স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। #দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-২৯)

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি।
#দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-২৯)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

রাত্রী প্রহর শেষে প্রভাতে নেমেছে। স্নিগ্ধ, নিস্তব্ধ, ঘুমন্ত সারা শহর। কোথাও কোলাহল নেই। নিস্তব্ধতা আর আঁধারতায় ঢাকা আঞ্জুমান ভিলার ভেতরকার প্রকৃতি। মনিব চাকর সবাই ঘুমে বিভোর। ঘুম নেই কেবল লায়লার চোখে। অসাড় বসে আছেন খাটের কিনারায়। বিমর্ষ চেহারা, কাতরতায় মাখা চোখ। উদাস হয়ে চেয়ে আছেন বাইরের দিকে। বেডসাইড রাখা ফোন। বাইরের থেকে চোখ ফিরিয়ে খানিক বাদে ফোন হাতে নিচ্ছেন। একটা ভিডিও প্লে করে মিনিট খানেক সময় ফোনের পর্দায় স্থির করছেন। দেখা শেষ হতেই ফোন রেখে দিচ্ছেন। ভেবেছেন আর দেখবেন না, কিন্তু না কিয়ৎক্ষণ বাদে আবার দেখছেন। বিগত কয়েকঘন্টায় এই নিয়ে ২০বারের উপর দেখা হয়েছে ভিডিওটা। তবুও তার দেখার শেষ হচ্ছে না। কানে বেজে চলেছে কথাগুলো, চোখে ভাসছে চেহারা, বুক কাঁপছে। অশান্ত হচ্ছে মন। ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দিচ্ছে তার ভেতরকার মরে যাওয়া মাতৃত্ব।

মায়েরা যতই নিষ্ঠুর হন, সন্তান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। গর্ভে ধারণের সময় জন্ম নেয়া টানটা কখনো না কখনো বেরিয়েই আসে। বেলায়, অবেলায় আনমনে। সেই ক্ষণে তারা হাজার চেষ্টার পরও কঠোর হতে পারেন না। লায়লা আঞ্জুমান এই ক্ষণে এসে সেই টানটা অনুভব করলেন। মেজো মেয়ের প্রতি জন্মে থাকা রাগের পাহাড় মেয়েকে নিয়ে ভাবতে দেয়নি। এতগুলো মাসেও মেয়েটাকে ভাবনায় আনেন নি। মনে জন্মে থাকা রাগ তাক্র কঠোর করে রেখেছিল। মেয়ের কোথায় বিয়ে হলো, বিয়ের পর কেমন আছে, আছে না মরেছে কিছুই জানতে চাননি। টানই অনুভব করেন নি। গতকাল জায়ফার পাঠানো ভিডিওটা দেখে তার শিকলে বাধা মনটা আকস্মিক নড়ে উঠল। মাতৃত্বের মমতা উঁকি দিল মনে। ভীষণ টান অনুভব করলেন। মেয়ে যখন তাকে ডাকল তখন বুক ভেঙে কান্না এলো। মেয়েকে বুকে টানতে ইচ্ছে হলো । এতকালের বিতৃষ্ণা যেন উবে গেল সেই ক্ষণে। তার জন্য মেয়ের কাতরতা দেখে তার বোধগম্য হলো তিনি মাতৃত্বের সংজ্ঞা ধরে রাখতে পারেন নি, এতকালের সব যুক্তি তুচ্ছ মনে হলো। মুশরাফার বলা ‘মা,আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ কথাটা যেন তাকে মনে করিয়ে দিল, মুশরাফা তার মেয়ে।
ইচ্ছে হলো ছুটে যেতে। কিন্তু এতকাল ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা জড়তা তা করতে দেয়নি। নিজমনেই গুমরে গেলেন তিনি। ভেবে নিলেন সময়ের সাথে সাথে মেয়েটা স্মরণ থেকে চলে যাবে। কিন্তু নাহ, গেল না। বরং ঝেঁকে বসল। বড়ন্ত সময়ের সাথে সাথে মেয়ের স্মরণ বাড়ল, স্মৃতি ভাসল। ছোটো বেলার সব স্মৃতি, তার আদরের ছোট্টো রাফা যেন এসে আবার মায়ের বুকে বসল। রাতে ঘুম হলো না, চিন্তায় কাতরতায়। এতগুলো বছর পর আজ মুশরাফার মা বোধ হলো নিজেকে, চটপট করতে লাগল মাতৃত্ব। চিন্তা, কাতরতার মাঝে রাত পোহাল। টেরটি পেলেন না তিনি। সেই সাথে তার মস্তিষ্ক জানান দিল, এই ক্ষণে মেয়েটাকে না দেখলেই নয়। ঘড়িতে তখন সকাল ৬টা ২০মিনিট। ডায়াল করলেন ছোটো মেয়ের নাম্বারে।

