স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-২৮)

স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। (পর্ব-২৮)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

সোনালী রোদ্দুরে ঝলমলে করছে সারাঘর। দেয়ালে টাঙানো ফটোফ্রেমের মুখগুলো প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে সেই আলোয়। স্বচ্ছ কাচের ভেতর ফুটে ওঠেছে মা, বাবা, দুই মেয়ে, এক ছেলের পরিবারটার ধারণ করা চমৎকার মুহুর্ত হাসছে প্রতিটা মুখ। মা বাবা আগলে রেখেছে তার তিন সন্তানকে, সুখ যেন ঠিকরে পড়ছে প্রতিটা চোখে। রোদ্দুরে গা ভাসিয়ে ফ্রেমের সামনে এসে দাঁড়াল মুশরাফা। পরিবারটা তার হলেও সে নেই ছবিতে। ছবির মতো মানুষগুলোর জীবনে ও সে নেই। মুশরাফা স্থির চোখে তাকিয়ে রইল বাবার চোখে, মায়ের মুখের দিকে, জায়ফাকে আগলে রাখা সাফার হাতের দিকে। মাকে হাসপাতালে দেখলেও বাবাকে সেই যে বিয়ের পর থেকে আর দেখেনি। কতগুলো মাস কেটে গেছে! মুশরাফা বাবার মুখপানে চেয়ে রইল। তার গম্ভীর বাবা প্রাণবন্ত হাসছে। এই হাসিটা তার উদ্দেশ্যে আসেনি কতকাল! মুশরাফা চাপা শ্বাস ফেলল। ছবির এই চমৎকার মুহুর্তে তারও থাকবার ইচ্ছে হলো। বাবা মায়ের কাছে দাঁড়ানার ইচ্ছে হলো, স্নেহ নেবার শখ জাগল। মাকে বলতে ইচ্ছে হলো, মা একটাবার আমায় ‘রাফা’ বলে ডাকো না? কতকাল ডাকো না তুমি? বাবাকে বলতে ইচ্ছে হলো, বাবা আমার মাথায় হাতটা রাখো না সেই ছোটোবেলার মতো। বোনকে বলতে ইচ্ছে হলো, সাফাপু আমার চুলটা বেধে দাও না, সেই ছোটোবেলার মতো। সবাইকে বলতে ইচ্ছে হলো, আমাকে তোমাদের সঙ্গে নাও না? সবাই আমার কাছে আসো না? বলতে পারল না। তার গলা কাঁপল, মলিনতা ভীড় জমাল মুখে, কাতরতা ভর করল চোখে। চোখ জ্বলল জলে। কাঁপা হাত রাখল ফ্রেমের বুকে। আলতো করে ছুঁলো বাবা, মা, বোনকে। বিড়বিড় করল,
‘ কতদিন তোমরা আমাকে ডাকো না। আমি তোমাদের কতটা মনে করি, যদি তোমরা জানতে! ‘

মুশরাফার স্বর কেঁপে উঠল। আর বলতে পারল না। দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল গালে। ঝাপসা চোখে চেয়ে রইল বাবার মায়ের দিকে। পলক পড়ল না। হাত সরল না। একবার, বারবার ছুঁয়ে দিল বাবা মাকে। বাবা মায়ের স্নেহবঞ্চিত একটা স্বর ডাকল, ‘
‘মা? বাবা? আমি তোমাদের ভীষণ ভালোবাসি।’

