হৃদয়ের_কথা #প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ |৫|

#হৃদয়ের_কথা
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
|৫|

৫.
বেশকিছুদিন ধরে রিধিমা লক্ষ‍্য করছে সম্রাট তার সঙ্গে ঠিক মতো কথা বলেনা। এই নিয়ে প্রচুর অশান্তিতে রয়েছে। তার সঙ্গে ঘটেচলা সবকিছু যে স্বাভাবিক নয় সেটা সে উপলব্দি করতে পারছে। রিধিমা বুঝে গেছে সম্রাটের জন‍্য সে উইক। এতটাই উইক কিন্তু আগে উপলব্দি করেনি। এইযে সম্রাট ওর সঙ্গে কথা বলেনা, ঠিকমতো ওদের দেখা হয় না, সম্রাট এখন আর রিধিমাকে বকাঝকা করেনা। অথচ এগুলো রিধিমা প্রচন্ড মিস করছে। এইতো কিছুদিন আগে সম্রাটের বন্ধু বান্ধবরা আসল তাদের সঙ্গে রিধিমার বেশ জমেছিল।সবাই এতো ভালো। ওদের পরিবারের সঙ্গে প্রায় মিশে গেছিলো। সেদিন সম্রাট, রিধিমা, রাহুল, মেধা, সাহিল আর সম্রাটের বাকি সব বন্ধুরা মিলে ধানমন্ডির এক লেকের পাশে অবস্থিত নতুন একটা রেস্টুরেন্টে গেছিল। সবার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেশ দেরীতে বন্ধুদের বিদায় দেয় সম্রাট তারপর রিধিমাদের নিয়ে চলে আসে। কথায় কথায় রিধিমাকে সম্রাটের বন্ধুরা হিংস দিচ্ছিল যে তাকে সবাই কিভাবে চিনে। এছাড়াও অনেক কথায় হয়েছিল। সম্রাটের বন্ধু সাম‍্য ভাইয়া সে তো সম্রাটের প্রশংসা করতে গিয়ে বোমা ব্লাস্ট করে ফেলেছে। সম্রাট যখন ইউনিভার্সিটিতে ছিল। ভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে নাকি তাকে প্রপোজ করেছিল। সেই সম্রাট রাজি করানোর জন‍্য কতোশত চেষ্টা করতো এদিকে সম্রাট তো কখনো পাত্তায় দেয়নি। একদিন সবার সামনে মেয়েটি সম্রাটকে জরিয়ে ধরেছিল। সেদিন বিনা টিকিটে বাংলা সিনেমা দেখেছিল সবাই। ব‍্যাস এই কথায় রিধিমার চোখ ছলছলে হয়ে যায়। একটু পর চোখের পানি গড়িয়ে পরবে পরবে ভাব। সম্রাট পরিস্থিতি বুঝে সৌভিক, সাম‍্য,মুরাদ, আর হৃদকে চোখ রাঙায়। সাম‍্য থামে না বরং আরো বলে সেদিন নাকি সম্রাট মেয়েটাকে প্রচন্ড অপমান করেছে। সবার সামনে রিজেক্ট হয়ে মেয়েটি একমাস ভার্সিটি আসেনি। এসব সহ আরো কতো শত গল্পে ব‍্যাস্ত ছিল সবাই। রিধিমা আড়াল থেকে সম্রাটকেই দেখছিল। ওর প্রতিক্রিয়া কেমন এটা জানা তো ডেফিনেটলি দরকার। সম্রাট হেসে উঠেছিল। একদম মুক্তার মতো ঝকঝকে হাসি। হাসলে সম্রাটের কপালে চুল চলে আসে। ওর ডান গালের কাছে ঠোঁট থেকে একটু নিচে ছোট্ট একটা তিল আছে সেটা আরো সুন্দর দেখায় লম্বা ফর্সা মুখশ্রীতে। রিধিমার হঠাৎ মনে হয় ওর হার্টবিট ফার্স্ট চলছে। কোন কিছু না ভেবেই সে উঠে পরে তারপর লেকের পাশটাই চলে আসে। সবাই হচকিত হয়ে কাহিনী বোঝার চেষ্টা করে কিন্তু কেউ বোঝার আগেই সম্রাট ও উঠে পরে। সবাইকে আড্ডা দিতে বলে নিজে রিধিমার কাছে যায়। সেদিন রিধিমা জিগ্যেস করেছিল সম্রাটকে কাউকে ভালোবাসে কিনা সম্রাট উত্তর দেয়নি। মনে মনে অভিমান করেছিল রিধিমা। ভেবেছিল সব অনুভূতি তার সম্রাট তো কিছু ফিলই করেনা। সম্রাটের সেদিন উত্তর না দেওয়া অন্ধকারে মিষ্টি হাসিটা রিধিমার আড়ালেই রয়ে গেলো।

