একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ৯

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৯
কড়ি আর দীপার বন্ধুত্বটা ভালোই যাচ্ছে। দীপার খুব একটা বান্ধবী নেই। বন্ধু আছে অনেক। স্কুল, কলেজ থেকেই ওর ছেলেদের সাথে ঝট করে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। উল্টোদিকে, মেয়েরা ওকে কোনো এক অজানা কারণে সহ্য করতে পারে না। এই প্রথম একটা মনের মতন বান্ধবী জুটেছে। বয়সে যদিও কড়ি ছোট তবুও খাতিরটা জমে ক্ষীর। কড়ি ইমি আর নিলয়ের মত না। দীপার সব কথাই ও মনোযোগ দিয়ে শুনে। যেখানে অন্যরা দীপার কথার ঝড়ে কানে আঙুল চেপে বসে থাকে সেখানে ওর এই বকবকে কড়ির অবিশ্বাস্য আগ্রহ। এত মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে দীপারও আনন্দের শেষ নেই। যেখানেই যায় কড়িকে সাথে নিয়ে যায়। এই যেমন আজ সে একটা হাত ঘড়ি কিনবে বলে কড়িকে ফোন করে মার্কেটে নিয়ে এল। খুব সুন্দর একটা কালো চেনের ঘড়ি কিনল সে। এরপর ফুচকা খেতে খেতে বলল, “তোমার বাসায় নিবে না আমায়? আজকে চলো তোমার বাসায় যাই।”
কড়ি ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, “বাসায় যাবে?”
“বন্ধুদের বাসায় গিয়ে আড্ডা দেওয়ার মজাই আলাদা। নিলয় আর ইমির মেসে ত আর যেতে পারি না। যদিওবা, ওরা আমার বাসায় আসে। তবুও আমার ত আর যাওয়া হয় না।”
ব্যস হয়ে গেল। কড়ি দীপাকে নিয়ে নিজের বাসায় চলে এল। তবে বিপত্তি বাঁধল রিকশা থেকে নেমে। রিকশাওয়ালা পাঁচটাকা ভাঙতি নেই বলে পঁচিশ টাকার জায়গায় ত্রিশ টাকা রেখে দিতে চাইল। ওদের কাছেও ভাঙতি ছিল না। অথচ, দীপা স্পষ্ট দেখেছে রিকশাওয়ালা যখন টাকা গুনছিল তার মাঝে পাঁচ টাকার নোট আছে। সে লেগে গেল ঝগড়া, “পাঁচ টাকা বেশি রাখতে চান বললেই হলো। মিথ্যে বলছেন কেন? আপনার টাকাগুলো দেখান ওখানে পাঁচ টাকার নোট আছে। এখনি, এখনি বের করুন।”
কায়েস চেঁচামেচি শুনে দু’তলার বারান্দা থেকে উঁকি দিলো। নীচে কড়িকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি করে নেমে এল, “কী হয়েছে, কড়ি?”
“তেমন কিছু না, ছোট ভাইয়া।” কড়ি দীপার হাত টেনে ধরল। ফিসফিস করে বলল, “শশশশশ্ বাসায় চলো, প্লিজ। বাসার সামনে চেঁচামেচি না।”
দীপা বিরক্ত হয়ে কড়ির দিকে তাকাল। কায়েস কিছু বলল না আর। অদ্ভুত চোখে দীপার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেল। রিমা বাসায় ছিল না বলে কড়ি দীপাকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে নিজেই নাশতা তৈরী করতে চলে গেল।
কাদের সাহেবও বাসায় ফিরলেন তখন। আজ ফিরতে একদম দেরি হয়ে গেছে! দুপুরে খাওয়াও হয়নি। ডায়াবেটিস এর রোগী তিনি। শরীর কাঁপছে রীতিমত। তাই কাপড় বদলে আগে খেতে বসলেন। ঔষধের বক্স নিয়ে এসে ইনসুলিন বের করলেন। ডাইনিং আর ড্রয়িংরুমের মাঝে টানানো পর্দাটা সরান ছিল। দীপা ড্রয়িংরুম থেকে দেখল এটা। সে নিজ থেকে উঠে এসে বলল, “দিন আমি দিয়ে দিই, আঙ্কেল।”
“না, না আমি নিজে নিজেই দিতে পারি। নিজের কাজ নিজে করে অভ্যস্ত।”
দীপা তার স্বভাব অনুযায়ী বারণ শুনল না। সিরিঞ্জ হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সে নিজেই ইনসুলিন দিয়ে দিলো। আর একটানা কথা বলেই গেল, “আমার আব্বাকে ত আমিই দিতাম। আপনি কত ভালো। একটুও জ্বালাতন করেন না। একদম শান্ত একটা বাচ্চা ছেলে। আর আমার বাবা যে কী ছিলেন! নিজে দিবেন ত দূরের কথা সিরিঞ্জ ভয় পেতেন। হা হা হা।” দীপা একাই কথা বলল। একাই হাসল। কাদের সাহেব চুপ রইলেন। এমনকি ধন্যবাদও দিলেন না। কিছু কিছু মানুষের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তাদের কথা শুনতেই পরাণ জুড়ায়।
দীপা চলে যাওয়ার পর কাদের সাহেব কড়িকে ধরলেন, “মেয়েটা কী তোর বান্ধবী?”