মুশরাফা যখন তারিফের ঘরে এসেছিল তখন কেউ রুমে ছিল না। তারিফ কোল্ড ড্রিংকস আনতে বাইরে গিয়েছিল। জায়ফা ফোনে টিভি দেখছিল। মুশরাফা রুম দেখে ফিরে যাবার কথা থাকলেও বাবা মাকে দেখে আটকে গেল। এতটাই মত্ত হয়ে গেল যে পেছনে তার দুইভাইবোন এসে দাঁড়িয়েছে সেই খেয়াল। বাসায় ফিরেই বোনকে খুঁজল তারিফ। না দেখে জায়ফা ও উঠে এলো। এ রুম ও রুম দেখে তারিফের রুমের দরজায় আসতেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য চোখে পড়ল। চমকাল, থামকাল ভাইবোন। মুশরাফার কাতরতায় বুক কাঁপল দুজনের। জায়ফা তো শব্দহীন হয়ে কেঁদেই দিল, দাম্ভিক তারিফের চোখেও পানি জমল। মুশরাফার করুণ চোখের চাহনি যে কারো হৃদয় নাড়িয়ে দিতে সক্ষম।
জায়ফা তড়িৎ ফোন তুলে ক্যামরা অন করল। ভিডিওতে ধারণ করল স্নেহ বঞ্চিত এক সন্তানের ভয়ংকর, করুণ, কাতর চেহারা! হৃদয়বিদারক কথা, বাবা, মা, বোনকে ছুঁয়ে দেয়াটা, চোখের হাজার আক্ষেপ। মুশরাফা টেরটি পেল না। জায়ফা নিঃশব্দে ক্যাপচার করে নিল সবটা। মুশরাফা যখন শেষ কথাটা বলল, তখন তারিফ চোখ মুখ খিঁচে ফেলল। কী গম্ভীর ক্ষত আদরের বোনটির ভেতর! জায়ফা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রাখছে। ব্যর্থ হয়ে অন্যরুমে চলে গেল। বোনের কাতরতা এই প্রথম চোখে পড়ল তার। বুকে তোলপাড় চলল। ঝাপসা চোখে চেয়েই সেই ছবিটা পাঠাল ফ্যামিলি গ্রুপে। যেখানে বাবা মা, সাফা, সবাই আছে। কাঁপা হাতে লিখল,
‘ মম, পাপা, আপ্পি দেখো আপি তোমাদের কতটা মিস করছে!’

তারিফ চলে গেল। বোনকে বুঝতে দিল না, তার উপস্থিতি। জাওয়াদ থেকে শুনেছে, মেয়েটা নিজের দুর্বলতা আড়ালে রাখতেই পছন্দ করে। থাকুক তবে আড়ালে। পুর্ণতারা কেবল সামনে এলেই হবে। সে যেতে যেতে বিড়বিড় করল, ‘মুশি, সেই দিন দূরে নয় যেদিন ছবির মানুষগুলো এবং ছবির মুহুর্তটা তোর হবে।’

নিজেকে স্বাভাবিক করে ডাকল, ‘মুশি? কোথায় তুই?’
মুশরাফা হুঁশ ফিরল। তড়িৎ আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে ফেলল, চোখ মুছে ফেলল। কিছুসময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বের হলো। স্মিত হেসে বলল,
‘তোমার বাসা ঘুরে দেখছিলাম। মা- শা-আল্লাহ সুন্দর সাজিয়েছো!’

তারিফ আর জায়ফা বিস্মিত চোখে চেয়ে দেখল বোনের দুঃখ ঢেকে রেখে স্বাভাবিক হওয়াটা। যেন কিছুই হয়নি। শান্ত, স্বাভাবিক লাগছে ওকে। জায়ফা তৎক্ষনাৎ মনে পড়ল একটা কথা, ‘ হাসতে হুয়ি চেহরোকে পিছে টুটে হুয়ি দিল হোতিহে। তারিফ কোমল বোনের কাছে এলো। আলতোভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। স্নেহ নিয়ে বলল,
‘অলমোস্ট দুটো বাজে। লাঞ্চ সার্ভ করছি। আয়, বস। ‘

কথাটা সাধারণ। আদেশের, আদরের নয়। কিন্তু তারিফ ভীষণ আদর নিয়ে বলল। তারিফের কথার ধরণ দেখে মুশরাফার মনে হলো, ও রাগ করেছে। তারিফ ওর রাগ ভাঙিয়ে খাওয়ার অনুরোধ করছে। এই সাধারণ কথায় মাথায় হাত বুলিয়ে, স্নেহের সুরে বলাটা অস্বাভাবিক লাগল মুশরাফার। সে ভ্রু কুঁচকাল। কিন্তু মনের কৌতূহল প্রকাশ করল না। বিনয়, অনুরোধের সাথে বলল,
‘আমি নামাজ পড়ে এসে বসি? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে প্লিজ?’

ওর বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল তারিফ, ‘ আচ্ছা যা। আমি ওয়েট করছি।’

মুশরাফা চলে গেল। কিছুক্ষণ বাদে আবার ফিরে এলো। বসার ঘরে টিভি ছেড়ে বসা ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল, ‘ভাইয়া, জায়নামাজ কোথায়?’

