#শেষ_বিকালের_আলো (৯ম পর্ব)
অরণ্য দরজা খুলতেই দেখলো রাহেলা খালা দাঁড়িয়ে আছে। অরণ্য যে আশা করে দরজাটা খুললো রাহেলা খালা তার ধারে কাছেও নেই।
রাহেলা খালা এই বাসার সাহায্যকারী। সকাল বেলায় এসে অবনীর সাথে কাজ গুছিয়ে দিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে রাহেলা খালাকে সন্ধ্যায়ও আসতে দেখতো অরণ্য।
কেন সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে আসতো অরণ্য এসব ব্যাপারে তেমন কিছুই জানতো না। কখনও অবনীর কাছে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করেনি।
রাহেলা খালা: ভাইয়া আফায় কই? সকাল বেলা দরজায় তালা দেখলাম! আফায় তো কোন সময় আমার কাছে কিছু না কইয়া কুথাও যায়না!
অরণ্যর খুবই বিরক্ত লাগছে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে! অরণ্য রাহেলা খালাকে উত্তর না দিয়ে উলটা প্রশ্ন করলো,তুমি এখন এসেছো কেন খালা?
রাহেলা খালা: আফায় না থাকলে যে আমার কি অইতো! আফারে না দেখলে পরানডার মধ্যে যেন কেমন করে!
আফায় না থাকলে রাহেলা খালার কি হইতো তা অরণ্যের মোটেও শুনতে মন চাচ্ছেনা।অরণ্য রাহেলা খালাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,তোমার আফা আসলে তোমাকে জানানো হবে এই বলে দরজা বন্ধ করে দিলো।
অরণ্য ধপ করে সোফায় গিয়ে বসে পরলো,বসে বসে ভাবতে লাগলো এই অবনীটা সবাইকে কেমন যেন বশ করে ফেলে।যেখানে যেতো সেখানেই সবাই অবনীর ভক্ত হয়ে যেতো।
অবনীর মধ্যে আশ্চর্য একটা ক্ষমতা ছিলো। সবাই খুব দ্রুতই অবনীকে বিশ্বাস করা শুরু করতো।
অরণ্য নিজেও তার ব্যতিক্রম ছিলোনা। অরণ্য নিজের থেকেও বেশি অবনীকে বিশ্বাস করতো কিন্তু অবনী এমন একটা কাজ করতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবেনি।
অরণ্য রিমোট দিয়ে চ্যানেল ঘুরাচ্ছে এলোমেলো। হঠাৎ কার্টুনের চ্যানেলে এসে থেমে গেলো।
অরণ্য টিভি দেখতে গেলেই লিনিয়া বেবি অনেক বিরক্ত করতো। সারাক্ষণ “কার্টুন দাও বাবা,কার্টুন দাও বাবা করেই যেতো।”
অরণ্য তখন অবনীকে ডাকতো…বিরক্ত হয়ে অবনীকে লিনিয়াকে নিয়ে যেতে বলতো ” সারাদিন পর বাসায় এসে কে একটু রিলাক্স ও করতে পারবো না অবনী” কি করো তুমি! ওকে নিয়ে যাও।
অবনী লিনিয়াকে নিয়ে যেত এসে…লিনসা আমার পাশে বসে আমি যা দেখতাম তাই দেখতো চুপচাপ কিছু বলতো না,যদি আবার লিনসাকেও চলে যেতে বলি তাই!
অরণ্যের এখন খুব কষ্ট লাগছে ভেবে যে বাচ্চাদের সাথে সে এমন করতো!