“হ্যাঁ।”
তারপর আরো কিছু কথা জানতে চাইলেন। কড়ি অন্যকিছু ভাবল না। তবে চমকে গেল রাতের টেবিলে খেতে বসে। সবাই এক সাথে খেতে বসেছে তখনি কাদের সাহেব কথাটা তুললেন,
“আজকে কড়ির সাথে যে মেয়েটা এল ওকে কাদিনের জন্য আমার খুব পছন্দ হয়েছে, কড়ি। মেয়েটার কোনো ছবিটবি থাকলে কাদিনকে দেখাস।”
কড়ি লুকমা মুখে তুলে নিতে গিয়ে থেমে গেল। মুখের সামনে লুকমাসহ হাত স্থির হয়ে রইল অনেকক্ষণ। দীর্ঘ সময় পর ছোট করে বলল, “ঠিক আছে।”
কাদিন কিছু বলল না। রিমা বলল, “কে এসেছিলরে কড়ি?”
“নতুন বান্ধবী তুমি চিনবে না।”
“তাই নাকি!”
“হুম।”
কড়ির বড় ভাই আব্দুল কাইয়ূম বলল, “তোর সাথে পড়ে নাকি?”
“না, না সিনিয়র। অন্যভাবে বন্ধুত্ব।”
কায়েস মিটিমিটি হাসছিল। রিমা সেটা খেয়াল করল। খাবার শেষে কায়েসকে গিয়ে ধরল, “সেসময় হাসছিলি কেন?আমাকে না বললে কিন্তু হবে না।”
কায়েস আবার হেসে ফেলল, “ঐ মেয়ে রিকশাওয়ালার সাথে ঝগড়া করছিল! ভাবা যায়! মিস্টার মোস্তফা কাদিনের বউ ভবিষতে অলিতেগলিতে, সবজিওয়ালা, দোকানদার, রিকশাওয়ালা সবার সাথে ঝগড়া করে বেড়াবে। উফ সিনেমার মত দৃশ্যটা চোখে ভাসছে! হায় হায় হায় বাবা এতদিনে একটা কাজের কাজ করতে যাচ্ছে।” কায়েস হাত দিয়ে রোল, ক্যামেরা অ্যাকশন এর মতন দেখাল।
“অ্যাহ? বলিস কী!” রিমাও হেসে কুটিকুটি।
কায়েস বলল, “খবরদার বড় ভাইয়াকে বলো না যেন! ও তাহলে কাদিন ভাইয়াকে ঝগড়ার কথা বলে দিবে।”
“আরে না ওকে বলব না, কিন্তু মেয়েটা এমনিতে ভালো তো?”
“কড়ির বান্ধবী যেহেতু অবশ্যই ভালো। তবে মোস্তফা কাদিনের অতিরিক্ত ইমেজ সচেতনতাকে দুই মিনিটে পা দিয়ে পিষিয়ে ফেলতে যথেষ্ট। আর ঝগড়াটে মেয়েগুলো খারাপ হয় কে বলল তোমায়? ওরা আরো ভালো হয়। একদম পিওর হার্টের। মনে যা মুখেও তা। তোমার বড় দেবরের মতন ভালো মানুষ সেজে থাকে না।”
“অ্যাহ আমার দেবরকে কিছু বলবি না তুই। ও হলো আদর্শ ছেলে।”
“হ্যাঁ, জানি তো ওই তোমার প্রিয় দেবর।”
“ও আমার প্রিয় দেবর হলে তুই আমার প্রিয় ভাই।”
“কলা দিয়ে আর ছেলে ভোলাতে হবে না।”
“আমি ভাবছি ভিন্ন কথা।”
“কী কথা?”