চট করে বোনের দিকে তাকাল তারিফ। মুশরাফার চোখে কৌতূহল দেখে আবার চোখ ফেরাল। টিভির পর্দায় তাকিয়ে চাপা শ্বাস ফেলল। চোখে হতাশার ছায়া নামল। বাসায় জায়নামাজ নেই। ধর্মীয় আচারবিধি পালনে বড্ড উদাসীন তারিফ। ওর ধর্মীয় বিধি পালন বলতে কেবল দুই ইদের নামাজটাই । দুই ইদ ছাড়া মসজিদে পা রাখা হয়না, কালেভদ্রে ও জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়ানো হয়না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জায়নামাজ তার অপ্রয়োজনীয় জিনিসের খাতাতেই পড়ে। কখনো কেনা হয়নি, কিংনা নেয়া হয়নি। বাসায় নেই জায়নামাজ। কাল রাতে মুশরাফার প্রয়োজনীয় জিনিসের লিস্ট করবার সময় জায়নামাজ আনবে ভেবেছিল, কিন্তু সকাল থেকে একা হাতে সব ম্যানেজ করতে গিয়ে আর স্মরণে ছিল না। ওর নিরবতা দেখে মুশরাফার বলল,
‘জায়নামাজ নেই, ভাইয়া!’

তারিফ বিব্রতবোধ করল। নামাজ না পড়লেও মুসলিম হিসেবে একটা জায়নামাজ তার ঘরে থাকা উচিত ছিল। বোনের সামনে লজ্জা পেল তারিফ। নিশ্চুপ রইল কিয়ৎক্ষণ। তারপর বলল,
‘তুই আমাকে দশমিনিট সময় দিতে পারবি, আমি ব্যবস্থা করছি।’

মুশরাফা বিস্মিত হলো না খুব একটা। স্মিত হাসল, ‘তোমার ব্যস্ত হতে হবে। আমি ওড়না বিছিয়ে পড়ে নিচ্ছি।’

মুশরাফা চলে গেল। তারপর তার ফ্রেশ ওড়না মেলে নামাজে দাঁড়াল। তারিফ লজ্জিত হলো। নিজের চোখেই ছোটো হয়ে গেল। তার বাসায় এসে বোন জায়নামাজ না পেয়ে ওড়না বিছিয়ে নামাজ পড়ছে! কী বিব্রতকর পরিস্থিতি!

নামাজ শেষ হতেই মুশরাফা টেবিলে গেল। তখন তারিফ খাবার সার্ভ করছে। টেবিল ভর্তি মুশরাফার পছন্দের খাবারে ভর্তি। মুশরাফা অবাক হলো। ভাইয়ের দিকে তাকাতেই তারিফ চেয়ার টেনে বলল, ‘বস।’

মুশরাফা বসে বলল, ‘ বাহ্! ভাইয়ার তো ঢের গুণ! আমার পাক্কা রাঁধুনি হয়ে গেছে দেখি! ভাবীর কপাল ভালো, আমার ভাইয়ের মতো বর পাবে। ‘ কৌতুক মাখানো ওর কথা।

জায়ফা বোনের পাশে বসে বলল,
‘ তুমি আজ ভাইয়ার যদি সেবা পাচ্ছো, এত সেবা ভাবি, মম কিংবা আমরা কেউই পাইনি। আজ ভাইয়া যত কাজ করেছে তা জীবনে প্রথম করছে, তাও তোমার জন্য। সে হিসেবে কপাল ভাবির নয়, তোমার ভালো। ‘

তারিফ জায়ফার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তারপর মুশরাফার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এগুলো অনলাইনে অর্ডার করেছি জাস্ট। আর কিছুই করিনি। ‘