মাঝে মধ্যেই অরণ্য দেখতো লিনিয়া অবনীকে অসম্ভব রকম বিরক্ত করছে,তাতে অরণ্য বিরক্ত হয়ে যেতো।অরণ্য রেগে লিনিয়াকে কিছু বলতে গেলে অবনী বলতো,” তোমাকে তো বিরক্ত করছেনা অরণ্য,যাও তাহলে নিজের কাজে মন দাও”
অরণ্য মেজাজ দেখিয়ে চলে আসতো,বাচ্চাদের চেঁচামেঁচি তার সহ্য হতোনা। অবনীর যে কি পরিমাণ ধৈর্য তা মনে হয় অবনী নিজেও জানেনা।
বাসাটা এখন একদম পিনপতন নিরব। অরণ্যের কত ভালো থাকা উচিৎ। শান্তিতে টিভি দেখা উচিৎ। অফিসের কাজ করা উচিৎ।
নাহ্… অরণ্য কিছুতেই তার মনো:সংযোগ ঘটাতে পারছেনা।
অরণ্য এখন বসে বসে কার্টুন দেখছে এটা দেখলে হয়তো অবনী এখন হার্ট ফেইল করে ফেলতো।
অরণ্যের এখন বসে বসে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।অরণ্য এখন কি করবে একা একা! কিছুই মাথায় আসছে না। অরণ্য মনে মনে ভাবলো…অবনীকে একবার পাই “ওর খবর আছে”
২ টা দিন চলে যাচ্ছে অবনী আর বাচ্চাদের কোন খোঁজ পেলোনা অরণ্য। ওদের আবার কোন বিপদ হলো নাতো! এটা ভাবতেই অরণ্যের মাথার মধ্যে প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেলো। অরণ্য মাথা চেপে ধরে সোফায় শুয়ে পরলো।
প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে মাথা চেপে ধরে উঠে কোনরকম ১ টা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আবার শুয়ে পরলো সোফার উপরে।
ফোনের শব্দে অরণ্যের ঘুম ভাঙলো। অরণ্যের মাথা ব্যথা এখনও কিছুটা আছে।একদম চলে যায়নি।মোবাইলে অনেক ফোন কল এসেছিলো কিন্তু অরণ্য কিছুই টের পায়নি।
ঘড়িতে সময় দেখলো ৮ টা। অরণ্যের পেট ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করছে।গ্যাস্ট্রিক এর ব্যথা শুরু হয়েছে।
এই সময়ে অবনী কত নাস্তা অরণ্যকে দিতো।অফিসের লাঞ্চ বক্স রেডি করে দিতো।অরণ্যকে জোর করে খাইয়েও দিতো অনেকসময়।অরণ্য রেগে যেতো মাঝে মাঝে।
এত আদিখ্যেতা সবসময় ভালো লাগেনা অবনী…এমন টাইপ কত কি বলতো কিন্তু অবনী সাময়িক মন খারাপ করলেও ধরে রাখতো না।
অরণ্য কি তাহলে ভুল ভেবে এসেছে! এগুলো কি অবনী মনে মনে রাখতো! অবনীকে তাহলে কি অরণ্য ভুল চিনে এসেছে!
