা থাকবে এই নিয়ে এমনিতে সারাক্ষণ মিলার মন খারাপ থাকে। অসহনীয় যন্ত্রণায় আর চিন্তায় নিঃশেষ হতে থাকা তার মাথায় পরীক্ষার সিলেবাস শেষ করবার নতুন দুশ্চিন্তা দেখে মুবিনের অপরাধবোধ হতে লাগল। তার উপর আজ সে মেরেছেও।
বাসায় ফেরবার আগে ইমাদ স্যারের মেসে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো সে। স্যারের মেসের ঠিকানা তার জানা ছিল। মা অধিক সচেতনায় প্রথম দিনই ঠিকানা জেনে রেখেছিলেন। মা ইমাদ স্যারকে অনেক জুরাজুরি করবার পরও তিনি আর কখনো পড়াতে যাননি। এর মাঝে আরেকজন টিউটরও পেয়েছিল ওরা, কিন্তু ইমাদ স্যারের মতন অত ভালো পড়ান না বলে মিলা বাদ দিয়ে দিয়েছে।
ইমাদ মেসে ছিল না, নিলয় ঘুমাচ্ছিল। দরজায় মুবিনের ধাক্কার পর ধাক্কায় নিলয় বিরক্ত হয়ে দরজা খুলল, “কাকে চাও, বাবু?” তার কণ্ঠ এখনো ঘুমে ভার হয়ে আছে।
“ইমাদ স্যারের কাছে এসেছি।”
নিলয় ভালো করে তাকাল। নীল থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট আর বেন টেন এর চিত্রখচিত সবুজ গেঞ্জি পড়ুয়া নাদুসনুদুস এক ছেলে। চুলগুলো খাঁড়া খাঁড়া। লম্বায় নিলয়কে প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে। নিলয় মুখের সামনে হাত নিয়ে হামি তুলে বলল, “ও এখন নেই।”
মুবিন কাঁধ ঝাকাল, “কখন আসবেন?”
“ক’টা বাজে এখন?” বলে নিজেই ঘাড় ঘুরাল। দেয়ালে লেপ্টে থাকা সোনালী রঙা বড় ঘড়িটা দেখে বলল, ” এসে পড়বে বিশ, পঁচিশ মিনিট।”
“আমি তাহলে বসি।”কোনো প্রকার অনুমতির অপেক্ষা ছাড়াই মুবিন ঘরে ঢুকে গেল। নিলয় বিড়বিড় করতে করতে নিজের চৌকিতে ফিরে গেল আবার, “দেশ এই ধরনের পোলাপানদের হাতে পড়লে সর্বনাশ। রসাতলে যাবে।”
নিলয় হাত দিয়ে কপাল ঢেকে শুয়ে রইল। ইমাদ এসে দেখল মুবিন তার চৌকিতে বসে আছে। অনবরত পা নাড়াচ্ছে আর গেইমস খেলছে মোবাইলে। সে কাঁধের ব্যাগটা চৌকিতে রেখে বাথরুমে গিয়ে হাত- মুখ ধুলো। গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বেরুতেই মুবিন উঠে দাঁড়াল, “স্যার, আমাদের পুরো সিলেবাস বাকি।”
“হুম।” ইমাদ শার্ট খুলে দড়িতে ঝুলাল।
মুবিন খানিক ইতঃস্তত করে বলল, “স্যরি স্যার।”
“ইটস ওকে।”
“অন্তত মিলার জন্যে পড়াতে আসুন।”
“আচ্ছা।”
মুবিন প্রফুল্ল হয়ে উঠল। চোখের তারায় হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল। সবকটা দাঁত বের করে হেসে বলল, “থেঙ্ক ইউ, স্যার।”
ইমাদ কিছু বলল না। পকেট থেকে মোবাইল বের করে চার্জে দিয়ে টেবিলে রাখল। মুবিন বলল, “তাহলে নেকস্ট মঙ্গলবার থেকে আবার পড়ব, স্যার।”
“আচ্ছা।”
“আসি স্যার?”
ইমাদ হ্যাঁ- সূচক মাথা নাড়ল। মুবিন ঘুরে চলে যাচ্ছিল। ফিরে এল আবার। ইমাদ মুখ তুলে প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল।
“পাথরের এই মূর্তিটা কী কেনা?” মুবিন আঙুল তাক করে দেখাল।
“না।”
“হ্যাঁ, দেখেই মনে হচ্ছিল। এখনও তো অসম্পূর্ণ।”
ইমাদও ভালো করে তাকাল। মুবিন আবার প্রশ্ন করল, “এটি কার?”
“ওর।”
“বানাচ্ছে?”
“হুম।”
“কী করে?”
“ওকে জিজ্ঞাসা করো।”
মুবিন নিলয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, “ভাইয়া আপনি ত দারুণ।”
নিলয় কপাল থেকে হাত না সরিয়েই বলল, “থেঙ্কস।”
মুবিন মূর্তিটার দিকে এগিয়ে যেতেই নিলয় ধমকে বলল, “ধরো না ওটা।”
মুবিন বিড়বিড় করল, “কী ভাব!” তারপর গটগট করে চলে গেল সে, কিন্তু ইমাদ আর কখনো ওদের পড়াতে গেল না।
চলবে….