ভাইয়ের অস্বীকার যাওয়া দেখে জায়ফা পোল খুলল। মুশরাফার কাছ ঘেঁষে ফিসফিস করে বলল, ‘ভাইয়া আজ ঘর ঝাড়ু দিয়েছে, মুছেছে, এঁটো বাসন ধুঁয়েছে, সব ফার্নিচার মুছেছে, আরও কত কী করেছে। সব কিন্তু তোমার জন্য। ভাবি এখানে যতবার আসে নিজে কাজ করে খায়, ভাইয়ার অগোছালো বাসা নিজে গুছিয়ে দিয়ে যায়। ভাইয়া এক গ্লাস পানি ঢেলেও খাওয়ায় নি। সেই ভাইয়া আজ ঘর অবধি মুছেছে। ভাবি আর মম শুনলে জ্ঞান হারাবে। তোমার ভাগ্য থেকে আমার ঈর্ষা হচ্ছে আপি।’

তারিফ বরাবরই অলস প্রকৃতির ছেলে। সব কাজ মেইডদের দিয়ে করানোর স্বভাব। সেই গল্প অজানা নয় মুশরাফার। তবে এখানে এসে ভেবেছিল সেই গল্প বদলে গেছে। কিন্তু এই ক্ষণে এসে ধরতে পারল ভাই কেবল তার জন্যই সদ্য সেই গল্প বদলে দিয়েছে। মুশরাফার ভীষণ আনন্দ লাগল। নিজেকে ভীষণ বিশেষ হিসেবে অনুভব করল। স্মিত হাসল সে। তারিফ বলল,
‘তোর জায়নামাজের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আর নামাজ পড়তে অসুবিধা হবে না।’

মুশরাফা কিয়ৎক্ষণ চুপ রইল। তারপর বলল, ‘ তোমার নিজের জন্য ও একটা জায়নামাজের ব্যবস্থা করা উচিত ভাইয়া।’

তারিফ ধীর স্বরে বলল, ‘নামাজ পড়া হয়না আমার।’
‘আমার মনে হয় তোমার পড়া উচিত।’
‘কেন?’
‘ আত্মিক শান্তির জন্য। নামাজ মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। তোমার পাপ যত বাড়বে, মনের শান্তি তত দূরে চলে যাবে। তোমাকে দেখে আমার কেন যেন মনে হয় তুমি বিগত কয়েক বছর ধরেই প্রাস্টেটেড, ডিপ্রেশড। ধরো, তুমি যখন খুব ডিপ্রেশনে থাকো, তখন নামাজ পরে সেজদায় কপাল ঠেকিয়ে আল্লাহর কাছে বলবে। মন থেকে বিশ্বাস করে দোয়া চাইবে। সালাম ফেরানোর পর তুমি মনে ভীষণ শান্তি অনুভব করবে। তোমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ ধীরে বলল মুশরাফা। দুই ভাই বোন শুনল নিশ্চুপ হয়ে। আকস্মিক তারিফ বলল,
‘তুই পেয়েছিলি?’

মুশরাফা হাসল। তাকেই দেখিয়ে বলল,
‘আমি এখন তোমার সাথে বসে লাঞ্চ করছি। এটা এমনি এমনি?’

জায়ফা বলল, ‘কিন্তু এত বছর পর পেলে কেন!’

মুশরাফা আবার হাসল,
‘আল্লাহ তার বান্দাদের পরীক্ষা করেন বিপদে ফেলে। বান্দা যদি ধৈর্য ধরে তার উপর বিশ্বাস অবিচল রাখতে পারে তবে আল্লাহ খুশি হয়ে তার পুরষ্কার দেন। একদিন এত বেশি দেন যে, তা হয়তো ধৈর্য না ধরলে সে পেত না, বা কল্পনা ও করতে পারত না।’

‘ তুমি কী পেয়েছো?’ আবার প্রশ্ন করল জায়ফা। মুশরাফা আবার হাসল। ধীরেই বলল,
‘ তুই একটু আগেই বলেছিস, ভাইয়া আজ আমার যত সেবা করেছে তা এত বছর তুই সাথে থেকেও পাস নি। এতেই বুঝা যায়, আমি একটু বেশিই স্পেশাল হয়ে গেছি এখন। এটা হয়তো তোর মতো সাথে থাকলে পেতাম না। আমি ভাইয়াকে তোর থেকে বেশি পেয়েছি। তা নয় কি ভাইয়া?’