ফোন বেজে কেটে গেল, জায়ফা তুলল না। আবার ডায়াল করলেন, এবারও তুলল না। মেয়েটার ঘুম একটু বেশি ভারি, ঘুমালে আর খবর থাকে না। কপালে বিরক্তির ভাজ ফেলে ডায়াল করলেন ছেলের নাম্বারে। প্রথমবার রিসিভ হলো না, তার কপালে বিরক্তির ভাজ গাঢ় হলো। রাগ নিয়ে বললেন, ‘দরকারের সময় এই ছেলেমেয়েগুলোকে পাওয়া যায়না।’
লাগাতার ডায়াল করে গেলেন। একবার, দু’বার, তিনবার, চারবার, পাঁচবার। ষষ্ঠতম কলে পাওয়া গেল তারিফকে। ঘুমজড়ানো স্বরে ‘হ্যালো ‘ বলল। লায়লা উদ্ধিগ্ন হয়ে বললেন, ‘তোরা এখন কোন ফ্ল্যাটে আছিস? বল, আমি আসছি।’

তারিফের ঘুম হালকা হলো। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে মম? ইজ এভ্রিথিং ওকে? ‘
‘সব ঠিক আছে। তুই বল কোথায় আছিস তোরা?’
‘আমরা তো সিলেট। ‘
‘সিলেট! কবে, কখন আর কেন গিয়েছিস? আমাকে বলিস নি কেন?’ এক নাগাড়ে প্রশ্ন করলেন লায়লা।
তারিফ বলল,
‘ উইদাউট প্ল্যানে ট্রিপে এসেছি। রাতের ফ্লাইটে এসেছি। জানানোর সময় হয়নি।’
‘ কে কে গিয়েছিস?’
‘আমরা ভাইবোন। মম এত ভোরে কল দিলে কেন? ঘুমাও নি রাতে?’

লায়লা উত্তর দিলেন না। নিশ্চুপ রইলেন। খানিক বাদে রয়ে সয়ে বললেন, ‘ভিডিও কল দে। আমি দেখি তোদের।’
‘ কী দেখবে মম? আমি আর জায়ফা দুজনই ঘুমাচ্ছি। উঠে কল দিব, তখন কথা বলে নিও। এখন ঘুমাতে দাও। রাখি।’

‘খবরদার রাখবি না! ‘চোখ গরম করলেন লায়লা। তারিফ একরাশ বিরক্ত নিয়ে বলল, ‘ সকাল সকাল কী শুরু করেছো মা? রাতে আসা যাওয়ায় ঘুম হয়নি। সবাই টায়ার্ড হয়ে ঘুমাচ্ছে।’

‘ওই মেয়েটাও ঘুমাচ্ছে?’ আকস্মিক বললেন লায়লা।
তারিফ চোখ বন্ধ করে হাসল। এতক্ষণে মায়ের কল দেবার কারণ বোধগম্য হলো তার। মা তবে মুশির জন্য ভাবছেন! আনন্দ হলো তারিফের। আনন্দে ঘুম উবে গেল চোখ থেকে। হাসিমুখে বলল, ‘ কোন মেয়ের কথা বলছো মম?’

লায়লা নামটা উচ্চারণ করবার আগে সময় নিলেন। কতদিন বাদে আবার আওড়াতে গিয়ে স্বর কাঁপল, ‘রা..ফা?’

তারিফের ঘুম জড়ানো ফুলো ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত হলো। মনে হলো মা ও তার দিশায় চলছে। মুশি এবার তার মাকে ও পেতে যাচ্ছে। খুশিতে আটখানা হলো তারিফ। অডিও কল কেটে ভিডিও কল দিল। তৎক্ষনাৎ রিসিভ করলেন লায়লা। তারিফ মায়ের ক্লান্ত, কাতর মুখখানা পরখ করল বিস্মিত চোখে। মাতৃত্বের মমতায় কাতর লায়লা। তারিফ অজানার ভান করে বলল, ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড মম? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’
লায়লা কাতর চোখে চাইলেন ছেলের পানে। কোমল গলায় বললেন, ‘ ওকে একটু দেখাবি?’