অবনী যদি খুব রেগে যেত এমন ব্যবহারে তাহলে হয়তো অরণ্য এমন ব্যবহার বার বার করতো না। কিন্তু অবনী রাগতোনা বলেই অরণ্য একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে যেতো সবসময়।
অরণ্য ফ্রেশ হয়ে বাইরে চলে গেলো। একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে কোনরকম কিছু গলধ:করণ করে নিলো।
এরপর থানার দিকে হাঁটতে লাগলো। থানায় গিয়ে অবনী আর বাচ্চাদের বিবরণ ও অবনীর ফোন নাম্বার দিয়ে একটা মিসিং ডায়েরি করে আসলো।
অনেক জরুরিভাবে ফোন ট্রাকিং করতে বলে আসলো।খোঁজ পাওয়ার সাথে সাথে যাতে অরণ্যকে জানায় এই বলে অরণ্য থানা থেকে বের হয়ে এলো।
অরণ্যের আসলে এ ছাড়া কিছু করার ছিলোনা। অবনীর ফোনে এর মধ্যে অনেকবার কল করেছে কিন্তু ফোন বন্ধ পাচ্ছে।কোনরকম একবার অবনীর ফোন ওপেন পেলেই অবনী কোথায় আছে তা ট্র্যাক করা যাবে এখন।
অরণ্যের এখন একটু ভালো বোধ হচ্ছে। অরণ্য কাউকে এই ঘটনা শেয়ার করেনি তাই তার এলোমেলো মাথায় কোন বুদ্ধি আসছিলো না।
গতকাল রাতে চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে “সি আই ডি” প্রোগ্রামে মোবাইল ট্র্যাকিং এর একটা অংশ সামনে আসায় রাতেই চিন্তা করে রেখেছিলো সকালে থানায় যাবে জিডি করতে।
অরণ্য বাসায় ফিরতে ফিরতে তার চোখ এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কোথাও যদি দেখতে পেতো! মনে মনে ভাবছিলো…অবনীর ফোন যদি আর কখনো ওপেন না করে তাহলে তো তাকে ট্র্যাক করেও পাওয়া যাবেনা।
এভাবে ৩ টা জ্বলজ্যান্ত মানুষ চোখর সামনে থেকে উধাও হয়ে গেলো।যাদের দেখে অরণ্যের দিন শুরু হতো আবার দিন শেষ হতো।
অরণ্য বাসায় আসলো। দুপুর হয়ে গিয়েছে,ভুলেই গিয়েছে অবনী বাসায় নেই মানে কোন খাওয়ার ব্যবস্থাও নেই। অরণ্য শাওয়ার নিলো।
ফ্রিজ খুলে একটা ডিম নিলো। ডিম সেদ্ধ দিলো। তারপর ছাদে চলে গেলো।
বৃষ্টি হয় প্রতিদিন তাই বাগানে ২ দিনেই বেশ আগাছা জন্মে গিয়েছে।অরণ্য বাগানের আগাছা পরিস্কার করতে লাগলো। অবনী যাতে এসে তার বাগান ফ্রেশ দেখতে পায়।
শসা গাছগুলোতে অনেক শসা ধরেছে। অরণ্য ২ টা কচি শসা ছিঁড়লো। লেবু গাছ থেকে ১ টা লেবু নিলো।কিছু পুদিনাপাতা আর লেটুসপাতা নিলো। অবনী বাগানে প্রয়োজনীয় সবকিছু রাখার চেস্টা করেছে।যা একবারে পারেনি তা বার বার চেষ্টা করে সফল হয়েছে।
ছাদ থেকে নিচে নেমে সবকিছু ধুয়ে কেটে নিলো।ডিম কেটে নিলো তারপর বিটলবণ, একটু চিনি,একটু গোলমরিচের গুঁড়ো,লেবুর রস আর মেয়নেজ নিয়ে স্যালাদ বানালো।
অবনী বিভিন্নরকম স্যালাদ বানিয়ে অরণ্যকে দিতো।অরণ্য বেশ মজা করে খেতো।সবচেয়ে সহজ স্যালাদের রেসিপি এটা যেটা অরণ্য জানে।
অরণ্য বাসার মধ্যে ঘুরে ঘুরে সব দেখতে লাগলো আর স্মৃতিচারণ করতে লাগলো যেন এই বাসায় সে প্রথম এসেছে।