ভাইকে প্রশ্ন করল মুশরাফা। তারিফ উদাস হয়ে ভাবল। এই বোনের জন্য ও কত কী করেছে! এতটা আর কারো জন্য করেনি। এত টান আর কারো জন্য অনুভব করেনি, এমন কি মায়ের জন্য ও না। ভাইয়ের নিরবতা দেখে হাসল মুশরাফা। তারপর বলল,
‘আমার জীবনের সবকিছুই ধৈর্য ধরে অর্জন করা। আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ গুলোও। মামা মামী ছাড়া কেউ আমার জন্য সহজলভ্য ছিল না। ‘
তারিফ বিস্মিত চোখে তাকাল,
‘জাওয়াদ!’

মুশরাফা হাসল, ‘আমার ধৈর্যের প্রতিদান। ‘

তারিফ জাওয়াদকে বোনের ভালোবাসার পাত্র হিসেবেই দেখেছে। বোনের প্রতি এই ছেলেটার কত ভালোবাসা তা নিজেই দেখেছে। জাওয়াদের ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন উঠানোর কথা মাথাতেই আনা যায় নি। কিন্ত এই ক্ষণে যেন প্রশ্ন উঠছে, এই ছেলেও বিরক্ত ছিল মুশরাফার উপর? কিভাবে সম্ভব যেন মানতেই পারল না তারিফ। পরক্ষণেই মনে হলো, বিরক্ত সহ্য করে যদি এত ভালোবাসা পাওয়া যায়, তবে বিরক্তই সুন্দর। মুশরাফা বলল,
‘ভাইয়া, জাওয়াদকে তো তুমি দেখেছো। আমি যদি ভুল না হই,তবে আমার সম্পর্কে ওর মনোভাবের সাথে তুমি পরিচিত। তা তোমার কি মনে হয়, আমি ধৈর্য ধরে ঠকেছি? ‘

তারিফ ধীরে বলল, ‘নাহ। ‘

জায়ফা আবার বলল, ‘ নামাজ পড়লে যদি মনে শান্তি আসে, তবে তোমার মনে এখনো কষ্টের ছায়া কেন?’

‘ধর, কারো হাত খন্ডিত হয়ে গেছে। অসহ্য য/ ন্ত্রণা করছে, এখন সে যদি চায় এখন ঘা ভালো হয়ে আগের মতো হয়ে যাক তাহলে সম্ভব হবে? হবে না, কারণ ঘা হয়ে গেছে। তার হাত চলে গেছে। এই হাত তো আর গজাবে না। রিপ্লেসমেন্ট করলেও আগেরটার মতো হবে না। সব কিছুর একটা প্রসেসিং থাকে। ঘা হলে তোর চিকিৎসা করতে হবে। খণ্ডিত হাতকে এক করে জোড়া করলে তারপর আগের মতো হবে, নয়তো ওভাবেই থাকবে। কারণ হাত গজায় না। শরীরের নখ একটা পড়ে গেলে আবার উঠে, বাড়ে। কিন্তু হাত আর উঠে না। আমার জীবনের সমস্যা গুলোও এমন। মা, বাবা, মানুষগুলো এমন যে যার রিপ্লেসমেন্ট হয় না। তাদের জায়গায় হাজার জন এলেও মা বাবার মতো নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে পারে না। আমার জীবনে আমার বাবা নেই, কিন্তু মামা আর আমার শ্বশুর আছেন। তারা দুজন আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন, আমার জন্মদাতা বাবার থেকেও ও বেশি। তবুও আমি কাতর ওই একজনের জন্যই, কারণ তার সাথে আমার কানেকশন জন্মপূর্ব থেকে। মা বাবা নখের মতো নয়, হাতের মতন। যে আর উঠেনা। স্রষ্টা পদত্ত রূপ নিয়েই অবিচল থাকেন। তাদের অভাব তোমাকে ভুগাবেই। তাদের আমি ভুলতে চাইলে এত কষ্ট পেতে হতো না। কিন্তু আমি ভুলতে চাইনি বলেই কষ্ট পাচ্ছি। ‘