সম্রাট আজও বাসায় ফিরতে লেট করেছে। মর্তুজা সাহেব তো বেজায় রেগে। সম্রাটকে কিছু বলবে তার আগেই মর্তুজা সারওয়ার সাহেব থামিয়ে দেন। মর্তুজা শহীদ সাহেব তখন ও অফিসের কাজে ব‍্যস্ত বাসায় ছিলেন না তিনি। মর্তুজা শাখাওয়াত সাহেব দিন দিন ছেলের উশৃঙ্খলতা দেখে চিন্তিত ছিলেন। কারণ সম্রাট কখনো কোন কিছুতে অনিয়ম করেনি সবসময় ভদ্র ছেলেটি এখন বাবার সঙ্গে তর্ক করে মাঝে মাঝে। বাসায় ফেরে লেট করে। সবকিছুতে লেট নয়ত অনিয়ম। এইতো কিছুদিন আগে বাড়ীর কাজের বুয়া সম্রাটের ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে সেখান থেকে বেশকিছু সিগারেটের টুকরোও পেয়েছে। তিনি ছেলের সঙ্গে আলাদা কথা বলবেন ভেবে চুপচাপ রাগটা আগলে নেন। সেইদিন রিধিমা সম্রাটের সামনে গেছিলো। সম্রাট যেন সমস্ত রাগ রিধিমার উপর ঝেড়েছিল। ওরনা ছিড়েঁ অনেক বকাঝকা করে রুম থেকে বের করে দেয়। রিধিমা সেই কি কান্না কেউ থামাতে পারছিলোনা। রুবায়াত বেগম আর সারওয়ার সাহেব মেয়েকে কোনরকম বোঝান সম্রাট রেগে ছিল ওর রুমে যাওয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু রিধিমা তো কেদেঁ কেটে অস্থির শেষে। শাখাওয়াত সাহেব রিধিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝায় তিনি সম্রাটকে বকে দিবেন। বড়বাবা আর বড়মার আদর পেয়ে রিধিমা চুপ করে যায়। মনে মনে অভিমান করে ঠিক করে সম্রাটের কাছে যাবে না।

৬. কলেজে ক্লাসটেস্ট এক্সাম শুরু হয় রিধিমার। সম্রাট বা রাহুলই ওকে পড়াশোনায় হেল্প করে। রাহুল তো ছিল না বাধ‍্য হয়ে সম্রাটের কাছেই ম‍্যাথ নিয়ে যায় রিধিমা। দরজায় টোকা দেয়।সম্রাট সেদিন কিছু বলেনি চুপচাপ দরজা খুলে দেয়। তারপর টেবিলে গিয়ে বসতে বলে সে ফ্রেশ হয়ে আসছে।
এদিকে রিধিমা ব‍্যস্ত ভঙ্গিতে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে। সম্রাট ফ্রেশ হয়ে কফি নিয়ে আসে। রিধিমাকে এটা ওটা বুঝিয়ে দেয়। তারপর রিধিমা যখন চুপচাপ বেরিয়ে আসছিল সম্রাট বলে উঠে,

_ রিধিমা শোন!