‘তুমি কি মুশিকে মিস করছো, মম?’ মায়ের চোখে চোখ রাখল তারিফ। লায়লা উত্তর দিলেন না, কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারিফ হাসল। বলল,
‘ ওয়েট, আমি গিয়ে দেখছি ।’

তারিফ রিসোর্টে দুটো কাপল বেড এবং একটি সিংগেল বেড রুমের একটা ফুল কটেজ নিয়েছে। ওর সামনের রুমটাতেই জায়ফা মুশরাফা ঘুমিয়েছে। তারিফ উঠে রুম থেকে বের হলো। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বোনদের রুমের দিকে। তার ভাবনা দুই বোন ঘুমিয়ে আছে। চুপিচুপি যাবে, দেখে আবার ফিরে আসবে। নব ঘুরাতেই দরজা খুলে গেল। কটেজের মেইন ডোর লক বিধায় ওরা দরজা লক করেনি। তারিফ ফোন কেটে দিল। ভেতরে চোখ বুলাল। জায়ফা বেডে ঘুমাচ্ছে। মুশরাফা জানালার পাশে ডিভানে বসে আছে। হাতে কুরআন ধরা। গুনগুন করে চমৎকার সুরে কুরআন পড়ছে। সাদা একটা হিজাবে মুখ ঢাকা, আবছা আলোয় যেন নুরানি ভাসছে মুখ থেকে। কী স্নিগ্ধ লাগছে ওর বোনটাকে! তারিফ মুগ্ধ হয়ে দেখল বোনকে। কুরআন শুনল। কিয়ৎক্ষণ বাদে নিঃশব্দে দরজা চেপে বেরিয়ে এলো। আবার ডায়াল করল মায়ের নাম্বারে। আফসোসের ভান করে বলল, ‘ওদের রুমের ডোর লক, মম। ঘুমাচ্ছে বোধহয়। যেতে পারিনি।’

লায়লা হতাশার শ্বাস ফেললেন, ‘কখন উঠবে ওরা?’
‘ রাতে দেরি করে ঘুমিয়েছে, বেলা হবে উঠতে।’

লায়লা মুখ মলিন হলো। তারিফ রুমে যেতে যেতে ডাকল, ‘মম?’
‘হু!’ আনমনে জবাব দিল লায়লা। তারিফ গম্ভীর মুখে বলল,
‘তুমি আমার মুশিটাকে একটু বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। এত কষ্ট ও ডিজার্ভ করে না। ফ্রি হলে বসে ভেবে দেখো, ওর গায়ে কতটা ঘা বসিয়েছো তুমি আর সাফা। ‘

লায়লা আঞ্জুমান উদাস হলেন। তারিফ আবার বলল, ‘ আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি, বিয়ের পর জাওয়াদ আর মুশির শ্বাশুড়িকে ও মুশির এগেইনস্টে ছিল। ভাবতে পারো, ওর জীবন কতটা কঠিন ছিল তখন? একটা দুঃখের শ্বাস ফেলবার মতো কাউকে পায়নি ও। কীভাবে সহ্য করেছে আমার বোনটা! আমার ভেবেই গায়ে কাটা দিচ্ছে। মম যদি তুমি ওর আপন হতে তবে অন্তত ওর একটা ছায়া হতো। মা হয়ে তুমি কিভাবে আপন হলে না মম?’

বিয়ের পর মুশরাফা জাওয়াদের সাথে ওদের বাসায় যাবার সময় জাওয়াদের মুখে মাস্ক আর মুশরাফার জন্য বিরক্তি বিতৃষ্ণা বেশ ঠাহর করেছিলেন লায়লা। সেই ক্ষণে তার ধারণা হয়ে গিয়েছিল, জাওয়াদ ওকে মেনে নেয়নি। তাই অবাক হলো না। কিন্তু শ্বাশুড়ির কথা শুনে অবাকই হলো। মেয়ের ক্ষত আন্দাজ করলেন। বুক কাঁপল। অনুতাপ উঁকি দিল। মা হয়ে কী করলেন তিনি! কিভাবে পারলেন! মায়ের অনুতাপ মাখা মুখ দেখে হাই তুলল তারিফ। বলল,
‘ ওরা উঠল ফোন দিব। এখন রাখছি মম।’

মাকে ভাবনায় রেখে ফোন কাটল। বিড়বিড় করে বলল, ‘মম, আমি চাইছি না, তুমি ওকে এত তাড়াতাড়ি পাও। অনায়েসে পাওয়া কিছু মূল্য থাকে না। আমি চাই তুমি কষ্ট করেই পাও ওকে। তুমি আমাকে মুশির সাথে যা করেছো তার জন্য তোমাকে অনুতপ্ত হতে হবে আমার মতো, বা আমার চেয়েও বেশি। তুমি ওর দেখা পাবে না এখন। শুধু অতীত স্মৃতি আওড়াবে। রিগ্রেট ফিল করবে, পস্তাবে। তারপর পাবে ওকে। ‘

চলবে….

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here