থামল মুশরাফা। তারপর আবার বলা শুরু করল, ‘
আজকালকার ছেলেমেয়েরা সামান্য কিছুতেই হতাশ হতেই নিজের কাছে নিজে হেরে যায়, শান্তি হারায়, নিজের জীবনের ইতি ঘটায়। তোমাদের একটাবার মনে হয়না, আমার জীবনে এত কষ্ট থাকবার পর ও কেন আমি এখনো হতাশ হইনি। আমার কখনোই আত্মহত্যার কথা মাথায় আসেনি। আমার মাঝে এখনো আশা আছে, সাহস আছে। আমি এখনো নিজের চোখে নিজে হারিনি। আমার মনে এখনো প্রশান্তি আছে, আমার চোখের নিচে কালি পড়েনি, আমার ঠোঁটের কোণের হাসি সরে নি। এটা কিভাবে? আমি বলব, এটা রবের উপর বিশ্বাসের ফল। নামাজ হলো একটা রহমত। আমি যখনই কোন কিছু নিয়ে ভীষণ কষ্ট পাই তখন নামাজে দাঁড়াই, নামাজ থেকে উঠবার পর আমি কষ্টটা ভুলে যাই। এই যেমন একটু আগেও আমি ভীষণ কষ্ট অনুভব করছিলাম, এখন আমার মন হালকা লাগছে। আমার মনে প্রশান্তি কাজ করছে, একটু ও অশান্তি নেই। এটা নামাজের ফল। রহমত, প্রশান্তি না থাকলে আমি কবেই ভেঙে পড়তাম। আমি কষ্ট পেয়েছি যতগুণ, প্রশান্তি পেয়েছি তারচেয়ে হাজারগুণ। আল্লাহ মানুষকে একদিকে না একদিকে অসুখী রাখেন, যাতে তার বান্দা তাকে ভুলে না যায়। অন্যদিক দিয়ে হাজারগুন প্রতিদান দেন। আমি নিজ পরিবারকে পাইনি, কিন্তু শ্বশুর পরিবার পেয়েছি। মা বাবার অভাব ছাড়া আমি কখনো নিজেকে অশান্ত, অসুখী হিসেবে পাইনি। সবসময় একটা প্রশান্তি অনুভব করেছি। তোমরা এটাকে যে যা ভাবো, আমি এটাকে পুরষ্কার ভাবব, কবুল হওয়া দোয়া ভাবব, সেজদায় কান্নার প্রশান্তি ভাবব। কষ্টের প্রতিদান ভাবব।’

মুশরাফা থামল। গলা শুকিয়ে গেছে। গ্লাস টেনে চুমুক দিল। জায়ফা আর আর তারিফ মুগ্ধমেয় চোখে চেয়ে আছে তার পানে। ওর কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল এতক্ষণ। সুন্দর প্রতিটা কথা। কথাগুলো বলবার সময় মুশরাফাকে কী ভীষণ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল! চেহারা ঝলমল করছিল। যেন নূর ভাসছিল! ওকে সত্যিই ভীষণ সুখী দেখাচ্ছে। চোখে কাতরতা নেই, ঠোঁটের হাসিটা মলিন কিংবা কৃত্রিম নয়। হিসেব কষলে দেখা যায়, মা বাবার ব্যাপার ছাড়া বাকি সব ব্যাপারে সে পরিপূর্ণ। মুশরাফার শ্বশুর শ্বাশুড়ির স্নেহ হাসপাতালে দেখা হয়েছিল,চমৎকার ছিল বন্ধন। জাওয়াদের মতো স্বামী, নিজস্ব সংসার সব যেন তার। অনেক পাওয়া, অনেক অর্জন হয়ে গেছে তার। কিছু মানুষকে দেখলে, আশেপাশে থাকলেই প্রশান্তি লাগে। মুশরাফা সেই দলে পড়ে। ওকে দেখলেই কেমন একটা উৎসাহ আসে। তারিফ এ কদিনে যতটা দেখেছে তাতে পরিবারিক আলাপ ছাড়া বোনকে ভীষণ সুখীভাবেই পেয়েছে। তারিফ ভ্রু কুঁচকাল,
‘নামাজ পড়লে সত্যিই মনে প্রশান্তি আসে?’