_ জ্বী ভাইয়া বলেন।

সম্রাটের মনে হয় পৃথিবীর সকল ভাইয়া ডাক একটা কাটাঁ।অসহ‍্যকর কাটাঁ। তারপর উঠে গিয়ে অফিস ব‍্যাগ থেকে সুন্দর একটা ব্রেসলেট বের করে রিধিমার হাতে দেয়। ব্রেসলেটটা মোটা করে সুন্দর ডিজাইন করা। রিধিমা তো মনে মনে সেই খুশি। সেদিনের রাগ দুর করতে বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই শুধু সম্রাটের মিষ্টি একটা হাসি আর একটু ভালো করে কথা বলা যথেষ্ট। সেখানে বরারবরের মতো সম্রাট ওর অভিমান ভাঙাতে নতুন উপহার এনেছে এখন সে কিভাবে রাগ করে থাকবে। সেতো ভারি খুশি এখন আর সেই ঝোকে সম্রাটকে জরিয়ে ধরে বলে উঠল,

_ থ‍্যাঙ্কস ভাইয়া। ইউ আর দ‍্যা বেস্ট।

সম্রাট পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিধিমার পিঠে হাত রাখল। রিধিমা হাসতে হাসতে ব্রেসলেট নিয়ে চলে যায়। সম্রাট ওইভাবেই তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে।

রিধিমা ব্রেসলেট পেয়ে এতো খুশি যে সারাদিন শুধু ওটা দেখতেই থাকে। জারিফা আর নীলিকেও দেখিয়েছে। ওরা দুজনেই তো সেম সেম নেবে বলেছে। রিধিমা বলেছে এটা সম্রাট তাকে উপহার দিয়েছে। দুজনেই তো অবাক আবার খুশি। কারণ সবাই জানে সম্রাট শক্ত কঠিন হৃদয়ের মানুষ। সে যে কারো জন‍্য মেয়েলী উপহার আনবে এমনটা ভাবাও যায় না। শেষে নীলি যখন বলল হয়তো বোন ভেবে দিয়েছে ব‍্যাস রিধিমা রেগে আগুন কিন্তু একটা কথাও সে মুখ ফুটে বলেনি। চুপচাপ কথা না বলে প্রমাণ করল সে রাগ করেছে। নীলি,জারিফা দুজনে ব‍্যাপারটা বুঝে রিধিমাকে জরিয়ে ধরে বলল,

_ আচ্ছা ঠিক আছে সরি। সম্রাট ভাইয়া তোকে বোন ভাবে না। হয়েছে এবার? রাগ করিস না চল।

.

এভাবে রিধিমার কলেজের এক্সাম ও শেষ হয়। এখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠে গেছে। এক্সাম চলাকালীন প্রতিদিন সে সম্রাটের কাছে পড়াশোনা করেছে। সম্রাট ওকে পড়াতে গেলে পড়া কম আবিজাবি সব গল্প শুরু করে। সম্রাট বেশ ধমক ও দেয়। রিধিমাও পড়ায় কনসেন্ট্রেশন নিয়ে আসে।

.

দুইদিনপর রিধিমার জন্মদিন। আঠারো বছরে পরবে সে নীলি,জারিফার অলরেডি পরে গেছে কিছুদিন আগে। সে তো অনেক এক্সাইটেড জন্মদিন নিয়ে। এখন থেকে ভেবে রেখেছে এটা করবে সেটা করবে। এর আগে সে পরক্ষ করতে চায় সবার তার জন্মদিনের কথা মনে আছে নাকি। সে প্রথমে বাবা মায়ের রুমে যায়। সারোওয়ার সাহেব এবং রুবায়াত বেগম তো এইসময়ে মেয়েকে দেখে অবাক কিছু চায় নাকি জিগ্যেস করলেন।

রিধিমা তো খুশি খুশি জিগ্যেস করল

_ পরশু দিনের কথা মনে আছে তোমাদের?

_ কি হবে পরশু?