এই ২ দিনে অরণ্য বাসায় যতটুকু সময় দিয়েছে তা মনে হয় বিগত ৬ মাসেও দেয়নি।
অবনী প্রায়ই আক্ষেপ করে বলতো, অরণ্য চলো একসাথে বিকালে ছাদে গিয়ে বসে নাস্তা করি। কিন্তু অরণ্যের হাতে সময় থাকতোনা।
কিন্তু এখন অবনী নেই তারপরও অরণ্যের বিকালবেলায় আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে মন চাচ্ছেনা। জীবন কি এমনি আসলে ” দূরে থাকলে পোড়ে মন আর কাছে থাকলে ঠনঠন ”
অরণ্য অফিস থেকে ১ সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে। এই ১ সপ্তাহের ১ টি দিনও অরণ্যের ঘুম ভালো হয়নি। বাইরে শুধু বের হয়েছে খাওয়ার জন্য।
অরণ্য একটা সময় বাসার কাজ, রান্না ছাড়াও অনেক কিছুই অবনীর সাথে সাথে করতো। লিনসা হওয়ার পর থেকে আর অবনীর সাথে হাতে হাতে আর আগের মত কাজ করে দেয়া হতোনা..যখন বেশি দরকার ছিলো তখনই অরণ্য বাইরে বেশি ব্যস্ত হয়ে পরে।
অরণ্য আর অবনী একই বাসায় থাকলেও আসলে তাদের কাজ ছাড়া তেমন কোন কথাই হতোনা বা সময় পেতোনা।
বাসার সবকিছুতেই যেন অবনী চুইংগামের মত লেগে আছে।যেখানেই অরণ্য হাত দেয় সেখানেই অবনীর ছোঁয়া পায়।
এই ১ সপ্তাহে অরণ্যের খাওয়া-দাওয়া,ঘুম,গোসল অফিসের কাজ,বন্ধুদের আড্ডা কোন কিছুই ঠিকমত হয়নি। অরণ্য যে অবনীকে ছাড়া শারিরীক ভাবে অচল শুধু তাই নয় মনের দিক দিয়েও অচল এটা এই ১ সপ্তাহে অরণ্য হারে হারে টের পেয়েছে।
অরণ্য কোনভাবেই এটা ভাবতে পারছেনা যে সে অবনীকে ছাড়া আর চলতে পারছেনা। ধীরে ধীরে কাছের অনেকেই জেনে যাচ্ছে অবনী আর বাচ্চাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে…
অরণ্য ভাবছে, কি অদ্ভুত জীবন! যেসব কাজ অরণ্য জীবনের অপরিহার্য ভেবে এসেছে,যা না করলেই নয় সেই কাজগুলো ছাড়াই অরণ্য ১ সপ্তাহের বেশি সময় কাটিয়ে ফেলেছে।তাতে তেমন কিছু হয়নি।
এই ১ সপ্তাহের মধ্যে থানা থেকে কোন ফোন আসেনি…অরণ্য অধীর আগ্রহে এই ফোনের জন্য অপেক্ষা করেছে। পরিচিত রাস্তাঘাট, বাসা যেখানে অবনী আর বাচ্চাদের যাতায়াত ছিলো সেসব জায়গায় খুঁজে বেড়িয়েছে তাদের! কিন্তু কোথাও অবনীদের দেখা নেই।
অরণ্য কি এত বেশি অপরাধ করে ফেলেছিলো যে অবনী তাকে একটা সুযোগ ও দিতে পারেনি। এভাবে কোন কিছু না বলেই চলে গেলো…
অবনীর উপরে অরণ্যের রাগ ক্ষোভ দিন দিন গলতে গলতে পানি হয়ে গিয়েছে । যত দিন গিয়েছে অরণ্যের নিজেকে অস্থির পাগলের মত লেগেছে।১ সপ্তাহকে তার কাছে ১ যুগ মনে হচ্ছে…
অরণ্য ভেবেই চলেছে…অবনী কিভাবে অরণ্যকে রেখে এভাবে চলে গেল! তাহলে কি অবনী অরণ্যকে এখন আর ভালোবাসেনা!অরণ্য ক্রেজি হয়ে উঠলো।
অরণ্যের এই প্রশ্নের উত্তর পেতেই হবে…এই উত্তর পেতে হলে অবনীকে তার চাই…যে করেই হোক চাই…আজ অথবা কাল…চাইই…চাই…
চলবে…
লেখনী: #নুসু