মুশরাফা হাসল, ‘সত্যিই আসবে যদি তুমি মন থেকে আল্লাহকে বিশ্বাস করো। মন দিয়ে একদিন ফজরের আযান শুনে দেখো। তারপর ফজরের দুই রাকাত সুন্নত পড়ে দেখো। সালাম ফেরানোর পর নিজেকে ভীষণ প্রশান্ত হিসেবে পাবে মিলিয়ে নিও। নামাজ পড়ে আল্লাহ কাছে কিছু চেয়ে পেয়ে যাবার অনুভূতি ভীষণ সুন্দর, ভাইয়া। এটা কতটা আনন্দের তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তোমাকে সারাক্ষণ প্রশান্তিতে রাখবে, এই ভেবে যে আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। ‘

মুশরাফা চঞ্চল হয়ে উঠল। জায়ফা চমকে চাইলে বোনের দিকে। কী সুন্দর, সুখী দেখাচ্ছে ওর বোনটাকে। এত সুখ! মুশরাফা ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ তোমার শান্তির দরকার ভাইয়া। মদের বোতলে চুমুক দিয়ে শান্তি খুঁজলে পাবে না, অযু করে নামাজে দাঁড়াও, দেখবে শান্তি ওখানেই। দেখবে?’

সত্যিই তারিফের জীবনে শান্তি নেই। মনটা কেমন অশান্ত হয়ে থাকে। অলসতা ভর করেছে, জীবনটা বিষাদ লাগে। শান্তির আসলেই দরকার। তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল না। কিছু সময় বাদে বলল, ‘দেখব।’


আঞ্জুমান ভিলা আজ ইদ আমেজে মেতেছে। বাড়ির বড়ো কন্যা ইদ উপলক্ষে স্বামী নিয়ে এসেছে বাবার বাড়িতে । সকাল থেকে ব্যস্ত কিচেন। শেপ’রা ব্যস্ত হাতে রান্নার কাজ করছেন, কেয়ারটেকার বাড়ি গুছাচ্ছেন। লায়লা দাঁড়িয়ে সব তদারকি করছেন। বেলা গড়াতেই এসে গেল সাফারা। হল রুমে আসর বসল। ফারুকী, লায়লা, মেয়ে মেয়ে জামাইয়ের সাথে সময় কাটালেন। দুপুর হতেই লাঞ্চের তোড়জোড় পড়ে গেল। পারিবারিক সময় কাটিয়ে ফোন হাতে নেবার জো হলো না কারো। লাঞ্চ সেরে আসতে আসতে তিনটে বেজে গেল। লাঞ্চ সেরে সবাই বিশ্রামে গেল। আরামে বসে ফোন হাতে নিতেই সবার চোখ আটকাল জায়ফার পাঠানো মিনিট খানেকের ভিডিওখানায়।

দাম্ভিক সাফার কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। না সে কাঁদল, আর না হাসল। মুশরাফার কাতরতা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন লায়লা, ফারুকীর। মুশরাফা যখন, ‘মা? বাবা? আমি তোমাদের ভীষণ ভালোবাসি’ কথাটা বলল তখন গায়ের শিরদাঁড়া উঁচিয়ে গেল দুজনার। ভেতরটা নাড়িয়ে দিল। কানে ঝঙ্কার দিয়ে বাজল, ডাক। বুকে তোলপাড় শুরু হলো। লায়লার কানে বাজল, মা?
ফারুকীর কানে বাজল, বাবা? কী কাতর স্বর। তীরের মতো হৃদয়ে গিয়ে বিঁধল যেন। কতদিন পর শুনলেন মধুর ডাকটা। ! কতদিন ডাকে না মেয়েটাকে। ভিডিওটা দেখে লায়লার চোখ ভিজে এলো! বুকে কাঁপন ধরল। একবার দেখে চোখ সরালেন। দ্বিতীয়বার দেখবার সাহস হলো না।

ফারুকী গম্ভীর রইলেন, কাঁদলেন না। নিশ্চল বসে রইল। ধারালো চোখে ভিডিও দেখলেন। মেরুন গাউন পরিহিত সুকন্যাকে দেখল। চোখ বুলালেন তার মায়াবী মুখশ্রীতে। কতকাল বাদে এতটা ধ্যান দিয়ে পরখ করলেন সেই হিসেব বোধহয় তার কাছে নেই। দেখবার মাঝেই তার চোখ কোমল হলো। চোখে ভাসল, পুতুলমুখের রাফা। কানে বাজল, কতদিন আমায় ডাকো না। তিনি আনমনে ডেকে উঠলেন, ‘রাফা?’

চলবে..

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here