রিধিমা যেন আকাশ থেকে পড়ল তার বাবা মা জানেনা পরশুদিন কি আছে। তার বাবা মা কিভাবে ভুলে গেলো। বেচারী কষ্ট পেয়ে বলল,

_ কিছু নয় আমি গেলাম।

মেয়ে চলে যেতেই সারওয়ার দম্পতি হেসে উঠলেন। এবার রিধিমা রাহুল,মেধা আর সাহিলের রুমে গেল। কেউই জানেনা পরশুদিন ওর বার্থডে। বেচারি এতটুকু মন নিয়ে বড়বাবা আর বড় মার রুমে গেলেন। হয়ত ভেবেছিল সবাই ভুলে গেলেও তার বড়বাবা বড় মা ভুলবে না। কিন্তু রিধিমাকে অবাক করে কারো মনে নেই ওর জন্মদিন সম্পর্কে। এমনকি মেজো আব্বু আর মেজো মার ও। বেচারীর কতো আশা আঠারো তম জন্মদিন নিয়ে। এখন এতোকিছুর পর তার আঠারো বছরে পরতে ইচ্ছে করছে না। সে অভিমান নিয়ে ভাবল সতেরোতেই ঠিক আছি দরকার নেই আঠারোর। রিধিমা নীলি,জারিফাকেও জিগ্যেস করেছে পরশুদিন নিয়ে তারা কেউই জানেনা। অথচ নীলি আর জারিফার জন্মদিনের দু চারদিন আগে থেকে সারপ্রাইজ প্লান করে রাখতো রিধিমা। রিধিমার এক মুহুর্তের জন্য মনে হচ্ছে সবাই ভুলাক্কার, স্বার্থপর। কোন রকম কষ্ট লুকিয়ে রিধিমা হাসি হাসি মুখে নিজের অভিমান লুকিয়ে ফেলল।

কলেজের পরীক্ষা শেষ তাই ছুটি চলছে। সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হবে ডিসেম্বরে শেষে। ডিসেম্বর শেষ হতে মাত্র কয়েকদিন। আজ উনিশ তারিখ রাত বারোটার পর তার জন্মদিন অথচ সবাই কতো শান্ত। এমনকি বাড়িটাও। বুক ভর্তি অভিমান নিয়ে ঠান্ডার মধ‍্যেও ছাদে বসে ছিল। গায়ে পাতলা একটা লেডিস পিংক হুডি আর নেভিব্লু জিনস। হুডিটা মাথার উপরে আর চুল গুলো দুই সাইড দিয়ে বের করা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে বসে আছে। একটু ঠান্ডা লাগছে কিন্তু সমস্যা নেই। অতো বেশিও ঠান্ডা না। দুর আকাশে চাদ দেখা যায়। কুয়াশার জন‍্য তারা গুলো আবছা। দুই একটা তারা আছে যেগুলো একটু বড়। রিধিমা সবসময় সেগুলোর সঙ্গে কথা বলে। রিধিমার ধারণা তার সঙ্গে কথা বলে তারাগুলো। আবার মিটমিট করে হাসে।

সময়টা হয়তো এগারোটা। তিনতালা ডুপ্লেক্সের বিশাল বাড়িটা অন্ধকার। সবাই হয়তো ঘুমে বিভোর। আর এক ঘন্টা পরে বিশ তারিখ মানে তার জন্মদিন অথচ কারো খেলায় নেই সবাই ঘুমে। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে দোলনা থেকে ছাদের রেলিঙে হেলান দেয়। আশেপাশে বাড়ি গুলোতে একটু আলো দেখা যাচ্ছে। আশপাশ থেকে গাড়ির হর্নের হালকা আওয়াজ আসছে। রিধিমার মনে হচ্ছে সময়টা যদি এখানেই থেমে যেতো। আকাশের দিকে তাকিয়ে শ্বাস নিয়ে নিচে নামতে হবে ভেবে দরজার দিকে পা বাড়ায় রিধিমা।

চলবে ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here