“ভাবছি কাদিনের জন্য এমন মেয়ে নিয়ে আসলে তোর জন্য কেমন মেয়ে খুঁজব? তোর বেলায় তাহলে গম্ভীর একটা হুতুম পেঁচা নিয়ে আসব।”
“কবে আনবে, আপু? আনো না। আর তো সহে না।” কায়েস বিছানায় কাত হয়ে শুলো।
“এত লাফিও না। তোমার বিয়ের অনেক দেরি! আগে কড়ি তারপর তুমি!”
“না মানি না, মানব না।” কায়েস হাত উঁচু করে আন্দোলন করার ভঙ্গি করতে লাগল।
“করতে থাক আন্দোলন, অনশন, হরতাল। আমি গিয়ে ঘুমাই।” রিমি হেসে চলে গেল।
.
একেকবার দীপার জন্য একেকটা বিয়ের সম্বন্ধ আসে আর দীপার মায়ের কান্নাকাটির রোল পড়ে। দীপার কাছে কেঁদেকেটে লাভ হয় না বলে মেয়ের বন্ধুদের কাছে কাঁদতে বসেন। উদ্দেশ্য একটাই, মেয়েকে কোনোভাবে কেউ যদি বিয়েতে রাজি করিয়ে দেয়, কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনো কেউ তা পেরে উঠেনি। দীপার মা তবুও হাল ছাড়েন না। যতবারই নতুন নতুন সম্বন্ধ আসে ততবারই যুদ্ধে নেমে পড়েন। কাদিনদের পক্ষ থেকে সম্বন্ধ আসার পরও তাঁর মেয়ের প্রতিক্রিয়া একই। বিয়ে করবে না, না, না মানে না। তিনি সববারের মতন এবারেও নিলয় আর ইমাদের কাছে কল করে কান্নাকাটি করলেন। দীপার মায়ের অসহায় কান্না শুনে ব্যর্থ হবে জেনেও ওরা দুজন ছুটে এসেছিল দীপাকে বিয়েতে রাজি করাতে, কিন্তু এসে বিস্ময়ের চরম সীমানায় পৌঁছে গেল। দীপা বিয়েতে রাজি। রাজি মানে বিয়ে করতে একদম উতলা হয়ে গেছে। দীপার মাও অবাক। খুশিতে তিনি পাগল পাগল হয়ে ওদের দুজনকে একটু পর পর ধন্যবাদ দিচ্ছেন। তিনি ধরে নিয়েছেন ওরাই রাজি করিয়েছে। অপরদিকে, ওরা কিছুতেই কিছু বুঝে উঠছে না। সকালে কল করে বিয়েতে রাজি হতে বলায় দীপা অনেক রাগারাগি করল। এমনকি ওদের কাছে কড়িকেও বকাঝকা করল। কড়িকে খুঁজে নিয়ে আসায় ইমাদের উপরও সেই ঝড় গেল। আর দুপুর গড়িয়ে বিকেলেই সব দৃশ্য এমনভাবে পাল্টে গেল!
দীপা ড্রেসিংটেবিল এর সামনে ঘাড় কাত করে বসে চুড়ি পরছে। ইমাদ আর নিলয় প্রায় একইসাথে সমস্বরে প্রশ্ন করে উঠল, “হচ্ছেটা কী?” নিলয়ের কণ্ঠ উত্তেজিত, ইমাদের স্বর হিমশীতল।
নিলয় অস্থির হয়ে ঘরময় পায়চারি করছিল আর ইমাদ চোখ বন্ধ করে কাউচে হেলান দিয়ে বসে আছে। দুজনের মাথাই চিন্তায় ফেটে যাচ্ছে।
চলবে…
★অটোগ্রাফ সহ আমার ২য় বই “যে শ্রাবণে ফাগুন” এর প্রি-অর্ডার চলছে….
★প্রি- অর্ডার লিঙ্কঃ
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=882805749142024&id=100022378217757
ফোনে অর্ডার করুন- ১৬২৯৭ এই নাম্বারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here